১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮'র সংকল্প :  ফ্যাসিস্ট জমানাকে  হঠাও ! ভারত বাঁচাও, পুনর্নির্মাণ কর।

২০১৮ সাল গণতন্ত্রপ্রিয় ভারতবাসী এবং ফ্যাসিস্ট মোদী জমানার মধ্যে যুদ্ধ রেখাকে তীক্ষ্ণ করে তুলেছে। ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো যতই তীব্র করেছে তাদের আগ্রাসনকে, ততই আমরা দেখেছি ফ্যাসিবাদ ও গণতন্ত্রের এই মহারণে গণউত্থানগুলো দৃঢ়ভাবে আত্মপ্রকাশ করছে। চরম আর্থিক সংকটের বিপর্যয়কারী যন্ত্রণা, ভারতীয় রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক শক্তি, গণমাধ্যমের তরফ থেকে বিপথে চালিত করার লক্ষ্যে প্রচার এবং সাম্প্রদায়িক উন্মত্ত জনতার শ্বাসরোধকারী হিংসাকে উপেক্ষা করে জনগণ উদ্দীপনার সঙ্গে পাল্টা প্রত্যাঘাতে নেমেছে। তিনটে বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিজেপি-র পরাজয়ের মধ্যে জনপ্রিয় প্রতিরোধের ক্রমবর্ধমান লক্ষণ ও শক্তিমত্তা স্পষ্টতই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ছত্তিশগড়ে বিজেপি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে, রাজস্থানে বিরাট ধাক্কা খেয়েছে, আর মধ্যপ্রদেশে বড় ধরনের চোট পেয়েছে।

ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য বিজেপির মারমুখী ও মরিয়া প্রচেষ্টার বিপরীতে ছাপিয়ে উঠেছে জনগণের তীব্র  ক্রোধ। ছত্তিশগড়ে তারা 'শহুরে নকশালে'র আওয়াজ তুলে এক হিংস্র প্রচারাভিযান চালায়। যোগী আদিত্যনাথকে দিয়ে তারা নামায় বিষাক্ত এক সম্প্রদায়িক প্রচার। কিন্তু তা সত্ত্বেও, এসব কিছুই দর্শনীয়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো। উত্তরপ্রদেশের জনগণ সংঘ বাহিনী ও শিবসেনার মধ্যে চলতে থাকা প্রতিযোগিতামূলক অযোধ্যা অভিযানকে তোয়াক্কাই করল না। তার বদলে সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির দিল্লি অভিযান গোটা দেশের নজর কাড়লো। গোরক্ষপুর থেকে কৈরানা, আর এখন ছত্তিশগড় থেকে তেলেঙ্গানা—সর্বত্র ভারতীয় জনগণ সংঘবাহিনীর ফ্যাসিস্ট সাম্প্রদায়িক প্রচারকে সোচ্চারে ও জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন।

একেকটা দিন অতিবাহিত হচ্ছে, আরও বেশি সংখ্যক ভারতবাসী এখন টের পেতে শুরু করেছেন যে মোদি সরকার ভারতকে এক নজিরবিহীন বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ ও অর্থনীতি থেকে শুরু করে গণতন্ত্রের প্রতিটা প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক শাসন প্রণালীর মূল কাঠামো, আধুনিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটা ক্ষেত্রে আজ ঘনিয়ে উঠেছে মারাত্মক বিপর্যয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর কাছে আজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, দেশটাকে এই সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচানো, ফ্যাসিবাদের গ্রাস থেকে প্রজাতন্ত্রকে মুক্ত করা। দেশকে রক্ষা ও উদ্ধারের এই আশু কর্তব্য কর্ম থেকে যাত্রা শুরু করে পুনর্গঠন ও পুনঃ প্রতিষ্ঠার কাজ পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কমিউনিস্টদেরই কাঁধে তুলে নিতে হবে ঐতিহাসিক ভূমিকা। কারণ একমাত্র কমিউনিস্টরাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে অবিচল ও দৃঢ় প্রত্যয়ী প্রহরী।

