সত্যি, দেখে মনে হচ্ছিল অধিকৃত ইরাক অথবা অধিকৃত প্যালেস্টাইন : কাশ্মীরে সরকার শিশুদের গ্রেফতার করছে
গত ৫ আগস্ট কেন্দ্রের বিজেপি পরিচালিত মোদী সরকার জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল ও রাজ্যটিকে দু’টুকরো করে, রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার পর চারজনের একটি তথ্যানুসন্ধানী দল কাশ্মীরে যায়। দলটি ৯-১৩ আগস্ট, ইন্টারনেট ও ফোন পরিষেবা- বিচ্ছিন্ন অবরুদ্ধ কাশ্মীরের প্রকৃত অবস্থা খতিয়ে দেখে।
দলের অন্যতম সদস্য কবিতা কৃষ্ণাণ ‘হাফপোস্ট ইন্ডিয়া’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই ভয়াবহ পর্যবেক্ষণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। দেশব্রতীর পাতায় প্রকাশ করা হল।

আপনারা কী দেখেছিলেন?

পরিস্থিতি একেবারে ভয়াবহ। কাশ্মীর সামরিক বাহিনীর দখলে। প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি বাড়ির সামনে, প্রত্যেকটি মহল্লার মুখে আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। অবস্থাটা সত্যিই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কারও কোনো কথা বলার সুযোগ নেই, নেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সুযোগ ।

ঈদের দিন ছিল জনমানবশূন্য। ছোট্ট বাচ্চারা ছাড়া কেউ উৎসবের পোশাক পরেনি। গ্রামাঞ্চলে কেউ মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা জানাতে পারেনি। আজানের অনুমতি ছিল না,তাই বাড়িতেই তাদের শুধু নামাজটুকু পড়ে ক্ষান্ত থাকতে হয়েছে। মানুষ ক্ষুব্ধ, তারা মনে করছে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। রয়েছে অসহায়তা, হতাশা।

কাশ্মীর উপত্যকায় আমরা একজনকেও খুঁজে পাইনি যে এই সিদ্ধান্তে খুশি। সংবাদমাধ্যমের প্রচারে তারা হতাশ। তারা বলছেন, মিডিয়ায় বলা হচ্ছে : ‘প্রত্যেকে বলছে, কাশ্মীরের জন্য এটা অনেক বড় ব্যাপার’ — কিন্তু বিয়েটা কার হচ্ছে আর কেই বা উৎসব করছে? ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিয়েটা আমাদের, অন্তত একবার তো আমাদের জিজ্ঞাসা করো আমরা খুশি হয়েছি কিনা? কেউ জানতে চাইছে না আমরা কী ভাবছি — এটা কেমন করে হয়?’ এটাকে কাশ্মীরী জনতার প্রতি অবমাননা এবং বিদ্বেষ বলেই মনে করা হচ্ছে।

taxi stand

কীরকম কার্ফিউ?

আমি আপনাকে বলতে পারি, এই কার্ফিউ সম্পূর্ণ এবং সর্বাত্মক। এমনকি আমরা যেখানে ছিলাম, শ্রীনগরের একটা জমজমাট বাজার অঞ্চল সেই রাজবাগের রাস্তায়ও। ঈদের দিনেও সেখানে ছিল সম্পূর্ণ কার্ফিউ। কাশ্মীরের মানুষের উপলব্ধি যে এটা কাশ্মীরের জনসাধারণের উপর একটা আক্রমণ এবং আগ্রাসন।

আপনারা কি কাশ্মীরী পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলেছেন?

