সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর হিন্দুত্ববাদী আক্রমণ বাড়ছে এখনই রুখে দাঁড়ানোটা জরুরি

মোদীর ‘নতুন ভারতে’ মুসলিম আর দলিত ও উপজাতিরা কেমন স্বাগত? গত পাঁচ বছরে মোদী জমানা যে চোখে তাদের দেখেছে, নিপীড়নের বিভিন্ন ঘটনায় যে বার্তা তাদের কাছে পৌঁছেছে, মোদীর দ্বিতীয় দফায় সেই অভিমুখের কোনো পরিবর্তন কি অপেক্ষা করছে? নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই ঘটতে থাকা ঘটনার ঘনঘটা কিন্তু এ সম্পর্কে অত্যন্ত উদ্বেগজনক ইঙ্গিত দিচ্ছে। সংসদের সেন্ট্রাল হলে ২৫ মে নব-নির্বাচিত এনডি সাংসদদের সমাবেশে মোদী মুসলিম সম্প্রদায়ের ‘‘বিশ্বাস জয়’’ করার কথা বললেন। ২০১৪-র ‘‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’’- এর বাণীর সঙ্গে যুক্ত হল নতুন শব্দবন্ধ ‘‘সবকা বিশ্বাস’’। কিন্তু বাস্তবের ঘটনাবলী যেন ঐ নতুন অভিলাষকে বিদ্রূপ করতে থাকল। বাস্তব পরিস্থিতি জানিয়ে দিল — যে ধারায় নির্বাচনী প্রচার চালানো হয়েছে, মোদী-অমিত শাহ-যোগী আদিত্যনাথ থেকে বিজেপির ছোট-মেজো-বড় নেতা-নেত্রীরা সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ভাঙিয়ে ভোটারদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটানোয় যেভাবে প্রয়াসী হয়েছেন, সমাজে সম্প্রদায়গত বিভাজনকে যে ধারায় গভীরতর করেছেন, শুধুই মনোবাসনার উচ্চারণে সেই ধারা পাল্টাবে তার সাধ্য কি। গত কয়েক দিনে এই ধরনের ঘটনা অন্তত পাঁচটা ঘটেছে, এর মধ্যে দুটি ঘটেছে ২২ মে, আর তিনটি ঘটেছে ২৫ মে, সংসদের সেন্ট্রাল হলে মোদীর ‘‘ধর্ম-জাতির ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ’’ না করার আহ্বানের দিন। ঘটনাগুলোকে সংক্ষেপে বিবৃত করা যাক।

২২ মে-র একটি ঘটনায় জাত নিয়ে অপমানে বিদ্ধ হয়ে এক আদিবাসী তরুণী ডাক্তার, পায়েল তদভির আত্মহত্যা রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যার স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছে। পায়েল ডাক্তারি পাশ করার পর মুম্বাইয়ের বিওয়াইএল নায়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের জন্য। কিন্তু ঐ কলেজের উচ্চবর্ণের অন্য ডাক্তারদের জাত তুলে গঞ্জনা তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে, গলায় দড়ি দিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলে তিনি আত্মহত্যা করেন। পায়েল ছিল ভিল উপজাতি সম্প্রদায়ের মেয়ে, আর ওর এই জাত পরিচিতিই ওর চাইতে ক্লাসে এক বছরের এগিয়ে থাকা হস্টেলে তারই ঘরের বাসিন্দা উচ্চবর্ণের তিন ডাক্তারের — হেমা আহুজা, ভক্তি মেহের, অঙ্কিতা খাণ্ডেলওয়াল — তার প্রতি আক্রোশ জাগিয়ে তোলে। পায়েলের মা-বাবা জানিয়েছেন, জাত তুলে এই খোঁটা নিয়ে তাঁরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, কিন্তু এই অভিযোগে গুরুত্ব দিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পায়েলের স্বামী ঐ হাসপাতালেরই চিকিৎসক সলমনও জানিয়েছেন, ২০১৮-র ডিসেম্বর মাসেই জাতি বিদ্বেষের এই অত্যাচার নিয়ে তাঁরা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছিলেন। উচ্চবর্ণের ঐ ডাক্তাররা ওকে বলত যে, সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে ভর্তিহয়ে সে ‘পিছনের দরজা’’ দিয়ে ঢুকেছে, হুমকি দিয়ে আরো বলত, অপারেশন করার ঘরে ওকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, পায়েলের মা-বাবার করা এফআইআর-এ এই কথা বলা হয়েছে যে, ‘‘ওর সিনিয়ররা ওর মেধা নিয়ে প্রশ্ন তুলত এবং ওকে বলত যে ও যেন কোনো রোগীকে স্পর্শ না করে, তাহলে রোগী অশুচি হয়ে যাবে।’’ পায়েলদের মেনে নেওয়ার মতো ঔদার্য মোদীর নতুন ভারতের নেই, আর তাই জাতি বিদ্বেষের মানসিক অত্যাচারের শিকার হয়ে নিজের স্বপ্নকে, নিজের জীবনকে শেষ করার পথই বেছে নেয় ২৩ বছরের উপজাতি তরুণী। এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা ছাড়া আর কিছু কি বলা যায়!

