কাশ্মীর : ৭ আগস্ট দিল্লীতে বাম দলগুলির প্রতিবাদী কর্মসূচীতে দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের বক্তব্য

কাশ্মীরের সাথে যা হল তা অত্যন্ত ভুল এবং তা সারা দেশের জন্যই এক মারাত্মক খতরনাক ইঙ্গিত। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা ভারতের সাথে কাশ্মীরকে জুড়ে রাখার এক সাংবিধানিক সেতু ছিল। সম্পূর্ণ একতরফাভাবে, কাশ্মীরের জনতার সাথে কোনো আলোচনা ছাড়া, কাশ্মীরের মানুষের মতামত না শুনে সেই সেতু জ্বালিয়ে দিল ধ্বংস করে দিল ভারত সরকার। এর আইনী তাৎপর্য কী তা নিয়ে সামনের দিনে বিতর্ক চলবে, কিন্তু যে পদ্ধতিতে কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে দিয়ে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বানিয়ে দেওয়া হল – একটা জম্মু-কাশ্মীর আরেকটা লাদাখ – বিহারের মানুষকে, ইউপির মানুষকে তা ভাবতে হবে বুঝতে হবে। যদি কাল বিহার রাজ্যকে খতম করে দিয়ে মিথিলা, মগধ, ভোজপুর আর কোশী চারটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বদলে দেওয়া হয় তো আপনাদের কেমন লাগবে? উত্তর প্রদেশকে যদি কাল ভেঙে দিয়ে পূর্বাঞ্চল, হরিৎ প্রদেশ, বুন্দেলখন্ড ইত্যাদি কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে দেওয়া হয় তাহলে আপনাদের কেমন লাগবে? ভেবে দেখা উচিৎ যে ৩৭০ ধারা ঐতিহাসিক কারণেই কাশ্মীরের জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থাপনা হিসেবে ছিল, ঠিক যেমন আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতার কারণে, আমাদের নির্দিষ্ট ইতিহাসের কারণে আমাদের দেশের দলিতদের জন্য, আদিবাসীদের জন্য, পিছড়ে বর্গের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা আছে। আজ রাষ্ট্রীয় একীকরণের নামে কাশ্মীরের বিশেষ ব্যবস্থাপনা খতম করে দেওয়া হল, কাল সামাজিক একীকরণের নামে যদি পুরো সংরক্ষণ ব্যবস্থাটাই তুলে দেওয়া হয় তাহলে আমাদের কেমন লাগবে? এ’কথা ভেবে দেখার সময় এসে গেছে।

সাথী আমরা জানি না কাশ্মীরের মানুষ এখন কীভাবে বেঁচে আছে। কাশ্মীরে জরুরি অবস্থা চলছে। কাশ্মীরে কারফিউ চলছে। কাশ্মীরের সব নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে আছে। আর, মানুষের কোনও রকম গণতান্ত্রিক অধিকার নাই। আমরা দাবি করতে এসেছি যে কাশ্মীরে কারফিউ খতম করো, কাশ্মীরে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনো, কাশ্মীরের নেতাদের মুক্ত করো। সাথী আপনারা দেখছেন যে কাশ্মীরে কাল কী হবে তা আমাদের কারও জানা নাই। কিছু লোক বলছে যে কাশ্মীরে এবার আমরা জমি পাবো, আমরা জমি কিনতে পারব কাশ্মীরে, বাইরের লোক যা এতদিন পারতো না। এই জমির বিষয়টি কেবল কাশ্মীরের বিষয় নয়। দেশের অনেক পাহাড়ি রাজ্যে, দেশের অনেক আদিবাসী-বহুল অঞ্চলে এই বিশেষ অধিকার আছে। ঝাড়খন্ডের আদিবাসীদের এই বিশেষ অধিকার আছে। ছোটো নাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট, সাঁওতাল পরগণা টেনান্সি অ্যাক্ট ও পঞ্চম তপশীলের মাধ্যমে দেশের আদিবাসীদের অধিকার ছিল নিজের জমি সুরক্ষিত রাখার। কোন লোকেরা এখন কাশ্মীরের জমির কথা বলছে? যারা শোনভদ্রয় আদিবাসীদের হত্যা করে তাঁদের জমি কব্জা করছে তারাই একথা বলছে। ওরা জমি লুট করার দল, কর্পোরেট লুটেরাদের দল। যারা কাশ্মীরকে কেবল এক জমি রূপে দেখছে। কাশ্মীর জমি না, কাশ্মীর এক জিন্দা মুলুক, এক জীবন্ত কৌম, এক প্রাণবন্ত সংস্কৃতি।

আমরা এখানে বলতে এসেছি যে আমরা কাশ্মিরিয়াতের সাথে আছি, আমরা কাশ্মীরি জনতার সাথে আছি। কাশ্মীরের ওপর যে দমন চলছে আমরা তার বিরুদ্ধে। আর, সমগ্র ভারতের জন্যই এ এক বিপদঘণ্টি। এ এক সতর্কবার্তা। সংবিধানকে যদি বাঁচাতে হয়, গণতন্ত্রকে যদি বাঁচাতে হয়, দেশের এই যে কাঠামো আছে তাকে যদি বাঁচাতে হয় তাহলে এখন এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সবারই দায়িত্ব সকলে মিলে কাশ্মীরের পক্ষে, সংবিধানের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, এই দেশের ফেডেরালিজমের পক্ষে আমরা সোচ্চার হই। এই কাজটা কঠিন। বিজেপি গাঁয়ে গাঁয়ে উৎসব বানাচ্ছে, মানুষকে বিপথে চালিত করছে, ভুল বোঝাচ্ছে। সেই কারণেই, কমরেড ডি রাজা যা বললেন, এটা একটা সুরুয়াত। এ কেবল সারা দেশ জুড়ে একদিনে মিছিল বের করা বা পথসভা করার ব্যাপার নয়, প্রয়োজনটা হল দেশের এক একটি মানুষকে বোঝানো, কাশ্মীর প্রসঙ্গে যা সত্য তা মানুষকে জানানো। যে মিথ্যা চলছে, যে ফেক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে, আম্বেদকরের নাম থেকে শুরু করে সংবিধান ও ইতিহাসকে নিয়ে হোয়াটস্যাপে যে ঝুটা প্রচার চালানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আমাদের সব্বাইকে সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের মানুষের মাঝে যেতে হবে এবং তাঁদের মাঝে কাশ্মীরের প্রকৃত অবস্থা ও দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রকৃত অবস্থার কথা রাখতে হবে আর সংবিধান গণতন্ত্র ও ফেডেরালিজমকে বাঁচানোর জন্য একজোট হতে হবে। আমি দিল্লীর সাথীদের অভিনন্দন জানাই যে তাঁরা পাঁচ তারিখেও এরকম প্রতিবাদ করেছিলেন এবং আজ আরও বিপুল সংখ্যায় এসেছেন। আপনাদের ওপর ভরসা আছে এবং আপনাদের কাছে আবেদন করব যে এই পুরো প্রতিবাদকে এক প্রচারান্দোলন হিসেবে নিন আর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে, কলকারখানায়, মজদুর মহল্লায়, ঘরে ঘরে যান। মানুষকে বিজেপি ও আরএসএসের অপপ্রচারের কাছে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেবেন না। মানুষকে সত্যিটা বলুন, মানুষকে সাথে নিন। মানুষকে সাথে নিয়ে কাশ্মীরের মানুষের পাশে দাঁড়ান, সংবিধানের পাশে দাঁড়ান। অনেক অনেক ধন্যবাদ। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।

খণ্ড-26