রবীন্দ্রনাথকে আরএসএস-এর চাড্ডি পরানোর হাস্যকর প্রচেষ্টা সম্পর্কে

আরএসএস সঙ্ঘ পরিবার একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাপত্র পাঠ্যসূচী থেকে সরিয়ে দিচ্ছে আর অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের কিছু লেখা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে একটি করে বাক্য বা বাক্যাংশ তুলে ধরে নিজেদের হিন্দুত্ববাদকে বৈধতা দিতে চাইছে। একটি হোয়াটস্যাপ মেসেজ ইতিমধ্যে বহুল পরিমাণে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মেসেজটি এরকম,

গুরুদেব বিজেপি ছিলেন নাকি?

আজকের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অবগতির জন্য ... সবাই আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। তিনি ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে কী বলেছেন সেটা জানা দরকার। যারা ইসলামকে শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম, সব ধর্ম সমান বলে চিল্লান তাদের থেকে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানী ছিলেন। দেখা যাক্ তাঁর উক্তি সমূহ –

১. যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে। (অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র : ১১)

২. চল্লিশলাখ হিন্দু একলাখ মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভিভূত। (আনন্দবাজার পত্রিকায় সাক্ষাৎকার, ৫.৯.১৯২৩)

৩. যদি মুসলমান সমাজ মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭, কালান্তর)

৪. কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেই মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন হলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৭, কালান্তর)

৫. এই ধর্মযেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিস্যাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তর কাজ করেছে। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১২ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৮, শান্তিনিকেতন)

৬. হিন্দুমুসলমানের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। (রবীন্দ্র রচনাবলী, জ.শ.স, ১৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮২, পরিচয়)

৭. ইতিহাসে দেখা যায়, নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুণ্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। (ঐ, পৃষ্ঠা ৪৮৫, ইতিহাস)

৮. প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না। (হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)

যেখানে রবীন্দ্রনাথের মতো কবি মুসলিমের সম্পর্কে সজাগ ছিলেন সেখানে বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিতে থেকেও কীভাবে হিন্দুমুসলিম ভাই ভাই এসব উচ্চারণ করি? অবাক্ হই, হতবাক হই।

রবীন্দ্রনাথকে জানুন, চিন্তা করুন।

একের পর এক উদ্ধৃতির শেষে এরা মূল মেসেজ দিচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথই যখন এসব বলেছেন তখন আমরা “কীভাবে হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই এসব উচ্চারণ করি?” ফেক নিউজে যখন আমাদের চারপাশ ভরে উঠেছে তখন অনেকেই ভাবতে পারেন যে এইসব উক্তিগুলি প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের লেখাতে নাই। কিন্তু সেটুকু ভেবে এই সঙ্ঘী প্রচারকে এড়িয়ে যাওয়াটা ভুল হবে। বিশেষত তাঁরা যখন তাঁদের বার্তার শেষে আহ্বান রেখেছেন যে ‘রবীন্দ্রনাথকে জানুন, চিন্তা করুন’, তখন নিশ্চয় আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত।

১৫ নভেম্বর ১৯৩৪ তারিখে অমিয় চক্রবর্ত্তীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চিঠিটিতে ১নং উদ্ধৃত বাক্যটি পাওয়া যাবে, ‘চিঠিপত্র’ একাদশ খণ্ডের ১১৮-১২২ পৃষ্ঠায়। এই বাক্যটি আগেপরের আরও কয়েকটি বাক্যসহ উদ্ধৃত করে দেখা যাক রবীন্দ্রনাথ যা বলছেন তা আরএসএস-এর প্রচারের সাথে কিছুমাত্র খাপ খায় কিনা,

