প্রতিবেদন
শবরীমালা, কামাক্ষ্যা এবং নারীত্ব

শবরীমালায় রজঃস্বলা নারীর প্রবেশ নিষেধ, কারণ দেবতা “আয়াপ্পান” নাকি ব্রহ্মচারী আর তিনি নাকি ঋতুমতী নারী দেখে কামাতুর হন ... !!!

যদিও সবাই সহমত হবেন না তবু বলছি -- আমার মতে; “মানুষই ভগবান সৃষ্টি করেছেন, ঈশ্বর মানুষের বিশ্বাসে বাঁচে”...।

যাই হোক, যদি ঈশ্বর থাকেও তবু তাঁর কাছে নারীপুরুষ তো সন্তান তুল্য, তবে কেন তিনি ঋতুমতী নারী দেখলে কামাতুর হবেন, নিজের সন্তান দেখলে কি কামরিপু জাগা উচিত? যদি যুবতী নারী দেখলে ‘পাথর দিয়ে গড়া পুরুষ দেবতা’ সংযম হারান, তাহলে রক্ত মাংসের পুরুষ তো সংযম হারাবেই ... ! মন্দিরের দেবতার অসংযমী হওয়া’র ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে মন্দিরের ভিতরই এক একজন নররূপী নারীমাংস লোভী রাক্ষস আসিফা’দের ওপর চালাবে পাশবিক অত্যাচার ... !

একদিকে যখন কেরলের শবরীমালায় রজঃস্বলা নারীর প্রবেশ নিয়ে এত কথা, তখন অন্যদিকে ভারতের আসাম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিমাংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত হিন্দুদেবী কামাক্ষ্যা-এর মন্দির এবং কামাক্ষ্যা মন্দিরের পুজো কাহিনী নিয়ে এই কট্টর ধর্মান্ধরা নীরব ... !! প্রচলিত মতে -- দেবী সতীর দেহের ৫১ টি খণ্ড নিয়ে তৈরি হয়েছে “৫১ সতীপীঠ”। যিনি দেবী সতী—তিনিই দুর্গা, তিনিই কালী আবার তিনিই পার্বতী। পুরাণ মতে দেবী সতী’র দেহের ৫১টি খণ্ডের মধ্যে তাঁর 'যোনি’টি পড়েছিল নীলাচল পর্বতে, আর সেখানেই তৈরি হয় কামাক্ষ্যা মন্দির ... !

এই মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে “কামাক্ষ্যা দেবী’’র তথাকথিত মূর্তি নয় বরং যোনি এবং ভূগর্ভস্থ প্রস্রবণটি আছে। এখানে প্রতিবছর অম্বুবাচী তিথিতে দেবী কামাক্ষ্যা’র ঋতুমতী হওয়ার ঘটনাকে উদযাপন করা হয়, এইসময় ঘটা করে পুজো হয় এবং মেলা বসে কামাক্ষ্যা মন্দিরে।

তাহলে, “অম্বুবাচী” অর্থাৎ মা কালী (তিনিও তো নারী) তিনি নিজেই যখন অশুদ্ধ থাকেন তখন তাঁরই আর এক রূপ #কামাক্ষ্যা দেবীর “রজঃস্বলা অবস্থা”কে সাগ্রহে পুজো করে উৎসব পালন হয় আর অন্যদিকে মেয়েরা “ঋতুমতী” হওয়ার “অপরাধে” মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধাপ্রাপ্ত হয় ... !!

এইসময় মন্দিরের মূল গর্ভগৃহের প্রস্রবণের জল “আয়রণ অক্সাইড”-এর প্রভাবে “লাল” হয়ে থাকে বলে তাকে দেবীর (নাকি নারীর) “ঋতুস্রাব” হওয়ার ঘটনা বলে মনে করা হয় এবং তা ধুমধাম করে পালন করা হয় ... !!

আর, অন্যদিকে রক্ত-মাংসের নারীর “ঋতুস্রাব” হওয়ার স্বাভাবিক ঘটনাকে “অশুচি”, “অশুদ্ধ” ইত্যাদি বলা হয় যেখানে জানা কথা যে : “একটি মেয়ের জীবনে এই স্বাভাবিক ঋতুচক্র’টির অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে যখন সেই মেয়েটি সন্তানহীনতায় ভুগবে তখন তাকে খুব সহজেই বন্ধ্যা জাতীয় উপাধি দেওয়া হবে, এছাড়াও অন্যান্য
শারীরিক জটিলতা তো আছেই ... !!”

মাটির নারীকে ভক্তিভরে পুজো,
রক্ত-মাংসের নারীকে তাচ্ছিল্য ভরে লাঞ্ছনা,
মাটির নারীর রজঃস্বলা রূপের পুজো,
রক্ত-মাংসের নারীর রজঃস্বলা রূপের অবমাননা,
মাটির নারীকে দামি শাড়ি গয়না,
রক্ত-মাংসের নারীকে বিবস্ত্র করে পাশবিক উল্লাস,

“কালো নারী” কালীর জন্য অমাবস্যার আঁধার রাতও আলোয় মালায় সজ্জিত,

আর “কালো কন্যা” হয়ে জন্মানোর “অপরাধে”(?)
একটি “নারী” সারাজীবন লজ্জিত ... !!!
এরপরও বলুন ধর্মান্ধরা :
এগুলো শঠতা নয়?
ভক্তির নামে ভণ্ডামি নয়?
শুদ্ধতার নামে নারীত্বের অপমান নয়?
যদি রক্ত-মাংসের নারীকে সম্মান দিতে না পারলেন,
তবে কি হবে মাটির নারীকে সম্মান দেখিয়ে?

তাহলে একদিন তো এমনই ঘটবে যে :

“একদিকে চতুর্ভুজ বিষ্ণু বা কালীকে ঘটাকরে পুজো করলেন আর অন্যদিকে চতুর্ভুজ মানুষ দেখলে তাকে অতিপ্রাকৃত বা ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে মারলেন ... !!!”

স্বচ্ছ ভারত গড়তে গেলে আগে নিজের মানসিকতাটাকে স্বচ্ছ করুন ... !!!

শুধু “মেয়েদের বাঁচান বা মেয়েদের পড়ান”-এর তৎকালীন বিজ্ঞাপন নয়, মেয়েদের যোগ্য সম্মান করতে শিখুন ... !!

খণ্ড-25
সংখ্যা-35