ফিরিয়ে দাও উপত্যকার রাজ্যের মর্যাদা

অমরনাথ যাত্রার নির্ধারিত নির্ঘণ্ট যখন হঠাৎ বাতিল করে দেওয়া হল প্রশাসনিক ফতোয়ায় তখন সন্দেহের জল্পনা জমতে শুরু করেছিল কোন এক সন্ত্রাসবাদী হানা বুঝি আসন্ন! কিন্তু অচিরেই প্রকাশ হয়ে গেল সেই কল্পনার গল্প নয়, বরং অতি গোপনে মধ্যরাতে ভারত শাসকের তৈরি করা জম্মু-কাশ্মীর অপারেশনের এক সুপরিকল্পিত চিত্রনাট্য, যার নাটের গুরু একদা গুজরাট সাম্প্রদায়িক অপারেশন মায় সংখ্যালঘু নিধন অভিযানে অমিতবিক্রম প্রমাণদায়ী অন্যতম কুখ্যাত শা। আজকের ভারতের হীরকরাজার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মশাই, ষড়যন্ত্রী মশাই। রাজধানীর গৈরিকভবন চত্বরের সামনে যখন দৃশ্যমান হতে থাকে ক্ষমতার দাপট-উল্লাস প্রদর্শনের লাড্ডু বিতরণ, তার আগে থাকতে নতুন করে শুরু হয়ে যায় কাশ্মীর অস্মিতার অসহনীয় জ্বলন। আভাসের অভাব রাখছে না, অপেক্ষা করছে অজস্র রক্তক্ষরণ। জম্মু ও কাশ্মীরকে দুটুকরো করে তার গণতন্ত্র, আত্মপরিচয়, মর্যাদা, মন ও হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হল। সেনা-আধাসেনা আর কাঁটাতারে ভরিয়ে দিয়ে, কার্ফু জারি করে, বিরোধী নেতাদের প্রথমে গৃহবন্দী তারপর অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে গিয়ে, জনতাকে সন্ত্রস্ত রেখে, দূরভাষ-ইন্টারনেট ও সংবাদমাধ্যম থেকে, বাকি ভারত এবং বর্হিবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে যে ‘পুনর্গঠনের’ বলি দেওয়া হল তাতে উপত্যকার জনতার প্রতি শুধুমাত্র নয়, গোটা দেশের প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রিয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবতায় বিশ্বাসী শক্তিগুলোর প্রত্যাশার প্রতি প্রদর্শিত হচ্ছে চূড়ান্ত অমার্জনীয় অপরাধ। এতে উস্মা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জ।

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা – সর্বত্র সহমর্মী সংবেদনশীল শক্তিসমূহ একদিকে, আর আগ্রাসনকারী রাষ্ট্রশক্তির মালিক বিজেপি ও তার দোসর এনডিএ শরিকেরা অন্যদিকে। এনডিএ বর্হিভূত কিছু কিছু আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল, যার মধ্যে কোনোটা রাজনীতিতে তথাকথিত নৈতিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার নজির স্থাপনের দাবিদার, আবার কোনোটা দলিত মুক্তি নিয়ে আসার স্বঘোষিত ঠিকেদার, যারা গত লোকসভা নির্বাচনে পর্যন্ত ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে, তারাও অবাক করল, বিজেপির কাশ্মীর পলিসির পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল! কংগ্রসের গৃহীত অবস্থানে আনঅফিসিয়াল-অফিসিয়াল মডেলে উপত্যকার রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পক্ষে-বিপক্ষে দ্বিভাজিত চেহারাও কম প্রহসনের নয়। তবে এহেন দৃশ্য একেবারে আনকোরা নয়। ঠিক এরকম দোল খাওয়া টাল খাওয়া আর অবশেষে কল্পনাতীত প্রতারণার ‘কীর্তি’ কংগ্রেস দেখিয়েছিল সংঘশক্তিগুলো বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময়ে। রামলালার তালাও বদান্যতায় একবার নয়, দু'দুবার খুলে দিয়েছিল ‘সর্ব ধর্ম সদভাবনা’পন্থী ‘সেকুলার’ শাসক কংগ্রেস। জম্মু ও কাশ্মীরে সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারাকে মান্যতা দেওয়ার বাধ্যতা কংগ্রেস অনুসরণ করে এলেও কংগ্রেসী শাসনে উপত্যকা শাসিত হোত বধ্যভূমি হিসাবেই। সুতরাং আজ কংগ্রেসের মধ্যে যে ‘নবীন- প্রবীণের’ মতভেদ পরিস্ফুট তার উৎস রয়েছে তাদের দ্বিচারিতায় ভরা কাশ্মীর পলিসির পরম্পরায়। তৃণমূলের অবস্থান বকচ্ছপ ধরনের, সংসদে বিরোধিতায় বিতর্কে অংশ নিল, কিন্ত ভোটাভুটিতে থাকল অনুপস্থিত। বলছে আপত্তি রয়েছে পদ্ধতিগত আচরণে। তবে কি পলিসিতে বিরোধ নেই! যে এনডিএ বর্হিভূত আঞ্চলিক দলগুলো জম্মু ও কাশ্মীর পলিসির প্রশ্নে বিজেপির পক্ষ গ্রহণ করল তাদের গন্ডগোলের সূত্র রয়েছে সম্ভবত দু-তিনটি ক্ষেত্রে। হয় সংবিধানে ৩৭০ ও ৩৫এ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের তাৎপর্য বুঝতে ব্যর্থতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, “বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে”র ভারতের ধারণার ভিত্তি যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জনগণের স্বার্থ ও দাবিকে কেন্দ্রে রেখেই গ্রাহ্য হওয়া উচিত – এই বোধের প্রশ্নে রয়ে যাচ্ছে সমস্যা। নয়তো তাড়না থাকছে আগামী বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দুর্ভাবনায়। যদি বিজেপির জম্মু ও কাশ্মীর পলিসির বিরুদ্ধে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ধাক্কা খেতে হয়! অথবা বিজেপির কাশ্মীর পলিসির পক্ষে দাঁড়ানোর মাধ্যমে এনডিএ-র ঘনিষ্ট হতে চাওয়ার আভাস ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে কি?

