‘ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে আশা ও আশঙ্কা’ — অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আইজাক চটিনার: গত পাঁচ বছরে ভারত যেদিকে মোড় নিয়েছে, তা লক্ষ্য করে আপনি কি এখন ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং এর সংবিধান সম্পর্কে ভিন্নভাবে চিন্তা করছেন? নাকি এসব একেবারেই পরবর্তীকালের উপলব্ধি?

অমর্ত্য সেন: আমার মনে হয়, একদমই পরবর্তীকালের উপলব্ধি। ভারতের সংবিধান সভার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, ভারতীয় সংবিধান যথেষ্ট ভালো ছিল। সংবিধান কেমন হওয়া উচিত, সংবিধান সভায় সে বিষয়ে খুব ভালো আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছিল। তবে আমার মনে হয়, সংবিধান সভা ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও একটা বিষয় বিবেচনায় রাখেনি। সেটা হল, যদি কখনো কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা দল, আন্দোলন বিপুল জনসমর্থন নিয়ে বেরিয়ে আসে, ভারতের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, তাহলে তারা সেটাকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। আমার মনে হচ্ছে, ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এই ব্যাপারে ভীষণ মন্থর ও বিভক্ত। তা ছাড়া সুপ্রীম কোর্ট ভালো কাজ যা-ই করে থাকুন না কেন, বহুত্ববাদের দেখভাল যেভাবে করতে পারতেন, সেভাবে পারেননি।

আজ সবকিছুতেই উন্নাসিক, কট্টর হিন্দুত্ববাদী চিন্তাভাবনার আধিপত্য। আজ ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও নেতারা সবাই হিন্দু। কিন্তু ধরা যাক, আজ থেকে ১২ বছর আগে, ২০০৭ সালে রাষ্ট্রপতি ছিলেন একজন মুসলমান, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শিখ এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেতা ছিলেন খ্রিষ্টান। সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁরা নিজেদের চিন্তাভাবনা অন্য সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু আজকে আমরা এমন অবস্থানে পৌঁছে গেছি যে একজন মুসলমানকে গরু খাওয়ার জন্য নির্যাতন করা হচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি প্রাচীন সংস্কৃত লেখাপত্রের দিকে তাকান, যেমন বেদের দিকে, তাহলে দেখবেন, সেখানে গরু খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল না। সুতরাং বলা যায়, স্বাধীনতার পরের ভারতে শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রেরই অবক্ষয় ঘটেনি, হিন্দু ভারতের ঐতিহ্য সম্পর্কে বোধেরও অবক্ষয় ঘটেছে।

আমরা এই সত্যও উপেক্ষা করে যাচ্ছি যে প্রাচ্য জগতে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল; খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের আন্তরাজ্য যোগাযোগের অন্যতম ভাষা ছিল সংস্কৃত। এর কারণ ছিল বৌদ্ধচিন্তার প্রভাব। এক হাজার বছর ধরে ভারত ছিল একটা বৌদ্ধ দেশ। এটাও আমাদের ঐতিহ্য।

পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল নালন্দা; এর শুরু হয়েছিল পঞ্চম শতাব্দীতে। সেখানে শুধু ভারতীয় ছাত্ররাই পড়ত না; চীন, জাপান, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকেও ছাত্ররা নালন্দায় পড়তে আসত। আমরা যখন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সহযোগিতায় সেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলাম, তখন ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার এটাকে আর কোনো বিশিষ্ট বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হতে দিল না; ক্রমেই এটাকে একটা হিন্দু প্রতিষ্ঠানের মতো চেহারা দেওয়া হল। আমি নিজেও একজন হিন্দু [হাসি]। হিন্দুধর্ম নিয়ে আমার কোনোই আপত্তি নেই। আসলে, অদ্ভুত লাগবে শুনতে, আমার বয়স যখন কম ছিল, তখন প্রকাশনা সংস্থা পেঙ্গুইন আমার ঠাকুরদাকে হিন্দুধর্ম নিয়ে একটা বই লিখতে বলেছিল। ঠাকুরদা বইটা লিখেছিলেন, তাঁর ইংরেজি জ্ঞান ছিল সীমিত; তাই আমাকে সে বইটা সম্পাদনা ও অনুবাদ করতে হয়েছিল। আমার প্রথম সম্পাদিত ও অনূদিত বইটাই ছিল হিন্দুধর্ম সম্পর্কে একটা বই। ঠাকুরদা সব সময় বলতেন, নেহরুর আমলে ভারতের সমস্যা হল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সহিষ্ণুতার কথাই শুধু বলা হয়, কিন্তু সহিষ্ণুতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে কাজ করা।

