প্রতিবেদন
সিপিআই(এমএল) নেতা বিজেপি-র বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পক্ষপাতী

যতটা খারাপ হবে বলে দেখানো হচ্ছে ভারতে বামদের নির্বাচনী সম্ভাবনা ততটা খারাপ নয়। নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বামেরা হয়ত সর্বাধিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে ২০১৪-র নির্বাচনে। কিন্তু ২০১৯ এ তাদের পুনরুত্থানের সমস্ত ক্ষেত্রগুলিই দৃশ্যমান। এটা কোন অনুমানের বিষয় নয় বরং বিদ্যমান বাস্তবতার ওপর নির্ভর করেই এই আশাবাদ গড়ে উঠছে।     

ভারতীয় বামরা হল এক তত্ব-নির্ভর গণতান্ত্রিক শক্তি যা কখনোই নিশ্চল ও স্থাণু নয়। দিল্লীর রামলীলা ময়দানে ৩০ নভেম্বরের বিশাল সমাবেশ ও ৮-৯ জানুয়ারী কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি কর্তৃক অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ ধর্মঘটের যৌথ শপথই বাম শক্তিগুলির পুনরুত্থানকে নির্দেশ করছে। (সম্প্রতি) কৃষকদের দিল্লী অভিযানটি হল স্বাধীন ভারতে বামেদের দ্বারা সংগঠিত সর্ব বৃহৎ সমাবেশ।

এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে বামেদের ধাক্কার মুখে পড়ার জন্য বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদির কোনো শয়তানিপূর্ণ চক্রান্তের থেকে বামদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলি ঢের বেশি দায়ী। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও তাঁর কর্তৃত্বকে (দলের মধ্যে) জোরাল ভাবে ও স্বকীয় ভঙ্গীতে তুলে ধরতে দ্বিধা বোধ করেন।

সিপিআই(এমএল)-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর বলেছেন, সম্ভাব্য প্রতিটি জায়গায় নির্বাচনী ময়দানে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করার চ্যালেঞ্জ হাতে নিতে কমিউনিস্টদের কার্যকরী হস্তক্ষেপের রণনীতি সূত্রায়িত করতে হবে। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার চ্যালেঞ্জটা অবশ্য শুধুমাত্র নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করে নির্বাচনী চৌহদ্দির মধ্যে আটক রাখা চলবেনা। বিজেপিকে দূরে রাখতে কোন একটি তথাকথিত মহাজোটে ঢুকে পড়া বা তাকে সমর্থন করার কর্তব্যকর্মেও নামিয়ে আনা ঠিক হবে না।

কোন‍ো কোনো বাম নেতা বিজেপিকে কংগ্রেসের সাথে তুলনা করেন। আমি অবাক হই এবং সত্যিই আমার বোধগম্য হয়না যে কেমন করে একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠনের সাথে একটি জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া দলকে সমান ভাবা হয়!এই মানসিকতার কারণেই ২০১৪-য় কমিউনিস্টদের বিজেপিকে পথ করে দিতে হয়। ২০১৯ এর নির্বাচনে একই ভুল ঘটতে দেওয়া চলবেনা। কথা প্রসঙ্গে দীপঙ্কর জানিয়েছেন যে অন্যান্য বাম দলগুলির সাথে তাঁর নিয়মিত সংযোগ রয়েছে এবং গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে মতাদর্শগত নির্যাস জোগানোর কাজে তিনি লাগাতার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা একান্ত জরুরী ও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এটি ব্যাতীত গেরুয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর প্রকল্পটি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। দীপঙ্কর মনে করেন, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে প্রতিরোধ ও পরাস্ত করতে জনগণের হাতে দুটো কার্যকর হাতিয়ার রয়েছে-সংবিধান ও ভোটাধিকার। বিপ্লবী লাইনের প্রতি দায়বদ্ধ বামপন্থীদের সম্ভাব্য প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচনী ময়দানে ফ্যাসিবাদী শক্তিসমূহের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে ও তাদের পরাস্ত করতে কার্যকরী হস্তক্ষেপের রণনীতি উদ্ভাবন করতেই হবে।বামেদের উচিত ফ্যাসিবাদী ও অ-ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির মধ্যে পার্থক্যকরণ করা। অবশ্য ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার চ্যালেঞ্জটা শুধুমাত্র নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ হিসেবে পরিগণিত করাটা কোনভাবেই সঠিক হতে পারেনা। তিনি ইতিমধ্যেই সমস্ত গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও বাম দলগুলিকে একটি একক মঞ্চে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। যদিও তিনি জোর দিয়েই বলেছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মতাদর্শগত-রাজনৈতিক পালটা অভিমত গড়ে তোলার প্রকৃত কর্তব্য কর্ম থেকে কখনোই নজর ফেরালে চলবে না।

এ যাবৎ সমঝ‌োতা গড়ে তোলার কাজটি বড় বড় দলগুলিরই একান্ত এক্তিয়ারভুক্ত ছিল। এবার এটি যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্জক যে সিপিআই(এমএল) এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দীপঙ্কর জানিয়েছেন যে ইতিমধ্যেই তিনি আরজেডি নেতা তেজস্বীর সাথে প্রাথমিক এক দফা আলোচনা চালিয়েছেন।

