পর্যবেক্ষণে সিঙ্গুর

করলে আবাদ ফলতো সোনা,
কিন্তু চলছে কেবল প্রতারণা।

১৫ ডিসেম্বর সিঙ্গুরে তদন্ত অনুসনন্ধানে গিয়েছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির চার সদস্যের এক প্রতিনিধি দল। ছিলেন সজল অধিকারী, তপন বটব্যাল,চৈতালী সেন, জয়তু দেশমুখ।

প্রকল্প এলাকার বেশ কিছুটা জায়গা-দোবাদী, জয়মোল্লা, খাসের ভেড়ি, বাজেমেলিয়া, গোপালনগর প্রভৃতি গ্রাম পর্যবেক্ষণ ও গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলার মধ্য দিয়ে দেখা গেল—১০ ভাগ জমিও চাষযোগ্য করা হয়নি। জমি সমতলীকরণ, মাটি ফেলা, পূর্বেকার নির্মাণ আবর্জনা স্তূপ অপসারণ, "বেনা" নামক আগাছা নির্মূলীকরণ-প্রভৃতি কাজ শুরু হলেও মাঝপথে থমকে গেছে। লক্ষ লক্ষ টাকার কাজের বর্ণনাকারী ফলকগুলি রাস্তার পাশে শোভা পাচ্ছে। অথচ কাজ আদৌ হয় নি। ১০০ দিনের প্রকল্পে আংশিক ভাবে জমি সংস্কার, আগাছা তোলা হলেও খাপছাড়াভাবে যত্রতত্র করা হয়েছে, কোন গ্রামের পার্শ্ববর্তী জমির থেকে শুরু করে একলপ্তে ঐ কাজ করা হয়নি, সর্বোপরি গ্রামবাসীদের কমিটি গড়ে তাঁদের তদারকিতে কাজ হয়নি। ফলে বড় ধরনের টাকা নয়ছয় তথা দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যেই ব্যাপক মাত্রায় শোনা গেল। বহু স্থানে তিন/চার বার আগাছা তোলা হয়েছে,জমি তৈরীর কাজ হয়নি, ফলে পুনরায় সেগুলি গজিয়ে গেছে। জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। আন্দোলনে যারা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং "অনিচ্ছুক" ছিলেন সেই বাজেমেলিয়া গ্রামের কৃষকরা জানালেন, যদি এক একটা গ্রামের পাশ থেকে জমি সংস্কারের কাজে এগুনো যেতো, গ্রামবাসীদের মতামত নিয়ে কাজ হতো জমি আস্তে আস্তে চাষযোগ্য হতে হতে মাঝের দিকে এগুতো। কিন্তু কাগজে কলমে গ্রাম কমিটি থাকলেও সেগুলি কার্যতঃ শাসক পার্টির ছোট ছোট  চক্র। যারা কাজের তদারকির নামে পকেট ভরাতে ব্যস্ত। একটা মৌজায় ৫টা মিনি টিউবওয়েল বসানো হয়েছে—অথচ অব্যবহৃত পড়ে আছে। ডিপ টিউবওয়েলও বসেছে, অপারেটার নেই, কাজ হয় না। কংক্রিটের নির্মাণগুলি অনেকটাই ভাঙ্গা ও অপসারিত হয়েছে, কিন্তু এখনও পাথর-লোহার রড প্রভৃতি মাটির তলা থেকে সম্পূর্ণ তুলে ফেলা হয়নি। যদিও এ ধরনের জমি মোট অধিগৃহীত জমির এক-চতুর্থাংশ। বাকী তিন ভাগ উর্বরা জমি চাষযোগ্য করার  সম্ভাবনা থাকলেও উপযুক্ত পরিকল্পনা নেই,সদিচ্ছা নেই,বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ার ব্যাপারও থাকতে পারে। একজন গ্রামবাসী বললেন, "করে দিলে তো হয়েই গেলো,তাহলে করছি করবো বলে বারবার ভোট চাওয়া যাবে কি করে!'' "ইচ্ছুক জমিদাতা" ছিলেন যারা—কেউ এ্যাবসেন্টি বা চাকুরী-ব্যবসাজীবী (প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) তাদের চাষে আগ্রহ নেই, জমি ফেলে রেখে দিয়েছে। ভাগ চাষীরা চরম বঞ্চিত, চাষাবাদ থেকে উচ্ছেদ  হয়ে গেছে, এদের ছোট একটা অংশই কেবল "সরকারী টোকেন" পেয়েছে, ফলে তারা চাল-টাকার অনুদান পাচ্ছে। মাসে ১৬ কেজি চাল, ২০০০ টাকা। এটাই ক্ষেতমজুর সহ গ্রামবাসীদের একমাত্র সম্বল। তবে আগামীতে যদি সেটা বন্ধ হয়ে যায় (মুখ্যমন্ত্রী তেমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন) ''আমরা কৃষি কাজ জানি পেটের ভাত ঠিক যোগাড় করে নেবো' প্রকাশ্যেই বললেন একজন চাষী, "কিছু একটা করুন, যাতে সরকার সঠিক ভাবে জমি চাষযোগ্য করে দেয়" তার আবেদন শোনা গেলো। ক্ষেত মজুররা ১০০ দিনের কাজ অনেকেই পাচ্ছে,অনেকেরই ৮৪/৮৫ দিন এমনকি ১০০ দিনও সম্পূর্ণ। কিন্তু ব্যাপক ভাবে অভিযোগ শোনা গেল, লোকাল নেতারা অর্ধেকেরও বেশী পরিমান টাকা পকেটে পুরছে। এমনকি জমিতে ফেলার জন্য মাটি নদী থেকে আনা হলো, সেই মাটির ৯০ ভাগ অন্যত্র বিক্রী হয়ে গেলো—এ সব আকছার ঘটে চলেছে। প্রকল্প এলাকার মধ্যে যে খাস জমি আছে (পরিমাণ অনুসন্ধান সাপেক্ষ) সেখানে গরীব ক্ষেতমজুরদের বাস্তু সংকট সমাধান করা যায়,জানালেন দোবাদীর মজুররা। বললেন, এখন চাষের কাজ অর্ধেক কমে গেছে। ৪/৫ মাইল দুরে গিয়ে কাজ করতে হয়, স্থানীয় গ্রামে কাজ নেই। এদের ক্ষতিপূরণের অধিকার সরকার স্বীকারই করে নি। গোটা এলাকায় মানুষ প্রকাশ্যেই সরকারের বিরুদ্ধে নির্দ্বিধায় কথাবার্তা বলছিলেন। তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, স্বজনপোষণ, নেতাদের আখের গুছিয়ে নেওয়া, প্রকৃতই যারা যোগ্য তাদের পাত্তা না দেওয়া, নেতাদের অহঙ্কার এসব নিয়ে ক্ষোভ দেখালেন।

