প্রতিবেদন
শবরীমালার ঘটনায় কীসের ইঙ্গিত?

এ রাজ্যে যখন মহাসমারোহে মাতৃবন্দনা চলছে, তখনই কেরল রাজ্যে ঘটে গেল এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ ভারতের নারীসমাজকে এখনও যে কতটা হীন চোখে দেখে সেটাই গোটা বিশ্বের কাছে বেআব্রু হয়ে গেল আরেকবার।

কেরলের শবরীমালা মন্দির নিয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ে জানায় দেবালয়ে উপাসনার ক্ষেত্রে বয়স বা শারীরিক অবস্থা বাধা হতে পারে না, তাই সব বয়সের মহিলারাই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবেন। এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। ১০-৫০ বছর বয়সী বালিকা ও মহিলাদের এতদিন ঋতুমতী হওয়ার কারণে মন্দিরে প্রবেশাধিকার ছিলনা। মন্দিরের আরাধ্য দেবতা আয়াপ্পা চিরকুমার এবং সেখানে ঋতুমতী নারীরা প্রবেশ করলে নাকি আয়াপ্পার কৌমার্য ভঙ্গ হবে! ভারতবর্ষের আরও কয়েকটি মন্দিরে এই যুগপ্রাচীন কুসংস্কার চালু আছে।

এই রায়কে প্রথমে সব রাজনৈতিক দল লিঙ্গ-সমতার প্রশ্নে সমর্থন জানিয়েছিল। মহিলারাও অনেক আশা নিয়ে তৈরি হচ্ছিলেন আরেকটি ইতিহাসের সাক্ষী হতে, সদ্য পাওয়া অধিকারবলে মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহের পুজো দেবেন বলে। কিন্তু হঠাৎ তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্বে রায়ের বিরোধিতা করে মিছিল ও জমায়েত হল, হুমকি প্রদর্শন চলল, মিছিলে সামিল ছিলেন বহু মহিলাও। এই রায় নাকি ভক্তদের ভাবাবেগকে আহত করেছে। তাদের দাবি রাজ্য সরকারকে রায় বাতিলের আবেদন জানাতে হবে; নয়তো গোটা কেরল উত্তাল হবে। প্রথামত ১৭ অক্টোবর থেকে পাঁচ দিন পুজো হওয়ার কথা মন্দিরে। কিন্তু প্রথম দিনেই মহিলাদের মন্দিরে ঢোকা নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেল। সঙ্ঘ পরিবারের মদতপুষ্ঠ ‘ভক্ত’বাহিনী, বিজেপি কর্মী, পাণ্ডারা এবং মন্দিরের পুরোহিতরা পুণ্যার্থী মহিলা, সমাজকর্মী ও মহিলা সাংবাদিক যারা দীর্ঘ পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে মন্দিরের পথে এগিয়েছিলেন, তাদেরকে শুধু যে ঢুকতে দিলেন না, তাই নয়, তাদের শারীরিক নিগ্রহ, চরম হেনস্থা, ভীতি প্রদর্শন সব কিছুই করা হল। সাংবাদিকদের মারধর করা হল, গাড়ি ভাঙচুর হল। সুপ্রিমকোর্টের ছাড়পত্র, প্রশাসনের সতর্ক প্রহরা থাকা সত্ত্বেও মহিলারা পূজা দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিতই থেকে গেলেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় ধূলায় লুটালো।

ভক্তদের ‘ভাবাবেগ’ আহত হওয়ার কারণটির আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। মহিলাদের ঋতুমতী হওয়াটা একেবারেই একটি শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার; দাড়ি গোঁফ, চুল, নখ বাড়ার মত। এটার সাথে ‘পবিত্রতা’ ‘শুচিতা’র কোনো সম্পর্ক নেই। ‘আয়াপ্পার কৌমার্য ভঙ্গ’ হওয়ার কথা বলে একদিকে মহিলাদের অন্য দিকে দেবতা আয়াপ্পাকে অসম্মান করা হচ্ছে। মহিলারা কি শুধুই যোনি সর্বস্ব সম্ভোগের বস্তু? যাদের উপস্থিতি বা দর্শন মাত্রেই দেবতা কাম পীড়িত হয়ে পড়বেন? তাছাড়া এমন অদ্ভুত যুক্তির মাধ্যমে তারা তো পুরুষদের ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নে উৎসাহিত করছেন, বৈধতা দিচ্ছেন!

