সম্পাদকীয়
রাস্তাই দেখাবে রাস্তা

সংসদের দুই কক্ষে ‘সিএবি’(‘ক্যাব’)  পাশ হওয়া, তাতে রাষ্ট্রপতির সম্মতি দিয়ে দেওয়া এবং তা গেজেটে পরিণত হওয়ার পর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনটির নাম দাঁড়িয়েছে ‘সিএএ’। বেনাগরিক করার মুদ্রার একপিঠে এনআরসি, অন্য পিঠে সিএএ।

ওরা এনআরসি-র নামে ধর্মের কলে নাগরিকত্ব ঝাড়াই-বাছাইয়ের যে প্রকল্প নামিয়েছে তাতে — কলের মধ্যে কল লাগিয়ে— নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বানিয়ে হিন্দুত্বের সাম্প্রদায়িক নতুন এক সাঁড়াসি আক্রমণ নামানোর হাতিয়ার করে তুলল। ওরা প্রথমে অপারেশন শুরু করেছে অসমে, এখন তার বর্শামুখ বাংলা, কারণ এরাজ্যে ২০২১ সালে হবে বিধানসভা নির্বাচন, ক্রমে ক্রমে গোটা দেশকে এই নয়া সংজ্ঞায়িত নাগরিকত্বের শেকলে বেঁধে ফেলাই ওদের গৈরিক নকশা। এটা এতদিনকার ভারতরাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার সৌধ ভেঙে ওদের হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যেতে পদক্ষেপ করার একটা বিশেষ ছক।

‘আইনে’র নামে যে অ-সাংবিধানিক আক্রমণ ওরা নামিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়ায় গোটা দেশ উত্তাল। ওরা যুক্তির কথা শুনতে নারাজ। সংসদের দুই কক্ষে ‘বিতর্কে’র নামে ঘোরতর অপ-তর্ক চালিয়েছে, তথ্য-পরিসংখ্যান পেশ করার ক্ষেত্রে মিথ্যাচার চালিয়েছে, লোকসভায় গরিষ্ঠতার জোর দেখিয়েছে তো রাজ্যসভায় তা ‘জোগার’ করেছে। কিন্তু অচিরেই তা দেশের ব্যাপক অংশে, বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ওদের বিশেষ টার্গেট সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। বিপরীতে প্রতিবাদে-প্রতিরোধে পথে নামছে  আমজনতা, সম্প্রদায় নির্বিশেষে। আন্দোলনে নামছে বিজেপি বিরোধী  বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তি। জনপথে থাকতে শুরু করেছে বিশেষত বামপন্থী শক্তি, নাগরিক অধিকার-গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষার শক্তিগুলো। সোচ্চার হচ্ছেন প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবীরা। মানুষ যত বুঝতে পারছে নাগরিকত্বের অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়ার কি মারাত্মক পরিকল্পিত আক্রমণ শুরু হয়েছে তত স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছড়াচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে। দেশের প্রখ্যাত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্ররা পণ করেছে নাছোড় লড়াইয়ে অবিচল থাকার। মোদী সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ছে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। রাতের অন্ধকারে লেলিয়ে দিয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। আর পুলিশ চালিয়েছে বর্বর আক্রমণ।

