প্রতিবেদন
শবর মরে কেন? শবর-ই মরে কেন?

প্রশ্নটি ছুঁড়ে দেওয়া গিয়েছিল অন্তর্জালে। ঝাড়্গ্রামে পূর্ণাপাণি জঙ্গলখাসে সাত শবরের মৃত্যুর প্রেক্ষিতেই এই প্রশ্ন। যদিও, তেমন করে উত্তর মেলেনি। হয়তো, উত্তর সকলেরই জানা। সময় নষ্ট ভেবে উত্তর দিতে চাননি। কিংবা, চটজলদি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে চেয়েছেন। হতে পারে নানা সমীক্ষা, তদন্ত, কষ্টিপাথরে যাচাই করা তথ্য এলে তত্ত্ব রচিত হবে। সেই ফাঁকে আবারও কোনও শবরপল্লিতে শিশিরের মতো নি:শব্দে মৃত্যু নেমে আসবে।

ইতিমধ্যে তথ্য, স্বাভাবিক তথ্য, ক্রমে উঠে আসছে। উন্নয়ন-অনুন্নয়ন, যোজনা, পঞ্চায়েত, অপুষ্টি, অনাহার, চিকিৎসা, চিকিৎসায় অনীহা, মদ্যপান–নানা স্বাভাবিক শব্দ, শব্দাবলী ঘিরে বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এই পথেই আবারও সেই তত্ত্বই নির্মিত হবে, বলে ফেলা যাক। কিন্তু সেই তত্ত্ব দিয়ে এই ক্ষুদ্র প্রাক কৃষিযুগের শিকারি ও খাদ্য-সংগ্রাহক আদিম নৃগোষ্ঠীটিকে বোঝা যায় না। কত-ই বা জনসংখ্যা তাঁদের? রাজ্যে আদিবাসী জনসংখ্যা ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ৪৪,০৬,৭৯৪ জন। মোট জনসংখ্যার ৫.৫ শতাংশ। আদমসুমারিতে এই নৃগোষ্ঠীটি দু’ভাগে বিভক্ত। একটি লোধা জনসংখ্যা ৮৪, ৯৬৬ (১.৯ শতাংশ) এবং অন্যটি শবর ৪৩,৫৯৯ (১ শতাংশ)। লোধা ও শবর একই নৃগোষ্ঠী। লোধা-শবরদের মূল বাস পশ্চিম মেদিনীপুরে। পুরুলিয়ায় খেরিয়া শবরদের। দুই ২৪ পরগনা, উত্তরের চা বাগানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন এই জনজাতির মানুষ। সরকারি বয়ানে যারা “প্রিমিটিভ ট্রাইবাল গ্রুপ” (পিটিজি), যেমন বীরহোড়, পাহাড়িয়া, তেমনই লোধা-শবরেরা। মানে বিশেষ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী হিসেবে বিশেষ আইনি রক্ষাকবচ এবং সুযোগ-সুবিধার অধিকারী। এখন কথা হল, ডজন খানেক সাংবিধানিক ও আইনি রক্ষাকবচ, ট্রাইবাল সাবপ্ল্যান, লোধা সেল, পিছিয়ে থাকা এলাকা তহবিল, সাম্প্রতিক কালের মাওবাদী প্রভাবিত এলাকার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা ও তহবিল, সর্বোপরি পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং তার নানা যোজনার পরও শবরেরা না-মরলে আলুপোস্ত-ডিম জোটে না কেন? গ্রামে ভিয়েন বসাতে হয় কেন? আইনি রক্ষাকবচ আর পরিকল্পনার যা আয়োজন সেই দলিল- দস্তাবেজ এক জায়গায় জড়ো করলে খুব নিশ্চিতভাবেই শবর জনগোষ্ঠীকে তার নীচে ঢেকে ফেলা যাবে। আর তাঁদের জন্য উন্নয়ন তহবিলের অর্থ যদি একটি পাইপ লাইনের মাধ্যমে বইয়ে দেওয়া যেত, তবে হয়তো সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীটিই বানভাসি হয়ে পড়ত। কর্তা-ব্যক্তিদের ভাবভঙ্গি, কথাবার্তা শুনলে মনে হয় উন্নয়নের বান-ই ডেকেছে। কিন্তু, বাধ সেধেছে হাড়হাভাতে মানুষগুলো। যত নষ্টের গোড়া। অসুখ হলে ওষুধ খাবে না, চিকিৎসা নেবে না। ঘরবাড়ি গড়ে দিলে চাল, দরজা-জানলার কাঠামো বেচে দেবে। আর সকাল-বিকেল সারাদিন মদ। অর্থাৎ, সরকার-সমাজ-দল সকলেই শবরের উন্নয়নের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে আর অকৃতজ্ঞ শবরেরা উন্নয়নকেই অস্বীকার করে চলেছে।

