সারদা কেলেঙ্কারির ন্যায় বিচার অবশ্যই চাই, কিন্তু বাংলার মাটিতে কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রমূলক দখলদারি মানছি না

কয়েকমাস আগে আমরা দিল্লিতে সিবিআই বনাম সিবিআই এর এক অভূতপূর্ব কুনাট্যরঙ্গ দেখেছিলাম। সেই ঘটনাবলী দেশের প্রধান তদন্তকারী সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক বদলের ইঙ্গিত দিয়েছিল। সেখানে সেইসমস্ত সন্দেহজনক আধিকারিকদের নিয়োগ করা হচ্ছিল যারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের ঘনিষ্ঠ। আর সম্প্রতি আমরা দেখলাম সিবিআই এবং কোলকাতা পুলিশের মধ্যে প্রকাশ্য সংঘাত। সিবিআই চেষ্টা করেছিল কোলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করতে। এজন্য তারা পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বা প্রশাসনের থেকে আগাম কোনও অনুমতি নেয়নি। আর এই সূত্রেই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা যেখানে মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ কমিশনারকে উদ্ধার করতে নেমে পড়লেন আর কোলকাতা পুলিশ ও সিবিআই পরস্পর পরস্পরকে আটক করল।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের মধ্য দিয়ে ব্যাপারটার আপাতত একটা সমাধান হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে সিবিআই পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারির মতো পদক্ষেপ করতে পারবে না এবং পুলিশ কমিশনারকে সিবিআই এর মুখোমুখি হতে হবে (দিল্লি বা কোলকাতার পরিবর্তে) নিরপেক্ষ জায়গা শিলং-এ। সারদা ও রোজ ভ্যালি দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই তদন্ত এবার কোনদিকে এগোয় তা তো ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু এই সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব মোদি সরকারের দ্বারা সিবিআই-কে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কাজে ব্যবহার ও তদন্তের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে বেশ কিছু জরুরি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

সারদা গোষ্ঠীর অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল পশ্চিমবঙ্গ সহ আসাম ওড়িষা ঝাড়খণ্ড-এর মতো পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির ছোট সঞ্চয়কে করায়ত্ত করার মধ্য দিয়ে। এজন্য তারা দ্রুত এবং অনেক বেশি পরিমাণ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আর নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করেছিল নানা 'বিশিষ্টদের'। এর মধ্যে ছিলেন সংবাদমাধ্যম, চলচ্চিত্র ও থিয়েটার জগতের অভিনেতা অভিনেত্রী, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ আধিকারিক, শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা। সারদার উত্থান ও পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার সময়কালটি ছিল সংযুক্ত। কিন্তু দ্রুতই এই পনজি স্কিমের ব্যবসা নিজের ভারেই ভেঙে পড়ে। লক্ষ লক্ষ সাধারণ গরীব মানুষ তাদের সঞ্চয় হারান এবং এই ব্যবসার সঙ্গে (এজেন্ট হিসেবে) যুক্ত থাকা হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। রাজ্য জুড়ে শুরু হওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরে ব্যাপক প্রতিবাদের চাপে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাধ্য হয় ক্ষতির পরিমাণ খতিয়ে দেখে একদিকে ক্ষতিপূরণ দেবার লক্ষ্যে একটি কমিশন ও অন্যদিকে দুর্নীতির তদন্তের জন্য একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করতে।

২০১৪ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এর তদন্তভার যায় সিবিআই এর হাতে। সারদা গোষ্ঠীর ওপর মহলের কিছু কর্তা ব্যক্তি এবং তৃণমূলের কয়েকজন নেতা মন্ত্রীর জেল হাজত হয়। কিন্তু এর পরই এই দুর্নীতির প্রধান দুই অভিযুক্ত পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেতা মুকুল রায় এবং আসামের কংগ্রেস নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিজেপিতে যোগ দিলে সিবিআই তদন্ত খানিকটা গতি হারায়।

এখন ২০১৯ এর গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে সিবিআই বেছে বেছে কিছু সক্রিয়তা দেখাচ্ছে। এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলোর দুর্নীতিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নীতীশ কুমার শাসিত বিহারের বিরাট মাপের সৃজন দুর্নীতির কথা। বিজেপির দিকে ঝুঁকে থাকা নেতারাও রক্ষাকবচ পাচ্ছেন। বেছে বেছে হানা আসছে বিরোধী দল শাসিত রাজ্য এবং বিরোধী দল ও তাদের নেতাদের ওপর। বিজেপি সিবিআই-কে ব্যবহার করতে চায় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে, আর জনগণ চান সারদা ও রোজভ্যালি দুর্নীতির ন্যায়বিচার।

পশ্চিমবঙ্গে বামেরা দুর্নীতি বিরোধী লড়াইয়ের সামনের সারিতে আছেন এবং তারা কিছুতেই জনগণকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ বিজেপিকে দেবেন না। সুযোগ দেবেন না সিবিআই তদন্তের মধ্যে দিয়ে তাদের নেতাদের আড়াল করার চেষ্টাকে। গোটা দেশেই আজ বিজেপি একদিকে তার সাম্প্রদায়িক ও বিভাজন নীতি, অন্যদিকে আর্থিক বিপর্যয় নামিয়ে আনা ও পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির ঘটনাগুলির জন্য ধিকৃত। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বা আঁতাতের (শাসক দল ও পুঁজিপতি গোষ্ঠীর) পুঁজিবাদ এবং স্বৈরশাসন হল এই দুর্নীতির দুই প্রধান স্তম্ভ৷ যদি সিণ্ডিকেট রাজ নামক দুর্নীতির নিদর্শনের পরাকাষ্ঠা হয়ে থাকে পশ্চিমবঙ্গের স্বৈরশাসনের এই জমানা তবে কেন্দ্রের মোদি সরকার আঁতাতমূলক পুঁজিবাদের জমানা এবং সাম্প্রদায়িক গুণ্ডামির আরো বড় উদাহণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। তৃণমূলের দুর্নীতি এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই কোনওভাবেই বিজেপির ফাঁদে বন্দী হতে পারে না। আর এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে বামেদের ভূমিকা এই সন্ধিক্ষণের পরিস্থিতিতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বামেদের মমতা জমানার দুর্নীতি, স্বৈরতন্ত্র ও অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সংস্থাকে দিয়ে বিজেপির ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার সমস্ত চেষ্টার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে।

খণ্ড-26