নতুন আশা নিয়ে শুরু হল নতুন বছর

নতুন বছরের প্রথম দিনটা নিয়ে এল এক ঝলক তাজা বাতাস যা ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং সংস্কারচ্ছন্ন পিতৃতন্ত্রের ভ্যাপসা, শ্বাসরোধী বাতাবরণকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।

লক্ষ লক্ষ নারী সারা কেরলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ৬২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক নারী প্রাচীর তৈরি করলেন : কেরল ও ভারতে নারী এবং নিপীড়িত জাতগুলোর ছিনিয়ে আনা সমতা ও মর্যাদাকে খর্ব করতে চাইছে যে শক্তিগুলো, ঐ প্রাচীর তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নারীদের দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে উঠল।

বাম দলসমূহ এবং ১৭৬টি অন্যান্য সামাজিক - রাজনৈতিক সংগঠন সংগঠিত ঐ নারী প্রাচীর ছিল সাংবিধানিক নৈতিকতা এবং প্রগতিবাদী সামাজিক পরিবর্তনের মূল্যবোধের সপক্ষে নারীদের এক বলিষ্ঠ আত্মঘোষণা। শবরীমালা মন্দিরে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে আদালত ১৯৯১ সালে রায় দেওয়ার পর এই প্রথম দুই মহিলা দেবালয়ের একেবারেকেন্দ্রে প্রবেশ করলেন। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ হুমকি দিয়েছিলেন যে, কেরল সরকার সুপ্রীম কোর্টের রায়কে রূপায়িত করে মন্দিরে নারীদের ঢুকতে দিলে ঐ সরকারের পতন ঘটানো হবে। দুই নারীর মন্দিরে প্রবেশের পর সংগঠিত ঐ নারী প্রাচীর অতএব অমিত শাহর কাছে মখেু র মত এক জবাব হয়েই দেখা দিল।

ঐ একই দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর গুণমুগ্ধ এ এন আই-এর এক সাংবাদিককে আরো একটা ‘‘সাক্ষাৎকার’’ দিলেন। ঐ সাক্ষাৎকারের প্রশ্ন-উত্তর আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। তাতে উত্তরের জের টেনে পাল্টা কোন প্রশ্ন করা হয়নি। যে কোন সাংবাদিক সম্মেলনেরই মুখোমুখি হওয়ার মোদীর যে ভীতি, যে সম্মেলনে তাকেঁ তাঁর সরকারের বহু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও নির্ভেজাল মিথ্যাচার সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিতে হত, এই সাক্ষাৎকার স্পষ্টতই ঐ ধরনের সাংবাদিক সম্মেলনের বিকল্প হওয়ার নিকৃষ্ট এক প্রচেষ্টা হয়েই দেখা দিল।

কিন্তু পূর্ব-নির্ধারিত চিত্রনাট্যের এই উপস্থাপনাতে উত্তর দিতে গিয়েও মোদী হোঁচট খেয়েছেন। শবরীমালা এবং তাৎক্ষণিক তিন তালাকের ইস্যুতে তাঁর দল অনুসৃত দু’মুখো নীতিকে যেভাবে তিনি খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন, তা ঐ দুমুখো পনাকেই প্রতিপন্ন ও সুস্পষ্ট করেছে। শবরীমালায় নারীদের প্রবেশাধিকারের উপর নিষেধাজ্ঞাকে নড়বড়েভাবে সমর্থন করেছেন তাকে ‘প্রথা’ রূপে ব্যাখ্যা করে, আর তাৎক্ষণিক তিন তালাকের বিলোপের ক্ষেত্রে দাবি করেছেন যে তা হল ‘লিঙ্গ সমতার’ বিষয়!

বিমুদ্রাকরণ বিপর্যয় নিয়েও মোদী বিমুদ্রাকরণের কালোটাকা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই হওয়ার মামলিু বুলিই হাজির করতে পেরেছেন—যে যুক্তি এমনকি আর বি আই-এর নিজের স্বীকারোক্তিতেও পুরোপুরি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তবে, উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোর বিধানসভা নির্বাচনে সম্প্রতি কংগ্রেসের বিজয় ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’-এর তাঁর শ্লোগানকে গুরুত্বহীন করে তুলল কিনা—এই সম্পর্কে এক প্রশ্নে মোদীর উত্তরই সম্ভবত ঐ ‘সাক্ষাৎকারের’ সবচেয়ে লক্ষণীয় অংশ ছিল। এই প্রশ্নে মোদী অত্যন্ত ভেবেচিন্তে আগেই তৈরি করে রাখা একটা উত্তর দিলেন : তিনি বললেন, কংগ্রেসকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করতে হবে এমন কথা তিনি কখনই বোঝান নি—তিনি শুধু স্বজন-পোষণ ও দুর্নীতির মধ্যে মর্তূ হওয়া রাজনীতির ‘কংগ্রেসি সংস্কৃতির’ বিরুদ্ধেই আক্রমণ চালিয়েছেন, যে সংস্কৃতির অস্তিত্ব অধিকাংশ দলের মধ্যেই দেখা যায়। তিনি আরো বললেন, কংগ্রেস দলকেও এই ‘কংগ্রেসি সংস্কৃতি’ থেকে মুক্ত হতে হবে।

