প্রতিবেদন
আমার দেখা রাজ্য সম্মেলন

কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে রবীন্দ্রভবনমুখী মিছিলটি দুধারের দোকানপাট লোকজনের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। তরুণ দৃপ্তকণ্ঠের সুনির্দিষ্ট শ্লোগানগুলি বেশ কিছু প্রবীণ জং ধরা পা-কেও পুরোটা পথ ছন্দোবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। ধন্যবাদ অক্লান্ত শ্লোগানদাতাদের।

সেমিনারটিও অনেক ভাবনার খোরাক যুগিয়েছে। সম্মেলন কক্ষে দু’দিনের অভিজ্ঞতাও চমৎকার। শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র যুবরা আগামী বছরগুলিতে সঠিক পদক্ষেপে পার্টিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্য বিগত বছরগুলির কাজের অভিজ্ঞতা তথা সমস্যা সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছেন।

কী নেই তাতে? যুক্ত এবং গণকার্যকলাপ, সংগঠনের শরীরস্বাস্থ্য, অসুস্থতা (ব্রাঞ্চ কমিটিগুলির নিষ্ক্রিয়তা, নেতা ও কর্মীদের মধ্যে নিবিড় সংযোগের অভাব, বিভিন্ন কমিটির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, আত্মসমালোচনায় অনীহা, গতিহীনতা, আমলাতান্ত্রিকতা)। গ্রাম ও শহরে বিভিন্ন পেশায় ও কাজে (প্রসাধন বিক্রেতা, ই-কমার্স-এর কর্মী, গ্যাস সিলিন্ডার বাহক, রিকশা ও ভ্যান চালক ইত্যাদি) নিযুক্ত পুরুষ ও মহিলাদের সংগঠন গড়া, বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করা, ক্ষয়িষ্ণু তাঁত ও বিড়ি শিল্প, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে কম্পারেটিভ স্টাডি, জেন্ডার সেন্সিটাইজেশন, ইতিহাসচর্চা, বিপিএমও-এআইপিএফ-এর আন্তঃসম্পর্ক, পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর হামলা, পার্টির মধ্যে সংখ্যালঘু সেল গঠন, রোড সেফটি বিল প্রত্যাহার, বেসরকারি যাত্রী ও মাল পরিবহণ শ্রমিকদের সংগঠন, তৃণমূলের শিক্ষানীতির বিরোধিতার স্পষ্ট পার্টি-গাইডলাইন, ছাত্রযুবদের কলকাতাকেন্দ্রিকতা, পার্টি অ্যাজেণ্ডায় সংস্কৃতির গুরুত্ব, গ্রামে প্রচারে সিনেমার গুরুত্ব, পরিবেশ দূষণ নিয়ে পার্টির স্পষ্ট গাইড লাইন, কৃষিতে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক, ইমাম ভাতার পরিবর্তে ওয়াকফ বোর্ডের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া, আইনজীবীদের ইউনিট, এস এস সি’র আন্দোলনে আর ওয়াই এ’র ভূমিকা, পার্টির মহিলা সংগঠনে ক্যাডারের থেকে নেত্রীর আধিক্য ও নিজেদের কর্মসূচি থেকে যুক্ত কার্যক্রমে বেশি গুরুত্ব, উত্তর বঙ্গে নদী থেকে বেআইনি পাথর তোলা, হাতির আক্রমণে মৃত্যু ও ফসলহানির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, দেশব্রতী-প্রতিবিধানের প্রকাশনা ও বিক্রি, বহুবছর ধরে চলা ট্রেড ইউনিয়নে পার্টি কাঠামো না গড়ে ওঠা, কামতাপুরি সংখ্যালঘুদের মধ্যে কাজের বিস্তার ও মুসলিম ও আদিবাসীদের সেন্টিমেন্ট বোঝা, পার্টি মেম্বারশিপের মান, সরকারি কর্মীদের বঞ্চনা, চা বাগানে চাল ও পানীয় জল না পাওয়া এবং অ্যাম্বুল্যান্সের অভাব, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে পার্টির গাইডেন্সের অভাব, প্রোগ্রামের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না তুলে ধরে চাঁদা তোলা, ছাত্রদের উপর কোনো অঞ্চলের পার্টি সংগঠনের বিভাজনের ক্ষতিকর প্রভাব ইত্যাদি বহু বিষয় খসড়া প্রতিবেদন উপলক্ষ করে উঠে এসেছে।

করন্দার শহীদ পরিবারের জুটমিল শ্রমিকটি সংগঠনের উদ্দেশে মায়ের মতো যে কঠোর সতর্কবার্তা রেখেছেন (জং ধরে গেছে, মাজা ঘষা করতে হবে) সেটি আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। উত্তরবঙ্গের কিশোরীটি জুঁইফুলী সারল্যে কিন্তু অকপট দৃঢ়তায় যেভাবে নিজের ঝকঝকে সাহসী মনটি তুলে ধরেছে পার্টির প্রতি অগাধ আস্থায়— তাও আমাদের পাথেয় হয়ে উঠতে পারে। এবার একটু অন্য কথায় আসতে হচ্ছে। সম্মেলনের বিরতির মধ্যে এক ফাঁকে জগদ্বিখ্যাত ঘূর্ণিতে গিয়েছিলাম পুতুলপট্টি দেখতে। মাত্র পনেরো মিনিটের অবস্থিতিতে যে ছবি উঠে এল তা বড় করুণ।

নদীয়ার কমরেডরা প্রতিনিধিদের থাকা খাওয়ার চমৎকার বন্দোবস্ত করেছিলেন ক্রিশ্চান মিশনারিদের দুটি বাড়িতে। অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাগানঘেরা প্রাঙ্গণে ছিল খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় ভরা মাঠগুলিকে আমরা চরম নোংরা করে এলাম উচ্ছিষ্টভরা থালায়, তাচ্ছিল্যে ছুঁড়ে ফেলা প্লাস্টিকের গ্লাস আর কাপে। একবারও খেয়াল করলাম না ওগুলো আমারই মতো কাউকে ঘাসের ফাঁক থেকে থেকে তুলে এনে জড়ো করতে হবে। এটা কমিউনিস্টদের নীতির পরিপন্থী ।

অবশেষে দক্ষিণ দিনাজপুরের সেই দৃষ্টিহীন কমরেডের অন্তরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ভাবাই যায় ... আগামী সম্মেলন শ্রমিক-কৃষক-দলিত-আদিবাসী-সংখ্যালঘু-ছাত্রযুব-মহিলাদের থেকে দরদী লড়াকু একঝাঁক নতুন তরুণ মুখ দেখতে পাবে মঞ্চের উপরে, সামনে এবং রাজ্যকমিটিতে। ভারত জুড়ে যে গণজাগরণ আছড়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গেও তা থেকেই উঠে আসবেন তারা।

খণ্ড-25
সংখ্যা-36