২০১৯ নভেম্বর থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোট ১৬ টি রাজ্যে রয়েছে বিধানসভা নির্বাচনের পালা। রাজ্যগুলো দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল- পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি গণতন্ত্র ও জীবন-জীবিকার প্রশ্নে জর্জরিত ঘনীভূত হয়ে ওঠা সংকটকে মোকাবিলা করতে হাতিয়ার করেছিল পুলওয়ামা ও বালাকোট নির্ভর পাক-বিরোধী উগ্র জাতিয়তাবাদের জিগিরের ওপর। তার দৌলতে ক্ষমতায় ফেরার উদ্দেশ্য পূরণ হলেও সংকটের কারণগুলো রয়ে গেছে, আর সেগুলো আগামী পরের পর বিধানসভা নির্বাচনে তাড়া করতে থাকবেই। একে মোকাবিলা করতে মোদী সরকার জনমুখী সংস্কার-কার্যক্রম নেওয়ার পক্ষপাতী নয়, বাজেটে যথেচ্ছ বরাদ্দ ছাঁটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ, তাই ফের চাগিয়ে তুলছে উগ্র জাতীয়তাবাদের জিগির। এবার উপলক্ষ বানাচ্ছে কাশ্মীরকে। ৩৭০ ও ৩৫এ ধারার বিলোপের। এটা বিজেপির লোকসভা নির্বাচনী ঘোষণাপত্রেও ছিল। আর দেরী না করে নিজের হাওয়া ধরে রাখতে শুরু করল অপারেশান। গণতন্ত্রীকরণ, বিকেন্দ্রীকরণ ও যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ যখন যুগের ডাকে সাড়া দেওয়ার সাধারণ প্রবণতা হওয়া উচিত; যখন জনগণের হাতে ক্ষমতা, রাজ্যগুলির হাতে আরও ক্ষমতা, রাজ্যের মধ্যে রাজ্য গঠনের, কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলিকে রাজ্যস্তরের মর্যাদায় উন্নীত করার দাবিসমূহই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত; তখন মোদী-শা জমানা নিচ্ছে উল্টাপূরাণের পথ, ক্ষমতার অতি কেন্দ্রীকরণের পদক্ষেপ। জম্মু ও কাশ্মীরে সংবিধান স্বীকৃত ক্ষমতার অংশিদারী ও স্বাধিকারের যে বিশেষত্ব এযাবৎকাল অনুসৃত হয়ে এসেছে তোষণের অবসানকরণের নামে এক ঝটকায় কেড়ে নেওয়াটা ফ্যাসিবাদী আচরণই। স্তোকবাক্য দেওয়া হচ্ছে, যা কিছু করা হল তা উপত্যকায় ‘উন্নয়ন ও শান্তি’ ফেরানোর উদ্দেশ্যেই! এখানেই ধরা পড়ে ফ্যাসিবাদী চাতুরি। সাধারণভাবে বাকি ভারতে, বিশেষত উপত্যকার রাজ্যে প্রথম পর্বেমোদী জমানা কেমন ‘উন্নয়ন-শান্তি’ উপহার দিয়েছে সে তো বোঝাই গেছে। কালা অপারেশান নামিয়ে কাশ্মীরের অর্থনীতির বনিয়াদ পর্যটন অর্থনীতির সর্বনাশ করল। এই সময়ে তীব্র বেকারিতে জর্জরিত অসংগঠিত মজদুরবাহিনীর যে পরিযায়ী স্রোত রুটি-রুজির আশায় ঢোকে উপত্যকায় তারও রাস্তা হয়ে গেল বন্ধ।

কর্পোরেট মহল মোদী সরকারের কাশ্মীর কর্তনের পদক্ষেপকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে স্বাগত জানিয়েছে। ওদের মুখেও সেই একই ধোঁকাবাজির গল্প। ‘উন্নয়নের’ জন্য নাকি লগ্নির নয়া রাস্তা খুলে যাবে! আসলে কাশ্মীরের জল-স্থল লুণ্ঠনের আর বাজার দখলের ওপরেই রয়েছে শ্যেনদৃষ্টি। রতনে রতন চেনে। সরকার-কর্পোরেট আঁতাত মুখিয়ে থাকবে তাদের স্বর্গরাজ্য রচনায়।

প্রতিবাদ উঠছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, ক্ষোভ-বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে অবরুদ্ধ কাশ্মীরের ভেতর থেকেও। সব দেখে মোদী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের নামে আরও একবার শোনালেন শা কথিত ‘জুমলা’ : ‘কাশ্মীরে উন্নয়ন-ভোট সব হবে’, ‘রাজ্যের মর্যাদাও ফিরে পাবে’, চুপ থাকলেন বিলোপের বিল প্রত্যাহারের গণদাবি প্রসঙ্গে। তাই পাল্টা সোচ্চার হতে হবে : ফিরিয়ে দাও উপত্যকার রাজ্যের অধিকার ।

খণ্ড-26