সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন—এনআরসি-র দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পথ দেখাচ্ছে ছাত্ররা

মাত্র তিন দিনেরও কম সময়ে মোদী-শাহ সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯-কে আইনে পরিণত করে দিল। লোকসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, আর রাজ্যসভায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও বিজেডি, ওয়াইএসআরসিপি, টিডিপি-র মতো এনডিএ বহির্ভূত দলগুলোর নেওয়া অবস্থানের জন্যই তারা জোড়াতালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা যোগাড় করতে পারে। তবে, ভারত সংশোধনীর তাৎপর্যকে যত উপলব্ধি করছে এবং সারা দেশে ছাত্র ও প্রতিবাদরত জনগণের অন্যান্য অংশের উপর সরকারের শুরু করা যুদ্ধটাকে দেখছে, সংবিধানের উপর চালানো সাম্প্রতিকতম সার্জিক্যাল স্ট্রাইকটার বিরোধিতা রাস্তায় তত বেড়ে চলেছে। আসামে প্রতিবাদ সবচেয়ে তীব্র ও ব্যাপক আকার নেয় এবং সেখানে পুলিশের গুলিতে পাঁচ যুবক নিহত হয়েছে — দীপাঞ্জন দাস, স্যাম স্ট্যাফোর্ড, দ্বিজেন্দ্র পানজিং, ঈশ্বর নায়ক এবং আব্দুল আলিম। এছাড়া, জামিয়া ও আলিগড়ের মতো ক্যাম্পাসে কয়েকজন ছাত্র গুরুতর রূপে আহত হয়েছে।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) বিরুদ্ধে চলা প্রতিবাদগুলোর ওপর নির্মম নিপীড়ন নামিয়ে আনা ছাড়াও সরকার মনে করছে যে, জনগণের বৈধ বিক্ষোভকে সরকারের বিরুদ্ধে ‘জেহাদি-মাওবাদী’ চক্রান্ত বলে ছাপ মেরে দিয়ে তারা প্রতিবাদকারীদের কলঙ্কিত ও বিচ্ছিন্ন করে তুলতে পারবে। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, যিনি নিজেই জেএনইউ-র এক প্রাক্তনী, এই ‘জেহাদি-মাওবাদী’ অভিধাটা ব্যবহার করলেন, আর জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে, এমনকি সেখানকার গ্ৰন্থাগার ও শৌচাগারেও অনুমতি ছাড়াই পুলিশের প্রবেশ ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে চালানো হিংসার ভিডিও ক্লিপ দেখে সারা দেশ মর্মাহত হল। প্রধানমন্ত্রী মোদী বললেন, পোশাক দেখেই প্রতিবাদকারীদের চিনে নেওয়া যাচ্ছে, আর একথা বলে তিনি মুসলিম প্রতিবাদকারীদের নিশানা বানালেন এবং গোটা ব্যাপারটায় একটা সাম্প্রদায়িক রং চড়ানোর চেষ্টা করলেন। ছাত্র সম্প্রদায় কিন্তু এই অভিসন্ধিটাকে ধরে ফেলেছে এবং গণতান্ত্রিক সংহতির অনুপ্রেরণা সঞ্চারি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বৃহত্তর প্রতিবাদে শামিল হচ্ছে।

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে সংঘ-বিজেপির প্রচার একগুচ্ছ অর্ধ সত্য ও নির্ভেজাল মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে রয়েছে। প্রথম বড় মিথ্যাটা হল, এনআরসি-র সঙ্গে সিএএ-র কোনো যোগ নেই এবং এই ভণিতাটা করা যে, সিএএ গোটাটাই হল যোগ্য মানুষদের নাগরিকত্ব ‘দেওয়ার’ এবং কারুরই নাগরিকত্ব কেড়ে না নেওয়ার ব্যাপার, আর তাই ভারতীয় মুসলিমদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। অমিত শাহ নিজেই নানান উপলক্ষে বলেছেন, সিএএ হল দেশব্যাপী এনআরসি চালু করার প্রথম প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ। আসন্ন জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জি প্রক্রিয়া এবং আটক শিবিরগুলো নির্মাণের যে কাজ চলছে সেগুলোরও লক্ষ্য সারা ভারতে এনআরসি চালুকে সহজসাধ্য ও বলবৎ করা। সংঘ বাহিনী যখন মুসলিমদের নাগরিকত্ব হারানোর ভয় না করতে বলে, তারা তখন সিএএ-র কথা বলে হিন্দুদের আশ্বস্ত করে যে, এনআরসি-তে ঠাঁই না হলেও সিএএ বুঝি বা সমস্ত হিন্দুদের জন্য সর্বজনীন রক্ষাকবচ!

