ছাত্রদের নিয়ে মোদী জমানা আতঙ্কিত কেন

 সংসদীয় নির্বাচনের তিন মাস আগে দিল্লী পুলিশ জে এন ইউ-র ছাত্রদের বিরুদ্ধে তিন বছর আগের এক ঘটনায় চার্জশীট পেশ করেছে। এর কারণটা একবারেই স্বচ্ছ। ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় জে এন ইউ-র যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে তারা এবং সারা ভারতের ছাত্র ও যুব আন্দোলন মোদী রাজের বিরুদ্ধে—যে জমানা ভারতের অর্থনীতি এবং সামাজিক বুনটকে ছারখার করে দিচ্ছে—প্রতিবাদের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরগুলোর অন্যতম হয়ে উঠেছে। ‘দেশদ্রোহের’ স্পষ্টতই এক মেকি মামলায় দিল্লী পুলিশের এই চার্জশীট আসলে এই তরুণ কন্ঠগুলোকে কলঙ্কিত করা, হুমকি দেওয়া এবং স্তব্ধ করার এক মরিয়া প্রচেষ্টা, কেননা, তারা সারা ভারতকেই জানিয়ে দিচ্ছে যে, মোদী রাজা উলঙ্গ।

এই প্রসঙ্গে এটা অবশ্যই উল্লেখ্য যে, জে এন ইউ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ জে এন ইউ ছাত্র সংসদের ভূতপূর্ব সভাপতি কানহাইয়া কুমার এবং অন্যান্য ছাত্রদের ‘দেশদ্রোহের’ ঐ একই কার্যকলাপের জন্য—যার জন্য এখন চার্জশীট দেওয়া হয়েছে—শাস্তি দেওয়ার যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, দিল্লী হাইকোর্ট ২০১৮-র জুলাই মাসে তাকে খারিজ করে দেয়। আদালত তাদের রায়ে বলে, শাস্তি দানের লিখিত নির্দেশ ‘‘অবৈধতা, অযৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত অযাথার্থতার দোষে’’ দুষ্ট ছিল। দিল্লী সরকার ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনায় ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে যে তদন্ত করায় তার রিপোর্টে বলা হয়, ঐ ঘটনার যে ভিডিও সংবাদ চ্যানেলগুলোতে দেখানো হয় তাতে কারচুপি করা হয় ‘‘যার উদ্দেশ্য সম্ভবত ছিল জনগণকে বিপথে চালিত করা।’’

ঘটনা হল, বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, কৃষকদের আয় বিপুল করা, নারীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার যে প্রতিশ্রুতি মোদী সরকার দিয়েছিল তা পূরণে ব্যর্থতার জন্য তারাই এখন কাঠগড়ায়। ঐ প্রতিশ্রুতি পূরণের পরিবর্তে মোদীর নিজের সচিবালয় ও সরকারই এখন স্যাঙাত তোষণ ও দুর্নীতির নিকৃষ্টতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যার এত প্রকোপ ভারতে আগে আর দেখা যায়নি। তাঁর সরকার প্রাণান্তকর ও দানবীয় বিমুদ্রাকরণ এবং জি এস টি-কে জোরজবরদস্তি চাপিয়ে দিয়েছে, ভারতীয় অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটিয়েছে, গত বছরে এক কোটি কাজ ধ্বংস করেছে, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আক্রমণ হেনেছে এবং জিও বিশ্ববিদ্যালয়ের মত অবিদ্যমান শিক্ষা বিপনিকে মদত দিয়েছে, বিজ্ঞানের নামে কুসংস্কারচ্ছন্ন আবোলতাবোলকে এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রামরত কৃষকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ‘দেশদ্রোহ’ আইন এবং এন এস এ এবং ইউ এ পি এ-র মত দানবীয় আইনই এখন এই সরকারের একমাত্র হাতিয়ার হয়ে উঠেছে—যার প্রয়োগ হয়েছে পাঞ্জাব এবং জে এন ইউ-র ছাত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের রক্ষক আসামের সক্রিয় কর্মীদের বিরুদ্ধে, ‘শহুরে নকশাল’ বলে ছাপ মারা মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে এবং উত্তরপ্রদেশে সংঘের পিটুনি বাহিনীর শিকার মানুষজনের বিরুদ্ধে। জে এন ইউ এবং বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্ত ছাত্রী যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চেয়েছেন তারা নিগৃহীত ও অপমানিত এবং শাস্তির শিকার হয়েছেন।