মৃত ৭ জন-এর একজন মৃত পল্টু শবরের স্ত্রী ময়না শবর।

শবর বেঘোরে মরলে এই অভিযোগগুলিই উঠে আসে। ১৪ বছর আগেও এই কথাগুলিই উঠে এসেছিল। সেই আমলাশোল-পর্বেও আমরা এই কথাগুলিই শুনেছিলাম। তারও আগে সেই ষাটের দশকেও। আর ব্রিটিশ আমলে ১৮৬১ সালে এদেরই ‘ক্রিমিনাল ট্রাইব’ হিসেবে দেগে দিয়েছিলাম না? আইনত সে দাগ মুছতে প্রায় ১০০ বছর লেগেছিল। ১৯৫২ সালে স্বাধীন দেশের সরকার সেই ‘অপরাধী’ তকমা তুলে নেয়। একশো বছরের কালো দাগ মোছার পালা আজও চলছে। যতই চর্যাপদ আওড়াই কিংবা মঙ্গলকাব্যের কালকেতু-ফুল্লরা উপাখ্যান— মহাকাব্য-পুরাণেই তো এই নৃগোষ্ঠীকে অধমসংকর অন্ত্যজ অস্পৃশ্য বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। দেগে দেওয়া হয়েছে বর্ণব্যবস্থা বহির্ভূত শূদ্রাধিক শূদ্র বলে। বর্ণগত অবস্থান তাদের এই ব্রাহ্মণ্যশাসিত সমাজে। চর্যাপদের বয়ানে, উঁচু উঁচু পাহাড় তাদের বাসস্থান। ময়ূরের পাখায়, গুঞ্জাফুলের মালায় নাকি সাজতো শবরী। শিকার যাদের জীবিকা। আবার তাদের বাড়ির পাশে কাপাস ফুল ফোটে, কাগনি ধান পেকে সুরভি ছড়ায়। সেই কাব্যকাহিনি’র নস্টালজিয়া আঁচ সেই কবেই নিভেছে। রাজ-রাজড়া থেকে জঙ্গল গিয়েছে জমিদারের ইজারায়, অবশেষে ইংরেজের অধিকারে এসেছে বন। বন থেকে আদিবাসী তাড়ানোর সেই শুরু। শুরু আদিবাসী বিদ্রোহেরও। জঙ্গলে ভিন দেশি, ভিন জাতির প্রবেশ মেনে নেয়নি পাহাড়ি গোষ্ঠীগুলো। চোরাগোপ্তা আক্রমণে অতিষ্ঠ করে তোলে পরিব্রাজক, ব্যবসায়ী, বনবাবুদের। ক্রুদ্ধ ইংরেজ সারা দেশের বেশ কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে ‘অপরাধপ্রবণ আদিবাসী’ বলে দাগিয়ে দেয়। ইংরেজ গিয়েছে। বনের উপর দখল আরও বেশি কায়েম করেছে দেশীয় সরকার। বন উজাড় হয়েছে। উঁচু উঁচু পাহাড় ভেঙে খনিজ, পাথর, লুটের উন্নয়ন, আকাশছোঁয়া শালের প্রাকৃতিক বন নিঃশেষ করা উন্নয়নের রথের চাকার নীচে শতকোটি বছরের প্রাচীন ছোটনাগপুর মালভূমি, তার জঙ্গলমহল, আজ বনহীন, বন্যপ্রাণী হীন, টাঁড়ে টাঁড় রুখাশুখা মালভূমি। এই পরিবেশে আদিবাসী বাঁচে না। শবর তো শরীর-মনে মরে থাকে। এ কথা মনে রাখতে গেলে উন্নয়নেরও একটা মন থাকা চাই। সংবেদী, সহমর্মী মন।