“বিদেশী সাম্রাজ্যের এতটা দাক্ষিণ্য ইংরেজজাতের ছাড়া আর কোনো জাতের হাত দিয়ে হতে পারত না। হয়তো এই দানের সঙ্গে সঙ্গে সুবুদ্ধিও আছে। জগৎ জুড়ে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘূর্ণিবাতাস জেগে উঠছে তাতে ভারতবর্ষের মন না পেলে ভারতবর্ষকে শেষ পর্যন্ত আয়ত্ত করা সম্ভব হতে পারে না। যে মুসলমানকে আজ ওরা সকলরকমে প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানই একদিন মুষল ধরবে। যাই হোক, লুব্ধতা স্বভাবে প্রবল থাকলে স্ববুদ্ধির দূরদর্শিত কাজ করতে পারে না। ... আমাদের তরফে একটা কথা বলবার আছে, ইংরেজের শাসনে যতই দাক্ষিণ্য থাক আজ পর্য্যস্ত না মিলল আমাদের উপযুক্ত শিক্ষা, না জুটল যথেষ্ট পরিমাণে পেটের ভাত, না ঘটল স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা।”

স্পষ্টতই “ওরা” বলতে ব্রিটিশ শাসকদের বোঝানো হচ্ছে, ব্রিটিশ শাসকদের স্বভাবে প্রবল লুব্ধতার কথা বলা হচ্ছে এবং “মুষল ধরবে” বলতে মুসলমানেরা যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে সেকথাই বলছেন রবীন্দ্রনাথ। বাস্তবেও তা ঘটেছে। ১৯৩৪ সালে ‘কমিউনাল এওয়ার্ড’ এবং ভারতবাসীকে স্বায়ত্ত্ব শাসন দেওয়ার যে “দাক্ষিণ্য” দেখাচ্ছিল ব্রিটিশ সরকার তারই পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছিলেন। বলাই বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ আশঙ্কিত ছিলেন ব্রিটিশদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতিতে। এই অংশটি পড়েও যদি তাঁর চিন্তা আমাদের কাছে স্পষ্টরূপে ধরা না দেয় তাহলে আরেকটু পড়া যেতে পারে। কিছুদিনের মধ্যেই, ১৯৩৫এর ৭ মার্চ, অমিয় চক্রবর্ত্তীকে তিনি লিখছেন,

“দেখতে দেখতে হিন্দুমুসলমানের ভেদ অসহ্য হয়ে উঠল, এর মধ্যে ভাবীকালের যে সূচনা দেখা যাচ্ছে তা রক্তপঙ্কিল। লক্ষ্ণৌয়ে একজন মুসলমান ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বলছিলেন, কী করা যায়। আমি বললুম, রাষ্ট্রীয় বক্তৃতামঞ্চে নয়, কাজের ভিতর দিয়ে মিলতে হবে ... না মিললে ভারতে স্বায়ত্ত শাসন হবে ফুটো কলসিতে জল ভরা।”

হিন্দুমুসলমানের ভেদ যে অসহ্য হয়ে উঠছে কেবল তাই নয়, ভাবীকালের রক্তপঙ্কিল সূচনাও দেখতে পাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, স্বায়ত্ত্বশাসন অর্থহীন হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন। ইংরেজ শাসকেরা যে নিজেদের কুটীল স্বার্থেই হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দূরত্ব বাড়াতে এই বিভেদের বিষ ছড়াচ্ছে তাও তিনি স্পষ্ট করে দেন এই চিঠিতে,

“ইংরেজ মানব ইতিহাসে হেয়তম যে পাপ করেছে সে হচ্ছে চীনের মতো অত বড়ো দেশের কণ্ঠে জোর করে আফিম ঠেসে দিয়ে। নিজের উদরপূরণের জন্যে এত বড়ো নরহিংসা সভ্য-বর্বরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত। অবশেষে নিজের স্বার্থকে চিরস্থায়ী করবার উদ্দেশ্যে ইংরেজ আজ হিন্দুমুসলমানের প্রভেদকে যে প্রশস্ত করে দিলে এও উক্ত প্রকার বিষপ্রয়োগেরই অনুরূপ।”

