প্রতিবেদন
আমাদের সামনে একটা বড় সুযোগ ও দায়িত্ব আছে

পার্টির পশ্চিমবঙ্গ একাদশ রাজ্য সম্মেলনে উপস্থিত সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য সার সংকলন করা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা যখন মার্চে পার্টি কংগ্রেস করলাম তখন আমাদের পুরো নজর ছিল মোদি সরকার ও ভারতে ফ্যাসিবাদী হামলার ওপর। এখানে আমাদের নজরে তার সাথে আছে রাজ্য সরকারও। শ্লোগানেও সেটা আছে। দুটোকে কীভাবে বোঝা যায়, পার্থক্য করা যায় সেটা একটা প্রশ্ন। একদম সাধারণ মানুষকে ফ্যাসিবাদকে বোঝানোর জন্য বলা যায় অত্যাচারী রাজতন্ত্র। ফ্যাসিবাদের মূল কিছ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধরা দরকার। পুঁজিবাদ, দক্ষিণপন্থা ইত্যাদি বললে অনেক নির্দিষ্ট নজর এড়িয়ে যায়। সব রাষ্ট্রই দমন করে। রাষ্ট্রীয় দমন বললে তা দিয়ে ফ্যাসিবাদকে বোঝা যাবে না। ফ্যাসিবাদের মূল বৈশিষ্ট্য এই দমনটাকে উৎসবের জায়গায় নিয়ে যায়। জনগণ তাতে নেমে পড়ে। এমার্জেন্সির সময় মানুষ সেই দমনের পক্ষে ছিল এরকম দেখা যায় নি। কিন্তু এই জমানায় দমনপীড়ণকে উৎসবের জায়গায় নিয়ে গিয়ে মানুষকে ক্ষেপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি বলি। এটা ঠিক মুসলিমরা অবশ্যই একটা টার্গেট। তাকে কোণঠাসা করে দেওয়া, শহরের নামের পরিচিতিতে মুসলিম গন্ধ থাকলে তাকে পাল্টে দেওয়া — এসব করা হচ্ছে। এভাবে দলিতদের ওপর জাতিগত হামলা আছে। মহিলাদের বিরুদ্ধে হামলাও এদের চরিত্রের মধ্যে আছে।

আদিবাসী দলিত সংখ্যালঘু এমনকী পরিবেশের পক্ষে কথা বললেই তাকে ‘আর্বান নকশাল’ বলা হচ্ছে। তাই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদ না বলে একে শুধু ফ্যাসিবাদও বলা যাবে। নির্বাচন থাকবে, গণতন্ত্র থাকবে এটা পুঁজিবাদের পছন্দ নয়। সে খোলা ময়দান চায়। ব্রাজিলে বলসোনারো ক্ষমতায় এলেন ট্রাম্পের পর। এটা আর কোনও ব্যতিক্রম নয়। অনেক জায়গাতেই এরা ক্ষমতায় আসছেন। পুঁজিবাদের আগের চেহারা শেষ হয়ে গেল কীনা সেটা একটা বিতর্ক। ওপেন ডিক্টেটরশিপ অব ক্যাপিটালিজম–কমিন্টার্ন যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিল–সেটা দেখা যাচ্ছে। ভারতে এই পুঁজি তা বিদেশী বা এদেশী যে চেহারাতেই আসুক, তার একটা লাগামছাড়া দৌরাত্ম দেখা যায়। ‘দেশ’ বলে, ‘জাতি’ বলে, ‘জাতিয়তাবাদ’ বলে সব কিছু করা হচ্ছে। জাতিয়তাবাদের পরিচয় দিয়ে দেশের সাথে যুক্ত করে এইসব কাজ ফ্যাসিবাদীরা ছড়াচ্ছে। দেশ সম্পর্কে এক অন্য ধারণা, পছন্দ তাদের আছে। যাকে ওরা দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করবে, মুসলিম, বামপন্থী, মুক্তমনা—তাদের সবাইকে এরা শেষ করে দেয় এবং এ জন্য এরা লোক ক্ষেপায়। এটা একটা সর্বভারতীয় ব্যাপার।