মনহীন এই উন্নয়ন প্রকল্পকে বার বার অমান্য করেছে শবরেরা। ষাটের দশকে সরকারি প্রকল্প এবং অর্থ সাহায্যে বাঁকুড়ার রানিবাঁধে খেরিয়া শবরদের জন্য বানানো হল টিনের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি। পরবর্তীকালে নৃতত্ত্ববিদরা সমীক্ষা করে দেখলেন, মাটির দেওয়াল ধসে গিয়েছে। টিনের চাল, দরজার কপাট প্রতিবেশী সাঁওতাল কিংবা শুঁড়িরা দু’চার টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তার পাশেই ফের তারা ডালপালা, লতাপাতা দিয়ে তৈরি করে নিয়েছে পর্ণঝুপড়ি। সরকার তাঁদের যে জমি দিয়েছিল সেখানে চাষ করছে সাঁওতালরা। যদিও তারা খেরিয়াদের ফসলের চারভাগের একভাগ দিচ্ছে। ছাগল, মুরগি, বলদ হয় বেচে দিয়েছে, না হয় খেয়ে ফেলেছে। এই ষাটের দশকেই শবরদের প্রিয় মানুষ, শবর অন্তপ্রাণ গোপীবল্লভ সিংদেও এক রচনায় শবরদের সারা বছরের এক খাদ্যতালিকা দিয়েছিলেন। সেই তালিকা অনুযায়ী, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে তারা বনের ফলমূল, শিকড়, পাখির বাচ্চা, ঢ্যামনা সাপ, গোসাপ, ব্যাঙ, শামুক সংগ্রহ বা শিকার করে। শ্রাবণ-ভাদ্র-আশ্বিনে ক্ষেত থেকে ব্যাঙ, বড় শামুক, ছোট মাছ, নদী জোড় থেকে কাঁকড়া। কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষে খেতের আল থেকে ইঁদুর ধরে, ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করে। মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্রে বনের ফল, চাক সহ মধু, ছোট পশু শিকার করে। এমন যাদের খাদ্যাভ্যাস তাদের জোর করে কৃষিজীবী বানাতে গেলে, গৃহপালিত পশু দান করলে, যা ফল হয়, বাঁকুড়ার উন্নয়নী পরীক্ষাতেও তাই হয়েছিল। সাঁওতাল, মুন্ডাদের উন্নয়নের যে রূপ, যে ছাঁদ, তা শবরের উন্নয়নে খাটে না। নৃতত্ত্ববিদরা বার বার একথা বললেও পরিকল্পনাকারেরা গভীর ভাবে উপলব্ধি করেননি। করেন না। বিপদ বুঝলে কমিটি গড়েন। তথ্য ধামাচাপা দেওয়া হয়।

শবরের উন্নয়ন বুঝতে গেলে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক বুঝতে হয়। তা হল তাঁদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। আদিবাসী সমাজের কাছাকাছি থেকেও একরকম নির্বাসিত একঘরে হয়ে থাকা, অস্পৃশ্য হয়ে থাকা। বন্য পরিবেশে, লোকালয় থেকে দূরে নির্জন পরিবেশে বাস করতে করতে তাঁরা বুনো পরিবেশ এবং জংলী খাদ্যেই অভ্যস্ত ছিলেন। শিকার যাঁদের রক্তে। আজ বন হারালেও তাঁদের মনের গহনে সেই আদিমতা কতটা রয়ে গেল, বন রয়ে গেল, সেও তো জানাবোঝার প্রয়োজন। অন্যান্য সমাজবদ্ধ গোষ্ঠী বা জাতির মানুষ যেভাবে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে তথাকথিত উচ্চতর সমাজ গড়েছে, গ্রাম গড়েছে, ঐতিহাসিকভাবেই শবর সে সমাজের অংশী হয়ে ওঠেনি। সে কেন স্কুলের পথে পা বাড়ায় না, হাসপাতালে যেতে চায় না, পঞ্চায়েতে পাত্তা পায় না—তার খোঁজ পেতে গেলে শবর সম্পর্কে হিন্দু তো বটেই, সাঁওতাল, মাহাতো, মুন্ডা সমাজের মনোভাবেরও খোঁজ রাখতে হবে। মনোজগতেরও খোঁজ রাখতে হয়। শবর বাচ্চা যে বিদ্যালয়ে যায়, মাস্টাররা তাদের সাঁওতাল, মাহাতোদের বাচ্চাদের মতোই একই চোখে দেখে? অন্য হিন্দু জাতির কথা বাদ দিলাম। হাসপাতালে ডাক্তারবাবু, দিদিমণিদের কাছে অন্যান্যদের মতো সমান মর্যাদা পায়? পঞ্চায়েতে? এই বর্ণবাদী, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এ খোঁজটিও রাখতে হয়। শুধু আদিবাসীদের, শবরদের নয়, ডাক্তার-বদ্যি-উকিল-শিক্ষক-ব্যবসায়ী-আধিকারিকদেরও যে মানসিক, সামাজিক সংস্কার ও উন্নয়ন জরুরি। আদিবাসীরা তাদের কাছে যেতে বাধ্য হয়। তাই, শুধুমাত্র দলিল-দস্তাবেজ, দান-খয়রাতি দিয়ে উন্নয়ন হয় না।

