মোদী-২-এর বাজেট : কর্পোরেটদের জন্য ঢালাও কর মকুব, আর সামাজিক ক্ষেত্রে সংকোচন

২০২৪ এর মধ্যে ৫ লক্ষ কোটি ডলার অর্থনীতি গড়ে তোলার মোদীর স্বপ্ন ফেরি করলেন প্রথম মহিলা অর্থমন্ত্রী। আর, এই মায়ামৃগকে বিপণন করার, অর্থাৎ, বাজেট পেশ করার ঠিক আগের দিনই বিজেপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা জানিয়ে দিলেন, “আগামী লোকসভা ভোটের আগে আরও ৫-৬% ভোট বাড়ানোর প্রথম ধাপই হবে এই বাজেট। বিজেপির এই লক্ষ্যপূরণের পথ ধরে, তাই বাজেট বক্তৃতার প্রথম অনুচ্ছেদ থেকে শুরু হয়েছে নির্মলা সীতারমনের ভোট বার্তা। তিনি ঘোষণা করেন, আপামর জনতা মোদীকে ভোট দিয়েছেন দেশ গড়ার জন্য। দেশকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই, দেশের মানুষের অধিকার নয়, নতুন করে দেশগড়ার জন্য, দেশসেবার ব্রতে ব্রতী হয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানালেন অর্থমন্ত্রী।’’ প্রঙ্গত উল্লেখ্য, দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসার পর থেকে মোদী বলে আসছেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে দলিত-কৃষক-শোষিতবঞ্চিতদের ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে, তাদেরই দেশের উন্নয়নে ‘পাওয়ার হাউস’ করা হবে।’’ ৫ লক্ষ কোটি ডলারের সোনার হরিণকে মুঠোবন্দি করার নয়া দেশপ্রেমের আলেখ্যই এইভাবে হয়ে উঠছে মোদী-২-এর রাষ্ট্রীয় ভাষ্য।

মোদী-২ সরকার তার প্রথম বাজেটের মধ্য দিয়ে একটা আর্থিক অ্যাজেন্ডা হাজির করল, যা নিয়ে বাজেট পেশের দিন, ৫ জুলাই থেকে অনেক বিতর্ক, আলোচনা হচ্ছে। যে বিষয়টা অনেক বেশি গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হতে পারতো, তা হল, উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডগুলোর আর্থিক বরাদ্দ কতটা এবং কি পদ্ধতিতে হয়েছে। বাজেটের পার্ট এ-তে রয়েছে ১০৫টি অনুচ্ছেদ, অর্থমন্ত্রীর দেওয়া অত্যন্ত ক্লান্তিকর ভাষণে যার মধ্যে ২৩টি অনুচ্ছেদেই রয়েছে ফিনান্সিয়াল বাজার সংক্রান্ত বক্তৃতা। সমস্ত ‘উন্নয়নমূলক’ কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ফিনান্সিয়াল বাজারের ভূমিকা, আর সেখানে সরকারের স্থান নেহাতই গৌণ। যে বেসরকারি পুঁজি খুবই দ্রুত ফেরত লাভের আশায় থাকে, তা দেশীয় বা বিদেশী যাই হোক না কেন, তার উপরই উন্নয়ন বা বিকাশের ভার তুলে দেওয়া হয়েছে।

পরিহাস এমনই, যে ফিনান্সিয়াল দেশীয় এবং বিদেশী বেসরকারি পুঁজির উপর ভবিষ্যত আর্থিক বিকাশের স্বপ্ন ফেরি করছে মোদী সরকার তাকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে বসল আইএমএফ-এর ২৩ জুলাইয়ের বিবৃতি। ওইদিন, এক বিবৃতি দিয়ে আইএমএফ জানিয়েছে যে, ২০১৯-২০২০ তে ভারতের বৃদ্ধি মন্থর হবে। তাদের হিসাবে, ওই দুই বছরে আর্থিক বৃদ্ধি হ্রাসপ্রাপ্ত হবে ০.৩ শতাংশ। আর, উল্লিখিত ওই দু-বছরে জিডিপি পূর্বেকার হিসাব অনুযায়ী শ্লথ হয়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৭ এবং ৭.২%, কমবে আভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা। ব্যাপক পরিমানে বিদেশী পুঁজির দেশান্তরি হওয়া এবং কর্পোরেট ঘরানাগুলোর আয় কমতে থাকায় আর্থিক বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বে। আইএমএফ-এর এই বক্তব্য আসার পরই মুহূর্তের মধ্যে বম্বে শেয়ার বাজারের সূচক ১০০ পয়েন্ট নেমে গেল। গুরুত্বপূর্ণ কর্পোরেট সংস্থাগুলোর শেয়ার, যেমন, বেদান্ত, ইন্দাস ইন্ড ব্যাঙ্ক, মারুতি, বাজাজ অটো, ভারতী এয়ারটেল, আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক, টাটা স্টিল, রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি লিঃ, বাজাজ ফিনান্স এর শেয়ার ওই ঘোষণার পরই মুখ থুবড়ে পড়ে। এতো অচঞ্চল, অস্থায়ী, অনির্ভর‍যোগ্য ও চরিত্রের দিক থেকে ফাটকা, এরকম পুঁজির উপরই মোদী- ২-এর আর্থিক বৃদ্ধি ভিত্তিশীল।

