প্রতিবেদন
সিবিআই-তে দুর্নীতির কেলেঙ্কারি জড়িয়ে পড়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী
(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়,
২০ নভেম্বর ২০১৮)

কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোতে চলা দুর্নীতি এবং তোলাবাজির যে আখ্যানের উন্মোচন ঘটছে তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও একরকম বিজড়িত করছে। দেশে শক্তিশালী দুর্নীতি-বিরোধী মনোভাব এবং মোদীর ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা-র’ বিশ্রুত প্রতিশ্রুতি তাঁকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে মোদী এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন যেখানে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েও কেলেঙ্কারি ও দুর্নীতির ক্রমবর্ধমান স্রোতকে আটকানো যাচ্ছে না — এবং কেলেঙ্কারিগুলো প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের এবং তাঁর নিজের দপ্তরকেও বিজড়িত করছে। রাফাল চুক্তি থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যালকে সরিয়ে তার জায়গায় তাঁর স্যাঙাত অনিল আম্বানির মালিকানাধীন অনভিজ্ঞ একটি কোম্পানিকে সেই চুক্তির বরাত পাইয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে ইতিপূর্বেই প্রধানমন্ত্রী জড়িয়ে পড়েছিলেন। আর সর্বশেষ এবং চরম নারকীয় ঘটনাটি অবশ্য হল সিবিআই-কে বিপর্যস্ত করে তুলে তোলাবাজির একটি চক্র সম্পর্কে তদন্তকে এবং চলমান অন্যান্য তদন্তকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা।

অল্প কয়েকদিন আগে মোদী সরকার মাঝরাতে সিবিআই-তে হানাদারি চালিয়ে সিবিআই ডিরেক্টর অলোক বর্মাকে অপসারিত করার চেষ্টা চালায়। অলোক বর্মা তোলাবাজি ও ঘুষের একটি ঘটনায় বিশেষ ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে মামলা করার প্রয়াসী হওয়ায় মধ্য রাতের ঐ হানাদারি চলে। রাকেশ আস্থানাকে মোদী নিজেই সিবিআই-তে নিয়ে আসেন যিনি মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তাঁর ও অমিত শাহর বিশ্বস্ত দলবলের একজন ছিলেন। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রশান্ত ভূষণ, অরুণ শৌরি এবং যশবন্ত সিনহার কাছ থেকে একটি স্মারকলিপি গ্রহণ করে বর্মা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের রোষ আকর্ষণ করেন। ঐ স্মারকলিপিতে রাফাল চুক্তি নিয়ে নিয়ম-না-মানা অনেক বিষয়ের বিশদ বর্ণনা ছিল এবং তাতে দুর্নীতি নিরোধক আইনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। তাঁর অপসারণের বিরুদ্ধে বর্মা সুপ্রীম কোর্টে আবেদন জানান, যার ফলে সুপ্রীম কোর্টের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়াকে এড়াতে মোদী সরকার তাঁর অপসারণ প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু মধ্য রাতের ঐ হানাদারিতে বর্মার তদন্তকারী দলের সদস্যদের বদলি করা হয়। ঐ তদন্তকারীদের হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ তদন্তগুলোর মধ্যে ছিল নীরব মোদী এবং মেহুল চোক্সির (মোদী ঘনিষ্ঠ গুজরাটের ব্যবসায়ী) জড়িত থাকা পিএনবি দুর্নীতি এবং সেই তোলাবাজি কাণ্ড যাতে আস্থানা জড়িয়ে রয়েছেন। বদলিগুলো বহাল থাকে এবং তদন্তগুলোও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