দেশ হয়তো বিদেশী শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্ত হবে একদিন, কিন্তু যে বিষাক্ত ভেদ আমাদের মজ্জায় ঢুকে যাচ্ছে তা থেকে কি মুক্ত করতে পারব দেশকে? — উদ্বেগ নিয়ে লেখেন তিনি,

“কোনো এক সময়ে যুরোপে যখন প্রলয়কান্ড ঘটবে তখন ইংরেজের শিথিল মুষ্টি থেকে ভারতবর্ষ খসে পড়বেই। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো এত বড়ো দেশে দুই প্রতিবেশী জাতির মজ্জায় মজ্জায় এই যে বিষবীজ সে রোপণ করে দিয়ে গেল কবে আমরা তাকে উৎপাটিত করতে পারব ? … পঞ্জাবে হিন্দুমুসলমানের মধ্যে যে বিচ্ছেদের ছবি দেখে এলুম তা অত্যন্ত দুশ্চিন্তাজনক এবং লজ্জাকর রূপে অসভ্য। বাংলার অবস্থা তো জানোই— এখানে উভয়পক্ষের বিকৃত সম্বন্ধের ভিতর দিয়ে প্রায়ই যে সব বীভৎস অত্যাচার ঘটছে তাতে কেবল অসহ্য দুঃখ পাচ্ছি তা নয়, আমাদের মাথা হেঁট করে দিলে।”

পঞ্জাব ও বাংলা ভাগ হতে দেখেছি আমরা রবীন্দ্রনাথের এই দুশ্চিন্তাজ্ঞাপনের বারো বছর পর। আর, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বাংলা ভাগে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে বলে এখনও গর্ব করতে দেখি এরাজ্যের আরএসএসকে। ব্রিটিশ শাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যারা দেশজুড়ে হিন্দুমুসলমানের বিভেদ বাড়াতে সর্বদা সচেষ্ট সেই ‘প্রধান বিভাজক’-রা কি বর্তমানেও বিশ্ব দরবারে মাথা হেঁট করে দিচ্ছে না আমাদের?

২ নং উদ্ধৃতি হিসেবে আনন্দবাজারে রবীন্দ্রনাথের যে সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করা হয়েছে তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবু যদি তা সত্যি হয় তাহলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে তিনি আসলে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতাকেই সমালোচনা করছেন। আরএসএস তার প্রচারে সর্বদাই ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ বলে বিপুল সংখ্যাগুরুকে “মুসলিমদের ভয়ে মারাত্মকভাবে অভীভূত” রাখতে চায়। মেসেজের ৮ নং বাক্যটিও কোথাও খুঁজে পাইনি। পেলে নিশ্চিত দেখা যাবে যে রবীন্দ্রনাথ আঘাত করছেন ব্রাহ্মণ্যবাদী জাত ব্যবস্থাকে।