বিজেপি-আরএসএস-সংঘ পরিবারের শক্তিগুলোও চুপচাপ বসে নেই। জনতার আন্দোলনের এই অভিন্ন টার্গেটকেই ওদের ভয়। তাই আন্দোলনের শক্তিগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিতে সেই বহু চেনা বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষ ছড়ানোর কৌশল নিচ্ছে। তাইই মোদী বলছেন, “পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে কারা আন্দোলনের নামে হিংসা ছড়াচ্ছে’’! বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি বলছেন, “যারা তথাকথিত আন্দোলন চালাচ্ছে তারা  বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী!” শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অনভিপ্রেত কিছু হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তাকে অনেক অতিরঞ্জিত চিত্রিত করতে সক্রিয় হয়েছে গেরুয়া পার্টির প্রচারকরা, লিপ্ত হয়েছে ভূয়ো খবর ও বানানো ছবি ছড়িয়ে দিতে। হাতেনাতে তার কিছু কিছু প্রমাণও ধরা পড়ছে। এরা আন্দোলনের ভীড়ে ঢুকে অন্তর্ঘাত চালানোয় তৎপর। এই ‘ভাগ কর, মোকাবিলা কর’ মার্কা কৌশলকে ব্যুমেরাং করে দিতে সচেতন ও সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে। তার জন্য যেমন সম্প্রদায় নির্বিশেষে আন্দোলনে থাকা প্রয়োজন, তেমনি আবশ্যিক হল আন্দোলনের কেবল গণতান্ত্রিক চরিত্রকেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন চলুক সাতরঙা। হিংসাশ্রয়ী রূপগুলো একেবারেই নেওয়া চলবে না, পরিহার করতে বুঝতে হবে-বোঝাতে হবে। যে কোনো পুঞ্জিভূত ক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় ফেটে পড়া আন্দোলনের মধ্যে চমকপ্রদ এ্যাকশনের রাস্তা নিয়ে সহজে বিজয়লাভের চিন্তা পেয়ে বসে। কিন্তু সেটা জনজীবনের ক্ষতি করে দেয় এবং আন্দোলনের জন্য সমর্থন-সহানুভূতি হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সংগ্রামের দুনিয়ায় শান্তিপূর্ণ জনজাগরণে শাসককে খানখান করে দেওয়ার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। উদাহরণ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের “আরব বসন্তের”। এরকম নজির রয়েছে আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে। শুধু তাই নয়, বামপন্থী আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। অবরোধ আন্দোলনকেও মানুষের ভাবাবেগ বুঝে শান্তিপূর্ণভাবে চালানো যায়। মোদী-অমিত শাহদের পাতা ফাঁদ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। কুৎসা ছড়ানোয় ওদের সুবিধা হয় এমন কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে। আন্দোলনের ধারা মূলত গণতান্ত্রিক পথেই থাকছে। এই তেজকে ক্ষুণ্ণ করে দেখানোর বিজেপি-আরএসএস এবং ওদের মিডিয়ার সমস্ত চক্রান্ত ও অপপ্রচারকে রুখে দিতে হবে।

এনআরসি-সিএএ-র অজুহাতে নাগরিকত্বের অধিকারকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার এই হামলা কোনও বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। মোদী-অমিত শাহদের সরকার কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা খারিজ করেছে। মাঝে মিলেছে সুপ্রীম কোর্টের বদান্যতায় অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের মাটিতে রামমন্দির তৈরির রায়। ইতিহাসের যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ, যুক্তি-তর্ককে চিতায় তুলে দিয়ে হিন্দুত্বের কেবল ‘বিশ্বাস’কে মর্যাদা দেওয়া কুৎসিত পক্ষপাতিত্বপূর্ণ রায়। মসজিদ ভাঙাটা অন্যায় হয়েছে এবং মসজিদ তৈরির জন্য অন্যত্র কিছু জমি দেওয়া হোক, শুধুমাত্র এটুকু উল্লেখ সহযোগে। অযোধ্যা রায় বাবরি মসজিদ ভাঙার অপরাধে অপরাধীদের শাস্তি হওয়া উচিত বলে কোনো উল্লেখ করেনি। এর সাথে যুক্ত করা দরকার বর্ণনাতীত আর্থ-সামাজিক বিপর্যস্ত অবস্থা। দেশ জর্জরিত হচ্ছে অর্থনৈতিক, কর্মসংস্থান, জনজীবনের জীবিকার উপায় ইত্যাদি প্রশ্নে সংকটের আবর্তে।

এই সবকিছুতেই সক্রিয় হতে হবে এখন রাস্তায়, রাস্তাই দেখাবে লড়াইয়ের রাস্তা।

খণ্ড-26
সংখ্যা-41