প্রতিবেদন
ছাত্রীদের কর্মশালা

সারা দেশজুড়ে আজ মেয়েরা যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে হ্যাসট্যাগ #-এর মাধ্যমে। এই মুখ খোলা শুরু হয় হলিউড থেকে বলিউডে, অনেক বিখ্যাত অভিনেতাদের নাম তাতে উঠে আসে। যারা লিঙ্গ সাম্যের কথা টিভি চ্যানেলে বলেছে তাদের ইমেজও আজ মানুষের কাছে পরিষ্কার। সারা পৃথিবী জুরে হ্যাসট্যাগ #মি-টু দিয়ে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার অভিজ্ঞতা সোশ্যাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে প্রচার করে। এই সময় বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের নাম উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বিখ্যাত নাট্য কর্মীদের নাম। সমাজকর্মী আইনজীবীর নামও। কিছ এনজিও কর্মী লিঙ্গসাম্য এবং অধিকার আন্দোলন নিয়ে কাজ করে। বিজেপির মন্ত্রী এবং সাংবাদিকের নামে প্রতিবাদ জানাতে মহিলা সাংবাদিকরা রাস্তায় নামে। এই প্রচার থেকে বাদ থাকেনি প্রগতিশীল রাজনীতির পুরুষ কর্মীরাও, বিশেষ করে কিছু ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নাম উঠে এসেছে। এই সময় সারা দেশ জুড়ে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়, বেঙ্গালুরুতে শ্রমজীবী মহিলাদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করা বা বিহারে ছাত্রীদের মধ্যে কর্মশালা করা হয়। এই রাজ্যেও মহিলা সমিতি হুগলী, হাওড়া, ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় একই ধরনের কর্মশালা অনুষ্ঠিত করে। কলকাতাতেও এই ধরনের কর্মশালার পরিকল্পনা চলছে।

হুগলির পোলবা বন্যপাড়ায় মহিলা সমিতির প্রথম উদ্যোগে ছাত্রীদের নিয়ে সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারীর যৌন স্বায়ত্ততা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় একদিকে কম বয়স থেকেই নিজের শরীর ও যৌনতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া, স্কুল থেকেই ছাত্রীরা নিজেরা সংগঠিত হওয়ার জন্য বিভিন্নরূপে সংগঠন গড়া, ঋতুস্রাব তথা নারী শরীর নিয়ে সমাজে চালু রাখা লজ্জাবোধ বা নিষিদ্ধতার ধারণাকে ভাঙা, স্যানিটরি প্যাড দাবি করা ইত্যাদির সাথে সাথে ‘সম্মতি’ প্রসঙ্গে সচেতনতার শিক্ষা ছিল মূল বিষয়। স্কুলের ছোট ছোট ছাত্র ও ছাত্রীদের মধ্যেও ‘নির্দোষ স্পর্শ’ ও ‘অনভিপ্রেত স্পর্শ’ বুঝতে শেখাতে অভিভাবিকাদের সচেতন হওয়া ও সন্তানদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করার প্রসঙ্গ আসে। গ্রাম ও মফস্বলের স্কুল ও কলেজে পাঠরত বেশ কয়েকজন ছাত্রী তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অভিভাবিকাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন রন্ধনকর্মী। ছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে কথা হয়।

হাওড়ায় বাগনানে একটি মুসলিম পাড়ায় মেয়েদের সঙ্গে কথা হল। মেয়েরা বলল, যে তারা দল বেঁধে স্কুলে যায় যাতে তাদের কেউ উত্যক্ত না করতে পারে। মেয়েরা বলে যে যৌন হেনস্থা হলেও তাদের বলার কোনও জায়গা থাকে না। কলেজে পড়া একটি মেয়ে বলে যে তার কলেজে যৌন হেনস্থা বিরোধী কোনো কমিটি আছে কি না তার জানা নেই। এই নিয়ে সে কিছুই শোনেনি তার কলেজে। কোনও ঘটনা ঘটলে ইউনিয়নের দাদারা সালিশী সভা বসিয়ে তার বিচার করে। একজন মহিলা আমাদের জানালেন যে অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চা মেয়েরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে পরিবারকে জানাতে ভয় পায়, আর শেষ পর্যন্ত পাচার হয়ে যায়। এই বিষয়ে মেয়েদের যে সংগঠিত হতে হবে এবং রুখে দাঁড়াতে হবে এই কথা সংগঠকরা তুলে ধরেন।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজে এক আলোচনা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহিলারা ও তার সঙ্গে কিছু কম বয়সি মেয়েরা। আলোচনা শুরু হয় যে সারা দেশজুড়ে মেয়েরা ঘর ছেড়ে স্কুল-কলেজ-কর্মক্ষেত্রে বেরোচ্ছে অন্যদিকে পিতৃতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একদিকে যখন মহিলাদের ওপর হিংসা বাড়ছে তখন পারিবারিক হিংসা বিরোধী যে আইন তাকে শিথিল করছে আর ধর্ষন বিরোধী যে আইন তাকে গুলিয়ে দিচ্ছে, যত কুসংস্কার আছে, যত পিতৃতান্ত্রিক ধ্যান ধারনা আছে, সেসব প্রচার করে মহিলাদের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই পিতৃতান্ত্রিক ধারণাকে ছোটো থেকে বুঝতে ও যুঝতে শিখতে হবে। এবং আত্মরক্ষা সমিতি গঠন করতে হবে। একজন মহিলা আমাদের বলেন যে, মেয়েরা ছোট জামা পরে, সেটা কিছুটা হলেও দায়ী। এক ছাত্রী তার উত্তরে বলেন, মেয়েরা যাই পরুক না কেন ধর্ষণ হলে তাদেরকেই দায়ী করা হবে। এমনকি শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু ছেলেরা কিছু না পরে যদি কলতলায় স্নান করে তাদের মেয়েরা ধর্ষণ করতে যায় না।

কর্মশালাগুলিতে দেখা গেছে যে মেয়েরা মুখ খুলছে। তারা পড়ার কথা বলছে, স্বাধীনতার কথা বলছে এবং লড়াইয়ের কথা বলছে।

কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন যে আলাদা করে ছাত্রীদের মধ্যে এই কর্মশালাগুলোর কি প্রয়োজনীয়তা আছে? কিন্তু এই বৈঠকগুলিতে প্রকাশ হয়েছে মেয়েদের স্বাধীনভাবে বাঁচার আকাঙ্খার ওপর পিতৃতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া কেমনতর। মেয়েরা চোখ রাঙানি বা দাদাদের শাসানিকে উপেক্ষা করে আজকে এগোতে চাইছে। আরএসএস যে আজ মতাদর্শের ভিত্তি তৈরি করতে পারছে সেটা এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে তার উপাদানকে কাজে লাগিয়েই। সরকারগুলো পিতৃতান্ত্রিক সাধারণ ধারণা প্রচার করে; উল্টোদিকে যদি পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করে মহিলাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে সেটাই আগামী দিনে সরকার বিরোধী স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-36