আস্থানা এবং বর্মা পরস্পরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করেন, কেন্দ্রীয় নজরদার কমিশনের (সিভিসি) দ্বারা তার তদন্ত সুপ্রীম কোর্টের এক প্রাক্তন বিচারপতির তত্ত্বাবধানে চালিত হওয়ার নির্দেশ সুপ্রীম কোর্ট দেয়। সিভিসি-র কিছু প্রশ্নের জবাবে বর্মা এই অভিযোগ করেছেন যে বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদী এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে যোগসাজশ করে আস্থানা আইআরসিটিসি দুর্নীতিতে আর জে ডি প্রধান লালু যাদবকে অভিযুক্ত করেন। এই বিষয়টাও বিশ্বাস করা হয় যে, বিহারের যে বিশাল সৃজন দুর্নীতিতে সুশীল মোদী অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত, তার তদন্তকে বানচাল করে দেওয়ায় আস্থানা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সুপ্রীম কোর্টের কাছে পেশ করা এক আবেদনে সিবিআই-এর যুগ্ম ডাইরেক্টর মনিশ কুমার সিনহা এই অভিযোগ জানিয়েছেন যে, মোদী মন্ত্রীসভার সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল চলমান তদন্তগুলোতে অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করছেন। মনিশ সিনহার হাতে নীরব মোদী এবং মেহুল চোক্সির ঘটানো কাণ্ডগুলোর তদন্তের ভার ছিল এবং আস্থানার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এফআইআর নিয়ে তদন্তকারী দলেরও তিনি সদস্য ছিলেন। তাঁর আরো অভিযোগ, তাঁর বদলি ছিল ‘‘মর্জিমাফিক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অসদ লক্ষ্যে চালিত’’, কেননা, তাঁর তদন্তাধীনে থাকা বিভিন্ন ব্যক্তিদের রক্ষা করতেই তাঁকে বদলি করা হয়েছে।

সুপ্রীম কোর্টের কাছে পেশ করা তাঁর লিখিত বক্তব্যে সিনহা হায়দ্রাবাদের ব্যবসায়ী সতীশ সানার — যাঁর কাছ থেকে জোর খাটিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ আস্থানার বিরুদ্ধে রয়েছে — দেওয়া সাক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর সাক্ষ্যে সতীশ সানা জানিয়েছেন যে, তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরিভাই পার্থিভাই চৌধুরীকে কয়েক কোটি টাকার ঘুষ দিয়েছেন। এই মন্ত্রী আবার কর্মীবর্গ, জন অভিযোগ ও পেনশন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং-এর মাধ্যমে সিবিআই-এর অফিসারদের উপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কর্মীবর্গ, জন অভিযোগ ও পেনশন দপ্তরের প্রধান নরেন্দ্র মোদী হওয়ায় জিতেন্দ্র সিং সরাসরি নরেন্দ্র মোদীর কাছে জবাবদিহি করেন। এছাড়া, হরিভাই পার্থিভাই চৌধুরী হলেন গুজরাটের বংশকান্ঠার সাংসদ (নীরব মোদী এবং চোক্সিও যেখানের বাসিন্দা) আর মোদী নিজেই তাঁকে মন্ত্রীসভার সদস্য করেন এবং তিনি এখন কয়লা ও খনি দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী।

সিনহা এই অভিযোগও করেন যে, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সিবিআই-কে আস্থানার ফোনটি বাজেয়াপ্ত করতে না দিয়ে আস্থানার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এফআইআর সম্পর্কে সিবিআই-এর তদন্তে বাধা দিয়েছেন। সিনহার আরো অভিযোগ, সতীশ সানার কাছ থেকে জোরজবরদস্তি টাকা আদায় কাণ্ডে দালাল মনোজ প্রসাদকে সিবিআই গ্রেপ্তার করার পর সে এই আস্ফালন করে যে তার বাবা ডোভালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ফল ভালো হবে না বলে সে সিবিআই-এর অফিসারদের হুমকি দেয়। মোদীর সংহত ব্যবস্থাপনায় ডোভাল সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের অন্যতম বলে সুবিদিত যিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিষয়ে এবং এমনকি বৈদেশিক নীতি সম্পর্কেও বিচার-বহির্ভূত প্রভাব খাটান। মনোজ প্রসাদের হুমকিতে যথেষ্ট সারবত্তা ছিল বলেই মনে হয়, কেননা তার পরপরই সানা/আস্থানা কাণ্ডে এবং অন্যান্য ঘটনায় তদন্তকারী অফিসারদের দলবেঁধে বদলি করা হয়!