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি চলে এলে তাকে আমরা এর পশ্চিমবঙ্গ সংস্করণ বলতে পারি। একে আমরা স্বৈরাচারী বলতে পারি। মোদি মমতার মধ্যে টাইপের একটা মিল আছে। তবে ওপর ওপর একরকম হলেও উৎসটা এক নয়। মোদিরা কর্পোরেট পুঁজি শাসকশ্রেণির মদত নিয়ে দেশের চেহারাটা পাল্টে দিতে চায়। এখানে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। এখানে বামেদের বিরুদ্ধে পুঁজিপতিদের অবস্থান এবং বামেদের ভুলের সমন্বয়ে মমতা এসেছেন। ২০১৪-র পর থেকে মোদির চেহারাটা পাল্টাচ্ছে। মমতা এখন আছেন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিটা দীর্ঘদিন আলাদা থাকবে না। একই সরকারের আমলে উন্নয়ন ভালো হয় এটা বিজেপি বলে। বিজেপির ত্রাসটাই এখানে বিকাশমান। বিজেপির ব্যাপারটা পশ্চিমবঙ্গের বাইরের আগ্রাসন শুধু নয়, এটা ভেতর থেকে হচ্ছে। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের উল্টোভাবে বাংলা-বাঙালি দিয়ে এর মোকাবিলা করে দেব তা হচ্ছে না। বাংলার অনেক ঐতিহ্যকে, প্রগতিশীল উপাদানকে ব্যবহার করা আছে। কিন্তু হিন্দি বনাম বাংলা করতে চাইলে হবে না। কারণ দাঁড়িভিটে দেখা গেল উর্দু বনাম বাংলা করা হল।

বিজেপি ও তৃণমূলকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তার মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ককে ভালোভাবে বোঝা দরকার। ফ্যাসিবাদ এমন অ্যাজেন্ডা তৈরি করছে কেউ এর সামনে আত্মসমর্পণ করছে, কেউ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এটা করা যাবে না। এই লড়াইয়ের অনেকগুলো দিক আছে। এর মূল দিক জনগণকে সমাবেশিত করা। যে প্রশ্ন নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে জাগরণ হচ্ছে, কৃষক-শ্রমিক-স্কিম ওয়ার্কার ছাত্রদের আন্দোলন হচ্ছে, তার উপাদান পশ্চিমবঙ্গেও আছে। এরকম বহু প্রশ্ন আছে যা নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন দরকার। এই কাজগুলোর মধ্যে দিয়ে আমাদের একটা গণভিত্তি বাড়বে। সেই গণভিত্তি বাড়লে তবেই তা দিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে পারব। গণকাজের মধ্যে দিয়েই আমরা গণ জমায়েত বাড়াতে পারব। যে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে দলিত, আদিবাসী, মহিলাদের জাগরণের মধ্যে দিয়ে সেই আলোড়নকে ধরা দরকার। এগুলো খুব গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্ন। এজন্য আমরা কিছু চেষ্টা শুরু করেছি। আদিবাসীদের অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ আমরা তৈরি করেছি। আদিবাসীদের ইতিহাস ঐতিহ্য আর তার পাশাপাশি আজকের দিনে তাদের জীবন-জীবিকা-অধিকার-সম্মানের প্রশ্ন নিয়ে অনেক কিছু করার আছে। বিহার, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি জায়গায় আমরা ইনশাফ মঞ্চ বানিয়েছি। অর্থাৎ ন্যায় এর জন্য লড়াইয়ের মঞ্চ। এর একটা বড় দিক আছে। মুসলিম বলে অতিরিক্ত দমন পীড়ন নিরাপত্তাহীনতার যে ব্যাপার আছে, সেটার বিরুদ্ধে লড়াই এর জন্য দলিত আদিবাসী মুসলিমদের সমন্বয়ে এরকম একটা মঞ্চ তৈরি করা যায়। এই কাজটা করতে পারলে আমাদের শক্তিটা বাড়বে। গণকাজ একটু বড় পরিধিতে করতে পারি।

এরাজ্যে কয়েকটা ফ্রন্ট নিয়ে কিছু আশার জায়গা আছে। ছাত্রফ্রন্টে গত তিন বছরে একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। পার্টির অবস্থান থেকে ছাত্রফ্রন্টের কাজকে দেখার একটা জায়গা তৈরি হওয়া দরকার। ছাত্রদের সমাজের অন্যান্য অংশের পাশে দলিত- মুসলিম-নারীদেরকে কৃষক-শ্রমিকের পাশে দাঁড় করানো দরকার। ছাত্র সংগঠন থেকে পার্টিতে উত্তরণ স্বতঃস্ফূর্ততার ওপরে ছেড়ে না দিয়ে সচেতন উদ্যোগ থাকলে ব্যাপারটা মসৃণ হতে পারে। পার্টিকে শুধু কিছ আদর্শ বিতর্ক দিয়ে বোঝা যাবে না। রক্তমাংসের যে সংগঠন তার সাথে একাত্ম হওয়ার দরকার আছে। একই কথা মহিলা ফ্রন্ট প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য। নতুন পুরনো সবাই থাকবেন এখানে। দরকার একটা আধুনিক নবীন দৃষ্টিভঙ্গী। নতুন জেনারেশনের কিছ নতুন স্টাইল থাকবেই।