হ্যাঁ, বলেছি। আমরা বেশ কয়েকজন কাশ্মীরী পণ্ডিতের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের একজনের কথোপকথন ভিডিও করেও রাখা হয়েছে। তিনি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন কাশ্মীরীয়াত একটা বিষয় আর তার অর্থ ঈদ উদযাপন। একজন পণ্ডিত হয়ে তিনি বলেছেন ‘আমাদের ঈদের উৎসব আসন্ন।’ আমরা শিখদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা হিন্দু পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা সকলেই নিরাপত্তা এবং যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে প্রত্যেকে রয়েছেন তার কথা বলেছেন।

মোদী সরকার বলেছে যে কাশ্মীর মোটের উপর শান্ত, তবে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রতিবাদের ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে জড়িত আছে অল্প কিছু মানুষ। তারা বিবিসি’র একটি ভিডিও ফুটেজ, যেখানে সৌরা-তে একটি বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ দেখানো হয়েছে তা উড়িয়ে দিয়েছে।

হ্যাঁ, কিন্তু তারা প্রতিবাদ করতে দিচ্ছে না। আমি মানছি, বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিবাদ হয়েছে। শ্রীনগরের কাছে সৌরা-তে একটি বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। এই সংবাদটি সঠিক ছিল। এটা অনেক বড় বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল। আমরা কয়েকজন পেলেট আক্রমণের শিকার হওয়া মানুষের সাথেও দেখা করি। তারা প্রতিবাদী ছিল না, সেখানে দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিল। আমরা ঐসব ছেলেদের সঙ্গেও দেখা করি। তোমরা মানুষের কণ্ঠরোধ করে, তাদের বেঁধে রেখে বলতে পারো না যে কোনো প্রতিবাদ নেই!

আমরা কাশ্মীরের গ্রামের মানুষদের সাথে দেখা করেছি, যেখানে ছোট্ট বাচ্চাদের — (ব্যবহারের মতো অন্য কোনো শব্দ পাচ্ছি না) — হ্যাঁ, পুলিশ জোর করে ‘অপহরণ’ করে নিয়ে গেছে। মাঝ রাতে তাদের বাড়িতে হানা দিয়ে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে গেছে এবং তাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য অবৈধভাবে, হয় সামরিক বাহিনীর ছাউনিতে আর নয়তো থানায় আটকে রাখা হয়েছে। তাদের মারাধর করা হচ্ছে। তারা ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাবে, না ফিরে আসবে, কিছুই জানার কোনো উপায় নেই তাদের অভিভাবকদের। কোনো গ্রেফতার নথিভুক্ত হয়নি, কোনো এফআইআর নেই। আমি বলতে পারি, যেসব গ্রামে আমরা গিয়েছি তার প্রত্যেকটিতে এমন গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে।

আপনি বলছেন যে সপ্তম শ্রেণীর একটি ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল?

একজনকে নয়। আমরা সপ্তম শ্রেণীর যে ছেলেটিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তার সাথে দেখা করেছি। সে আমাদের বলেছে যে সেখানে আরও বাচ্চারা আটক আছে — তার চেয়ে ছোট — যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং এখনও আটকে রাখা হয়েছে। পুরো সন্ত্রাস চলছে।

এত ছোট বাচ্চাদের কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়ে যাচ্ছে কেন?

ভয় দেখানোর জন্য। তাদের বাবা মায়েরা আমাদের নিশ্চিত করে বলেছেন, তারা পাথর ছোঁড়েনি। তারা বলেছেন, ওদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কখনও মসজিদে যাওয়ার সময়, কখনও বাড়ি থেকে আবার কখনও গভীর রাতে বিছানা থেকে। এই ব্যাপারটাই ঘটছে — রাতে বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে ছোট ছেলেদের তুলে নিয়ে যাওয়া। এটা প্রচণ্ড ভয় সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে। মেয়েরা আমাদের চুপি চুপি বলেছে, এইসব হানার সময় ওদের শ্লীলতাহানি করা হয়েছে। আমরা যে গ্রামগুলোতে গিয়েছিলাম — প্রত্যেকটিতে একই কাহিনি। আমার প্রশ্ন হলো, ভারতীয় মিডিয়া কী করছে? কেন তারা এই জায়গাগুলো ঘুরে দেখছে না? আমরা তাদের দেখাতে পারতাম।

এটা অত্যন্ত খারাপ খবর এবং গুরুতর অভিযোগ। আপনারা কি প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন?

