অবজ্ঞা অবহেলায় গণ-মৃত্যু আদিবাসী শবরদের

ঝাড়গ্রাম জেলার লালগড় ব্লকের পূর্ণাপানি অঞ্চলের জঙ্গলখাস গ্রামে পরপর সাত জন শবর আদিবাসী জাতির নারী-পুরুষের অকাল মৃত্যু পশ্চিমবাংলায় মমতা সরকারের ‘ডোল রাজনীতি’-র অন্ত:সারশূন্যতা তথা প্রান্তিক মানুষদের প্রতি টিএমসি দল ও ‘ভদ্র’ সমাজের অমানবিক অবহেলা সামনে এনেছে। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের তথ্যানুসন্ধানী দলের রিপোর্ট :

জঙ্গলখাসের শবর পাড়ায়

১) পানীয় জলের উৎস একটি পুরানো কুয়ো। জল নোংরা। জল খেতে চাইলে প্রথমে ভীষণ অবাক হয়ে তারপর অবিশ্বাসভরে জল তুলে গ্লাসে দেন। বিস্বাদ। ল্যাব-টেস্ট করালেই বোঝা যাবে কত জীবাণু আছে। লালগড় থেকে জঙ্গলখাসের এই পাঁচ কিলোমিটার রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটি সাবমার্শিবল পাম্প থেকে সরকারী জলের ধারা চোখে পড়ে। শবর পাড়ার একটু দূরেই চাষীদের পাড়ায়ও তা আছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে অথবা সাহস এঁদের নাই।

২) কার্ডে যেটুকু চাল পায় তাতে পরিবারের সকলের চাহিদা মেটেনা, চাল কিনতে হয় বাইরে থেকে। “২০ টাকা কিলো চাল!”- বলে আক্ষেপ করেন তাঁরা।

৩) চাষির বাড়িতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করলে কখনও কখনও ১০০ টাকা পাওয়া যায়। সেদিন কিছু সব্জি বা আনাজপাতি কেনা যায়।

৪) একশ দিনের কাজ তো এমনিতেই বছরে ২০/২৫ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে। শবরেরা সেটাও পায়না, পেলেও যায়না। সকলেই জানায় যে দিনের-মজুরি-দিনে যখন পাওয়া যেত তখনকার কথা আলাদা, কিন্তু এখন একটানা দশ/পনের দিন কাজ করে তিরিশ দিন পর টাকা পেলে তাদের তো চলবেনা। পরপর তিনদিন মজুরি না পেলেই অনাহার শুরু হয়ে যায়। তখন তারা জঙ্গলে গিয়ে লতা (ধুঁধলা লতার বান্ডিল দেখায় তাঁরা যা বান্ডিল প্রতি ৭ টাকায় বিক্রি হবে) সংগ্রহ করে। বনসম্পদ সংগ্রহ করলে তাঁদের আবার চোর বলা হয় ( স্কুলের মাস্টার মিড-ডে মিল রান্নার জন্য তাঁদের কাছ থেকে কখনও সস্তায় জ্বালানি-কাঠ কেনেন, তিনিই আবার তাঁদের কাঠ-চোর বলেন)।

৫) টিবি রোগের বর্তমান ‘ডট’ পদ্ধতির চিকিৎসায় বাড়ি গিয়ে রোগিদের ঔষধ খাইয়ে আসা প্রায় বাধ্যতামূলক। এ পাড়ায় কোনও রোগিকে কেউ ওষুধ খাওয়াতে আসতো না। ক্ষয় রোগীর প্রয়োজনীয় পথ্য/প্রোটিন কীভাবে জুটবে সে খবর ভালোবেসে কে নেবে!