এর চেয়ে বদমায়েশি ও অসত্য আর কিছু হতে পারে না। সিএএ ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা অ-মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। স্পষ্টতই, ভারতের অধিকাংশ স্থানে এনআরসি থেকে বাদ যাওয়া মানুষদের জন্য নিরাপত্তার কোনো আশ্বাস এর মধ্যে নেই। তা এনআরসি প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট ধরনের জন্যে এবং মেহনতি জনগণের নথিবিহীন অস্তিত্বের কারণে। এদের সাধারণত কোনো জমি থাকে না এবং জীবিকার সন্ধানে বিভিন্ন স্থানে চলাচল করতে হয় আর নারীদেরও বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থাকতে হয়। আসামে এনআরসি থেকে বাদ যাওয়া অধিকাংশ মানুষই এই ধরনের, যেখানে ১৯৭১ সালকেই ভিত্তিবর্ষ ধরা হয়েছিল। ১৯৭১ সালকে ভিত্তিবর্ষ করে সারা ভারতে এনআরসি চালু করলে সেখানে কি ভয়ঙ্কর মাত্রায় জনগণ তার থেকে বাদ পড়বে তা বুঝে উঠতে একটুও অসুবিধা হওয়ার নয়। এমনকি ভুলের মাত্রা মাত্র ৩ শতাংশ হলেও বাদ পড়া মানুষের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে অবাক করে দেওয়ার মতো একেবারে ৪ কোটিতে। এই বাদ পড়া মানুষদের কতজনকে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের অধীনে ভারতের নাগরিক হিসেবে পুনর্বাসিত করা হবে তা কেউই বলতে পারবেন না।

আসল সত্যিটা হল, সিএএ-র বলে এই তিনটি দেশ থেকে ভারতে আসা কেবলমাত্র অ-মুসলিমদেরই নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে, এবং প্রামাণ্য নথি না থাকা অথবা শুধুমাত্র আমলাদের পক্ষপাতিত্ব বা কাজ করতে গিয়ে ভুলভ্রান্তির কারণে বাদ যাওয়া ভারতীয়দের পুনর্বাসিত করার জন্য সিএএ-র আশ্রয় নেওয়া হবে না। কিন্তু এই বাস্তব ঘটনাটাকে আড়াল করার জন্য মোদী সরকার সিএএ-কে মুসলিম প্রধান আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে উৎপীড়নের শিকার হওয়া সংখ্যালঘু জনগণের জন্য আইনি রক্ষাকবচের ভেক দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই আখ্যানের নির্মাণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান পেশ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে হিন্দু জনগণের অনুপাত ১৯৪৭ সালে যেখানে ২৩ শতাংশ ছিল আজ সেটা নেমে এসেছে ৩ শতাংশে। এটা এক অতি বড় মিথ্যা। ১৯৪৭ সালে জনসংখ্যার বিশদ কোনো পরিসংখ্যান নেই, প্রথম পরিসংখ্যানটা পাওয়া যেতে পারে ১৯৪৭ পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫১ সালে চালানো জনগণনা থেকে। আর ১৯৫১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৩ শতাংশের আশেপাশে, এবং আজ তা সামান্য বৃদ্ধিকেই দেখিয়ে দেয়! ২৩ শতাংশ ছিল ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের পূর্বাংশে অ-মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত, আজ সেটা ৩ শতাংশে নেমে আসেনি, এসেছে ১০ শতাংশের সামান্য নীচের স্তরে। এই হ্রাস যথেষ্ট লক্ষ্যণীয়, কিন্তু এর অনেকটাই ঘটেছে বাংলাদেশের জন্মের আগে, এবং মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরিণাম থেকে জন্ম নেওয়া নিরাপত্তাহীনতা ও সংকটের ফলে। ঘটনাটা যদি এই হয় যে হিন্দুরা ব্যাপক সংখ্যায় ভারতে চলে এসেছে এবং তার ফলে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত ধাক্কা খেয়েছে, তবে সরকার কিন্তু এরই সাথে ব্যাপক সংখ্যায় বাংলাদেশী মুসলিমদের ভারতে অনুপ্রবেশের জুজকে তুলে ধরতে পারে না। আসামে এনআরসি বাংলাদেশ থেকে নথি ছাড়াই বিপুল সংখ্যায় অভিবাসনের ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা জুজুটাকে চুপসে দিয়েছে।