হ্যাঁ । আমরা পরিবারের সদস্যদের এবং একটি ছেলে যে আগের দিন ছাড়া পেয়েছে তার সঙ্গে কথোপকথনের ভিডিও রেখেছি। আমাদের কাছে ভিডিও তথ্য আছে।

eid

আপনি কি আরেকটু বিশদ ভাবে বলবেন?

আমি আপনাকে দুটো বিষয় বলছি। একটি ভিডিও এগারো বছরের একটি ছেলেকে নিয়ে — যে ঈদের আগের দিন ছাড়া পেয়েছিল। সে বলেছে তাকে পাঁচ তারিখ থেকে কাস্টডিতে রাখা হয়েছিল এবং মারা হয়েছিল। কাস্টডিতে তার চেয়েও ছোট বাচ্চারা ছিল। তারপর আমরা পরিবারের সদস্যদের ভিডিও তুলি। তবে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে কারণ তারা শঙ্কিত ছিল। তাদের নাবালক ছেলেকে গভীর রাতে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এখনও অবৈধভাবে আটকে রাখা হয়েছে। তারা থানায় গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে তাদের বলা হয় ‘এটা আমাদের হাতে নেই, আমরা কিছুই করতে পারবো না’ — এই বলে তাদের চরম বিভ্রান্তিতে রাখা হয়েছে। তারা সত্যিই ভীত কারণ তাদের বাচ্চার গ্রেফতারের কোনো নথি নেই। আগামীকাল যদি তার কিছু ঘটে যায় বা যদি সে স্রেফ ‘উবে’ যায়, এমন কোনও নথিই নেই যে প্রমাণ করা যাবে সে আদৌ গ্রেফতার হয়েছিল। আমরা সেটা রেকর্ড করেছি। আমার প্রশ্ন, ভারতীয় মিডিয়া কী করছে? কেন তারা ঐ জায়গাগুলোতে যাচ্ছে না?

আপনি যে গ্রেফতারগুলির কথা বললেন সেগুলি কারা করেছে — পুলিশ না সিআরপিএফ (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স)?

আমাদের বলা হয়েছিল — পুলিশ এবং তার সঙ্গে সামরিক বাহিনীও। আমরা থানায় যাইনি কারণ তারা আমাদের অনুনয় করেছিলেন যেন আমরা না যাই। তারা দ্বিধায় ছিলেন। একদিকে চাইছিলেন কেউ হস্তক্ষেপ করুক, আবার ভয় পাচ্ছিলেন যে এর ফলে হয়তো তাদের ছেলেদের জীবন আরও বিপন্ন হবে। তারা বলেছিলেন ‘আমাদের দুরাশা ওরা নিরাপদে ফিরে আসবে, কিন্তু দয়া করে এক্ষুনি কোনো এনকোয়ারি করবেন না।’ এমনকি তারা এটাও জানেন না ঠিক কোথায় বাচ্চাগুলিকে রাখা হয়েছে। তাদের অনুমান — ওদের কাউকে কাউকে হয়তো থানায় রাখা হয়েছে, বাকিদের আর্মিক্যাম্পে, যেগুলো গ্রামের কাছাকাছি। তারা বলছেন, পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর এই বেআইনিভাবে আটক রাখাটা একটা অপরাধ। এবং কাশ্মীরের ইতিহাস সাপেক্ষে — এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। আমরা জানি কাশ্মীরে ঘটেছে গণকবর, কাস্টডিতে গণহত্যা, গণনিখোঁজের ঘটনাগুলো।

ফিরে আসি সৌরা-র প্রতিবাদে। আপনারা সেখানে মানুষের সাথে কথা বলতে পেরেছিলেন?

