মোদী-২ : শ্রমিক শ্রেণীর ওপর আক্রমণ আরো তীব্র

শ্রম আইন সংশোধন, জমি অধিগ্রহণ আইন এবং রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার বেসরকারিকরণ - এই তিনটি বিষয় হলো মোদী-২ সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত তিনটি এজেন্ডা। এই প্রক্রিয়া দ্রুততর করার জন্যে যিনি সভা আহ্বান করেছিলেন তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং অমিত শাহ । সেই সভা থেকে বেরিয়ে এসে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ঘোষণা করলেন তারা প্রথমে শ্রম বিলের কোড (Code on Wages) এবং পেশাগত নিরাপত্তা কোড (Code on Occupational Safety), স্বাস্থ্য এবং কর্মপরিবেশ বিল গুলি অনুমোদন করবেন, এর পরে তারা শিল্প-সংক্রান্ত সম্পর্ক, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ সংক্রান্ত কোড বিল নিয়ে অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করবেন।

আরএসএস এবং বিজেপির নিজস্ব শ্রমিক সংগঠন ভারতীয় মজদুর সংঘই প্রস্তাবিত কোড বিলের বর্তমান রূপ বিন্যাসের বিরুদ্ধে শোরগোল তুলতে শুরু করেছে, কারণ “সামাজিক নিরাপত্তা নিধি” নাম দিয়ে ইএসআই ও প্রভিডেন্ট ফান্ড কে মিশিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠিত শ্রমিকদের মধ্যে তাদের সমর্থন কমতে শুরু করেছে, যা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।

শ্রম সংস্কার - ভুল বুঝিয়ে শ্রমিক স্বার্থের ঠিক বিপরীত আইন আনার চেষ্টা

৪৪ টি কেন্দ্রীয় শ্রম আইনকে বাতিল করে “মজুরি সম্পর্কিত, শিল্প সম্পর্ক, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ এবং পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের পরিবেশ” এই চারটি আইন প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদি সরকার। এগুলো বলবৎ হতে যাচ্ছে, যাতে নাকি কর্পোরেট এবং বিদেশি পুঁজির জন্যে “Ease of Doing Business’’ বা সহজে ব্যবসা আরো সহজতর হয়। এর তাৎপর্য হলো যে আইনগুলি শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় বলবৎ হয়েছিল সেগুলির ওপর পূর্ণ শক্তিতে হামলা শুরু করতে চলেছে মোদী-২ সরকার।

বিজেপি শাসিত রাজস্থান ছিল মোদী শাসনামলে অনেক পরিবর্তনের পরীক্ষাগার, এখন সেসব কার্যকর করা হচ্ছে । রাজস্থানের বিজেপি সরকার “ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপিউট এক্ট” সংশোধন করেছিল যাতে ৩০০-র কম শ্রমিক কর্মরত কোম্পানিগুলির ছাঁটাই বা লকআউট ঘোষণা করার জন্যে কর্পোরেটদের আর রাজ্য সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন রইলো না। শ্রম আইন সংস্কারের মডেল হিসেবে রাজস্থানকে নিয়ে খুব সুখ্যাতি, প্রশংসা করা হয়েছিল । কিন্তু একটি পয়সাও বিনিয়োগ হয়নি। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি এবং নীতি আয়োগের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত “কর্মসংস্থান এবং জীবিকা সৃজন” শীর্ষক সম্মেলনগুলির একটিতে প্রাক্তন শ্রম সচিব এই কঠোর বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু নীতি আয়োগের পন্ডিতেরা কোনোরকম কোনো যুক্তি ছাড়াই গায়ের জোরে দাবি করে চলেছেন যে শ্রম আইনের কড়াকড়ির জন্যেই পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে না।

জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মোদী প্রতিটি দেশ সফর করেছেন কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ টানতে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস ইন্ডেক্স ২০১৪ বলছে যে, যে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলি সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র এক দশমাংশের সামান্য কিছু বেশি সংস্থা শ্রম আইন-কে প্রধান বাধা বলে মনে করে। শম্বুকগতির বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের প্রকৃত কারণগুলি তুলে ধরার পরিবর্তে, সরকার মন্থর বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় দায় থেকে মুক্ত হতে চাইছে এবং কর্পোরেটদের তথা বৃহৎ পুঁজি-কে শোষণ এবং লুট করার বাধাহীন ও বেলাগাম ছাড়পত্র দিয়েছে।

ক্যালোরি বনাম ডায়েট, ন্যূনতম মজুরি বনাম আইনি ন্যূনতম মজুরি

বিগত সরকার জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বা Floor Wages নির্দিষ্ট করার জন্যে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ফ্লোর ওয়েজেস অর্থাৎ যে সর্বনিম্ন মজুরি দেশের যেকোনো প্রান্তে বাধ্যতামূলক দিতেই হবে। এই কমিটি মাসিক ৯৭৫০ টাকা অর্থাৎ দিন প্রতি ৩৭৫ টাকা ন্যূনতম মজুরির সুপারিশ করে। নতুন প্রণালীকে ভিত্তি করে করা এই হিসেব প্রতিটি শ্রমিকের ২৪০০ ক্যালোরি শক্তি উৎপাদনের জন্যে যতটা খাদ্য গ্রহণ প্রয়োজন তাকে উপেক্ষা করে। এই প্রণালী বলে খাদ্য গ্রহণ করলেই হবে, ক্যালোরি নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই ।