বেশ কয়েক দশক ধরে পুরুলিয়ার খেরিয়া শবর কল্যাণ সমিতি শবরদের স্থায়ী বসবাসের জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিছুটা লোকালয় কিছুটা প্রায় বৃক্ষহীন জঙ্গলের জমিতে গড়ে ওঠা ২৮টি গ্রামের ৬৮০টি পরিবারের উপর সমীক্ষা করেছিল সোনাগাছি রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। যা পুরুলিয়ার মোট খেরিয়া পরিবারের ২০ শতাংশ। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, শুধু পড়তে পারে কিংবা নিজের নামটুকু লিখতে পারে এমন সাক্ষরতার হার ২২ শতাংশ। এই ২২ শতাংশের মধ্যে মহিলা ২৫ শতাংশ পুরুষ ৭৫ শতাংশ। ভূমিহীন পরিবার ৬২ শতাংশ। ৩৭ শতাংশ কৃষিজমির মালিক। তাদের গড় জমির পরিমাণ ৩২.৬০ ডেসিমেল। নিজের সমাজের মানুষ, খেরিয়া কল্যাণে আন্তরিক মানুষদের লেগে পড়ে থাকা চেষ্টায়, নানা সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায়, তাঁদের অনেকেই লাঙল ধরেছেন। যেখানে সেচের ব্যবস্থা করা গিয়েছে সে জমিতে চাষের উৎসাহ বেশি দেখা গিয়েছে। কিছু ঘরবাড়ি হয়েছে। কম হলেও গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি-ছাগল পালন করছেন তাঁরা। এই ২৮টি গ্রামের ৬৮০টি পরিবারের বার্ষিক আয় ৪৫,৭৯,৬১০ টাকা। অর্থাৎ এক একটি বাড়ির গড় বার্ষিক আয় ৬,৭৩৪ টাকা। অর্থাৎ, গড় মাসিক আয় ৫৮১ টাকা। এই আয়ের বেশির ভাগটি খাবার খেতেই শেষ হয়। চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাস, অর্থাৎ মূল-কন্দ, রয়েই গিয়েছে। স্বাস্থ্য কিংবা চিকিৎসার কথা না বলাই ভালো। সমীক্ষা বলছে, সুষম খাদ্য খেরিয়ারা কখনওই পায় না। পূর্বপুরুষদের সঙ্গে তুলনা টেনে মন্তব্য করা হয়েছে, “ওদের পূর্বপুরুষরা যারা জঙ্গলের উৎপাদিত বস্তু থেকেই জীবনধারণ করত তাদের অবস্থা বোধহয় এতটা দীন ছিল না। কারণ তাদের খাদ্যে পুষ্টি মূল্য ছিল। বর্তমানে জঙ্গল চলে যাওয়ায় এদের খাদ্যভাণ্ডারে টান পড়েছে ফলে অপুষ্টি, অনাহার, রোগভোগ এবং সর্বোপরি মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। অপুষ্টিতে ভোগেন বেশি প্রধানত মহিলা ও শিশুরা। এভাবেই এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী প্রায় নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে চলেছে। সেই ষাটের দশকে গোপীবল্লভ তো একই কথা লিখেছিলেন, “... আজকে বনজঙ্গল অদৃশ্য হয়েছে, বন্যপশুর বিলুপ্তি হয়েছে — এরা এই শবরেরা আজও আছে, হয়তো আরও কিছুদিন থাকবে ... তার পর বন্যপশুর পথ অনুসরণ করবে।”