তিন বছর আগে ছাত্ররা মোদী জমানাকে একটা শিক্ষা দিলেও এখনও তারা তাদের সমালোচক এবং গণতন্ত্রের রক্ষকদের ‘‘দেশদ্রাহী’’ বলে ছাপ মারার সেই পুরনো বস্তাপচা কৌশলের আশ্রয় নিতেই মরিয়া। তিন বছর আগে ‘‘দেশদ্রোহের’’ অভিযোগ অভিপ্রায়ের চূড়ান্ত বিপরীত ফলই দিয়েছিল, জে এন ইউ-র ছাত্র ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের কন্ঠস্বর জে এন ইউ-র ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে সারা দেশেই অনুরণিত হয়েছিল এবং জনগণকে আশা ও সাহস দিয়ে অনুপ্রাণিত করেছিল। যে সরকার উচ্চ শিক্ষাকে ধ্বংস করে আম্বানির জিও বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপে সংস্কারাচ্ছন্ন গোঁড়ামি এবং তার সাথে স্যাঙাততন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতার পথ প্রশস্ত করতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, জে এন ইউ-র শিক্ষক ও ছাত্ররা তার বিরুদ্ধে এক নির্ভীক লড়াই চালাচ্ছেন।

কানহাইয়া, উমর এবং অনির্বাণের সাথে কাশ্মীরি ছাত্রদেরও চার্জশীটে অভিযুক্ত করা হয়েছে, ‘দেশদ্রোহের’ মেকি চার্জশীটের চরম মূল্য যাদের সম্ভবত দিতে হবে। ‘দেশদ্রোহের’ অভিযোগ অবশ্যম্ভাবিভাবেই এই ছাত্রদের পরিচিতিকে আরো কলঙ্কিত করবে, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং হিংসার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলবে, যে যন্ত্রণাগুলো তারা এবং অন্যান্য কাশ্মীরি ছাত্র ও যুবকরা ইতিমধ্যেই ভোগ করছে।

জে এন ইউ-র ছাত্রদের ‘দেশদ্রোহী’ এবং ‘জাতি-বিরোধী’ বলে কলঙ্কিত করতে সরকারের ধামাধরা যে চ্যানেলগুলো মেকি ভিডিও দেখিয়েছিল এবং মিথ্যা সংবাদ প্রচার করেছিল, তারা আবারও জে এন ইউ-র ছাত্রদের ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ (ভারতকে টুকরো টুকরো করার দল) বলে ছাপ মারছে এবং তা এমন শ্লোগানের ভিত্তিতে যেগুলো নাকি ছাত্ররা তুলেছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সুপ্রীম কোর্টকেদার নাথ সিং বনাম বিহার রাজ্য এবং বলবন্ত সিং বনাম পাঞ্জাব রাজ্য মামলার রায়ে বারবারই বলেছে যে, কোন শ্লোগান যদি হিংসাকে উসকিয়ে না তোলে তবে তা কখনই ‘দেশদ্রোহ’- এর সামিল হয় না। এ সত্ত্বেও বিদ্রোহী কন্ঠস্বরকে কালিমালিপ্ত করতে দেশদ্রোহ আইন রাজনৈতিক হাতিয়ার রূপে ব্যবহৃত হয়ে চলেছে।

এ কথা কোনভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে, আজ ভারতে আসল ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ হল মোদী সরকার যা ভারতকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে উদ্যত—তা ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেেঙ দিয়ে, ভারতে হিন্দু বনাম মুসলিম সংঘাত সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল এবং ‘সাধারণ বর্গের দরিদ্রদের’ জন্য ১০ শতাংশ কোটার আইন তৈরির মধ্যে দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করে, ভারতের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আর বি আই থেকে সি বি আই থেকে আদালতের মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপর্যস্ত করে তুলে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আর বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে চাওয়ার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু এই টুকরে টুকরে গ্যাং কখনই ভারতের জনগণের মনোবল এবং সাহসিকতাকে ভেঙে দিতে পারবে না। আমাদের দেশ ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে উদ্যত যে জমানা, আগামী নির্বাচনে ভারত অবশ্যই তার অবসান ঘটাবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৫ জানুয়ারি ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-4