সম্পাদকীয়
শিখতে হয়, নাহলে ঠকতে হয়

 ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ফিনিশ করে দেওয়ার আওয়াজ তুলে তৃণমূলের ডাকা জানুয়ারী ১৯-এর ব্রিগেড সমাবেশ সন্দেহ নেই যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রথমত, সামিল হয়েছিল শাসকশ্রেণীর বিভিন্ন আঞ্চলিক দল, যাদের কোন দল কোন রাজ্যে ক্ষমতাসীন, কোন দল আবার ঠিক এখন কোথাও ক্ষমতায় নেই, পাশাপাশি তৃণমূলের সাথে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের যাইই বনিবনা না থাক কংগ্রেসের হাই কমান্ড এই মিলিজুলি উদ্যোগ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখেনি, ঠিক তেমনই আমন্ত্রণ পেয়ে অংশগ্রহণ করতে দ্বিধা রাখেননি নতুন ধারার দলিত আন্দোলনের হিম্মৎ দেখানো নেতা এবং বিজেপি মোহ ছুৃঁড়ে ফেলে পাটিদার আন্দোলন গড়ে তোলার নেতা। এই তরুণ প্রজন্মের নেতাদের একটা আকর্ষণ ক্ষমতা তৈরী হয়েছে। দলিত নেতা জিগ্নেশ মেভানী আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার সাথে আন্ত:ক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছেন, কমিউনিস্ট বা বামপন্থী দলের সম্মেলন-সমাবেশেও থাকছেন, আবার তৃণমূলের ডাকা সমাবেশেও এলেন। সত্যিই, মোদী ভারতের প্রতিক্রিয়ায় বিরোধীপক্ষের ধারাগুলোতে পুরানো ও নতুন কি বিচিত্রসব বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি।

ব্রিগেডের ওই সমাবেশ সম্ভব হতে পেরেছে আয়োজকরাই জানিয়েছেন, দুটি শর্তে, বিজেপি হটাও আহ্বানে একমত হয়ে, আর বিকল্প প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নকে নির্বাচনোত্তর উহ্য করে রেখে। এই বৃহত্তর উদ্যোগের পরিণাম শেষপর্যন্ত কি দাঁড়াবে তা এখনই বুঝে নেওয়ার নয়, অপেক্ষায় থাকতে হবে। কোনও ‘বিকল্প কর্মসূচী’র ভিত্তিতে এই ঐকমত্যের সমাবেশ সংগঠিত হয়নি। সমাবেশ মঞ্চ থেকে উচ্চারিত হয়নি বুনিয়াদি শ্রেণীগুলোর জনগণের আজকের জ্বলন্ত দাবিগুচ্ছ। ওঠেনি দলিতের মান, সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা ও নারী সমাজের সমতার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতির কলতান। তা সত্ত্বেও প্রধান প্রতিপক্ষ ফ্যসিবাদী বিজেপির সাথে এহেন বিরোধী উদ্যোগগুলোর দ্বন্দ্ব যত তীব্র হয় ততই বিজেপি হটাও-এর কেন্দ্রীয় লক্ষ্যপূরণের পক্ষে তা প্রভাব ফেলতে পারবে। বলাবাহুল্য, বামপন্থীদেরও উপরোক্ত দ্বন্দ্বকে তীব্র করতে বাইরে থেকে প্রভাব ফেলা থেকে শুরু করে কার্যকরিভাবে ব্যবহার করতে দক্ষ হতে হবে, উল্টোটা নয়। যেমন, গণতন্ত্রের ওপর মোদী সরকার ও মমতা সরকার উভয়েরই আক্রমণ আছে, তার বিরোধিতাও করতে হবে কোনও ছাড় না দিয়ে। এমনকি এরাজ্যের ক্ষেত্রে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পরিত্রাতা’ সেজে সাজ সাজ রব তুলে বিজেপির মাথা তোলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য শাসক তৃণমূল দায়ি—এটাও বলে যেতে হবে কোনো ফাঁক না রেখে। তবু মোদী আর মমতা সরকারকে, বিজেপি আর তৃণমূলকে সমার্থক করলে চলবে না। হিন্দুরাষ্ট্রবাদী ও পুঁজির খুল্লামখুল্লা সর্বাত্মক একনায়কত্ব কায়েমের দালাল, দেশের সংবিধান ও আদালত থেকে শুরু করে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারে হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ করতে বেপরোয়া; ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, সামাজিক নিম্নবর্ণ-নিম্নবর্গের উপর আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া ও নারীর স্বাধীনতাকে মনুর বিধানে শেকল পরিয়ে রাখা তথা সমস্ত ক্ষেত্রে আর এস এস মদতপুষ্ট ফ্যাসিবাদী বিজেপির তুলনা একমাত্র বিজেপি-ই। এই পৃথকত্ব মাথায় না রেখে ‘মোদী-দিদি গোপন বোঝাপড়া’ বলে চললে হাস্যকর প্রতিপন্ন হয় এবং তৃণমূলকে উল্টোপাল্টা বলার সুযোগ করে দেওয়া হয়। অতএব এই ধরনের নির্বুদ্ধিতা থেকে বিরত থাকা উচিত।