সিনহার অভিযোগের মধ্যে আরো রয়েছে যে, কেন্দ্রীয় আইন সচিব সুরেশ চন্দ্র আইএএস অফিসার রেখা রাত্রির মাধ্যমে সানার সঙ্গে যোগাযোগ করে আদালতের নজরদারিতে চালিত সিভিসি-র তদন্তে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। রেখা রাণী মন্ত্রীসভা সচিব পি কে সিনহার হয়ে সানাকে বলেন যে, তিনি আস্থানার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নিলে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে রক্ষা করবে। সিনহা এই দাবিও করেছেন যে, তাঁর দলের সদস্যরা একটা টেপেরও নাগাল পেয়েছে যাতে ‘র’-এর অফিসার সামন্ত গোয়েলকে দাবি করতে শোনা গেছে যে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সিবিআই-এর মধ্যে চলা বিশৃঙ্খলার সমাধান করে ফেলেছে, আর তার পরই মধ্য রাতের ঐ হানাদারি ঘটে।

সিনহার আরো অভিযোগ হল, সিভিসি-র কে ভি চৌধুরী তাঁর নিজের বাসায় তাঁর এক আত্মীয় সহ সানার সঙ্গে দেখা করেন, যে আত্মীয় এই কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রয়েছেন।

ইতিমধ্যে, সিবিআই-এর এক আদালতে সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ হত্যা মামলায় যে শুনানি চলছে তাতে গান্ধিনগরের সিবিআই-এর পূর্বতন এসপি এবং সোহরাবুদ্দিন মামলায় প্রধান তদন্তকারী অফিসার অমিতাভ ঠাকুর তাঁর সাক্ষ্যে জানিয়েছেন যে, গুজরাটের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ঐ ঘটনা থেকে রাজনৈতিক এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। এবং সোহরাবুদ্দিন ও তুলসিরাম প্রজাপতি বাড়ি-ঘর নির্মাতাদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে তাদের কাছ থেকে যে ৭০ লক্ষ টাকা আদায় করে, সেই টাকা অমিত শাহ পেয়েছেন। তিনি আরো জানান, উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত পুলিশ অফিসার ডিজি বানজারা সোহরাবুদ্দিনকে হেফাজতে হত্যা করার জন্য ৬০ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। সোহরাবুদ্দিনের স্ত্রী কৌশর বাঈকেও হত্যা করা হয় এবং পরবর্তীতে সোহরাবুদ্দিন হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী প্রজাপতিকেও হত্যা করা হয়।

সিবিআই-এর বরিষ্ঠ অফিসাররা সুপ্রীম কোর্ট এবং সিবিআই কোর্টে কলঙ্ক কাহিনীর যে ডালি উজাড় করে দিয়েছেন তা দেখাচ্ছে যে, মোদী সরকার কিভাবে একেবারে সর্বোচ্চ স্তরেই দুর্নীতি এবং তোলাবাজির পাঁকে ডুবে রয়েছে। যে সমস্ত অফিসারদের মোদী নিজেই বেছে নিয়েছিলেন, তারা নিজেরাই সরাসরি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ায় সন্দেহের তির এখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দিকেই ধেয়ে যাচ্ছে। বিজেপি এই বলে দুর্নীতির অভিযোগগুলোর মোকাবিলা করতে চাইছে যে, মোদীর কোনো পরিবার নেই আর তাই দুর্নীতির কোনো অভিপ্রায় তাঁর থাকতে পারে না। ব্যক্তিগতভাবে ধনশালী হওয়া অথবা সন্তান-সন্ততির জন্য সম্পদ অর্জনের লালসা কখনই বিপুলাকায় দুর্নীতির উৎস হয় না। পেটোয়া পুঁজিবাদ এবং চক্র চালিত শাসনের মধ্যে দিয়েই দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত ঘটে, আর মোদী সরকার এই উভয়েরই মূর্তরূপ। এই সরকার যে চূড়ান্ত রূপের ষড়যন্ত্রমূলক এবং স্বৈরাচারী ধারায় তার কাজকারবার চালাচ্ছে তার লক্ষ্য হল সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে অন্তর্নিহিত ভারসাম্য রক্ষার গোটা ব্যবস্থাটার ভিত্তিকেই বিপর্যস্ত করে তোলা এবং যে কোনো তদন্তের হাত থেকে দুর্নীতিপরায়ণদের রক্ষা করা এবং ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গকে পুরোপুরি দণ্ডপ্রাপ্তির বাইরে রাখা। এটা দুর্নীতি এবং অপরাধের এক মারাত্মক মিশেল এবং সিবিআই-এর আলমারি থেকে সুপ্রীম কোর্টের সামনে বেরিয়ে পড়া কঙ্কালগুলো প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত প্রহসনের ভয়াবহ আভাস দেয়। ক্ষমতার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ অপব্যবহারের অবসানকে অবধারিত করে তুলতে হবে।

খণ্ড-25
সংখ্যা-36