আমরা সৌরাতে যেতে পারিনি কারণ পুলিশ আমাদের অনুমতি দিত না, কিন্তু আমরা শ্রীনগরের এসএমএইচএস (শ্রী মহারাজা হরি সিং) হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে ছররা (পেলেট গান) বন্দুকে মারাত্মক আহত দু’জন ভর্তি ছিলেন। তাদের চোখে মুখে হাতে এবং শরীরে আঘাত রয়েছে। আমরা তাদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। আমরা ওদের থেকে জানতে পারি, এটা ঘটেছিল সৌরাতে, আগের দিন। এবং আরও অনেকে আহত হয়ে ভর্তি আছেন সৌরা-র স্কিন হসপিটালে। আমরা সৌরাতে যেতে চেয়েছিলাম আর তখনই যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম। কিন্তু আধা সামরিক বাহিনী আমাদের যেতে দিল না। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি বলব, ভারতীয় মিডিয়ায় ওখানে মোতায়েন মিলিটারি এবং প্যারামিলিটারির যে সংখ্যা দেখানো হয়েছে তা আসল সংখ্যার চেয়ে কম। আমাদের মতে, এটা অনেক অনেক অনেক অনেক বেশি। প্রতিটি কাশ্মীরীর জন্য চারজন করে সিআরপিএফ জওয়ান সেখানে রয়েছে। প্রতিটি জায়গায়, সর্বত্র সিআরপিএফ থিকথিক করছে। কাশ্মীরে একটা রাস্তাও নেই যেখানে সিআরপিএফ নেই। প্রত্যেকটা বাড়ির বাইরেও মোতায়েন রয়েছে। অসহ্য।

crpf

কাশ্মীরে একটা রাস্তাও নেই যেখানে সিআরপিএফ নেই। সুতরাং আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে সৌরা-র প্রতিবাদ ছিল বিশাল?

এটা যে বিশাল ছিল, তা নিশ্চিত। সমস্ত স্তরের মানুষের প্রতিবাদ চলছিল। পরের দিন, আমরা যখন সৌরা-র পথে, পুলিশ আমাদের থামিয়ে দিল। কিন্তু পুলিশ আমাদের যেখানে থামিয়েছিল সেখান থেকেই আমরা দেখতে পেলাম কম বয়সী ছেলেরা কিশোররা রাস্তায় প্রতিবাদ করছে এবং সিআরপিএফ তাদের রাস্তা থেকে সরাতে পারছে না। আমরা ঐ ছেলেদের আর ঐ প্রতিবাদের ছবি নিলাম। মানুষের বিবৃতির ভিডিও নিলাম যা খুব পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিল মানুষ কী প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ আর হতাশ। তারা বলছিল ‘আমাদের সঙ্গে কয়েদিদের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের সঙ্গে ক্রীতদাসদের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।’ সর্বত্র এই দমন। ‘তোমরা আমাদের বাড়িগুলোকে জেলখানা বানিয়ে দিয়েছ, আমাদের গ্রামগুলোকে জেলখানা বানিয়ে দিয়েছ।’ ঈদ উপলক্ষে মানুষজন একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না। ঈদে পাশাপাশি গ্রামগুলোর ভাই বোনেরা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না। ভবিষ্যতে কী হবে তাই নিয়ে প্রচুর ক্ষোভ আর অশুভ আশঙ্কা রয়েছে ।

তোমরা মানুষের প্রতিবাদের কোনো শান্তিপূর্ণ পথ খোলা রাখোনি। সর্বত্রই যদি কার্ফিউ থাকে তবে মানুষ কোথায় প্রতিবাদ জানাবে! পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ঘটছে কারণ তোমরা প্রতিবাদের অন্য সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছ। তাই, কেবলমাত্র যারা মরিয়া বেপরোয়া আর চরমতম খারাপ কিছুর জন্য তৈরি, তারাই যাচ্ছে — ‘যতদূর পারো সর্বনাশ করো, আমরা তবুও পথে রয়েছি।’ তারা সংখ্যায় কম। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে চায়। তারা শান্তিপূর্ণ মিছিল করতে চায়,তারা বলতে চায়, তারা মানুষের সামনে হাজির হতে চায়। দেখা দিতে চায়। যদি আপনারা কার্ফিউ তুলতেন, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, শ্রীনগর এবং অন্যত্র বিশাল শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশ হোত। কিন্তু তার কোনো সুযোগ নেই।

karfu

কার্ফিউ উঠে গেলে, শান্তিপূর্ণ নয়, বিশাল হিংসাত্মক প্রতিবাদই হোত না কি?