৩ ও ৪ নং উদ্ধৃত বাক্য দুটি পাবেন ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ সংকলনের ‘সংযোজন’ অংশে। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের মৃত্যু নিয়ে লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। পঞ্জাবের জলন্ধরে জন্ম, রাওলাট অ্যাক্ট বিরোধী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বামী শ্রদ্ধানন্দর রাজনৈতিক জীবন শুরু, ওকালতি ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন আর “দৈনিক বিজয়” নামে পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দুমুসলমান ঐক্যের প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মৌলবাদীরা তাঁর ওপর চটে উঠেছিল। ১৯২৬ সালে মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন ধর্মান্ধ ব্যক্তির আক্রমণে নিহত হন তিনি। “সত্যকে জানে অনেক লোকে, তাকে মানে সেই মানুষ যে বিশেষ শক্তিমান, প্রাণ দিয়ে তাকে মানার দ্বারাই সত্যকে আমরা সকল মানুষের করে দিই। এই মানতে পারার শক্তিটাই মস্ত জিনিস...তাঁর মৃত্যুও আলোকের মতো হয়ে উঠে তাঁর শ্রদ্ধার সেই ভয়হীন ক্ষয়হীন ক্লান্তিহীন অমৃতচ্ছবিকে উজ্জ্বল করে প্রকাশ করেছে”, লিখছেন রবীন্দ্রনাথ, “কিন্তু, মৃত্যুর গুপ্তচর তো শ্রদ্ধানন্দের আয়ু হরণ করেই ফিরে যাবে না। ধর্মবিদ্রোহী ধর্মান্ধতার কাঁধে চড়ে রক্তকলুষিত যে বীভৎসতাকে নগরের পথে পথে সে বিস্তার করেছিল অনতিকাল পূর্বেই, সে তো আমরা দেখেছি। সে যাদের নষ্ট করেছে তাদের তো কিছুই অবশেষ থাকেনি। তাদের মৃত্যু যে নিরতিশয় মৃত্যু, তাদের ক্ষতি যে চরম ক্ষতি।” তিনি নিজে যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়েরই একজন তা ভুলে থাকার ভাণ করেননি রবীন্দ্রনাথ। নির্ভয়ে তিনি তাঁর সম্প্রদায়ের “দুর্বলতা” হিসেবে চিহ্নিত করেন ভেদবুদ্ধি ও প্রতিবেশীদের প্রতি অবিচার ও হিংসার পাপকে, বিভেদের পাপ দূর করার আহ্বান রাখেন তিনি কেবল নিজেদের কল্যাণ নয় প্রতিবেশির কল্যাণের জন্যেও। প্রবন্ধটি থেকে আরও কিছু অংশ আমরা পড়তে পারি,

“ভারতবর্ষের অধিবাসীদের দুই মোটা ভাগ, হিন্দু ও মুসলমান। যদি ভাবি, মুসলমানদের অস্বীকার করে এক পাশে সরিয়ে দিলেই দেশের সকল মঙ্গলপ্রচেষ্টা সফল হবে, তা হলে বড়োই ভুল করব। ছাদের পাঁচটা কড়িকে মানব, বাকি তিনটে কড়িকে মানবই না, এটা বিরক্তির কথা হতে পারে, কিন্তু ছাদ-রক্ষার পক্ষে সুবুদ্ধির কথা নয়। ... পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদের ডোবাটাকে আমরা সমাজের দোহাই দিয়ে গভীর করে রেখেছি। ... এই যে রুদ্রবেশে পাপ দেখা দিল এ তো ভালোই হয়েছে একভাবে। আজকে না ভেবে উপায় নেই যে, কী করে একে চিরকালের মতো পরাভূত করা যেতে পারে। ... পেশোয়াদের মনে ও আচরণে ভেদবুদ্ধি, খণ্ড খণ্ড স্বার্থবুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়ে ক্ষণকালীন রাষ্ট্রবন্ধনকে টুকরো টুকরো করে দিলে। আমার কথা এই যে, আমাদের মধ্যে এই-যে পাপ পুষে রেখেছি এতে কি শুধু আমাদেরই অকল্যাণ, সে পাপে কি আমরা প্রতিবেশীদের প্রতি অবিচার করি নে, তাদের মধ্যে হিংসা জাগিয়ে তুলি নে? যে দুর্বল সেই প্রবলকে প্রলুব্ধ করে পাপের পথে টেনে আনে। পাপের প্রধান আশ্রয় দুর্বলের মধ্যে। অতএব যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই– তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা। আপনার জন্যেও, প্রতিবেশীর জন্যেও আমাদের নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে হবে।”

আরএসএস যে বিভেদ বিদ্বেষের পাপ ছড়াচ্ছে তা কি সত্যিই আমাদের ও আমাদের প্রতিবেশীদের পড়ে পড়ে মার খাওয়ার মতোই গভীরভাবে দুর্বল করে তুলছে না?