৩১ আগষ্ট ২০১৬। সর্বোচ্চ আদালত রায় দিল, ক্ষতিপূরণ বজায় রেখে রাজ্য সরকার বেআইনি ভাবে অধিগৃহীত ওই ৯৯৭ একর জমি কৃষকদের ১২ সপ্তাহের মধ্যে চাষযোগ্য করে ফিরিয়ে দিক। কোম্পানির স্বার্থে অধিগৃহীত জমি 'জনস্বার্থ' কিনা, সে প্রশ্নও তুলেছে সুপ্রিম কোর্ট । মমতা ব্যানার্জি এই রায়কে বললেন 'ঐতিহাসিক', 'দৃষ্টান্তমূলক'। বললেন 'ন্যায় ও সত্যের জয়'। বললেন 'আমি এবার শান্তিতে মরতে পারবো'।

২ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুর দিবস। হাওড়া স্টেশন থেকে প্রতিদিন  ছাড়ছে 'আন্দোলন লোকাল'। ২০১১-তে কৃষক আন্দোলনের এই 'এপিসেন্টার' এরাজ্যে পালাবদল  আনল। এখনো সিঙ্গুর থেকে পরপর নির্বাচনে জয়ী হচ্ছে শাসক দল। কিন্তু অনেক আইনি, বেআইনি' লড়াই শেষে কৃষক যে অধিকার ফিরে পেল, তার কি হল?