আইজাক চটিনার: আমি লক্ষ্য করেছি, একজন মানুষের বহুমুখী পরিচয়ের বিষয়টা আপনার লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে আসে ...।

অমর্ত্য সেন: একদম ঠিক। এটা খুবই কেন্দ্রীয় বিষয়। আর আপনি যদি এটা নিয়ে ভাবেন, দেখবেন, অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে। একসময় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ভারতের চেয়ে কম ছিল। কিন্তু এখন বাংলাদেশের গড় আয়ু ভারতের চেয়ে পাঁচ বছর বেশি। আর হিন্দুত্ববাদী চিন্তায় যে ধরনের সংকীর্ণতা আছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের চিন্তায় সেই রকমের সংকীর্ণতা নেই। আমার মনে হয়, বহুমুখী পরিচয় বাংলাদেশের জন্য অনেক উপকারী হয়েছে। ভারতে যত দিন পর্যন্ত বহুমুখী পরিচয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংকুচিত করার চেষ্টা ছিল না, তত দিন সে দেশেও পরিস্থিতি বাংলাদেশের মতোই ছিল। আরও আগেও সেটা ছিল। ১৯২০–এর দশকে বেশ শক্তিশালী একটা হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন ছিল। ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) এক সদস্য মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। সেই আরএসএসই আজকের বিজেপিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু তখন তারা ক্ষমতায় ছিল না; তারা ছিল একদম প্রান্তিক একটা শক্তি, তাদের তরফ থেকে আমরা কোনো হুমকি অনুভব করিনি। সেই প্রান্তিক শক্তিই দিনে দিনে শক্তি সঞ্চয় করেছে, সর্বশেষ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। তাদের সে বিজয়ের আংশিক ভিত্তি ছিল হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক ফলপ্রসূতা।

বহুধর্মভিত্তিক, বহুজাতিগোষ্ঠীভিত্তিক ভারতের বিষয়ে মোদির দূরদৃষ্টি নেই। তিনি ছেলেবেলা থেকেই আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত, ওই গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি শক্তিশালী ও ভীষণভাবে সফল। ফলে নির্বাচনে মোদি একটা ফ্যাক্টর ছিল। তাদের বিপুল অঙ্কের অর্থও ছিল। তাদের প্রতি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বেশ বড় একটা অংশের সমর্থন ছিল। তাদের বড় অর্থদাতা হিসেবে পরিচিতি দু-তিনটা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নয়, পুরো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বেশ বড় অংশের সমর্থন তারা পেয়েছে। এতে আমি বেশ অবাক হয়েছি। নির্বাচনের সময় তারা অন্যান্য দলের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ ও অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। তারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জিতেছে বটে, কিন্তু নির্বাচনী ব্যবস্থাটা ত্রুটিপূর্ণ। মোদি যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন, সেটা মোট ভোটের ৪০ শতাংশের চেয়েও কম। এটা যে একটা ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থা, এমনকি আমেরিকার প্রেক্ষাপটেও, সে কথা আমি লিখেছি।

আইজাক চটিনার: হ্যাঁ, ট্রাম্প কিংবা এরদোগান, ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে যাঁদের বেশ কষ্ট করতে হয়েছে, মোদি তাঁদের তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয়; ভারতের বিপুলসংখ্যক মানুষ তাঁকে সমর্থন করে।

অমর্ত্য সেন: তা কিন্তু পরিষ্কার নয়। ভারতের লোকসংখ্যা ১০০ কোটির বেশি। তাদের মধ্যে ২০ কোটি মুসলমান। ২০ কোটি দলিত, বা যাদের বলা হয় অস্পৃশ্য। ১০ কোটি আছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, যাদের বলা হতো উপজাতি; ভারতে তাদের অবস্থা দলিতদের চেয়েও খারাপ। তা ছাড়া হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ আছে, যারা মোদিকে সমর্থন করে না। তাদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, অনেককে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে এটা বলা কঠিন যে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মোদিকে সমর্থন করে। সব সংবাদপত্র সরকারি বিজ্ঞাপন পায় না; আর যেসব সংবাদপত্রকে সরকার পছন্দ করে না, তারা সম্ভবত বেসরকারি বিজ্ঞাপনও বেশি পায় না। সরকারের সৃষ্টি করা নানা সমস্যার কারণে টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্রের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা ভীষণ কঠিন হয়ে উঠেছে।