মেসেজের ৫ নং উদ্ধৃত বাক্যটিকে আরএসএস মুসলিম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ জাগাতে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহার করেছে। অথচ মূল লেখা পড়লেই আমরা বুঝতে পারি যে ‘বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত’ করার যে প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ এনেছেন তাতে কোনও বিদ্বেষ বা বিভেদের কথা বলেননি। আঘাত বলতে তিনি অত্যাচারও বোঝাননি, বরং ধর্মমতের আঘাত বলেছেন, সত্যের আঘাত বলেছেন,

“ইতিহাসে দেখা গিয়েছে ভারতবর্ষ বারম্বার নব নব ধর্মমতের প্রবল আঘাত সহ্য করেছে। ... মুসলমানধর্ম প্রবল ধর্ম, এবং তা নিশ্চেষ্ট ধর্মনয়। এই ধর্মযেখানে গেছে সেখানেই আপনার বিরুদ্ধ ধর্মকে আঘাত করে ভূমিসাৎ করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের উপরেও এই প্রচণ্ড আঘাত এসে পড়েছিল এবং বহু শতাব্দী ধরে এই আঘাত নিরন্তন কাজ করেছে। ... সত্যের আঘাত কেবল সত্যই গ্রহণ করতে পারে। এইজন্য প্রবল আঘাতের মুখে প্রত্যেক জাতি হয় আপনার শ্রেষ্ঠ সত্যকে সমুজ্জ্বল করে প্রকাশ করে, নয় আপনার মিথ্যা সম্বলকে উড়িয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়। ... ভারতবর্ষতখন দেখিয়েছিল, মুসলমানধর্মের যেটি সত্য সেটি ভারতবর্ষের সত্যের বিরোধী নয়। দেখিয়েছিল, ভারতবর্ষের মর্মস্থলে সত্যের একটি বিপুল সাধনা সঞ্চিত হয়ে আছে যা সকল সত্যকে আত্মীয় বলে গ্রহণ করতে পারে।”

মুসলমান ধর্মের যা সত্য তা ভারতবর্ষেরও সত্য। এটিই মূল কথা রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু তা বলে কি বাস্তব জীবনে কোনও পার্থক্যই নাই? বাস্তবের সত্য পার্থক্য আনমনে ভুলে থাকলেই তো আর ঐক্য হয়ে যায়না। বরং তা হয় ফাঁকি। বরং সেই পার্থক্যকে সম্মান জানিয়েই প্রকৃত মিলন হতে পারে। তা ধর্মে ধর্মে, জাতিতে জাতিতে বা এক ব্যক্তির সাথে আরেক ব্যক্তির একতার ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। মতপার্থক্য বা স্বাতন্ত্র্য গুঁড়িয়ে দিয়ে একাকার করতে চায় ফ্যাসিবাদ। রবীন্দ্রনাথ তাকে নাকচ করেন,

“হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজনসাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্যকে যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজনকে মানিবে না …

“একটা দিন আসিল যখন হিন্দু আপন হিন্দুত্ব লইয়া গৌরব করিতে উদ্যত হইল। তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মানিয়া লইয়া নিজেরা চুপচাপ পড়িয়া থাকিত তবে হিন্দু খুব খুশি হইত সন্দেহ নাই, কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হইয়া উঠিল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা তুলিয়া উঠিল। এখন সে মুসলমানরূপেই প্রবল হইতে চায়, হিন্দুর সঙ্গে মিশিয়া গিয়া প্রবল হইতে চায় না।

“এখন জগৎ জুড়িয়া সমস্যা এ নহে যে, কী করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া এক হইব — কিন্তু কী করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়াই মিলন হইবে। সে কাজটা কঠিন — কারণ, সেখানে কোনো প্রকার ফাঁকি চলে না, সেখানে পরস্পরকে পরস্পরের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়। সেটা সহজ নহে, কিন্তু, যেটা সহজ সেটা সাধ্য নহে ; পরিণামের দিকে চাহিলে দেখা যায় যেটা কঠিন সেটাই সহজ।