তাহলে তাদেরও মিথ্যে বলা উচিত নয়। তাদের বলা উচিত ‘আমরা জানি এটা জনপ্রিয় নয়’ তাদের বলা উচিত ‘আমরা এটা করেছি প্রতিটি কাশ্মীরীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আর তাই আমরা তাদের কণ্ঠরোধ করে, তাদের বেঁধে রেখেছি। কারণ আমরা তাদের দখল করে রেখেছি এবং আমরা চাই না তারা কথা বলুক।’ সেটা বলো। কেন বলছ তারা সবাই খুব খুশি, তারা সবাই এটাকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং সব কিছু ঠিক আছে? ভারত সরকারের মিথ্যা বলা উচিত নয়। প্রত্যেকে খুশি — এটা বলবেন না। কেউ খুশি নয়। প্রত্যেকে ভীষণভাবে কষ্ট পাচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে ঈদের মধ্যে এটা করার পিছনে কোনো নির্দিষ্ট দুরভিসন্ধি আছে। তারা বলছে ‘আমাদের বছরে মাত্র দুটো উৎসব। আর তারা এই উৎসবে আঘাত হেনেছে এবং আমাদের উৎসবের আনন্দকে সম্পূর্ণ নিভিয়ে দিয়েছে।’ আমরা কোথাও উৎসবের আবহাওয়া দেখতে পাইনি। সাত বা আটের শিশু ছাড়া কোনো ছেলেমেয়েদের গায়ে উৎসবের জামা ওঠেনি।

কাশ্মীরীরা কীভাবে আপনাদের তথ্যানুসন্ধানের কাজে সাড়া দিয়েছে?

আমরা উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছি। আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না কতটা উষ্ণ আর আতিথ্যভরা ছিল সেই অভ্যর্থনা! আমরা দারুণ অভিভূত হয়েছিলাম। এই রকম একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ওখানকার মানুষদের ভারত এবং ভারতীয়দের বিরুদ্ধে রাগ থাকার যথেষ্ট কারণ ছিল। অবশ্যই তারা সন্দিগ্ধ হতে পারতেন। তারা আমাদের জিজ্ঞাসা করতেই পারতেন, আমরা ভারত সরকারের পক্ষ থেকে, না, মিডিয়ার থেকে আসছি। তারা বলতেই পারতেন ‘তোমরা মানবাধিকার কর্মীরা, আমাদের জন্য কখনোই কিছু করোনি। তারা দিল্লিতে সত্যি কথাটা বলতে ভরসা পাননি।

সেসব সত্ত্বেও, তাদের সামান্য সরবরাহ থেকেই আমাদের এক কাপ চা না খাইয়ে কখনও ছাড়েননি। দোকানিরা তাদের ভাঁড়ার খুঁজে জুসের প্যাকেট নিয়ে আসতেন। তারা আমাদের সাদরে ভিতরে নিয়ে যেতেন এবং দুপুরে খাওয়াতেন। এই রকম উষ্ণ অভ্যর্থনাই আমরা সব জায়গায় পেয়েছি। এরা ভারতীয় জনসাধারণের প্রতি বিদ্বেষহীন মানুষ। তাদের রাগ মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে। এটা ভারতীয় মিডিয়ার তুলে ধরা উচিত। তাদের সেখানকার প্রকৃত সত্য তুলে ধরা উচিত। ওদের মনুষ্যত্ব বোধ আছে, ওদের ভারতীয় জনতার প্রতি কোন রাগ নেই। ওদের রাগ মোদী সরকারের নীতির বিরুদ্ধে।

আগে কেবল টিভি বন্ধ ছিল। এখন চলছে?