এই উত্তরের মধ্যে দিয়ে মোদী তাঁর প্রকাশ করা ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’-এর ধৃষ্টতা থেকে পিছু হটলেন এবং এ সম্পর্কেতাঁর অবস্থানকে পাল্টালেন। এর চেয়েও যেটা আরো তাৎপর্যপূর্ণ তা হল, এই উত্তরের পরিপ্রেক্ষিতে তাকেঁ চেপে ধরতে সাক্ষাৎ গ্রহণকারীর ব্যর্থতা। মোদীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকারীরা (যেমন, অমিত শাহ) এবং তাঁর নিজের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত রূপে সামনে আসছে। তাই যদি বাস্তব হয় তাহলে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিভাবে শুধুমাত্র কংগ্রেসেরই একচেটিয়া ব্যাপার হতে পারে? সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিধানসভা আসনগুলির নির্বাচনী প্রচারে তিনি নেতৃত্ব দিলেন নেহরু থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের কংগ্রেসী নেতৃত্ব ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গলা চড়িয়ে—এ সত্ত্বেও জনগণ স্পষ্টতই এ ব্যাপারে তেমন আমল দিলেন না।

আর সর্বোপরি, মোদীর উত্তর আরো মৌলিক একটা সত্যকে গোপন ও বিকৃত করতে চেয়েছে : তা হল, সংঘ ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক, মনুবাদী, পিতৃতান্ত্রিক ও সংখ্যাগুরুবাদী হিন্দুত্বর মার্কামারা সংস্কৃতি ভারতে বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিষিয়ে তুলেছে।

ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িক মনুবাদী হিংসার সংঘীয় সংস্কৃতির প্রধান রাজনৈতিক প্রতিনিধি বিজেপি হলেও কংগ্রেস সহ অন্য দলগুলোও বারেবারেই এই সংস্কৃতির কাছে নতজানু হয়েছে এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রকাশ ঘটিয়েছে। বহুসংখ্যক যে সাম্প্রদায়িক গণহত্যা কংগ্রেস দল ও তাদের সরকারগুলো ঘটিয়েছে; কংগ্রেসী সরকারগুলোর তৈরি করা গোরক্ষা আইনসমূহ যা বিজেপি এখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে এবং যেভাবে কংগ্রেস আজ তার হিন্দুয়ানা এবং ব্রাহ্মণ্যত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করছে (এইভাবে সে মখেু না বলেও বিজেপির এই দাবিকে মেনে নিচ্ছে যে, উচ্চ বর্ণের একটা দলই ভারত শাসন করতে পারে)—এগুলো সবই দেখিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে সংঘের সংস্কৃতি শাসক শ্রেণীর ‘‘জ্ঞান-বুদ্ধি’’ হয়ে উঠেছে।

