“ওরা নিশিদিন মন্দ চায়, ওরা নিশিদিন দ্বন্দ্ব চায়, ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!”

ফ্যাসিবাদ সম্পূর্ণভাবে জনজীবনকে ধ্বংস করতে তার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দিয়ে যা কিছু প্রগতিশীল তাকেই নিশ্চিহ্ন করতে চায়। বাংলার বুকে এখন ফ্যাসিস্ট সংঘ বাহিনীর সফ্ট টার্গেট নজরুল। তাই দু’-চার কথা বলতেই হয়। সব থেকে বেশি শ্যামাসঙ্গীতের রচয়িতাকে সেদিনও হিন্দু বা মুসলিম উভয় গোঁড়া মৌলবাদীদের থেকেই কম কথা শুনতে হয়নি! কিন্তু তিনি নজরুল, উপনিবেশিক ভারতের সম্ভবত একমাত্র কবি যিনি ঔপনিবেশিকদের কোপে জেলে গেছেন। হ্যাঁ নজরুল যখন ব্রিটিশ বিরোধিতায় জেলে যাচ্ছেন তখন আরএসএস-হিন্দুমহাসভার ভাই-ভাতিজারা ব্রিটিশকে কিভাবে তৈলমর্দন করা যায় তার নব নব উপায় উদ্ভাবনে ব্যস্ত। সাভারকর ব্যস্ত মুচলেখা দিতে আর নজরুল লিখছেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। সরাসরি ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ের আহ্বান, অতএব যাও জেলে। জেলে বসে গরাদে তাল দিতে দিতে লিখে ফেললেন ‘শিকল পরা ছল’। এহেন নজরুল এখন ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।

‘আমার কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ এর মতো শ্যামাসঙ্গীত লিখছেন যিনি হঠাৎ তিনিই কেন সংঘীদের নিশানায়? কারণ তাঁর নাম নজরুল ইসলাম, জন্মসূত্রে মুসলমান। ওপর ওপর এই কারণ তো আছেই, আরেকটু গভীরে যান, কারণের ঘনঘটা এখানেই শেষ না। নজরুল কি শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেই থামলেন? শুধু একই বৃন্তে দু’টি কুসুম বলেই তিনি থামলেন না, এগিয়ে গেলেন আরও একধাপ, সোচ্চারে ঘোষণা করলেন ‘মানুষের থেকে বড়ো কিছু নাই/নহে কিছু মহীয়ান’; আর এই অমোঘ সত্যকে প্রয়োগ কোথায় করছেন নজরুল? তিনি হেমন্ত সরকার, কুতুবউদ্দীন আইবকদের সাথে সম্মীলিতভাবে তৈরী করেন ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজেন্টস্ পার্টি। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার পর কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পরে ঐ ওয়ার্কার্স এ্যাণ্ড পিজেন্টস পার্টিতেই কমিউনিস্ট কর্মীরা কাজ করতেন। বলা যেতে পারে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য রূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো এই পার্টি। নজরুল এমন একজন ব্যক্তি যিনি ভারতীয় উপমহাদেশীয় কোনও ভাষায় প্রথম কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সঙ্গীতের ভাষান্তর করলেন। নজরুল যে শুধু গান গাইতেন কবিতা লিখতেন তা নয়, তিনি কতটা দৃঢ়চেতা প্রকৃতির ছিলেন সেটা বুঝে নেওয়া যাক। গ্রামে গ্রামে কবিতা বলছেন আর গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন। সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে সভা করছেন বর্ধমানের এক গ্রামে, ব্রিটিশের তোষামদকারী এক জমিদার তার লেঠেল বাহিনী পাঠিয়েছে সভা ভাঙার জন্য। লাঠি হাতে একাই রুখে দাঁড়ালেন নজরুল তাদের বিরুদ্ধে। তাঁর দেখাদেখি তখন বাকিরাও সাহসে ভর করে রুখে দাঁড়াতেই সেই লেঠেল বাহিনী পুচ্ছ গুটিয়ে ধাঁ।

ছেলের মৃত্যুদশাতেও প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও যিনি নিজের কলম বিকিয়ে দেননি, আপস করেননি আদর্শের প্রশ্নে, সমাজের রক্ষণাশলী সব চোখরাঙানিকে পরোয়া না করে বিয়ে করছেন প্রমীলা দেবীকে, একের পর এক লিখেছেন ‘সাম্যবাদী’, ‘নারী’, ‘বারাঙ্গণা’র মতো কবিতা, যা তৎকালীন অবস্থার সাপেক্ষে প্রগতিশীলতার বাহক হয়ে উঠেছিল, অনায়াসে ঘোষণা করেছেন ‘মন্দির আর মসজিদ ওই শয়তানদের মন্ত্রণাগার’। এহেন মানুষটির প্রতি তৎকালীন হিন্দু-মুসলিম মৌলবাদী শক্তির মনোভাব কেমন ছিল তা নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় উল্লেখ আছে “মৌলোভী যত মৌলবী আর মোল্লারা কন হাত নেড়ে/দেবদেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে” অথবা “আমপাড়া পড়া — হামবড়া মোরা এখনও বেড়াই ভাত মেরে/হিন্দুরা ভাবে ফার্সী শব্দে কবিতা লেখে ও পাত নেড়ে”।

স্বভাবতই নজরুল খুব একটা প্রিয় হবেন না সংঘ পরিবারের কাছে সেটা স্পষ্ট। নজরুল লিখেছিলেন “মশা মেরে ওই গরজে কামান বিপ্লব মারিয়াছি/ মোদের ডান হাতে হাতকড়া বাম হাতে মারি মাছি” তেমনই আজ ফ্যাসিস্টরাও ভাবছে ক্ষমতায় এসে সব বুঝি জয় করে ফেলেছে, কিন্তু যতদিন নজরুলদের চেতনা আছে সেই চেতনা বারবার ব্যারিকেড হয়ে দাঁড়াবে ওদের সামনে,ওরা হিংসা-দ্বেষ-ভয়-সন্ত্রাসগুজব ছড়িয়ে যাবে, তার বিপরীতে আমরা নজরুলের ভাষায় বলে যাব —

“উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।”
নজরুলের সেই শাশ্বত আকাঙ্খা দিয়েই আপাতত শেষ করা যাক —
“প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!”

খণ্ড-26