অধিকার রক্ষার আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কনভেনশন

দেশজুড়ে সামাজিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের অন্যায় গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মানবাধিকার কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল গত ১৩ মে কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্রে। আয়োজন করেছিল ‘‘প্রতিবাদের অধিকার মঞ্চ’’। সহযোগিতায় দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি।

বক্তাদের মধ্যে মঞ্চে ছিলেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক ড: স্মরজিত জানা, আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ, ডা: বিনায়ক সেন, অনুরাধা তলোয়ার, আইনজীবী কল্লোল বসু প্রমুখ ব্যক্তিরা।

খসড়া প্রস্তাবনা উপস্থাপিত করেন শ্রদ্ধেয় তিমির বসুর অনুপস্থিতিতে প্রধান সংগঠক ড: স্মরজিত জানা। তিনি ব্যাখ্যা করলেন কেন মঞ্চটি তৈরি হল। প্রান্তিক মানুষ, দলিত, আদিবাসী, জনজাতি, উপজাতির গরীব মানুষদের ওপর নেমে আসা অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পরিসর ক্রমশ ছোট হয়ে দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিবাদী মানুষদের দানবীয় কালা আইন ইউএপিএ দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কারণ রাষ্ট্র এদের বিপদজনক মনে করছেন। লড়াই, সংগ্রামের জায়গাগুলো ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জেল থেকে বের করে আনা।

ড: পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, প্রতিবাদ করার ঝুঁকি কতটা আমরা এখন বুঝতে পারছি। কংগ্রেসী শাসকরাও বিরোধী মত প্রকাশের জন্য বামপন্থীদের গ্রেপ্তার করত। বড় উদাহরণ জরুরী অবস্থা। কিন্তু দমনপীড়নের প্রক্রিয়াগুলো এখন আলাদা। সাংবিধানিক অধিকার তুলে নেওয়া হয় জরুরী অবস্থায় এবং দেড় বছরের মতো তা চলেছিল। এখন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে যেমন মিথ্যা মামলা, সিবিআই, আয়কর বিভাগ ইত্যাদির দ্বারা আলাদা আলাদাভাবে প্রতিবাদীদের ওপর আক্রমণ নেমে আসছে। ভীমা কোরেগাঁও ঘটনায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত ১০-১৫ জনের জেল হয়েছে। নতুন শব্দবন্ধ হয়েছে ‘শহুরে নকশাল’। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কোনো নির্দিষ্ট চার্জশীট দেওয়া হচ্ছে না। প্রশাসন কোর্টকে যুক্তি দিচ্ছে, এত সাংঘাতিক অপরাধ যে তা গোপন রাখতে হবে। আদালতও সেটা মেনে নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জামিন দিচ্ছে না। এছাড়াও রাষ্ট্র নানাভাবে যেমন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতিবাদীদের পেছনে লাগছে। শাসক দলের সর্বোচ্চ স্তর থেকে বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনী নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলে তা হবে দেশদ্রোহীতা। গণতন্ত্র তাই প্রশ্নের মুখে। জরুরী অবস্থার সময় যুক্তিবাদী, সমাজ সংস্কারক, সাংবাদিককে খুন করা হয়নি, এখন যেটা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের অপরাধীদের সাক্ষ্য প্রমাণের ‘অভাব’ দেখিয়ে বেকসুর খালাস দেওয়া হচ্ছে।

সিপিআই(এম) নেত্রী কনীনিকা বোস বলেন, ‘‘এই বিষয়গুলো নিয়ে সভা, প্রতিবাদের দরকার আছে। দলিত, আদিবাসীদের ওপর অত্যাচার এবং রোহিত ভেমুলার মৃত্যু আসলে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তবে আগামী দিনে রাস্তায় নেমে ঠিক হবে প্রতিবাদের ধরন।

ডা: বিনায়ক সেন বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া সকলেই প্রায় তাঁর বন্ধুস্থানীয়। তিনি নিজেও রায়পুর সেশন আদালতের দ্বারা অন্যায়ভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। সালওয়া জুড়ুম নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছেন রাষ্ট্র তার নিজের দেশের লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাজ্যের পর রাজ্যে একই ঘটনা ঘটছে। এর প্রকৃত কারণ হল প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা এক ক্ষুদ্র স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত করা এবং এর জন্য এক শ্রেণীর মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে। এইভাবে মেধা সম্পদও কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কোনো কোনো গোষ্ঠীর হাতে। প্রসঙ্গত অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটির লেখা বই ‘সারভেইল্যান্স অফ ক্যাপিটালিজম’ (পুঁজির নজরদারি)-এর উল্লেখ করেন। মানবাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে এই ব্যাপারগুলো তুলে ধরতে হবে।

আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিকের কর্তব্য হল মানুষকে রাষ্ট্রের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করা। বর্তমানে আদালতের অমানবিকতা, অবিবেচকের ভূমিকার নিন্দা করেন তিনি। রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের পক্ষে থাকলে ‘দেশপ্রমী’ কিন্তু বিরোধী মত পোষণ করলে সে ‘দেশদ্রোহী’ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে।

আইনজীবী কল্লোল বসু বলেন, ‘মানবাধিকার কর্মী হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্ত হল তাকে জনপ্রিয়তা হারানোর সাহস দেখাতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, সংবিধানের ২১ নং ধারায় বর্ণিত মানুষের মর্যাদা রক্ষার কথা। আদালতকে হয়ে উঠতে হবে রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আগুনের দেওয়ালের মত নিরপেক্ষ। সংবিধানে আরও পরিষ্কার ব্যাখ্যা রাখতে হবে মানবাধিকার নিয়ে। তিনি বিজ্ঞানে কোয়ান্টাম তত্ত্বের অনিশ্চয়তা নীতির উল্লেখ করে বলেন, আইন এবং বিচার ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত।

সমাজকর্মী নব দত্ত জরুরী অবস্থা প্রসঙ্গে বলেন, সেইসময় দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছিল। শাসকদলের একটা অংশকে জেলে যেতে হয়েছিল। আর এখনকার অবস্থা আলাদা। এখন বিভিন্ন দাবিদাওয়া, প্রতিবাদ, সভা করার জন্য টাকা জমা দিয়েও হল পাওয়া যায় না। এই চিত্র কম বেশী সব রাজ্যেরই। একজন বলেন, কোনো ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলায় আটক করার পর যদি মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয় তাহলে যারা গ্রেপ্তার করলেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি মাধ্যমে আমরা কতদূর যেতে পারি? এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। ইউএপিএ-তে একজন হেড কনস্টেবলই সন্দেহের বশে গ্রেপ্তার করতে পারে। রাউলাট আইনও এত ভয়ংকর ছিল না।

অমিতাভ চৌধুরি বলেন, ‘আমি আরটিআই-কে আইন মনে করি না বরং আন্দোলন মনে করি। এই আরটিআই নিয়ে আন্দোলনে অনেক মানুষ খুন হয়েছেন। আইনের কষ্টিপাথর হচ্ছে আরটিআই। মানবাধিকার এবং আরটিআই আন্দোলনের কর্মীদের একসাথে চলা দরকার। দিল্লীতে ২৫টি বড় সংগঠন মিলে ‘পিপলস চার্টার’ (গণদাবি) নামে একটি মঞ্চ তৈরি করেছিল। মঞ্চ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেয়। পরে আরও ১৭১টি সংগঠন সমর্থন করে।

সমাজসেবী অনুরাধা তলোয়ার বলেন, যৌনকর্মীরা নিজেদের পেশার কথা বলতেও পারেন না। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদ করার অধিকার নেই, দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন, এমনকি ট্রেড ইউনিয়ন করাও ‘অপরাধ’ হিসাবে পরিগণিত হয়। তাই প্রতিবাদী আন্দোলন, ক্ষোভ বিক্ষোভগুলিকে সংগঠিত করে বিস্তৃতি দরকার। এখনকার অবস্থা হচ্ছে, কেউ সরকারের পক্ষে না বিপক্ষে? বিপক্ষে হলে তাকে যে কোনো অজুহাতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হবে। এটাই সরকার থেকে
সরকারের পরম্পরায় চলছে। জুলাই মাসে দিল্লীতে ‘প্রতিবাদের অধিকার’ নিয়ে কনভেনশন হচ্ছে। অন্যান্য শহরেও হবে।

এপিডিআর-এর স্বপ্না দাস উল্লেখ করেন, ২০১৭-১৮ সালে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের জেলে দুই শতাধিক বন্দী অসুস্থ হয়ে ও বিনা চিকিৎসায় মারা যান।

বিজয় সরকার বলেন, প্রতিরোধ ছাড়া প্রতিবাদের অর্থ নেই। অরণ্য অধিকার আইন সংশোধনের কারণে গৃহহীন পেশাহীন হবে আদিবাসী মূলধারার বহু মানুষ। সংখ্যাটা প্রায় চব্বিশ লক্ষ পরিবার। তাই মানবাধিকার আন্দোলনের একটা ধারণাগত পরিবর্তনও আনতে হচ্ছে।

দূর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির কাজল বসুর ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং খসড়া প্রতিবেদন সংশোধনী সহ সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হওয়ার মধ্যে দিয়ে সভার পরিসমাপ্তি ঘোষণা হয়।

খণ্ড-26