কনসিউমার বাস্কেট বা ক্রেতাদের তালিকাবদ্ধ নির্দিষ্ট কতগুলি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য- সেই দ্রব্য গুলির মূল্য সূচক পরিবর্তনের ভিত্তিতেও ন্যূনতম মজুরি নির্ণয়ের কৌশলগত চালাকি করা হয়েছে। উপরের পদ্ধতি অনুসরণ করে কমিটি সুপারিশ করে যে জুলাই ২০১৮ থেকে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি দৈনিক (মাসিক) অঞ্চল ১ এর ক্ষেত্রে ৩৪২ টাকা (৮৮৯২ টাকা), অঞ্চল ২ এর ক্ষেত্রে ৩৮০ টাকা (৯৮৮০ টাকা), অঞ্চল ৩ এর ক্ষেত্রে ৪১৪ টাকা (১০৭৬৪ টাকা), অঞ্চল ৪ এর ক্ষেত্রে ৪৪৭ টাকা (১১৬২২) এবং অঞ্চল ৫-এর ক্ষেত্রে ৩৮৬ টাকা (১০০৩৬) হওয়া উচিত এবং তা ক্ষেত্র, দক্ষতা, পেশা এবং গ্রাম বা শহর স্থান নিরপেক্ষ হবে ।

দূর্ভাগ্যজনক যে এই কমিটি ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাসে তাদের এই রিপোর্ট জমা দিচ্ছে, যেখানে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে এই একই সরকারেরই গঠিত সপ্তম বেতন কমিশন তাদের রিপোর্টে সুপারিশ করে যে কোনো শ্রমিককে, এমনকি সে যদি ঠিকা শ্রমিকও হয় তাহলেও তাকে মাসে ১৮০০০ টাকার কম মজুরি দেওয়া যাবে না। গত তিন বছরের মুদ্রাস্ফীতির হিসেবে যদি আমরা ক্ষতিপূরণ গণনা করি তাহলে এই বেতন আজকে কমপক্ষে মাসিক ২০০০০ টাকা এসে দাঁড়াবে।

কেন্দ্রীয় সরকারের যে কোনো শ্রমিকের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সপ্তম বেতন কমিশন সুপারিশ করেছিল যে কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বনিম্ন বেতন, নিয়মিত কর্মীদের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বেতনমান কিছুতেই ২৫০০০ থেকে ৪৫০০০ এর কম দেওয়া যাবে না।

শুধু তাই নয়, রাজ্য সরকারের ধার্য করে দেওয়া মাসিক ন্যূনতম মজুরি ১৫০০০ টাকার বিরুদ্ধে মালিকদের আনা পিটিশন কর্ণাটক হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছে। দিল্লিতেও হাইকোর্ট অনেক নরম মনোভাব দেখিয়েছে (শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রাম, বিশেষ করে ডিটিসি কর্মীদের আন্দোলনের কারণে) এবং দিল্লির আম আদমি পার্টির সরকারের সংশোধিত এবং বর্ধিত ন্যূনতম মজুরিকে স্বীকৃতি দিয়েছে ।

তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি রাজ্যে গড় ন্যূনতম মজুরি ১৫০০০-১৬০০০ টাকা, আর মোদির তৈরি করে কমিটি প্রস্তাব দিচ্ছে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বা “ফ্লোর ওয়েজেস” ১০০০০ টাকার কম হোক।

বিভিন্ন রাজ্যে বাজারের দামের ভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরির স্তর বাড়ছে, আর মোদি সরকার ফ্লোর ওয়েজেস বা জাতীয় ন্যূনতম মজুরির ধারণাকে বিভিন্ন রাজ্যগুলির ন্যূনতম মজুরির চেয়েও অনেক কম অঙ্কের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । নীতি আয়োগ আবার এই কমিটির ফ্লোর ওয়েজেস নিয়ে সুপারিশ কে প্রশংসাও করেছে।

এখনো পর্যন্ত ন্যূনতম মজুরি বিষয়টিকে বাধ্যতামূলক করানো গেছে - যদিও অবশ্যই কিছু সংখ্যক মালিক আইনত বাধ্যতামূলক মজুরি প্রদান করেন । মোদী সরকার এখন “ফ্লোর ওয়েজেস” কে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করছে যখন ন্যূনতম মজুরিকে আসলে জুমলা বা একটা কথার কথায় পরিণত করা হচ্ছে এবং এভাবেই ন্যূনতম মজুরি বিষয়টির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে।

(ক্রমশ)

(লিবারেশন জুলাই ২০১৯ থেকে) ভাষান্তর : মৃণাল

খণ্ড-26
সংখ্যা-20