ভারতে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে প্রতিহত করার উপরই সিপিআই(এমএল) প্রধান গুরুত্ব আরোপ করেছে। দীপঙ্কর জানিয়েছেন, ভারতে ফ্যাসিবাদের নিশ্চিত উত্থানের মুখে আমরা আমাদের দশম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করেছি। আজকের দিনে বিজেপি প্রতিটি ক্ষেত্রে নয়া উদারবাদী হামলা নামিয়ে আনছে-একই সাথে সাম্প্রদায়িক দিশায় সমাজের পরোপুরি মেরুকরণ ঘটানোর সাথে সাথে আরএসএস-এর অ্যাজেন্ডাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলিতে অনুপ্রবেশ ও কব্জা করতে তৎপর হয়েছে। সংসদীয় নিয়মবিধি সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে কাজে লাগানো এবং সাংবিধানিক সংস্থা ও দপ্তরগুলিতে অন্তর্ঘাত চালানোর মাধ্যমে বাস্তবত সংসদীয় ব্যবস্থায় ঝটিকা আক্রমণ সম্পন্ন করেছে।

উৎসবগুলির সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং সঙ্ঘ পরিবার কর্তৃক রাম নবমীর নামে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে যে ভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানো হচ্ছে তার নিন্দা করে পার্টি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে।‍‍ 'স্ব শাসনের’ নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বেসরকারীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতি এবং জেএনইউ-এ এক অধ্যাপক কর্তৃক ছাত্রদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতি পার্টি সংহতি জ্ঞাপন করেছে।

বিগত চার বছরে শাসকশ্রেণীর আধিপত্যকারী রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপির উঠে আসার মধ্য দিয়ে ভারত এক বিপুল রাজনৈতিক পরিবর্তনকে প্রত্যক্ষ করেছে। ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে এই প্রথমবার বিজেপি শুধুমাত্র কেন্দ্রেই যে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তাই নয় কয়েকটি বাদে প্রায় সমস্ত রাজ্যেই, হয় একক ক্ষমতায় অথবা অন্যদের সঙ্গে জোট গড়ে, শাসক পার্টি হিসেবে উঠে এসেছে। কেন্দ্র এবং রাজ্যস্তরে আধিপত্যকারী শাসক দল হিসেবে বিজেপির উত্থান সমগ্র সঙ্ঘ পরিবারকে অভূতপূর্ব শক্তি ও আগ্রাসনের মাধ্যমে তাদের ফ্যাসিবাদী কর্মসূচিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম করে তুলেছে। গণ পিটুনি,বিরুদ্ধ মত প্রকাশকারী বুদ্ধিজীবী ও (সমাজ) কর্মীদের বেছে বেছে হত্যা ও লাগাতার বিষাক্ত ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে সঙ্ঘ বাহিনী কর্তৃক সাম্প্রদায়িক-জাত পাত ভিত্তিক-পুরুষতান্ত্রিক বিধানগুলিকে বলবৎ করার ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ও গোপন মদত দেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্রমেই বেশি বেশি করে কর্তৃত্ববাদী ও হামলাবাজের চেহারা নিচ্ছে।

দীপঙ্কর বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং সংসদীয় রীতিনীতি ও প্রক্রিয়াগুলোকে অবজ্ঞা করে উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের স্বার্থবাহী ধ্বংসাত্মক আর্থিক অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্ষমতায় এসেই নরেন্দ্র মোদি ২০১৩-র জমি অধিগ্রহণ আইনের রক্ষাকবচ এবং ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের তুলনামূলক উন্নততর শর্তাবলীকে নস্যাৎ করতে উদ্যত হয় যা জমি ও জীবিকা হারানো মানুষেরা অর্জন করেছিল। যদিও প্রবল প্রতিরোধের মুখে তার সরকার জমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করতে পারেনি। কিন্তু তা সত্বেও কর্পোরেট স্বার্থবাহী অ্যাজেন্ডাকে নগ্নভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেনি। কর্পোরেটমুখী আর্থিক কর্মসূচিকে আগ্রাসীরূপে অনুসরণ করার পাশাপাশি অত্যুগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির তোলা হচ্ছে। সম্প্রদায় হিসেবে মুসলিমদের আক্রমণের নিশানা বানানোর সাথে সাথে দলিতদের বিরুদ্ধেও সমান তালে সঙ্ঘ বাহিনী হামলা চালাচ্ছে। ক্ষমতার বিভিন্ন অবস্থান ও প্রতিষ্ঠানে সঙ্ঘ বাহিনীর অধিষ্ঠান দলিত নিপীড়নের ঘটনার ব্যাপক বৃদ্ধির এক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দীপঙ্কর জোর দিয়েই বলছেন, গুজরাট থেকে উত্তরপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্র থেকে বিহার,দলিত প্রতিরোধের উদ্দীপনাময় দৃষ্টান্তগুলি এবং জমি, শিক্ষা, কাজ ও মর্যাদার মত বুনিয়াদী ইস্যুতে বিপ্লবী রাজনৈতিক সমাবেশ ঘটানোর নতুন সম্ভাবনাগুলি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দলিতদের বিরুদ্ধে আরএসএস মদতপুষ্ট আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধির মুখোমুখী দলিত যুবকদের নেতৃত্বে নতুন প্রজন্মের আন্দোলনেরও উদ্ভব ঘটছে।আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশে এসে দলিত আন্দোলনের দৃঢ় ভাবে দাঁড়ানোর সংকল্প ও সাম্প্রদায়িক হিংসা সংঘটনের কাজে দলিতদের সামিল করার অপচেষ্টাকে প্রতিহত করাটা অবশ্যই সাধুবাদ যোগ্য। তবে নিশ্চিত ভাবেই ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার চ্যালেঞ্জকে শুধু এক নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখলে চলবে না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী মতাদর্শগত-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার বুনিয়াদী কর্তব্য থেকে কখনোই বিরত থাকা যাবে না। ঘৃণা ছড়ানো ও ঘৃণ্য অপরাধ সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ফ্যাসিস্টদের যে দ্বিফলা আক্রমণ তাকে রুখে দেওয়ার জন্য দীপঙ্কর সমস্ত বাম দল ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির কাছে আহ্বান জানিয়েছেন।

খণ্ড-25
সংখ্যা-37