‘ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে আশা ও আশঙ্কা’— অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার
—(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আইজাক চটিনার: আমার মনে হয়, আরএসএস ভারতকে ভাবাদর্শগত বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘ সময় ধরে পোষণ করে আসছে।

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ। তারা এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে পেরেছে, যা বেশ কার্যকর। ‘ভারত দীর্ঘ সময় ধরে মুসলমান দখলদারদের অধীন ছিল, এখন আমাদের সময় এসেছে, তাদের চিরতরে ধ্বংস করতে হবে। আর যেহেতু দেশের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু, তাই সেটারই প্রতিফলন ঘটাতে হবে।’ কিন্তু আরএসএস লক্ষ্য করে না যে হিন্দু ইতিহাসে বিভিন্নমুখী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে অনেক সহিষ্ণুতা ছিল। তর্কপ্রিয় ভারত নামে আমার একটি বই আছে, সেখানে আলোচনা করেছি, কত ব্যাপক তর্কবিতর্ক ছিল। আরএসএস একটা ভাবাদর্শ তৈরি করে নিয়েছে, তারা সেটার প্রচার করে চলেছে এবং সেটা ভীষণ কার্যকর হয়ে উঠেছে। এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়; কিন্তু আমি মনে করি দুঃখের বিষয়টাকে বেশি বড় করে দেখানো ভুল হবে। কারণ, পরিস্থিতি এখনো আমাদের হাতেই আছে। আমি যখন ব্রিটিশ ভারতে বেড়ে উঠছিলাম, তখন ব্রিটিশরা গান্ধীর মতো ভারতীয়দের চেয়ে শোচনীয়ভাবে শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই লড়াইয়ে ভারতীয়দের বিজয় সম্ভব হয়েছে।

আইজাক চটিনার: গত মাসে কাশ্মীর পরিস্থিতির দৃশ্যমান অবনতি ঘটেছে। কিন্তু কাশ্মীর এমন একটা জায়গা, যেখানে দেশভাগের সময় থেকেই পরিস্থিতি খারাপ ছিল, বিশেষত ৩০ বছর ধরে। আপনার কি মনে হয়, কয়েক দশক ধরে কাশ্মীরের ব্যাপারে কথা বলায় ভারতের উদারপন্থী নাগরিক ও বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতা রয়েছে?

অমর্ত্য সেন: অবশ্যই অংশত ব্যর্থ হয়েছেন। কাশ্মীরকে যতটা না ভারতের অংশ মনে হতো, তার চেয়ে বেশি মনে হতো ভারতশাসিত একটা অঞ্চল। তবে সেটা স্বীকার করার পরে, ভারতীয়রা প্রায়ই কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী অংশগুলোর ওপর বড় বেশি শাস্তিমূলক পাল্টা-আঘাত হেনেছে, কখনো কখনো পাকিস্তানপন্থীদের চেয়েও বেশি। পাকিস্তানপন্থীরা ভারতীয়দের দ্বারা যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি। কারণ, পাকিস্তানপন্থীরা পাকিস্তানি কাশ্মীরে পালিয়ে যেতে পেরেছে, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই; তাই তাদের ধ্বংস করা অপেক্ষাকৃত সহজ। এইভাবে ভারতবিরোধী আন্দোলন যতটা না কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পাকিস্তানপন্থী হয়ে উঠেছে।

এইভাবে, আগের সরকারগুলোও সব ধরনের রাজনৈতিক ভুলই করেছে। আর আপনি ঠিকই বলেছেন, ভারতের অধিকাংশ মানুষ, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষদেরও বড় অংশ, কাশ্মীরের বিষয়ে নিজেদের জড়াতে অনাগ্রহী থেকেছে বলে আজ এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয়, এই ভুল অনেক আগেই শোধরানো উচিত ছিল।

আইজাক চটিনার: কাশ্মীরের ব্যাপারে আপনি নিজে কি আরও বেশি কিছু করতেন?