এনআরসি প্রসঙ্গে মোদী সরকার বারবারই বাংলাদেশকে বলেছে যে, তাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই, কেননা এনআরসি হল ভারতের ‘অভ্যন্তরীণ’ ব্যাপার। এখন কিন্তু সিএএ-র যৌক্তিকতা প্রতিপাদনে সেই একই সরকার ভর করছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের লাগাতার নির্যাতিত হওয়ার অনুমানের উপর। ভারতের বিদেশ নীতি এত বছর ধরে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানকে মিত্র দেশ বলেই গণ্য করে এসেছে, কখনই পাকিস্তানের সমগোত্রীয় বলে বিবেচনা করেনি। সিএএ আখ্যান এখন বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানকে পাকিস্তানের সঙ্গে একই শ্রেণীভুক্ত করে ঠিক সেটাই করে তুলেছে, তাদের সবগুলিকেই চিত্রিত করেছে দুষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসাবে যেখানে সংখ্যালঘুরা উৎপীড়নের শিকার হয়। এবং এমন সময় এটা করা হল যখন গোটা দুনিয়াই ভারতীয় মুসলিমদের, ভারতের নিজের সংখ্যালঘুদের মধ্যে বৃহত্তম সম্প্রদায়ের অসহায়তা ক্রমেই বেড়ে যাওয়ার কথা বলছে। এনআরসি, সিএএ এই জোড়া পরিকল্পনার উদ্দেশ্য নিয়ে মোদী সরকার আমাদের যা বোঝানোর চেষ্টাই করুক না কেন, আসল সত্যিটা কি গোটা দুনিয়াই তা জানে। এটা ভারতীয় সংবিধানের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের যুদ্ধ, যে সংবিধান ধর্মীয় বিশ্বাস নিরপেক্ষে সমস্ত নাগরিকদের সমান চোখে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এটা ভারতের বিরুদ্ধে সংঘ বাহিনীর যুদ্ধ।

জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র-ছাত্রীদের উপর নির্মম আক্রমণের পর সারা দেশেই বেড়ে চলা ছাত্র সংহতি সামনে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছে। সেদিন রাতেই জেএনইউ, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দিল্লী পুলিশের সদর দপ্তরে গিয়ে ঐ দমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং এখন আবার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিবাদে যোগ দিচ্ছে। আগামী ১৯ ডিসেম্বর ভারত দেশের তিন অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্ৰামীর সম্মিলিত শহীদত্ব এবং সংহত উত্তরাধিকারের ৯২তম বার্ষিকী উদযাপন করবে — এঁরা হলেন আসফাকুল্লা খান, রামপ্রসাদ বিসমিল এবং রোশন সিং। বিসমিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সুপ্রসিদ্ধ সংগীত “সারফারোসি কি তামান্না অব হামারে দিল মে হ্যায়, দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজ-এ-কাতিল মে হ্যায়”কে (আমাদের হৃদয়ে বিপ্লবের আকাঙ্খা, আমাদের জল্লাদের হাতে কত ক্ষমতা আছে দেখা যাক) অমর করে রেখেছেন এবং ভগৎ সিং ও চন্দ্রশেখর আজাদের মতো উত্তরসূরিদের প্রেরণা যুগিয়েছেন। আজ সংঘ-বিজেপি বাহিনী যখন দেশ ভাগের সময়কার জঘন্যতম ধর্মান্ধতা এবং হৃদয়বিদারক বিভেদকে পুনরায় জাগিয়ে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছে, আমাদের তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের অনন্য ভাবাবেগ ও মূল্যবোধগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে সংঘ-বিজেপির সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিভেদের চক্রান্তকে পরাস্ত করতে হবে, ফ্যাসিবাদী বিপর্যয়ের যে ছায়া প্রলম্বিত হচ্ছে তার উপর বিজয়ী হতে হবে গণতন্ত্রকে।

(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয় ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯)

খণ্ড-26
সংখ্যা-42