আর ঘটনাটা ঘটে গেল এমন একটি রাজ্যে যা শিক্ষা-স্বাস্থ্য, জনসংখ্যায় নারী-পুরুষের অনুপাত এবং মানবসম্পদ বিকাশের হারে অন্যান্য রাজ্যগুলি থেকে এগিয়ে আছে। যে রাজ্যটি মাত্রই কয়েকদিন আগে দারুণ ঐক্যবদ্ধভাবে ভয়ঙ্কর এক বন্যাকে মোকাবিলা করেছে, পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। যে রাজ্যটিতে আসীন এক বাম সরকার! এই পরিঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে খুব অদ্ভুত এবং বিচ্ছিন্ন ঠেকতে পারে। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে রহস্যটা বুঝতে সময় লাগে না। এর পেছনে যে মতাদর্শ ও রাজনীতি রয়েছে তা অনুসন্ধান করা যাক।

আসলে গোটা দেশজুড়ে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার উগ্র হিন্দুত্ববাদের মোড়কে যে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ শানাচ্ছে এটা তারই এক মহড়া। এই আক্রমণের প্রথম নিশানা দলিত, মহিলা ও বামপন্থীরা। বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবার কোনোদিন লিঙ্গ-সাম্য চাইবে না, যেমন চাইবে না বর্ণভেদপ্রথার অবসান। কারণ তাদের হিন্দুত্ববাদের মতাদর্শ দাঁড়িয়ে আছে যে মনুবাদের উপর, স্মৃতিশাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা সেই মনুর নারী এবং শূদ্রদের প্রতি ছিল প্রবল ঘৃণা। তিনি নারী ও শূদ্রদের পূর্ণমানব তো মনেই করতেন না, বরং তাদের সঙ্গে পশুর তুলনাও করেছেন।

বর্ণভেদ বিভক্ত ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীর সামাজিক অবস্থান কখনও মর্যাদার ছিল না। সব ধর্মশাস্ত্র, স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণেই নারীকে ‘হীনজন্মা’ রূপে দেখানো হয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে ‘প্রয়োজনে স্ত্রীকে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মারার’ মতো অবমাননাকর বিধানও রয়েছে।

বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক প্রসার ও অন্যান্য কারণে হিন্দুধর্ম যখন খানিকটা অস্তিত্বের সংকটে, তখন কঠোর বিধি নিষেধ সম্বলিত আচরণবিধি নিয়ে অবতীর্ণ হল মনুসংহিতা যা আদতে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।

মনু চেয়েছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা আর নারীর উপর পুরুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও অধিকার কায়েম করা। এই জন্যই মনুসংহিতায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক কঠোর বিধান দেওয়া হয়েছে। এমনকি নারীকে মনুসংহিতা পাঠ বা শ্রবণের অধিকার পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। মনুর এই তত্ত্বের ভিত্তি ছিল কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ। যেমন এই জন্মে যদি নারী এবং শূদ্র পতি এবং দ্বিজকে ভালভাবে সেবা না করে, পরজন্মে তাদের আরও হীন পশুযোনিতে জন্ম হবে ইত্যাদি।

বেদ অধ্যয়ন ছিল শিক্ষার প্রথমপাঠ। বেদের যুগে নারীর বেদপাঠ করা, ব্রহ্মবাদিনী হওয়া ও হোম করার অধিকার ছিল। বিশ্ববারা, বাক, অপালা, লোপামুদ্রা এরা ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন, বিয়ে করে পুরুষের অধীনতা স্বীকার করেননি।

কিন্তু মনুসংহিতায় নারীর এই সমস্ত অধিকার নিষিদ্ধ হল। নারীর জন্য বিবাহই হল সবচেয়ে বড় সংস্কার এবং তা বাধ্যতামূলক। ‘পতিসেবাই হল তার কাছে গুরু গৃহে বাস’-এর তুল্য। আর ‘গৃহকর্ম’ই হল তার ‘অগ্নি পরিচর্যা’ (অর্থাৎ হোম করা)। মোদ্দা কথা, পড়াশুনা নয়, ঋতুমতী হওয়ার আগেই কন্যাকে উপযুক্ত পাত্রে সম্প্রদান করতে হবে। (লক্ষনীয়, কন্যা পিতার কাছে একটি দানযোগ্য সামগ্রী, সম্প্রদানের পর যার উপর থেকে পিতৃসত্ত্ব বিলুপ্ত হয়, এবং কন্যা গোত্রান্তরিতা হয়।) শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী এবং বার্ধক্যে পুত্রই রক্ষক—এমনটা তো আমরা জন্ম থেকে শুনে আসছি। অর্থাৎ নারীর কোনো স্বাধীন সত্তাই নেই। মনুসংহিতায় নারীর জন্য স্বতন্ত্রভাবে কোনো যজ্ঞ, ব্রত বা উপবাসের বিধান নেই। সাক্ষী হওয়ার বা স্বাধীনভাবে ঋণ করারও অধিকার নেই। বিধবা নারীকে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে। নারী ‘মিথ্যার’ মতো ‘অশুভ’, ‘অধর্মজ্ঞ’, ‘মন্ত্রহীন’ ও ‘পাপী’। শুধু বেদপাঠ নয়, অন্যান্য ধর্মশাস্ত্র পাঠও নারীর জন্য নিষিদ্ধ।