অমর্ত্য সেন: সম্ভবত। কিন্তু আমার হাতে অনেক কাজ ছিল। মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত; তা ছাড়া, কাশ্মীরের বিষয়টা ঠিকভাবে বোঝা প্রায়ই কঠিন, বিশেষত এই কারণে যে তারা একেবারেই একটা বিচ্ছিন্নকৃত জনগোষ্ঠী। আর লোকজন বলেই চলেছে যে পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। এটা একটা ভুল। আমিও ভাবি, কাশ্মীর নিয়ে কি আমার আরও বেশি লেখালেখি করা উচিত ছিল? সম্ভবত হ্যাঁ। কিন্তু কেন লিখিনি, তার কোনো ব্যাখ্যা কি আমি দিতে পারি? পারি। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র, নারী-পুরুষের সমানাধিকার এবং আরও অনেক বিষয়ে আমার হাতে ছিল প্রচুর কাজ।

আইজাক চটিনার: দ্য গেটস ফাউন্ডেশন ঘোষণা, তারা মোদিকে পুরস্কার দিতে যাচ্ছে। মোদিকে এখনো আন্তর্জাতিক পরিসরে একজন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এতে কি আপনি বিস্মিত?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ। মনে হয় বিশ্ব সম্প্রদায় সাফল্য পছন্দ করে, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটসও সাফল্য পছন্দ করেন। আর মোদি এতই ক্ষমতাধর যে তাঁকে এক ধরনের সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। অকপটেই বলছি, মোদিকে গেটস পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, এই খবরে আমি বিস্মিত হয়েছি, আঘাত পেয়েছি।

আইজাক চটিনার: আপনি দুর্ভিক্ষ নিয়ে অনেক লিখেছেন; দুর্ভিক্ষ রোধের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের গুরুত্ব, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন। আপনি যখন দেখতে পাচ্ছেন, কোনো গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে কিংবা কম সাড়া দিচ্ছে, সে রকম কোনো গণতান্ত্রিক দেশ অগণতান্ত্রিক শক্তির দখলে চলে গেছে, তখন কি দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি বিষয়ে আপনি যে কাজগুলো করেছেন, সেসব সম্পর্কে আপনাকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে হচ্ছে?

অমর্ত্য সেন: না। আমি এখনো মনে করি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে। নিয়মিত অপুষ্টি, নারীর প্রতি নিয়মিত বৈষম্য ইত্যাদি অদৃশ্যভাবে বিস্ফোরক কদর্যতা প্রতিরোধে গণতন্ত্র খুব একটা সফল হয় না। সেই লক্ষ্যে গণতন্ত্রকে অবশ্য কাজে লাগানো যেতে পারে, কিন্তু সেটা নির্ভর করে রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর। গণতন্ত্র কোনো সমস্যার স্বয়ংক্রিয় সমাধান নয়। গণতন্ত্র ম্যালেরিয়া সারানোর কুইনাইনের মতো নয়। গণতন্ত্র সামর্থ্য সৃষ্টি করার একটা পন্থা। সামর্থ্যপূর্ণ পরিবেশ-পরিস্থিতি থাকলে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করা খুব সহজ হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের একদম শেষ পর্যায়ে ব্রিটিশ ভারতে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, কিন্তু যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেল এবং পরপর কয়েকটা নির্বাচন হল, তখন দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে গেল। দুর্ভিক্ষের কদর্যতার রাজনীতিকরণ খুবই সহজ ছিল। কিন্তু নিয়মিত অপুষ্টি, পুরুষের তুলনায় নারীর নিয়মিত বঞ্চনা, শিশুদের পড়াশোনার অব্যাহত দুর্দশা — এই বিষয়গুলোর রাজনীতিকরণ করা খুব কঠিন। আমি জানি না, গণতন্ত্র শব্দটা খুব বেশি ব্যবহার করি কি না। কিন্তু এটা সত্য যে কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র একটা সহজ সমাধান। অন্যগুলোর সমাধান আরও কঠিন।

আইজাক চটিনার: বৈশ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনাকে যতটা হতাশ দেখতে পাব বলে আমি ভেবেছিলাম, আপনাকে ততটা হতাশ দেখাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনি সাধারণভাবে সবকিছু নিয়েই বেশ আশাবাদী একজন মানুষ।

অমর্ত্য সেন: আশাবাদী বলব না। তবে আমি যতটা নিরাশ প্রকৃতির হব বলে আশা করা হয়, কখনো কখনো আমি তার চেয়ে কম নিরাশ।

(ক্রমশ)

খণ্ড-26
সংখ্যা-42