৬) শবর পাড়া থেকে কিছুটা দূরে অঙ্গনওয়াড়ি। কিন্তু শিশুদের সেখানে পাঠায়না মায়েরা। তাঁরা উত্তর দেন যে, কখনও কোনও কারণে একদিন না গেলে দিদিমনিরা এমন গালমন্দ করে যে তাঁরা আর ওপথে যাননা। শৈশব থেকেই বহিস্কার অথবা আত্মগোপন শুরু হয়। এক দশক আগেও যেটুকু ইস্কুল যাওয়ার চল ছিল এখন প্রায় নাই বললেই চলে।

৭) ইটের দেয়াল, মাটির কালচে প্রলেপ, এসবেস্টসের ছাউনি ঝুপড়ি টাইপের ঘর-বারান্দা ১৫-১৬ বছর আগে সরকার দিয়েছিল। বর্তমানে কেন্দ্র বা রাজ্য আবাসন যোজনার ঘর এখানকার কোনও শবর পরিবার পায়নি। বসতবাড়ির জায়গাটির পাট্টা নাই, অনেকে ঠিক বলতেও পারলেননা পাট্টা আছে কি নাই। চাষ জমি নাই কারও। এক দুই জনের অল্প কিছু জমি আছে “ডাঙা”, চাষ হয়না।

৮) সরকারের অবহেলা, ‘ভদ্র’ সমাজের অবজ্ঞা ও জঙ্গলের অধিকার থেকে বিচ্ছিন্নতা দরিদ্র শবরদের য‍ৌথ পাড়াগুলিতে গড় আয়ু কমিয়ে দিয়েছে। পাঁচটি মৃত্যুই (অন্য দুজনের মৃত্যুকে এই হিসেব থেকে বাইরে রাখতে চেয়েছেন ওই পাড়ার সুকেশ শবর) দীর্ঘ অনাহার/অর্ধাহার জনিত অপুষ্টি ও ক্ষয়ের ্রত্যক্ষ ফলশ্রুতি। রাজ্য সরকার শবরদের প্রসঙ্গে যা বলেছে ও বলছে তার অর্থ দাঁড়ায় মৃত্যুগুলি ‘হত্যা’ নয় ‘আত্মহত্যা’। মরবে জেনেও মদ খাওয়া ও ওষুধ না খাওয়াই যদি মৃত্যুর প্রকৃত কারণ হয় তাহলে পাঁচটি মৃত্যুকে শবরদের গণ-আত্মহত্যা ছাড়া আর কী বলা যায়, সরকারের প্ররোচনা বা অনুপ্রেরণায়। বিজেপির মন্তব্যে অথবা আনন্দবাজার পত্রিকাতেও প্রথমদিন থেকে শবরদের প্রতি একই ঘৃণার অভিব্যক্তি। মদ স্বাস্থ্য ভালো রাখবে না ক্ষয় ধরাবে তা নির্ভর করে পেটের ওপর। গণ-মৃত্যুর খবরে আলোড়ন শুরু হতেই সরকার প্রশাসন যে শবর পাড়ায় ভাত খাওয়াতে ছুটেছে তার থেকেও কি অনাহারের বাস্তবতাই প্রমাণ হয়না! আর সরকার নিজেই তো মদের ব্যবসায় ঘোষণা দিয়ে নেমেছে! সরকার শবরপাড়ার অনাহারক্লিষ্ট দুর্দশাকে আড়াল করতে এসব বলছে। হত্যা হোক বা আত্মহত্যা মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর দলের দায় থাকছেই।