জন স্টুয়ার্ট মিলের কাছ থেকে যে বড় জিনিসটা আমরা জেনেছি, তা হল, গণতন্ত্র মানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা। আপনি যদি আলাপ-আলোচনাকে ভীতির ব্যাপারে পরিণত করে তোলেন, তাহলে আপনি গণতন্ত্র পাবেন না, তা সে ভোট আপনি যেভাবেই গণনা করেন না কেন। এই কথাটা এখন ভীষণভাবে সত্য। মানুষ এখন কথা বলতে ভয় পায়। আমি আগে কখনো এরকম দেখিনি। কেউ যখন টেলিফোনে আমার সঙ্গে কথা বলার সময় সরকার সম্পর্কে সমালোচনামূলক কিছু বলে, তখন বলে, ‘এবিষয়ে সাক্ষাতে কথা বললেই ভালো হয়, কারণ কেউ নিশ্চিত আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছে।’ সত্যিকারের গণতন্ত্র এইভাবে চলে না। দেশের অধিকাংশ মানুষ কী চায়, তা বোঝার পন্থাও এটা নয়।

আইজাক চটিনার: মোদির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ আছে—এই কথা বলা, আর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ আছে—এই কথা বলার মধ্যে কি কোনো টানাপোড়েন আছে?

অমর্ত্য সেন: জনগণের মধ্যে যদি ভীতি কাজ না করত, তাহলে আরও বেশি থাকত।

আইজাক চটিনার: কিন্তু জনগণ যদি ভয় পেয়েই থাকে, তাহলে তো প্রশ্ন ওঠে, ভারতীয় গণতন্ত্র আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, আমরা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সম্পর্কে আগে যা ভাবতাম, এখন আর সেভাবে ভাবা চলে না। নাকি আপনি তা মনে করেন না?

অমর্ত্য সেন: আমি তা মনে করি। কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের সবটুকু শেষ হয়ে যায়নি। প্রথমত, ভারতে এমন কিছু সাহসী সংবাদপত্র আছে, যারা কিছু প্রকাশের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে না। সেরকম দু-একটা টিভি স্টেশন আছে, রেডিও স্টেশন আছে, জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভারত একটা ফেডারেল রাষ্ট্রও বটে। কয়েকটি রাজ্য আছে, যেখানে বিজেপি একমাত্র প্রধান শক্তি নয়।

আইজাক চটিনার: পশ্চিমবঙ্গ সহ আর।

অমর্ত্য সেন: তামিলনাড়ু ও কেরালাতেও নয়। আরও কয়েকটি অঞ্চল আছে, যেখানে বিজেপির একক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে আপত্তি আছে। একইভাবে আছে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট। সুপ্রীম কোর্টের ওপর আমার গভীর আস্থা আছে, কিন্তু কাজ করছে খুব মন্থরভাবে; কিছু বিচারক আছেন, যাঁরা সরকারের অভিপ্রায়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতে বেশি আগ্রহী। সুতরাং, ভারতে নানান গণতান্ত্রিক উপাদান রয়ে গেছে। অন্যদিকে, আমরা যদি দেখি, গত ১৫ বা ৩০ বছরে কি গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে। আমি বলব, হ্যাঁ, ঘটেছে। ১৯৭০–এর দশকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন জরুরি অবস্থা জারি করেন, তখন গণতন্ত্রের জন্য বিরাট হুমকি সৃষ্টি হয়েছিল বটে, কিন্তু তিনি সাধারণ নির্বাচনে গিয়েছিলেন এবং আমরা যেমন ভেবেছিলাম যে বিরোধী দলগুলো ভয়ভীতি ও বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হবে, সে রকম কিছু ঘটেনি এবং ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে হেরেছেন। তাই আমার মনে হয়, প্রতিরোধের কিছু উপাদান আছে, সেগুলো আরও শক্তিশালী হতে পারে। একটা গোষ্ঠী আছে, যাদের বলা হয় নকশাল, তাদেরকে মাওবাদী চরমপন্থী মনে করা হয়। কিছু লোক আছে, যাদেরকে নকশালপন্থী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। সুতরাং ভারতের রাজনৈতিক চিত্রটা মিশ্র। তবে আমরা যে উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক চিত্রটা সহজেই পেতে পারতাম, যা কিছু মাত্রায় অতীতে ছিল, এখন সেরকম নয়।

আইজাক চটিনার: নির্বাচনের পর আপনি লিখেছিলেন, ‘অনেকে হয়তো বলতে চাইবেন, বিজেপি কংগ্রেস দলের বিরুদ্ধে “ভাবাদর্শের লড়াইয়ে” জিতেছে। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদের দর্শনের বিজয় ঘটেনি, আর গান্ধী, নেহরু ও রবীন্দ্রনাথ যে সর্বজনের অংশগ্রহণভিত্তিক ঐক্যের ভাবধারার কথা বলতেন, তারও কোনো লক্ষণীয় অবক্ষয় ঘটেনি।’ আপনি কি ব্যাখ্যা করবেন, কী বোঝাতে চেয়েছেন, এবং সেটাই ভাবেন কি না?