২০১৬ সালে “ওয়ার্ল্ড জার্নাল অব ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাসিটিউকাল সায়েন্সেস” জার্নালে শবর ও সাঁওতালদের পুষ্টি বিষয়ক এক সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। ঝাড়্গ্রামের চারটি গ্রামে করা এই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, লোধা-শবর রমণীদের ৩৩.৩ শতাংশ অপুষ্টিতে ভোগেন। সাঁওতালদের ক্ষেত্রে তা ৮.৭ শতাংশ। এর পিছনে স্বাস্থ্য পরিষেবা, স্বল্প আয়, শিক্ষার অভাব এবং অন্যান্য সামাজিক কারণকেও দায়ী করা হয়েছে। সমীক্ষাগুলিতে দেখা যাচ্ছে, এই জনজাতির মানুষের যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, পঙ্গুত্ব, চর্মরোগ, রক্তাল্পতা, কলেরা, অপুষ্টিজনিত রোগ লেগেই থাকে। আধুনিক চিকিৎসার বদলে তাদের ভক্তি জঙ্গলের শিকড়-বাকড়, গাছ-গাছড়া এবং ওঝাদের উপর। হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি শবরদের নিয়মিত মদ্যপান, কখনও কখনও অপরিমিত দেশি, হাড়িয়া পানের কথাও সমীক্ষায় উল্লেখ রয়েছে। শুধু মদের উপর দোষ চাপিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলা হয়নি।

এই মৃত্যুর পর বিবেকহীন আগ্রাসী উন্নয়ন আরও জোরদার হবে। শাসনের বাড়াবাড়ি দেখা যাবে। নানা প্রকল্প, পরিকল্পনার চমৎকারিত্বে ভরিয়ে দেওয়া হবে। জমি ও জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে না। মর্যাদা পাবে না তাঁদের ভাষা-সংস্কৃতি। উন্নয়নী প্রকল্পে আদিবাসী মানসসত্তা, তাদের ভাবসত্তা, স্থান পাবে না। ভিন্ন ভিন্ন আদিবাসী সমাজের কাছে একই উন্নয়নী প্রক্রিয়া সাংস্কৃতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য, মর্যাদা পাবে না সে প্রশ্নও।

এর পরও নিশ্চয় একদিন লোধানী জঙ্গলের অধিকার চাইবে। জঙ্গল থেকে তাড়াতে গেলে গো ধরবে — মুখে মুখে তর্ক জুড়বে গাঁয়ের মাতব্বর, সম্পন্ন দোকানি বঙ্কু মাহাতোর সঙ্গে। — আমরা বলে সেই কুন যুগ থিক্যে আছি। সত্য তেরতা দ্বাপর। ম’লা আজ ‘উঠ’ বললেই — ওসব ‘পেঁদের’ কথা ছাড়-অ লোধানী। ফের দোকান ঘরে উঠে যেতে যেতে বঙ্কা (মাহাতো) বলল, কুন যুগ থেকে আছো যে ‘পরমাণ’ আছে? টিপ-ছাপ দেয়া কোনও কাগজ-পতর? পাট্টা?

‘পেঁদের কথা’? তার মানে মিছা কথা। রাইবু যা বলে, রাইবুর বাপ গেঁড়াশবর যা বলত, বড়সোলের গজনা এখনও যা বলে—সব, স-ব পেঁদের কথা? আমাদের চৌদ্দপুরুষেরা তবে পেঁদা? সব ‘পেঁদা-মানুষ’?

আর আমাদের নীলমাধব? আমাদের রক্তে খুড়দারাজার রক্ত নাই আছে? মহাপরভু রাম শবরবুড়ীর সঙ্গে দেখা নাই করে? জরাশবর আমাদের আদি পুরুষ নাই বটে? নাই নাই — হুঁ-অ, হুঁ-অ আমাদের টিপ-ছাপ দেয়া কাগজ-পতর নাই। ‘একড়ের-নামা’ নাই। পাট্টাও নাই। নাই নাই — তবে কী জীবনটাই ‘পেঁদের’ হয়ে গেল? ফুলটুসি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল খুব ত ফুটানি বঙ্কার। খালভরা বেধুয়ামড়ার। এবার একবার আসুক ত শুতে, ‘জাঁকমাড়া’ করতে — হাঁকাড় দিয়ে বলব, ফুটট-অ—

(শবর চরিত, নলিনী বেরা।)

লেখক একজন স্বতন্ত্র সাংবাদিক এবং সামাজিক কর্মী

খণ্ড-26
সংখ্যা-3