এখন কেবল টিভি চালু আছে তবে কোন স্থানীয় কাশ্মীরী চ্যানেল পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কেবল নয়াদিল্লির মতো জাতীয় চ্যানেলগুলো দেখতে পাচ্ছে। স্থানীয় কাশ্মীরী সাংবাদিকরা অনেক লড়াই করছেন। তারা কয়েক দিন কাগজ বের করতে পেরেছিলেন কিন্তু এখন ১৭ তারিখ পর্যন্ত তাদের অফিস বন্ধ। তারা বলছেন, ‘আমরা এখনও পর্যন্ত প্রতিদিন যে ভাবে হোক কাগজ ছাপতে পারছি কিন্তু সেনারা এসে আমাদের জিজ্ঞাসা করবে,’ কেন ছাপছো? কীভাবে ছাপছো? কোত্থেকে খবর পাচ্ছ? ইন্টারনেট যখন নেই, তোমরা কী করে ছাপতে পারছো? তোমরা সংবাদ সংস্থার খবর পেতে পারবে না’। তাদের কেউ কেউ এত সব সত্ত্বেও ভেসে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু স্থানীয় কাশ্মীরী চ্যানেলগুলো কিছুই করতে পারছে না। তারা বলছেন যে আমরা কাগজ ছাপতে পারছি না কারণ নিউজপ্রিন্ট আসে দিল্লি থেকে।

eid

শ্রীনগর সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। শ্রীনগরের বাইরে কী অবস্থা?

আরও আরও খারাপ। ঈদের আগে কার্ফিউ সামান্য শিথিল হয়েছিল, কিন্তু খুবই সামান্য আর খুব কম সময়ের জন্য। লোকজন ঈদের কেনাকাটার জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছিলো। ভেড়া বিক্রি হয়নি। ভেড়া ব্যবসায়ীদের এক বছরের প্রস্তুতি জলে গেল। লোকের হাতে কেনার মতো টাকাই নেই। গ্রামের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। সেখানে লাগামছাড়া গ্রেফতার চলছে, যে কোনো রাজনৈতিক দলের, তা সে যত ছোট হোক, একটি কর্মীকেও ছাড়া হচ্ছে না। ছোট ছেলেদের কিশোরদের ব্যাপকভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এইটুকু আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি।

এগুলো সব গ্রাম আর ছোট শহরের অবস্থা?

হ্যাঁ, গ্রাম আর ছোট শহর। আমরা সোপোর আর বান্দিপোরায় গিয়েছিলাম যেমন গিয়েছি শ্রীনগর আর সোপোর এবং সোপোর আর বান্দিপোরার মাঝের গ্রামগুলোতে। আমরা দক্ষিণ কাশ্মীরের গ্রামগুলিতে গিয়েছি, গিয়েছি অনন্তনাগ, শোপিয়ান, পাম্পোরায়।

check post

এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে মানুষ কীভাবে চলছে? আপনারাই বা এর মধ্যে কীভাবে কাজ চালালেন?

যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ। আমরা কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। পুলিশ অফিসারদের ঘিরে লাইন পড়ে যায়। যদি কোনো পুলিশের কাছে ফোন থাকে লোকজন তার পাশে জড়ো হয়ে যায় সন্ধ্যাবেলায় এই আশায় যে কাশ্মীরের বাইরে কোনো প্রিয়জনের সঙ্গে একবারটি যদি কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায়। কাশ্মীরের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। কেউ হয়তো শ্রীনগরে আছে, তার পরিবারকে গ্রামে রেখে এসেছে, বাড়ির সকলের কুশল জানার কোনো উপায় নেই তার। একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা। এমনকি এইসব জায়গার দিকে যে রাস্তাগুলো গিয়েছে তার সর্বত্র অসংখ্য চেকপয়েন্ট আছে। প্যারামিলিটারির বিরাট বিরাট কনভয় চলেছে। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমি খোলাখুলিই বলছি, দেখে মনে হত যেন অধিকৃত ইরাক বা অধিকৃত প্যালেস্টাইন। কাশ্মীরে উন্নয়নের ঘাটতি নেই, অভাব গণতন্ত্রের।

যদি কোনো পুলিশের কাছে ফোন থাকে মানুষ সন্ধ্যায় তাকে ঘিরে ধরে — এটা শেষ হতে চলেছে এমনটা মানুষ ভাবছে?