উদ্বেগের আরও বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে। বানিজ্য মন্ত্রণালয় এক পরিসংখ্যান দিয়ে জানিয়েছে, জুন মাসে দেশের রপ্তানি ৯.৭১ শতাংশ কমেছে। আরও চিন্তার বিষয় হল, যেখানে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ হয়, সেই সব শ্রম নিবিড় শিল্পেই রপ্তানি কমেছে। এর ফলে বহু শ্রমিক কাজ খোয়ানোর আশংকায় দিন গুনছেন। এবারের বাজেটে ২০২২-এর মধ্যে কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণ করে ৬০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য মাত্রা ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু, দেখা গেল, এপ্রিল-মে মাসে সামগ্রিক কৃষিপণ্যের রপ্তানি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে ৮ শতাংশ (ওই একই সময়ে গত বছরের তুলনায়)। আর বাজেট যখন পেশ হয়, তখন দেশের আর্থিক অবস্থা রীতিমতো সঙ্গীন। দেশীয় বাজারে ভোগ্যপণ্য এবং অটোমোবাইল এর বাজারে নেমেছে বিরাট চাহিদার ঘাটতি। গ্রামীণ ক্ষেত্রে বাজার সংকুচিত। গ্রামীণ বাজারকে চাঙ্গা করার কোন পদক্ষেপ বাজেটে ঘোষিত হল না।

এদিকে, বিরাট এক ঋণের ফাঁদের দিকে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে — দেখা যাচ্ছে, ৭.১০ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবর্ষে সরকারকে বাজার থেকে ধার করতে হবে। কিন্তু, পুরোনো ধারের সুদ মেটাতেই সরকারের বেরিয়ে যাবে ৬.৬০ লক্ষ কোটি টাকা! জাতীয় আয় বৃদ্ধির তুলনায় সরকারের ধার পরিশোধ করার হার অনেক বেশি হবে।

কর্পোরেটদের জন্য ব্যাপক কর ছাড় দিয়েছে মোদী সরকার
ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরেই মোদী কর্পোরেটদের জন্য যে কর মকুব করেছে তার মোট পরিমাণ হল ৪.৩২ লক্ষ কোটি টাকা। বাজেট সংক্রান্ত নানা নথি থেকেই এই তথ্য উঠে আসছে। ফি-বছর এই ছাড়ের পরিমাণ বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০১৪-১৫ সালে ছাড়ের যে পরিমাণ ছিল ৬৫,০৬৭ কোটি, ২০১৮-১৯ তা দাঁড়ায় ১.০৯ লক্ষ কোটি টাকায়। কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্ব সংগ্রহের ৭.৬% হচ্ছে এই কর মকুবের পরিমাণ। কর মকুবের বা ছাড়ের এই দিকটাকে সরকার সংজ্ঞায়িত করে “ইন্ডাইরেক্ট সাবসিডি টু প্রেফার্ডট্যাক্সপেয়ার্স’’, যদিও ইউপিএ আমলে এগুলোকে বলা হতো “রেভেনিউ ফোরগোন’’ হিসাবে। শাসকেরা মনে করে, কর ছাড় দিলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, গতি নেবে আর্থিক বৃদ্ধি। আর এই যুক্তিতে সেজ, বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক গ্যাস, আবাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলোতে ঢালাও ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। মোদী জমানায়, এই ছাড়ের মাত্রা বেড়েছে ২২ শতাংশ। কিন্তু, বাস্তব অভিজ্ঞতা হল, এই সমস্ত কর ছাড় কর্মসংস্থানের বদলে কর্পোরেটদের আরও মুনাফা বৃদ্ধিতেই সাহায্য করেছে।

এর বিপরীতে, বছরের পর বছর কমেছে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ। কর্পোরেট ছাড়ের সাপেক্ষে, ২০১৯-২০-তে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে ধার্য হয়েছে ৬০ হাজার কোটি, মিড ডে মিল এর জন্য ১১ কোটি, অঙ্গনওয়ারীর জন্য ২৩,২৩৪ কোটি টাকা। স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্রে, ২০১৪-১৫ থেকেই জাতীয় আয় সাপেক্ষে এ খাতে ব্যয় বরাদ্দ ০.৩%-এ ঘোরাফেরা করছে। ২০১৯-২০-র আর্থিক বছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের জন্য বরাদ্দ সমগ্র বরাদ্দের মাত্র ২.৩২% এবং জিডিপির মাত্র ০.৩২৬%। আন্তর্জাতিক সংস্থা আক্সফাম তার রিপোর্টে জানিয়েছে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ১৯৫ টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪৫, আর, পড়শি দেশ বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের থেকে ভারতের স্থান নীচে।

যে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প গ্রামীণ ভারতে কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ বাজারকে সম্প্রসারিত করতে, তুলনামূলকভাবে ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, আজ মোদীর দৌলতে তা ক্রমে ক্রমে যাদুঘরে স্থান পেতে চলেছে। মোদী নিজেই বলেছিলেন, ওই একশ দিনের কাজের প্রকল্পটিকে ব্যর্থতার এক বিরাট স্মারক হিসাবে তাঁর সরকার রেখে দেবে। এনএসএস-ও তার পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে রিপোর্টে দেখিয়েছে, শ্রম বাজারের মজুরির তুলনায় ১০০ দিনের কাজের মজুরিকে পরিকল্পিতভাবে কমিয়ে মনরেগা প্রকল্পকে টুঁটি টিপে হত্যা করা হচ্ছে। যাই হোক, এই প্রবন্ধে তা আলোচনা করার পরিসর নেই।

১০০ দিনের অ্যাকশন প্ল্যানের অধীনে মোদী- ২ সর্বাত্মক আক্রমণ নামিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলোর বেসরকারিকরণ, বিলগ্নীকরণ, ক্লোজার, তার স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করা — সার্বিক এক ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছে ফ্যাসিস্ট এই সরকার। তার বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ।

খণ্ড-26
সংখ্যা-22