এতদিন ধরে মোদি-অমিত শাহ' জুটির অপরাজেয়তার যে ফানুস কর্পোরেট আশ্রিত মিডিয়াগুলো উড়িয়েছিল, তারাই এখন আবার কংগ্রেসের পুনরুজ্জীবনের কথাবার্তা বলে সমস্ত কৃতিত্ব দিচ্ছে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসকে। তারাই বলছে কিভাবে রাহুল গান্ধী ক্রমেই অর্জন করেছে এবং তুলে ধরছে এক হিন্দু ভাবমূর্তি। বিজেপি অবশ্য নরেন্দ্র মোদির অপরিহার্যতাকে তুলে ধরে সংগঠিত করবে লোকসভার প্রচারাভিযান, আর সেখানে আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিদম্ভী উন্মত্ততার পরিমণ্ডলকে উসকে দিতে তারা বিন্দুমাত্র কসুর করবে না। কিন্তু আমরা যদি ২০১৮-র নির্বাচন ও উপনির্বাচন গুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করি, তবে দেখব যে সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে জোরালো ফ্যাসিবাদ বিরোধী প্রত্যয়। আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাবো যে নির্বাচনে ও রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর এই 'গোপন রহস্য'টি কংগ্রেসের হিন্দু ভাবমূর্তির জন্য হয়নি, বরং প্রতিবাদী কন্ঠস্বরগুলো হিম্মত ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে, সমাজের নানান স্তরের ঐক্যবদ্ধতা ও সংকল্পের জন্যই তা ঘটেছে। ওই সামাজিক স্তরগুলো হল, ছাত্র-বেকার-নামমাত্র বেতনভুক, মর্যাদাহীনতায় আক্রান্ত যুবশক্তি, মহিলা, দলিত ও আদিবাসী, কৃষক-শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এরাই হলেন মোদি-অমিত শাহ-যোগী রাজের আক্রান্ত মানুষ। এটাই হল জনতার সেই প্রতিরোধ, যাকে ২০১৯ সালে মোদীর ফ্যাসিস্ট জমানার মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করতে হবে। ভারতবর্ষের শ্রমিক শ্রেণী ৮-৯ জানুয়ারি জনতার সর্বাত্মক ধর্মঘট ডেকেছে। নতুন বছরের আগমনকে উদযাপন করতে এর থেকে ভালো পন্থা আর কি বা হতে পারে ?

১৯৭০-র ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দশকে সি পি আই (এম এল) নিজের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের মাধ্যমে। জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্রশক্তির নির্মম দমনের মুখে সবচেয়ে নিপীড়িত মানুষের অধিকার ও মর্যাদার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পার্টি অবিচল ছিল। ১৯৯০-এর দশকে বিজেপি যখন তার ফ্যাসিবাদী এজেন্ডাকে নিজের আস্তিন থেকে বার করলো, তখন তার বিরুদ্ধে জোরালো কমিউনিস্ট প্রত্যাঘাত হানতে পার্টি প্রকাশ্যে কাজ শুরু করে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস সাধনের বেদনাদায়ক ঘটনার সময়কালে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় পার্টির ৫ম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। তার ছ'বছর পর লক্ষ্ণৌতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক চলাকালীন কমরেড বিনোদ মিশ্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই গোটা পর্যায়ে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনে যে সমস্ত বড় বড় চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, তাকে মোকাবিলা করতে তিনি তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান ও সর্বশক্তি উৎসর্গীকৃত করেন। আজ হিম্মতের সঙ্গে আমাদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে সি পি আই (এম এল) লিবারেশনের সেই মহান ঐতিহ্য। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে ও জনগণতন্ত্রের পথে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করতে হবে।

কেন্দ্রীয় কমিটি,
সি পি আই (এম এল) লিবারেশন

খণ্ড-25
সংখ্যা-38