“মানুষ যখন আপনাকে বড়ো করে তখনই আপনাকে ত্যাগ করিতে পারে। যত দিন তাহার অভাব ও ক্ষুদ্রতা ততদিনই তাহার ঈর্ষা ও বিরোধ। ততদিন যদি সে আর কাহারও সঙ্গে মেলে তবে দায়ে পড়িয়া মেলে — সে মিলন কৃত্রিম মিলন। ছোটো বলিয়া আত্মলোপ করাটা অকল্যাণ, বড়ো হইয়া আত্মবিসর্জন করাটাই শ্রেয়।”

মেসেজের ৭ নং বাক্যটিকেও এই প্রসঙ্গেই আমরা পেয়ে যাই অন্য আরেক লেখায় যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্বোক্ত ‘সত্যের আঘাত’-এর ইতিহাস বলছেন,

“ভারতবর্ষে মুসলমান-প্রবেশের অনতিপূর্বে খৃষ্টশতাব্দীর আরম্ভকালে ভারত-ইতিহাসে একটা রোমাঞ্চকর মহাশূন্যতা দেখা যায়। দীর্ঘ দিবসের অবসানের পর একটা যেন চেতনাহীন সুষুপ্তির অন্ধকার সমস্ত দেশকে আচ্ছন্ন করিয়াছিল– সেটুকু সময়ের কোনো জাগ্রত সাক্ষী কোনো প্রামাণিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। গ্রীক এবং শকগণের সহিত সংঘাত তাহার পূর্বেই সমাপ্ত হইয়া গিয়াছিল। ... এ দিকে অনতিপূর্বে ভারতবর্ষের প্রতিবেশে বহুতর খণ্ডবিচ্ছিন্ন জাতি মহাপুরুষ মহম্মদের প্রচণ্ড আকর্ষণবলে একীভূত হইয়া মুসলমান নামক এক বিরাট কলেবর ধারণ করিয়া উত্থিত হইয়াছিল। ... তখন শ্রান্ত পুরাতন ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্মবৌদ্ধদের দ্বারা পরাস্ত; এবং বৌদ্ধধর্মবিচিত্র বিকৃত রূপান্তরে ক্রমশ পুরাণ-উপপুরাণের শতধাবিভক্ত ক্ষুদ্র সংকীর্ণ বক্র প্রণালীর মধ্যে স্রোতোহীন মন্দগতিতে প্রবাহিত হইয়া একটি সহস্রলাঙ্গুল শীতরক্ত সরীসৃপের ন্যায় ভারতবর্ষকে শতপাকে জড়িত করিতেছিল। ... নবভাবোৎসাহে এবং ঐক্যপ্রবণ ধর্মবলে একটা জাতি যে কিরূপ মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করে পরবর্তীকালে শিখগণ তাহার দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছিল। ... কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় নিরুৎসুক হিন্দুগণ মরিতে কুন্ঠিত হয় নাই। মুসলমানেরা যুদ্ধ করিয়াছে, আর হিন্দুরা দলে দলে আত্মহত্যা করিয়াছে। মুসলমানদের যুদ্ধের মধ্যে এক দিকে ধর্মোৎসাহ, অপর দিকে রাজ্য অথবা অর্থ-লোভ ছিল; কিন্তু হিন্দুরা চিতা জ্বালাইয়া স্ত্রী-কন্যা ধ্বংস করিয়া আবালবৃদ্ধ মরিয়াছে — মরা উচিত বিবেচনা করিয়া; বাঁচা তাহাদের শিক্ষাবিরুদ্ধ সংস্কারবিরুদ্ধ বলিয়া। তাহাকে বীরত্ব বলিতে পার কিন্তু তাহাকে যুদ্ধ বলে না। তাহার মধ্যে উদ্দেশ্য অথবা রাষ্ট্রনীতি কিছুই ছিল না।”

ভালো করে ভেবে দেখলে বুঝতে পারি একটা কোনো আকস্মিক অভাবনীয় উপপ্লব না ঘটলে এই নাগপাশবন্ধন আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব না।