মনুর যুগে এইভাবে নারীকে প্রথাগত সব শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হল এবং সম্পূর্ণভাবে পুরুষের পদানত হয়ে প্রায় এক পশুর জীবন যাপনে বাধ্য করা হল। মনুসংহিতার ‘মনুবাদ’ নির্দিষ্ঠ কোনো একজন ব্যক্তির মতবাদেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। যুগে যুগে ব্রাহ্মণরা নিজেদের স্বার্থে ও প্রয়োজনে নানা বিধান এর মধ্যে ঢুকিয়েছেন।

তো এই মেয়েদের প্রতি চরম ‘অশুভ’, চরম অবমাননাকর ও পিছিয়ে দেওয়ার বিধান ‘মনুসংহিতা’ নিয়ে আজ এত চর্চা কেন? যখন ভারতীয় নারী জাতীয় ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে তার সমকক্ষতা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করেছে? যখন দিকে দিকে নারীরা স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের দাবিতে আন্দোলনে উদ্বেল হচ্ছেন?

কারণ মনুসংহিতাই বিজেপি তথা আরএসএস ও সঙ্ঘ পরিবারের স্বপ্নলালিত ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ সংবিধান, ঠিক যেমন ইসলামিক রাষ্ট্রের সংবিধানের ভিত্তি ‘শরিয়ত’। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ কায়েমের উদ্দেশ্যেই তারা আজ এতখানি আগ্রাসী হয়ে ভারতীয় সংবিধানকে আক্রমণ করছে, তাকে সরিয়ে ‘মনুসংহিতা’কে সংবিধানের মান্যতা দিতে চাইছে।

যুগপ্রাচীন একটি কুসংস্কারকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাই তারা সুপ্রিমকোর্টের রায়কে অগ্রাহ্য করে। শবরীমালা মন্দিরের বিষয়টি ছিল তাদের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটি ছোট ধাপ, একটি পরীক্ষা। এটা আরো স্পষ্ঠ হয়ে যায় বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতা বিনোদ বনসালের কথায়—”শবরীমালা প্রকৃত অর্থেই দক্ষিণ ভারতের অযোধ্যা” বা বিজেপি নেতা- অভিনেতা কোল্লাম থুলসির হুঙ্কারে—”যে মেয়েরা মন্দিরে ঢুকবে তাদের ছিঁড়ে দু’টুকরো করে ফেলা হবে।” তাৎক্ষণিকভাবে তারা সফল হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় নারীর কাছে তাদের মুখোশ খুলে গেছে। তারা যে ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’কে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করার জন্য অর্ডিন্যান্স জারি করেছে, তা যে আদৌ মুসলিম নারীদের প্রতি ‘সহানুভূতি’ থেকে নয়, মুসলিম বিদ্বেষ থেকে এবং ভোটের রাজনীতির তাগিদে—তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। আসলে তারা ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীর প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকারের বিপক্ষেই অবস্থান করছে।

তথাকথিত হিন্দু ‘ঐতিহ্য’ ও ‘পরম্পরা’র নাম করে যারা সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিরোধিতা করছেন তারা কি ‘সতীদাহপ্রথা’ ‘বাল্যবিবাহ’ ‘কুলীনপ্রথা’ ‘বৈধব্য পালনের’ নামে নারীর উপর চরম অত্যাচার— এই সব ‘ঐতিহ্য’কে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন?

সেদিন যে মহিলারা বিজেপি’র মিছিলে জড়ো হয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টের রায় বাতিলের দাবিতে, তারা সেইসব উৎপীড়িত সম্প্রদায়গুলি থেকে আসা, যাদের এক সময় একটি কুৎসিত ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল। সেই লড়াই ছিল, মেয়েদের অনাবৃত বক্ষ ঢাকতে দেওয়ার দাবিতে।

সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি বিজেপি’র সঙ্গে রায়—বিরোধী এই উচ্ছৃঙ্খলতায় সামিল হয়েছে আরও একটি উদ্দেশ্যে—কেরলের প্রগতিশীল বাম সরকারকে কোণঠাসা করা। কারণ লিঙ্গ সাম্যের সপক্ষে তথা বর্ণভেদ প্রথার বিলুপ্তির জন্য বামপন্থীরাই লড়ছেন। দু:খের বিষয়, কেরল কংগ্রেসও সংকীর্ণ ভোটের রাজনীতির স্বার্থে এই রায়ের বিরোধিতা করছে।

শবরীমালার এই অশুভ ইঙ্গিত ভারতীয় নাগরিকদের সামনে গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার এক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির একজোট হওয়াটা আজ সময়ের দাবি।   

খণ্ড-25
সংখ্যা-33