অমর্ত্য সেন: আমি এখনো সেভাবেই ভাবি। কাশ্মীর বা এধরনের কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণকে উত্তেজিত করে তোলা খুবই সহজ। ভারতীয় শাসনব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাশ্মীর যে বিশেষ অধিকার ভোগ করে আসছিল, সেটা অব্যাহত না থাকার কোনো কারণই নেই। কিন্তু এর বিরুদ্ধে জনগণের সমর্থন বাড়ানো সহজ। সাধারণ নির্বাচনে সেটাই করা হয়েছে; ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডে মিসেস থ্যাচারের পক্ষে যেটা হয়েছে, ভারতের সাধারণ নির্বাচনেও মোদির পক্ষে সমর্থন বাড়াতে কাশ্মীর ইস্যুকেও সেভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। আপনার হয়তো মনে আছে, মিসেস থ্যাচার নির্বাচনে হেরে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই আসে ফকল্যান্ড যুদ্ধ।

আইজাক চটিনার: আমার জন্ম সেই বছরই, সুতরাং আমার মনে নেই। তবে হ্যাঁ, ‘ফকল্যান্ড ফ্যাক্টর’ কথাটা জানি।

অমর্ত্য সেন: ফকল্যান্ড যুদ্ধ ব্রিটিশদের মধ্যে পরিবর্তন এনেছিল, তারা জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিল। যদিও সেটা খুব বেশি দিন থাকেনি, তবু যত দিন ছিল, মিসেস থ্যাচারের বিপুল বিজয়ের জন্য সেটাই যথেষ্ট ছিল। এ বছর আরও আগের দিকে ভারতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দিকে যদি তাকান, দেখবেন, তাতে কয়েকটি বিষয় কাজ করেছিল। প্রবল প্রচার, ভীতি; ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যা চলছিল। ভারত সরকার দাবি করেছিল, পাকিস্তান ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা কনভয়ের ওপর নাশকতা করিয়েছে। যুদ্ধের চেয়েও বেশি খারাপ ছিল যুদ্ধ নিয়ে উন্মাদনা। এটা একটা প্রমাণ যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, কিন্তু আসলে ততটা জনপ্রিয় হয়নি, নির্বাচনের ফলাফল থেকে যতটা মনে হয়। ভারতের গ্রামাঞ্চলে যখনই দেখার চেষ্টা করা হয়েছে যে সংখ্যালঘুদের একদম গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় কি না, তখনই দেখা গেছে সেটা করার জন্য প্রবল আকাঙ্ক্ষা নেই। সংখ্যালঘুদের প্রতি একধরনের সহিষ্ণুতা আছে, এটা একটা প্রবল ঐতিহ্য, আজও এটা আছে।

আইজাক চটিনার: ভারত এমন কাউকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেনি, যিনি সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক জাতিগত সহিংসতায় নেতৃত্ব দেননি।

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ, এটা সত্য। মোদির একটা বড় সাফল্য হল, তাঁর বিরুদ্ধে ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে ২০০২ সালে গুজরাট হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে করা মামলা আদালতকে দিয়ে খারিজ করাতে পেরেছেন। তাই ভারতের অনেক মানুষ এটা বিশ্বাস করে না। ২০০২ সালে মোদি গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পরেই মুসলমানবিরোধী দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই দাঙ্গা রোধে ব্যর্থ হওয়া এবং দাঙ্গায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে মোদির বিরুদ্ধে মামলা হলে, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সে দেশে ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।

আমার মনে হচ্ছে, আপনি যদি বলতে চান যে ভারতে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারার বিজয় ঘটেছে, তাহলে তো প্রত্যেক মানুষের সত্য জানার সুযোগ অনেক বেড়ে যাওয়ার কথা। গণপরিসরে ব্যাপক আলোচনার সুযোগ, সংবাদপত্রের আরও স্বাধীনতা, টেলিভিশনের আরও স্বাধীনতা ভোগ করার কথা; কারও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভয় থাকত না। তাই আমি বলব না যে হিন্দুত্ববাদের জয় হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের ওপর ভয়ভীতি, সরকারি সেন্সরশিপ ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণের জুলুম যদি না থাকত এবং মোদি নির্বাচনে জিততেন, তাহলে আমি বলতাম যে হিন্দুত্ববাদের জয় হয়েছে।

(ক্রমশ)

খণ্ড-26
সংখ্যা-41