২২ মে-র আর একটি ঘটনা গোরক্ষকদের উজ্জীবিত হয়ে ওঠার সাক্ষ্য বহন করছে। মধ্যপ্রদেশের সিওনীতে গোমাংস রাখার অজুহাতে দুই মুসলিম যুবককে গাছের সঙ্গে বেঁধে লাঠি দিয়ে যথেচ্ছ মারতে থাকে নিজেদের ‘রাম সেনার’ সদস্য বলে পরিচয় দেওয়া যুবকরা। প্রহৃত ঐ দুজনের সঙ্গে থাকা এক মহিলাও তাদের উৎপীড়ন থেকে রেহাই পায়নি। তারা নিজেরাই শুধু মহিলাকে মারধোর করে না, প্রহৃত দুই যুবকের এক জনকে দিয়ে ঐ মহিলাকে চটি দিয়ে মারতেও বাধ্য করে। এই ঘটনার ভিডিও পোস্ট করে ঐ অত্যাচারে যুক্ত ‘রাম সেনার’ সদস্য শুভম সিংহ। ঘটনায় অভিযুক্ত পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের সাথে প্রহৃত তিনজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়, অজুহাত মধ্যপ্রদেশে গোমাংস নিষিদ্ধ।

২৫ মে-র একটি ঘটনায় দু-বছর আগে ফেসবুকে গোমাংস খাওয়ার সমর্থনে একটি পোস্ট করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয় ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী অধ্যাপক জিতরাই হাঁসদাকে। ২০১৭-র জুলাই মাসে জিতরাই হাঁসদা ফেসবুকে লেখেন, আদিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই গোমাংস খেয়ে আসছে। এই রেওয়াজ তাঁদের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার। তাঁর আগাম জামিনের আবেদন খারিজ হয় এবং কলেজ তাঁকে সাসপেণ্ড করার পিছনে আর এস এস-এর ছাত্র সংগঠন এ বিভি পি-র চাপ কাজ করেছে বলে প্রকাশিত সংবাদ জানায়। দু-বছর আগের ফেসবুক পোস্টের জন্য নির্বাচনের ফল বেরনোর পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হল কেন? ব্যাপকতর স্তরে মনে করা হচ্ছে, নির্বাচনে আদিবাসী ভোট যাতে বিজেপির থেকে সরে না যায়, সেই আশঙ্কাতেই দু-বছর পর এই গ্রেপ্তারি।

সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস অর্জনের মোদীর আহ্বানের দিন ২৫ মে গুরগাঁওয়ে সংখ্যালঘু বিদ্বেষের প্রকট প্রকাশ দেখা গেল। নমাজ পড়ে মসজিদ থেকে ফিরছিলেন মহম্মদ বরকত আলম। কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি বিহার থেকে গুরগাঁও গিয়েছিলেন টেলারিং-এ তালিম নেওয়ার জন্যে। মসজিদ থেকে ফেরার পথে অভিযুক্তরা ওকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে থাকে—ওর মাথায় স্কাল ক্যাপ কেন? এরপর কি হয়েছিল আলমের করা এফ আই আর থেকে শোনা যাক — ‘‘অভিযুক্তরা আমাকে হুমকি দেয়, বলে এই এলাকায় টুপি করা নিষিদ্ধ। ওরা আমার টুপি খুলে নেয় এবং চড় মারতে থাকে আর ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলতে বলে। ওদের কথা শুনে আমি ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলি, তারপর ওরা আমাকে ‘জয় শ্রী রাম’ বলতে বলে, কিন্তু আমি তা বলতে অস্বীকার করি। আর এতেই ওরা রাস্তার ধারে পড়ে থাকা একটা লাঠি দিয়ে আমাকে নির্মমভাবে মারতে থাকে।’’ পুলিশ এতে কোনো মুসলিম বিদ্বেষ খুঁজে পায়নি, তারা বলছে, যুবকরা মদ খেয়েই আলমকে মারধোর করেছে। মোদীর ভারতে অতএব টুপি পরার অপরাধে নিপীড়নের মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এরপরের ঘটনা বেগুসরাইয়ে, মুসলিম হওয়ার অপরাধে গুলিতে বিদ্ধ ফেরিওয়ালা মহম্মদ কাসিম। কাসিম যখন তার মপেডে চেপে জিনিসপত্র বিক্রি করছিল, অভিযুক্ত রাজিব যাদব ওকে ওর নাম জিগ্যেস করে। হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় কাসিমের বক্তব্যের ভিডিও-তে কাসিমকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘ও আমার নাম জিগ্যেস করল। আমি বললাম, ‘মহম্মদ কাসিম’। এরপর ও আমাকে গাল দিল, মিঁঞা বলে সম্বোধন করল, আর বলল আমার যখন পাকিস্তানে থাকার কথা তখন সেখানে আমি কি করছি, আর তারপর ও আমার পিঠে গুলি করল।’’ কাসিম সাহায্যের জন্য অনেকের এবং এমনকি পঞ্চায়েত প্রধানের দ্বারস্থ হলেও কেউ ওর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। কোনক্রমে থানায় পৌঁছলে পুলিশ ওকে বেগুসরাই সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। এই ঘটনার মধ্যেও পুলিশ ঘৃণা তাড়িত কোনো অপরাধ দেখতে পায়নি, এক মদপ্যের দৌরাত্ম্যকেই খুঁজে পেয়েছে।