এই চিঠিতেই তিনি আরও লিখছেন,

“সভ্যতার বণিকবৃত্তি যতদিন না ঘুচবে ততদিন ভারতবর্ষকে ইংরেজ মহাজনের পণ্যদ্রব্য হয়ে থাকতেই হবে, কোনোমতেই তার অন্যথা হতে পারবে না। একপক্ষে লোভ যে রাষ্ট্রব্যবস্থার সারথি সেখানে অপরপক্ষে দুৰ্ব্বলকে বল্গাবদ্ধ বাহনদশা যাপন করতেই হবে। অবস্থাবিশেষে কখনো দানা বেশি জুট্‌বে কখনো কম। অসহিষ্ণু হয়ে যে-জীব হ্রেষাধ্বনি করবে পা- ছোড়াছুড়ি করবে তার স্পৰ্দ্ধা টিকবে না।

সভ্যতার এই ভিত্তিবদলের প্রয়াস দেখেছিলুম রাশিয়ায় গিয়ে । মনে হয়েছিল নরমাংসজীবী রাষ্ট্ৰতন্ত্রের রুচির পরিবর্তন যদি এরা ঘটাতে পারে তবেই আমরা বাঁচব নইলে চোখরাঙানীর ভান করে অথবা দয়ার দোহাই পেড়ে দুৰ্ব্বল কখনোই মুক্তিলাভ করবে না। নানা ক্রটি সত্ত্বেও মানবের নবযুগের রূপ ঐ তপোভূমিতে দেখে আমি আনন্দিত ও আশান্বিত হয়েছিলুম। মানুষের ইতিহাসে আর কোথাও আনন্দ ও আশার স্থায়ী কারণ দেখিনি। জানি প্রকাণ্ড একটা বিপ্লবের উপরে রাশিয়া এই নবযুগের প্রতিষ্ঠা করেছে কিন্তু এই বিপ্লব মানুষের সব চেয়ে নিষ্ঠুর ও প্রবল রিপুর বিরুদ্ধে বিপ্লব — এ বিপ্লব অনেকদিনের পাপের প্রায়শ্চিত্তের বিধান।”

মহাপুরুষ মহম্মদের অমোঘ আকর্ষণে নব কলেবরে একীভূত হয়েছিল বহু খন্ডবিচ্ছিন্ন জাতি এবং একই রকম ঐক্যপ্রবণতার মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি লাভ করেছিল শিখ ধর্ম। এরকমই উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গীয় হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারিত বিচ্ছিন্ন বাক্যগুলির প্রসঙ্গে আমরা অল্প কয়েকটি লেখার অংশ পড়লাম রবীন্দ্রনাথকে জানতে এবং তা নিয়ে চিন্তা করতে। এছাড়া অজস্র লেখায় রবীন্দ্রনাথ বহুভাবে বহুবার ব্যক্ত করেছেন ভারতের এই মিলনতীর্থের মর্মকথা। তাঁর সব লেখাতে দেখি হিন্দু ও মুসলমান একসাথে উচ্চারিত হলেই জুড়ে গিয়ে হিন্দুমুসলমান হয়ে যায়। জাতীয়তাবাদের উগ্র সংকীর্ণতাকে নির্মম সমালোচনায় বিদ্ধ করে গেছেন তিনি। স্বদেশীয়ানার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বর্ণহিন্দুর স্বার্থকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন সেই স্বদেশী আন্দোলনের উত্তাল যুগেই। আরএসএস-বিজেপি যে তাঁর লেখাসকলকে পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দিতে চাইবে তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাতে বঙ্গসঙ্ঘীরা পড়েছে কুম্ভীপাকে। তাঁরা না পারছে ফেলতে না পারছে গিলতে। উপায়ান্তর না পেয়ে তাঁরা নিজেদের চাড্ডির মাপেই কেটেছেঁটে রবীন্দ্রনাথকে হাজির করার হাস্যকর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

খণ্ড-26