জানুয়ারী ১৯-এর ব্রিগেড সমাবেশে মঞ্চ যতটা জমকালো নানারঙের হয়েছিল, জনজমায়েত তত জমজমাট হয়নি। কর্পোরেট মিডিয়া জমায়েত সংখ্যাকে সাড়ে বত্রিশ লাখ পর্যন্ত বলে প্রচার করে থাকতে পারে, এরাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনও সেই সুর জুগিয়ে থাকতে পারে, পুলিশ-প্রশাসন তো রাজ্যের শাসকদলের, আর কর্পোরেট মিডিয়ার যে অংশগুলো বামপন্থী শক্তিগুলোকে নগণ্য অপ্রাসঙ্গিক দেখিয়ে বিজেপি বনাম বামবিরোধী বা অ-বাম দলগুলোর মধ্যেই আগামী লোকসভা নির্বাচনী যুদ্ধের দুই প্রধান বিপরীত পক্ষ ছকে দিতে চায়, তারা তো ১৯ জানুয়ারীর ব্রিগেড পুরো না ভরলেও ভরন্ত দেখাবেই। অবশ্য যে জমায়েত হয়েছে সেটা বিজেপি বিরোধী হিসেবে এবং সংখ্যাগতভাবে খাটো করে দেখার নয়।

বামপন্থীদের অনিবার্য ষুক্তিসঙ্গত কারণেই ১৯ জানুয়ারীর সমাবেশে উপস্থিত থাকার কথা ছিল না। এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের তীব্র গণতন্ত্র বিরোধী দমনতন্ত্র চালানো, উগ্র বাম বিরোধীতা চালিয়ে যাওয়া, পক্ষান্তরে বামপন্থীদের দিক থেকেও তৃণমূল আমলের সাথে প্রতি পদে পদে সংঘর্ষের সম্পর্ক থাকার কারণে এখানে তৃণমূলের ডাকা বিজেপি বিরোধী কোনো সমাবেশে বামপন্থীদের অংশগ্রহণের প্রত্যাশা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু গোটা দেশের মানুষজন জানেন, ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বাম ধারার শক্তিগুলোর উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গ তথা দেশব্যাপী জারী রয়েছে। বামপন্থী এই উদ্যোগকে শক্তিশালী করা ও দেশের কোণে কোণে বিস্তৃত করে তোলা এই সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ দাবি, দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিরোধিতার সমস্ত ধারাই ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে বিধ্বস্ত করতে কার্যকরি হোক। এই মূল লক্ষ্য সব ধারাকেই বজায় রাখতে হবে। আর এই লড়াইয়ের পথে এখানে তৃণমূল সরকার তথা অন্যান্য অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলো জনবিরোধী আচরণ ও বিজেপি পল্লবিত হওয়ার জন্য দায়ি থাকার কারণে যে যে শাস্তি পাওয়া দরকার সেটাও দিতে হবে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-4