উপরে বর্ণিত পরের পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে — সংখ্যালঘু বিদ্বেষের, নিম্নবর্গীয় বিদ্বেষের যে বীজ আরএসএস-বিজেপি বুনেছিল, সেটাই আজ মহিরুহে পরিণত হয়ে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে তার থেকে নির্গত গরলে চারদিক ভাসিয়ে তুলছে। হিন্দুত্বের হলাহলের এই গ্রাস থেকে বুঝিবা কারুরই রেহাই নেই। বহুত্ববাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সামাজিক বুনটে বড় বড় ফাটলের অমোঘতা এক শঙ্কাজনক বাস্তবতা হয়েই সামনে আসছে। বিজেপি-আরএসএস বলে থাকে, যারা এই হাঙ্গামার কাণ্ডকারখানা ঘটায় তারা ‘ফ্রিঞ্জ ফোর্স’ বা প্রান্তিক শক্তি, হিন্দুত্বর মূল ধারার সঙ্গে তা খাপ খায় না। সত্যিই কি তাই? দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার ২৮ মে সংস্করণে রুচির যোশির লেখা ‘‘এক উৎকৃষ্টতার স্থান’’ শীর্ষক নিবন্ধে এই প্রসঙ্গে লেখক কি বলছেন শোনা যাক — ‘‘ভোট গণনার সময় টিভিতে একজনকে এই মজাদার মন্তব্য করতে শোনা গেল যে, সংঘ পরিবারের কট্টর ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রিত করার কাজটা মোদী-শাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। সোজা কথাটা সোজা করে বলা যাক — মোদী ও শাহ হলেন সংঘ পরিবারের সবচেয়ে কট্টর উপাদান, শাহ ও মোদীর চেয়ে আরো উগ্রবাদী কিছু যদি থেকে থাকে তবে তা হল সেই কদর্যতর পথ যেটা তাঁরা প্রয়োগ করতে পারেন, অথবা তাড়াহুড়ো করছেন তাঁদের সেই লক্ষ্যে হিন্দুত্ব-তালিবানদের দ্বারা শাসিত ভারতে পৌঁছানোর জন্য।’’ অতএব, প্রগতিবাদী, উদারবাদীদের জন্যও কাজটা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। মোদী-শাহর ছলাকলার কাছে প্রতারিত হওয়া নয়, হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডাদের দৌরাত্ম্যকে অপ্রতিরোধনীয় বলে মেনে নেওয়া নয়, হিন্দু রাষ্ট্রের অনিবার্যহয়ে ওঠার ধারণার কাছে আত্মসমর্পণ নয়—ভারতের বহুত্ববাদী, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের খানখান হয়ে যাওয়া সামাজিক বুনটের পুনরুদ্ধারে কোমর বাঁধুন, মানুষের সমাবেশে আস্থা রাখুন, আগ্রাসনের প্রতিরোধে সাহসী হোন। এই আকালেও স্বপ্ন দেখাটা শুধু শ্লাঘনীয় নয়, তা একান্ত জরুরীও বটে।

খণ্ড-26
সংখ্যা-14