আমি মনে করি কেউ এর শেষ দেখতে পাচ্ছে না। তারা বরং ভাবছে এটা থেকেই যাবে। তাদের আশা নিয়ন্ত্রণ সামান্য উঠবে।

gas

অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য পণ্যের সরবরাহের কী অবস্থা?

৯ আগস্ট পর্যন্ত, এমনকি দুধ পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিল না। শিশুরা দুধ পাচ্ছিল না। একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা চলছিল। ১০ তারিখের পর, কয়েক ঘন্টার জন্য কার্ফিউ সামান্য শিথিল করা হলে মানুষ বেরিয়ে এসে অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করে নেয়। প্রতিটি জিনিস অনিশ্চিত। সব দোকান বন্ধ। এখানে সেখানে খুব সামান্য সময়ের জন্য হয়তো সেগুলো খোলে। সামান্য কয়েকটা এটিএম খোলা আছে। আরেকটা সমস্যা হল — মানুষ আয় করতে পারছে না। তাই তাদের খাবার কেনার পয়সাও নেই। বিহার ও উত্তর প্রদেশের মতো অন্য রাজ্যগুলো থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদেরও একই অবস্থা। তারা আমাদের বলেছেন, অন্য যে কোনো রাজ্য থেকে তারা কাশ্মীরে বেশি আয় করেছেন— দৈনিক ৬০০, ৭০০, ৮০০ টাকা — এটা অন্য রাজ্যগুলি থেকে বেশি। কাশ্মীরে উন্নয়নের ঘাটতি নেই, আছে গণতন্ত্রের অভাব।

plate attackহাসপাতালগুলির কী অবস্থা?

পেলেট আহতদের পরিস্থিতি সাংঘাতিক। পেলেট-আহত দু’জনকে আমরা দেখেছিলাম — জানি না কীভাবে বর্ণনা করব — ভয়াবহ! ক্ষতগুলি ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক। তাদের দৃষ্টিশক্তি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের গোটা মুখ পেলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত।

সাধারণভাবে রোগীরা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারছে না। বড় হাসপাতালগুলি বলছে ‘আমাদের স্টক আছে। কিন্তু কার্ফিউ-এর জন্য রোগীরা হাসপাতালে আসতে পারছেন না।’ আজ শ্রীনগরে এক অটো ড্রাইভারের সঙ্গে আমাদের দেখা হল। উনি হাঁপানি রোগী। তার জরুরি দুটি ওষুধ — অ্যাসফিলিন আর সালবুটামোল ফুরিয়ে গেছে। তিনি হন্যে হয়ে এদিক ওদিক ঘুরেছেন ওগুলো কেনার জন্য, কিন্তু ওষুধের দোকান বন্ধ। যে দু’একটি দোকান খোলা ছিল, তাদের স্টক শেষ। কয়েকটি হাসপাতালে ভালো স্টক আছে। কিন্তু তিনি বললেন, তিনি হয়তো এসব হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবেন না। সব জায়গায় তিনি যেতে পারেন না।

আর, পেলেট-আহতরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে যেতে পারেন না কারণ পুলিশ তাদের দেখলেই আটক করে কেস দিয়ে দেবে। সুতরাং তারা শুধুমাত্র ছররা বন্দুকের শিকার নন, কেসের আতঙ্কও তাদের তাড়া করে ফিরবে সারা জীবন।

ভাষান্তর : জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-26
সংখ্যা-25