মার্কস নিয়ে আলোচনার সময় বা এখানে সভায় ডাকার সময় বামপন্থীদের কর্মী-সমর্থকদের কাছে আমাদের বার্তা যাচ্ছে। আমরা আমাদের স্বাধীন রাজনীতি করেছি। আমাদের রাজনীতি সিপিএম বা বামফ্রন্ট বিরোধী রাজনীতি ছিল না। স্বাধীন বামপন্থী রাজনীতি ছিল। তার ফলে শাসক হিসেবে তার জনবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াতাম। এখন পরিস্থিতি আলাদা। ২০১৬-তে সিপিএম কংগ্রেসের সাথে গেল, আমরা তাদের সাথে লড়িনি। আমাদের বিতর্ক বাড়ানো দরকার এবং নির্বাচনের ময়দানেও আমাদের ঐক্য হোক — এই দাবিটা তোলা দরকার। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী শিবিরের একটা পুনর্বিন্যাসের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। আমাদের একটা বড় সুযোগ, দায়িত্ব আছে এই পুনর্বিন্যাসের মধ্যে হস্তক্ষেপ করার। রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বিজেপির যে প্রচার চলবে গণতন্ত্রের প্রশ্নকে সামনে রেখে, আমাদের কাজ হবে তার স্বরূপকে উন্মোচিত করা।

কমরেড দীপঙ্কর আরও বলেন, আগামী ১৮ ডিসেম্বর কমরেড বিনোদ মিশ্র, জহর, রাম নরেশ রাম, জগদীশ মাস্টার, রামেশ্বর যাদব — এই পাঁচজনের আরাতে পাঁচটি মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে আমরা এবারের সংকল্প দিবস পালন করব।

জনগণ রুখে দাঁড়াচ্ছেন আসুন, আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াই

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলনে পার্টির বরিষ্ঠ নেতা এবং পলিটব্যুরো সদস্য স্বদেশ ভট্টাচার্য বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাংলায় বাম আন্দোলনের পথ প্রসঙ্গে বলেন, পশ্চিমবাংলায় আজ যাঁরা বাম আন্দোলন করছেন তাঁদের অবস্থানে ভিন্নতা আছে। আমরা আন্দোলনে আছি, আবার দীর্ঘদিন যাঁরা সরকারে ছিলেন তাঁরাও পথে নামতে বাধ্য হয়েছেন।

পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন, আবার বেশ ভালো। ঠিকই, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বামপন্থী আন্দোলন নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগও উপস্থিত রয়েছে। আজকের বামপন্থী আন্দোলনকে নতুন মোড় দেবে যৌথ আন্দোলন। যাঁরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিলেন তাঁরাও উপলব্ধি করছেন যে, উঠে দাঁড়াতে গেলে সংগ্রাম বিমুখতা চলবে না। এই রাজ্যের জনগণ বামপন্থার পুনরুজ্জীবন চান—দৃঢ়ভাবে রাস্তায় নামলে পরিস্থিতি এগিয়ে যাবে। ঝড়-ঝঞ্ঝার মোকাবিলা করে, মৃত্যুভয়কে জয় করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। ঝড়-ঝাপটার মোকাবিলা না করে কোনো বিপ্লবী আন্দোলনই এগিয়ে যেতে পারে না।

তৃণমূলী সন্ত্রাস বা বিজেপির দৌরাত্মই শেষ কথা নয়। এ সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হচ্ছে সারা দেশের সঙ্গে এখানেও, এটাই মূল কথা। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে অন্যান্য বাম দলের জনগণকে রাস্তায় নামানোর চেষ্টা করতে হবে, পশ্চিমবাংলার মানুষের আকাঙ্খার অনুসারী করে নিজেদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে জোর কদমে নামতে হবে। বিজেপির হামলা শ্রমজীবী মানুষদের, সমস্ত স্তরের জনগণকে ক্রমেই বেশি করে রাস্তায় নামার পরিস্থিতি তৈরি করে দিচ্ছে। আমরা সেই সংগ্রামগুলোর সামনের সারিতে থাকার চেষ্টা করছি, আন্দোলনের বর্শামুখকে বিজেপির ফ্যাসিবাদ ও তৃণমূলের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছি। আগামী দিনে বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুনরুত্থান দেখা যাবে। জনগণ রুখে দাঁড়াচ্ছেন, আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়ালে ঐ প্রতিরোধ আরো জোরদার হবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-36