সরকার বলছে, ১০০ কোটির বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে সুসংহত সেচ বিকাশে। ১৫টি ট্রন্সফর্মার, ৫৬টি মিনি ডিপ। নিয়ম করে 'বেনা' পরিষ্কার যজ্ঞ। এরপরও চাষ সেই তিমিরে। চাষ হচ্ছে মোটামুটি ৪টি এলাকায়—বাজেমেলিয়া মনসাতলা, হিমাদ্রি সংলগ্ন এলাকা, উজ্জ্বল সংঘ সংলগ্ন এলাকা ও সানাপাড়া এলাকায়। এটা ঠিকই যে 'অনুপস্থিত জমিদাররা'ও মূলত ফেলে রাখছে জমি। কিন্তু বাজেমেলিয়া, খাসের ভেড়ির যারা 'জাত কৃষক', তারা কেন চাষ করতে পারছেন না? কোটি কোটি টাকার সংস্কার কর্মসূচী ঘিরে লুণ্ঠন চালাচ্ছে এক কায়েমী গোষ্ঠী। মমতা রাজনৈতিক মাইলেজ নিয়ে চলেছেন। এর জবাবও তাঁকে দিতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে দু বছরের অধিক সময় অতিক্রান্ত। জমি চাষযোগ্য করা নিয়ে তামাশা চলছে। কোন গোপন উদ্দেশ্য সরকার ও কায়েমী গোষ্ঠীর আছে কি! সব দেখে শুনে এ প্রশ্নও আজ উঠছে। শালবনির উদাহরণ সৃষ্টি করেছে এই সরকারই! কৃষক মহলে আজ বড়  অসন্তোষ। শুধু উপরতলায় বিভাজন না, সিঙ্গুরে  আজ পঞ্চায়েত নির্বাচনেও শাসক কে মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিক্ষুব্ধ নির্দলের। মাত্র ৯ ভোটে হারছে বারোহাত কালীতলার নির্দল প্রার্থী। নিকাশি অব্যবস্থা অসন্তোষের আর এক কারণ। সিঙ্গুরে পরিত্যক্ত প্রকল্পের একর1000 একর জমি ও বিপর্যস্ত  নিকাশি ব্যবস্থা। যা আবার ডোবাচ্ছে প্রকল্প বহির্ভূত আরো ১০০ একরকে। মহতি  কৃষক আন্দোলনের কোন ক্ষেত্রে কিছু ডোল দিয়ে অমীমাংসিত সমস্যাগুলি চাপা দেওয়া যায়না, সিঙ্গুর এই সত্য আবার তুলে ধরছে। এ রাজ্যের গণতান্ত্রিক মহলের হস্তক্ষেপের জন্য সিঙ্গুর আবার  অপেক্ষারত। যে দাবিগুলি সামনে আসছে (১) জমি চাষযোগ্য করে কৃষকদের ফিরিয়ে দাও। এজন্য (ক) সংস্কার কাজে সরকারি বরাদ্দ যথাযথ ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বৃদ্ধি করা (খ) ইতস্তত মাঝেসাঝে বেনাবন সাফ না করে  কৃষকদের সামিল করে কৃষকদের সক্রিয় কমিটির তদারকিতে বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনার অধীনে জমি চাষযোগ্য করা (গ) জমির মালিকানা চিহ্নিতকরণের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা (২) প্রকল্প এলাকার খাস জমি (৩০০ একরের বেশী) কৃষিমজুর ও বর্গাদার, গরিব কৃষকদের মধ্যে বিলিবন্টন করা (৩) নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন। সেচ ও নিকাশি ব্যবস্থা উন্নয়নে সুসংহত পরিকল্পনা গ্রহণ। কানানদী, দৈবক ইত্যাদি খাল সংস্কার। এই  মাটি  তুলে প্রকল্প এলাকা ভরাট করার জন্য এন আর ই জি এস-কে কাজে লাগানো । (৪) সরকারি প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা। (৫) কৃষি বিকাশে বিশেষ পরিকল্পনা ।

রিলিফ পাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত, বিপর্যস্ত মানুষের অধিকার। শাসক রিলিফকে ব্যবহার করে অসদ্ উদ্দেশ্যে; জনসক্রিয়তা স্তব্ধ করতে। সিঙ্গুরের খাসের ভেড়িতে বছর সত্তরের এক অসহায় মহিলার চোখের জলের সাক্ষীও হলাম আমরা। শুধুমাত্র 'ইচ্ছুক কৃষক' এই 'অপরাধে' যাঁর সব ধরণের রিলিফ, এমনকি বার্ধক্য ভাতাও জোটে না। দুর্নীতিগ্রস্ত আত্মীয়দের চাকরি বাগানো নেতাদের বিপরীতে বিধবা 'আঙ্গুর দাস' আর এক সিঙ্গুর, আর এক বাস্তবতা!

সামগ্রিক পরিস্থিতি দাবি জানাচ্ছে নতুন করে গণতান্ত্রিক মহলের হস্তক্ষেপ।সিঙ্গুর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এক অনন্য স্পিরিট। জনগণের জয় অর্জনেরও দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত অস্বচ্ছ করতে পারলে শাসকদের নৈতিক জয়।সেই চক্রান্তও চলবে। আমাদের শপথ নিতে হবে, সিঙ্গুর কে শালবনি বানাতে দেবো না।

খণ্ড-25
সংখ্যা-38