প্রতিবেদন
এই বিভীষিকা কবে থামবে?

কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার জিরণু গ্রামে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮ জঙ্গীদের উপস্থিতির খবর পেয়ে যৌথবাহিনী অভিযানে নামে এবং নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সাত নাগরিককে হত্যা করে। গণমাধ্যমে প্রকাশ যৌথবাহিনী ওই গ্রামে জঙ্গীরা আত্মগোপন করে আছে খবর পেয়ে অভিযানে যায়। জঙ্গীদের মধ্যে প্রাক্তন সেনা জাহর আহমেদ ঠোকরও আছে বাহিনী খবর পায় গোয়েন্দাদের কাছে। এ বছরই জুলাই মাসে জাহর বারামুলার সেনা ছাউনি থেকে রাইফেল চুরি করে চম্পট দেয় পরে সে নাকি জঙ্গীদের দলে যোগ দেয়। পুলিশ জানিয়েছে, তল্লাশি শুরু হলে জঙ্গীরা জওয়ানদের লক্ষ করে গুলি ছোঁড়ে, তাতেই সংঘর্ষ বেধে যায়। এ সময়ই নিহত হন সাবর কিষণ সিং রাজপুত নামে এক সেনা ও তিন জঙ্গী। ওই তিন জঙ্গীর মধ্যে ঠোকারও আছে বলে খবর। অন্য দু'জনের পরিচয় জানা যায়নি। এই সংঘর্ষে ১২ জন জখম হয়েছেন ও পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

উল্লেখ্য, সংঘর্ষস্থল থেকে দূরে নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে সাত জন আম জনতাকে হত্যা করেছে। জানা যায় সংঘর্ষ শেষে এক ঘন্টা পরে বাহিনী ফিরে যাচ্ছিল। এই সময় সাধারণ নাগরিকরা নানা কাজে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলেন। যেমন একজন রাস্তার ওপারে ঝরণা থেকে জল নিয়ে ফিরছিলেন। সেই সময় নিরাপত্তা বাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই সময় পাশের গ্রামগুলিতে বিক্ষোভ চলছিল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। মহম্মদ ইউসুফের ১৯ বছরের ছেলে শাহনওয়াজেরও হয়েছিল এই পরিণতি। গুলজার আহমেদ আপেল গাছ কাটছিল। নিরাপত্তা বাহিনী তাকে লক্ষ করে গুলি চালায়। নেট যুগে কোন ঘটনাই আর বিশ্বের মানুষের কাছে অধরা থাকছে না। হয় ঘটনা ঘটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিংবা এক-আধ ঘন্টা পরে নানান ধরনের ওয়েব পোর্টালে আঁখো দেখা হাল ছড়িয়ে পড়ছে। ওইসব ওয়েব পোর্টাল এবং পরে প্রকাশিত প্রিন্ট মিডিয়া থেকে জানা যাচ্ছে এই সমস্ত বিভীষিকার কাহিনী।

ওইদিন নিহতদের সম্বন্ধে জানা যাচ্ছে যে ৪ জন ছিল বিদ্যালয় পড়ুয়া, যাদের মধ্যে ২ জন নাবালক। ১ জন এম বি এ স্নাতক, ১ জন অস্থায়ী সরকারি কর্মী ও ১ জন মিস্ত্রি। আবেদ হুসেইন লোন বেঙ্গালুরু থেকে এম বি এ পাশ করে সদ্য বাড়িতে ফিরেছিল। ইন্দোনেশিয়ার বাসিন্দা শাইমাকে বিয়ে করে কাশ্মীরে নিয়ে আসে সে। আবিদের ৩ মাসের ছোট ছেলে ও মাও আছেন। দু:খের সাগরে শাইমা চোখের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে, স্বামীর এই অকাল মৃত্যু কিভাবে সে মেনে নেবে? দূষণ পরীক্ষা সংস্থায় কাজ করতেন আমির আহমেদ। আঠারো বছরের আমিরের বাবা-মা ছাড়াও ২ বোন ও ১ ভাই আছে। গ্রামবাসীদের বয়ান অনুযায়ী সিনরোতে বাহিনী প্রথম হত্যা করে আমিরকে। সেই সংসারে একমাত্র উপাজর্নকারী। নেওয়ার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের পড়ুয়া, লিয়াকত মাজিদদার ছিল একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সংবাদে প্রকাশ পারিগ্রামের বাসিন্দা লিয়াকতের বাবা গ্রামে গ্রামে দুধ সংগ্রহ করে বাজারে দুধ বিক্রি করেন। তার মা-বাবা ছাড়াও প্রতিবন্ধী ১ ভাই আছে, দাদা কাঠমিস্ত্রি, আছে আরও ৩ বোন। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ জানিয়ে বলেছেন, অভিযান শেষ হওয়ার এক ঘন্টা পরে বাহিনী যখন ফিরে যাচ্ছে সেই সময় তারা আরও ৪ জনকে গুলি করে হত্যা করে। বছর ২৬-এর যুবক তৌসিফ মীরও নিহত ৪ জনের ১ জন। উচিরসো গ্রামের বাসিন্দা তৌসিফ সরকারি পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট দপ্তরের অস্থায়ী কর্মী। তাঁর আছে একটি ৩ বছরের মেয়ে ও ১ বছর বয়সী ছেলে। বাবা-মা, স্ত্রী ছাড়াও ৫ বোনের সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী ছিল সে। বাড়ির সামনেই (সংঘর্ষের জায়গা থেকে দূরে) হত্যা করা হয় শাহনওয়াজকে। মোঙ্গামা গ্রামের বাসিন্দা সে। বিদ্যালয় পড়ুয়া শাহনওয়াজের সরাসরি মাথায় গুলি লাগে। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র পুলওয়ামার ব্রিচো গ্রামের মহম্মদ মুরতজা দার। গ্রামের বিদ্যালয়েই সে পড়াশোনা করে। নিরাপত্তা বাহিনী তাকে সরাসরি মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে! এইদিন যাঁরা নিহত হয়েছেন মুরতজাই সকলের মধ্যে কনিষ্ঠতম, তার আত্মীয়-স্বজনেরা জানিয়েছেন, হত্যার ১ ঘন্টা পরেও মুরতজাকে চেনা যায়নি। সুহেল রাশিদ দশম শ্রেণীর ছাত্র। বাবা-মা আর ২ বোন নিয়ে তাদের সংসার। সেও মুনরো গ্রামের বাসিন্দা। সকালেই স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে যায়। সে আর বাড়ি ফেরেনি। তাকেও হত্যা করা হয়েছে।

পুলওয়ামা জেলার হাসপাতালের ডাক্তারদের বয়ান থেকে জানা যাচ্ছে যে সকলেরই বুলেট লেগেছে কোমরের উপরে। মাথায়, পেটে, বুকে গুলিবিদ্ধ সাধারণ মানুষকে দেখে বলা যায় যৌথ বাহিনী নাগরিকদের হাত থেকে বাঁচতে আত্মরক্ষায় গুলি চালায়নি। তারা গুলি চালিয়েছে বেপরোয়া, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে। বিভীষিকা শেষ সেখানেই নয়। পুলওয়ামা জেলার হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪০ জন নাগরিক ভর্তি আছেন। কয়েকজনের অবস্থা সঙ্কটজনক। বেশ কয়েকজন বুলেটবিদ্ধ, কয়েকজন পেলেটবিদ্ধ। পরিকল্পিতভাবেই যে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে হাসপাতালে ভর্তি নাগরিকদের শরীরে গুলির চিহ্নের ক্ষতগুলোতেই তা পরিস্ফুট। উগ্রপন্থী ধরার নামে গ্রামের সাধারণ যুবক, বিদ্যালয় পড়ুয়া, অস্থায়ী কর্মীদের হত্যা দেখিয়ে দেয় দিল্লীর সরকার সে রাজ্যে অশান্তি জিইয়ে রাখতে চায়। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নেই কাশ্মীরকে দমিয়ে রাখতে চায়। পুলওয়ামা গণহত্যার পরপরই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসনও জারি হয়েছে। না পুলওয়ামার ঘটনার জন্য রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়নি। নির্বাচিত পিডিপি-বিজেপি জোট সরকার ৬ মাস আগে ভেঙে দেওয়া হয় বিজেপি জোট থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার কারণে। রাজ্যে রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক বিধানসভা ভেঙে দেন যখন ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং পিডিপি জোট বেঁধে সরকার গড়তে ঐক্যবদ্ধ হয়। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় জম্মু-কাশ্মীরে ৬ মাস রাজ্যপালের শাসনের মধ্যে সরকার গঠন না হলে রাষ্ট্রপতি শাসন ঘোষিত হবে। তাই হয়েওছে। জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এ পর্যন্ত যা যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবক্ষেত্রেই তা বুমেরাং হয়েছে। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। বলা হচ্ছে জঙ্গী দমনের কথাও। জঙ্গীরা যে সাধারণ নাগরিক (পুলওয়ামাতে যা ঘটল) তাও কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাবাহিনীর দমনে প্রকাশিত। বিষাদময় বর্ষে পুলওয়ামা সংঘর্ষের আগে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ২০১৮-তে ৭৭ জন সাধারণ নাগরিককে বলি হতে হয়েছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে। টাইমস অব ইণ্ডিয়ার ৯ ডিসেম্বর ২০১৮ কলকাতা সংস্করণে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রধান খবরটি হল—২২৩ জন জঙ্গী এই বছরে জম্মু-কাশ্মীরে নিহত হয়েছে যা গত ৮ বছরের মধ্যে সর্বাধিক (সারণী-১)।
০০    ২০১৭    ২০১৮
জঙ্গী হত    ২১৩    ২২৩
বিদেশে জন্ম    পাওয়া যায়নি    ৯৩
সাধারণ নাগরিক    হত    ৪০    ৭৭
নিরাপত্তা বাহিনী হত    ৮০    ৮০
হিংসার ঘটনা    ৩৪২    ৪২৯
সারণী থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে জম্মু-কাশ্মীরে হিংসার ঘটনা ২০১৭-র তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট হিংসার ঘটনা ২০১৭ সালে ছিল ৩৪২ সেখানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-তে ৪২৯ হয়েছে। একমাত্র নিরাপত্তারক্ষী হত হওয়ার ঘটনা ২ বছরেই এক থেকেছে, সংখ্যা ৮০। এরকম এক হিংসার বাতাবরণে রাজ্যে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যদি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে সেখানে বহি:শত্রুর আক্রমণের কথা কি ধোপে টিকবে? কেন না কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে প্রায় অভিযোগ করা হয় যে পাকিস্তানের আই এস আই এই রাজ্যে অতি সক্রিয়। আই এস আই কিছুমাত্রায় সক্রিয় হলেও সাধারণ নাগরিকদের যদি নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় রাজ্যে শান্ত নাগরিকরাও বিদ্রোহে ফেটে পড়বে। পড়ছেও। সাম্প্রতিক পুলওয়ামার ঘটনাতেও দেখা গিয়েছে গ্রামবাসীরা সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। যুবকরা সেনাদের উদ্দশে ঢিল ছুঁড়ছে। এ ঘটনা শুধু পুলওয়ামাতেই ঘটছে না। অনন্তনাগ, বারামুল্লা, উরি, ডোবা, শ্রীনগর, সোপোর সর্বত্রই ঘটছে। হিংসা দিয়ে হিংসাকে রোখা যাবে? রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন আগে বন্ধ করতে হবে। সাধারণ যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে, উন্নয়ন ঘটাতে হবে—তবেই হিংসা থামবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-39