৯) জঙ্গলে উৎপন্ন বিভিন্ন জিনিসের ওপর এবং জঙ্গলের ভেতর জমিতে আদিবাসীদের যৌথ মালিকানার অধিকার স্বীকৃত আছে ২০০৬-এর অরণ্যের অধিকার আইনে। কিন্তু এরাজ্যে এই অধিকার কাউকেই দেয়নি রাজ্য সরকার। কেন্দ্র সরকারও নতুন ‘জাতীয় ফরেস্ট পলিসি’ আনছে এই আইনকে অকার্যকর করতে। জঙ্গল থেকে শবরদের সংগ্রহ বলতেও ওই যৎসামান্য কাঠকুটো আর লতা। শবরেরা চাষের জমি থেকেও প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এলাকায় ধানকাটা চলছে এখন। একাজের শ্রমিকেরা সবাই নারী। গোটা এলাকাতেই মজুরি খুবই কম। পুরুষ মজুরেরা পনেরো/কুড়ি দিনের জন্য পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্য অঞ্চলে যাচ্ছে একটু বেশি মজুরিতে ধান কাটা ও আলু বসানোর কাজে। ঝাড়গ্রাম জেলার এই জঙ্গলখাস গ্রামে আমরা গিয়েছিলাম ১৫ নভেম্বর। দিনটি ছিল ধরতী আবা বিরসা মুন্ডার ১৪৩তম জন্ম জয়ন্তী।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদক ও শৈলেন মাইতির প্রকাশিত এই রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমের একাংশে প্রচারিত হয়। এরপর অন্য কিছু মানবাধিকার ও ‘খাদ্যের অধিকার’ সংগঠনের রিপোর্টেও অনুরূপ পর্যবেক্ষণ উঠে আসে। মুখ্যমন্ত্রী প্রকৃত বাস্তবতাকে তবু অস্বীকার করে চলেন। উল্টে স্থানীয় শবরদের সাথে পর্যবেক্ষক দলগুলির সম্পর্ক স্থাপনের ওপরই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে শুরু করেন। আমাদের প্রতিনিধিদল যখন গেছিল তখনও গ্রামে ঢোকার মুখে সিআরপিএফ প্রহরা ও পাড়ার ভেতর সাদা পোষাকে পুলিশ প্রহরা ছিল। এখন একদিকে আরও কড়াকড়ি ও অন্যদিকে শবরদের মনে ভীতি সঞ্চার করা হচ্ছে। বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারতে অনাহার-অপুষ্টি এক নিদারুণ বাস্তবতা। এই বছরই দিল্লীতে তিনটি অনাহার মৃত্যু সংক্রান্ত প্রতিবেদনে হিন্দুস্তান টাইমসের একটি রিপোর্ট বলছে যে প্রতিরাতে দেশের কমপক্ষে উনিশ কোটি মানুষ খালিপেটে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য হন, প্রতিদিন দেশে তিন হাজার শিশু মারা যায় ‘ম্যালনিউট্রিশন’-এ। বলাই বাহুল্য ম্যালনিউট্রিশন শব্দটি সরকারী কাগজপত্রে ব্যবহার করা হয় অনাহার মৃত্যুকে আড়াল করতে। কালিহান্দি থেকে আমলাশোল, দিল্লী থেকে পূর্ণাপানি — অনাহারের এই জ্বলন্ত বাস্তবতাকে কোনও সরকারই স্বীকার করেনা। অথচ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী ফল এই ক্ষুধার সাম্রাজ্য। আসামে এনআরসি-র মাধ্যমে অর্ধকোটি মানুষকে না-নাগরিক বানিয়ে দেওয়া বা মজুরির সন্ধানে কোটি কোটি মানুষকে দেশদেশান্তরে পরিযান আর সেই যাত্রাপথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনীর বহুবিধ অত্যাচারে না-মানব বনে যেতে বাধ্য করা, ধর্ষণ-খুন থেকে শুরু করে নিত্যনৈমিত্তিক খুদে-আগ্রাসনের মাধ্যমে মেয়েদের দমনে রাখা অথবা ক্ষুধার এই সাম্রাজ্য কায়েম রাখা — এসব এক সূত্রেই গাঁথা — মুনাফা নিরন্তর করার লক্ষ্যে শোষণযোগ্য শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদন।

এদেশে পুঁজিবাদ যত যত প্রসারিত হয়েছে অনাহার তত তত বেড়েছে। বর্তমানে ভূভারতে এমন কোনও জলা-জংলা, পতিত-জঙ্গল, খাল-বিল-নয়ানজুলি বা অরণ্য-পর্বত বুঝি পুঁজির গ্রাসের বাইরে অবশিষ্ট নাই যেখান থেকে শাক-পাতা, ফল-মূল বা চুনো-পুঁটি সংগ্রহ করেও বাঁচার মত ন্যুনতম পুষ্টি আহরণ করতে পারে বৃহৎ অর্থনীতির বটম-লাইনে থাকা এই কোটি কোটি মানুষেরা। বটমলাইনের এই মানবেতর বাস্তবতা যে কেবল গ্রামীণ শ্রমের বাজারেই মালিকের পরম আধিপত্য কায়েম রাখে তাই নয়, এই বাস্তবতা সবচেয়ে অগ্রণী ক্যাম্পাস থেকে পাশ করা দক্ষ শ্রমিককেও মাথানত করে করজোড়ে মালিকের দরজায় দাঁড় করিয়ে দেয়।

খণ্ড-25
সংখ্যা-36