২০১৮ সাল যখন শেষ হতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ফ্যাসিবাদী সংখ্যাগুরুবাদের এই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে ওঠা সম্পর্কে এক উদ্বেগজনক সতর্কবার্তা সামনে এল। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল (যা স্ত্রীদের ত্যাগ করার জন্য বেছে-বেছে মুসলিম পুরুষদেরই অপরাধী সাব্যস্ত করে—যে অপরাধের জন্য অ-মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর স্ত্রীদের ফৌজদারির বদলে দেওয়ানি বিধিতে প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে) যখন সংসদে পাশ হচ্ছিল, বিজেপি সাংসদরা তখন ‘ভারত মাতা কি জয়’ শ্লোগান তুলছিলেন। এই যে শ্লোগানটার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের হিন্দুদেবী হওয়ার এক মূর্তি ফুটে ওঠে, সংঘ ও বিজেপি জনতার হাতে সেই শ্লোগানের মুসলিমদের দেশপ্রেম ও ভারতীয়তার অগ্নিপরীক্ষা হিসাবে ব্যবহৃত হওয়ার একটা ইতিহাস রয়েছে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল পাশ হওয়ার সময় এই শ্লোগান তুলে বিজেপি যৎসামান্য রেখেঢেকে বলছিল—‘‘মুসলিমদের উপর হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদীদের জয়।’’ এক মুসলিম মহিলা সাংবাদিক বিজেপি সাংসদদের এই শ্লোগান ওঠানোকে সাম্প্রদায়িক বলার জন্য কিছু বিশিষ্ট ‘ধর্মনিরপক্ষে উদারবাদী’ কন্ঠ যেভাবে তাঁকে তিরস্কার করছিলেন এবং মুসলিমদের ‘‘জাতি-বিরোধী’’ হিসাবে চিত্রিত করার বিজেপির প্রচেষ্টাকেই শক্তিশালী করছেন বলে তাঁকে দোষারোপ করছিলেন,তা আমাদের দুশ্চিন্তাকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। এদের অনেকেই কংগ্রেস দলের ঘনিষ্ঠ। সংখ্যালঘু মুসলিমদের হেয় করার জন্য বিজেপি যেভাবে তার সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদকে দেশপ্রেম বলে চালাতে চাইছে, সেটাকে স্বীকার করতে অস্বীকার করলে তা সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদকেই শক্তিশালী করবে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে যে সমস্ত রাজ্যে কংগ্রেস বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, সেখানেও এই প্রশ্নটা রয়ে গেছে - কংগ্রেস বিজেপির জন-বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক কর্মনীতিগুলোকে কার্যত বাতিল করবে কিনা। নতুন কংগ্রেস সরকারগুলো কৃষকদের দু-লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মকুব করার কথা ঘোষণা করেছে—কিন্তু সমস্ত কৃষি ঋণ মুকুব করেনি। এছাড়া, কৃষক আন্দোলনের মলূ দাবিনিয়ে ওরা এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়নি—যে দাবি হল, উৎপাদনের সমস্ত খরচের ৫০ শতাংশ বেশি দামের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে শস্য সংগ্রহ সুনিশ্চিত করা। পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হওয়ার জন্য বিজেপি যে অগণতান্ত্রিক শিক্ষাগত মানদণ্ড চালু করেছিল, নতুন রাজস্থান সরকার তাকে বাতিল করেছে এবং ঐ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতে হবে। ছত্তিশগড় সরকার ঘোষণা করেছে যে, সরকার অধিগৃহীত যে সমস্ত জমি এখনও অব্যবহৃত রয়েছে, সেগুলো বস্তারের জনগণকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ছত্তিশগড়ের কংগ্রেস সরকার কি ছত্তিশগড়ে সামরিকীকরণকে বাতিল করবে এবং বস্তার থেকে বিতাড়িত মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের বস্তারে ফিরতে দেবে? মধ্যপ্রদেশের কংগ্রেস সরকার কি ভ্যাপম দুর্নীতি মামলা এবং সিমি ভুয়ো সংঘর্ষমামলায় ন্যায় বিচার লাভকে সুনিশ্চিত করবে? রাজস্থানের কংগ্রেস সরকার কি পেহলু খান, আফরাজুল, কমরেড জাফর এবং সংঘের সন্ত্রাসের বলি অন্যান্য মানুষদের ন্যায়বিচার লাভকে সুনিশ্চিত করবে, দলিত নিপীড়ন বিরোধী আইনকে লঘু করে তোলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী মানুষদের উপর চাপানো মামলাগুলোকে কি প্রত্যাহার করে নেবে এবং সে সময় যারা দলিতদের বিরুদ্ধে হিংসা চালিয়েছিল তাদের শাস্তি দেবে? এই তিন রাজ্যের নতুন সরকার কি গেরুয়াকরণ করা পাঠ্যক্রম এবং শ্রমিক-বিরোধী শ্রম আইনগুলোকে দ্রুতই বাতিল করবে? তারা কি স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচীর নামে সর্বসমক্ষে অপদস্থ করার দানবীয় ও হিংসাপ্রবণ নীতির অবসান অবিলম্বে ঘটাবে?

২০১৯-এর এবং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জটা শুধু ক্ষমতা থেকে ফ্যাসিবাদী বিজেপি এবং সংঘ পরিবারকে অপসারিত করাই নয়—চ্যালেঞ্জটা আরো হল, সাম্প্রদায়িক মনুবাদের সংঘীয় সংস্কৃতিকে প্রতিরোধ করা, যে সংস্কৃতি অন্যান্য সংগঠনের মধ্যেও বাসা বেধেঁ রয়েছে এবং যারা তাকে স্বাভাবিক ব্যাপার করে তুলেছে। ২০১৯-এর মধ্যে আশার যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, আসুন, তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা সবাই কাজ করি—এমন এক ভারত গড়ার জন্য কাজ করি যা ঘৃণাময় এবং বিভেদমূলক ফ্যাসিবাদী রাজনীতিকে পরাস্ত করতে পারবে এবং এমন এক রাজনীতি গড়ে তুলি যা গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল মূল্যবোধের জন্য ধারাবাহিকভাবে লড়াই করে চলবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ১ জানুয়ারী ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-2