‘ভারতীয় গণতন্ত্র নিয়ে আশা ও আশঙ্কা’— অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার
—(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আইজাক চটিনার: কেন আপনার মনে হয়, আপনাকে নিরাশ প্রকৃতির ভাবা হয়? আর কেন মনে করেন, আপনি সে রকম নন?

অমর্ত্য সেন: কারণ, শৈশবে আমি এমন সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, যখন সবকিছুই বেশ খারাপ ছিল। আমি যখন বেড়ে উঠছিলাম, তখন আমার সব কাকা-মামাকে প্রিভেন্টিভ ডিটেনশন দিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাঁরা কখন মুক্তি পাবেন, তা নিয়ে কোনো আশা ছিল না। আমার বয়স যখন ৯ বছর, তখন বাংলার মন্বন্তর দেখি। ৩০ লাখ মানুষ মারা যায় সেই মন্বন্তরে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখেছি; আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সেটা ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত; এক মুসলমান দিনমজুর আমাদের পাড়ায় এসেছিল; পাড়ার হিন্দু গুন্ডারা তাকে ছুরি মেরেছিল। আমি বাগানে খেলছিলাম, লোকটা রক্তাক্ত অবস্থায় আমাদের বাগানে ঢুকেছিল, সাহায্য চাইছিল, পানি পানি করছিল। আমি চিৎকার করে বাবাকে ডেকেছিলাম, বাবা এক গ্লাস পানি এনে দিয়েছিল। লোকটা আমার কোলে মাথা রেখে বাগানে শুয়ে ছিল। বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, হাসপাতালে সে মারা যায়। লোকটা আমাকে অগোছালোভাবে বলেছিল, আমি বুঝতে পারিনি, বাবা গুছিয়ে বলেছিল যে লোকটার বউ তাকে কোনো হিন্দু মহল্লায় কাজ করতে যেতে মানা করেছিল, কিন্তু লোকটা তার বউকে বলেছিল, ছেলেমেয়েগুলো কিছু খেতে পায়নি, তাদের জন্য একটু খাবার আনতে হলে তো রোজগারের জন্য যেতে হবে।

এরকম কিছু আমি আর কখনো দেখিনি। এই অভিজ্ঞতা, দশ কি এগারো বছর বয়সে একজন মানুষকে রক্তে ভেসে যেতে দেখা; তারপর, সেই মানুষটা আমার বাবাকে যে বর্ণনা দিয়েছিল, কোন গুন্ডারা তাকে খুন করেছে, বাবা সেটা পুলিশকে জানিয়েছিল; কিন্তু ওই হিন্দু মহল্লার পুলিশ কিছুই করেনি। আমি এইসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এবং ভারত স্বাধীন হচ্ছে, এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েও আমি গেছি।

আমি অনেক সমস্যা দেখেছি, তারপর সেগুলোর সমাধান হতেও দেখেছি। এর মানে এই নয় যে আমি সব সময় আশাবাদে উদ্দীপ্ত হয়ে থাকি। কোনো কিছু নিয়েই আমি অতিমাত্রায় আশাবাদী নই। এর অর্থ আবার এটা নয় যে, নিরাশ হওয়ার যথাযথ কারণ না থাকলেও নিরাশ হতে হবে।

আইজাক চটিনার: এমন কোনো বিষয় বা ক্ষেত্র কি আছে, যা নিয়ে আপনি আরও কাজ করতে চান?

অমর্ত্য সেন: কিছু দার্শনিক বিষয় আছে। আমাকে নানা বিষয় নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে জ্ঞানশাস্ত্রে ফেরা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে আমাকে আরও কাজ করতে হবে।

আইজাক চটিনার: তা কি এ জন্য যে কাজটা গুরুত্বপূর্ণ? নাকি এ ধরনের কাজ আপনার পছন্দ?

অমর্ত্য সেন: দুটোই। কিন্তু আমি রাজনীতির বিষয়টা থেকে সরে যেতে পারি না; বিশেষত, ভারতে এখন যা চলছে। আমি খুব গর্বিত একজন ভারতীয়। শুধু গর্বিত ভারতীয় নই, গর্বিত এশীয়ও, এবং একজন গর্বিত মানুষও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে প্রগতিশীল বিদ্যাপীঠে আমি পড়াশোনা করেছি, তার একটা বড় সুবিধা ছিল এই যে, আট-নয় বছর বয়সেও একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি; সেই সুযোগে আমি প্রচুর ইতিহাস পড়েছি।

আইজাক চটিনার: আমি একবার কোথাও পড়েছিলাম, আপনি নিজেকে একজন ‘অপরিবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী’ (আনরিফর্মড সেক্যুলারিস্ট) বলেন। আপনি কি এখনো তা-ই আছেন?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ। আসলে এটা কোনো সমস্যা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজনই নেই।

আইজাক চটিনার: নেই?

অমর্ত্য সেন: কোন ধর্মে বা কী পরিচয়ে আপনার জন্ম হয়েছে, সেটা যে কোনো বিষয়ই নয়, এই সুরাহাটা গণতন্ত্রের মধ্যেই আছে। কিন্তু গণতন্ত্র প্রায়ই ব্যর্থ হয় বলে এ বিষয়টাকে বড় করে তোলা হয়। সে জন্যই একজন মানুষের বহু পরিচয়ের বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

আইজাক চটিনার: আপনার ছেলেমেয়েরা কি আপনার বই পড়ে?

অমর্ত্য সেন: খুব বেশি নয়। [হাসি]। একজন সাংবাদিক। একজন ছোটদের জন্য বই লেখে। আরেকজন মিউজিশিয়ান। আরেকজন একটা ম্যাগাজিনের সম্পাদক। আমি কখনো চাইনি ওদের বিরাট কিছু অর্জন করতে হবে, বরং চেয়েছি ওদের যা করতে ভালো লাগে, তা-ই যেন করে। ওদের কীভাবে অসাধারণ কিছু করতে হবে, এ নিয়ে আমি কখনোই আগে থেকে কিছু ভাবিনি। আমি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে একজন অভিনেত্রীকে কারাগারে যেতে হয়েছে এ জন্য যে তাঁর মেয়ে ...

আইজাক চটিনার: ও, ফেলিসিটি হফম্যান?

অমর্ত্য সেন: তিনি যা করেছেন, সেটাকে আমার বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। আপনি মনে করতেই পারেন যে আপনার সন্তানের একটা ভালো স্কুলে যাওয়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সেটা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না।

আইজাক চটিনার: আপনার কি এখন গল্প-উপন্যাস পড়ার অবকাশ হয়?

অমর্ত্য সেন: এটাই ভীষণভাবে কমে গেছে। আমার দুবার ক্যানসার হয়েছিল। আমার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন প্রথমবার। আমাকে রেডিয়েশন নিতে হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আমার আর পাঁচ বছর বাঁচার সম্ভাবনা আছে; সেই সম্ভাবনাও ১৫ শতাংশ। সেটা ৬৮ বছর আগের ঘটনা। তাই আমি ভাবি যে এখন ঠিক আছি। আমাকে প্রস্টেট ক্যানসারের জন্যও চিকিৎসা নিতে হয়েছে; প্রচুর পরিমাণ রেডিয়েশন নিতে হয়েছে। অবশ্য সাম্প্রতিক পরীক্ষায় ক্যানসার ফেরার লক্ষণ পাওয়া যায়নি। চিকিৎসার সময় আমাকে একটা লিনিয়ার অ্যাকসেলারেটর নিয়ে শুয়ে থাকতে হতো, ফলে পড়ার সুযোগ ছিল প্রচুর। সেই সময় প্রচুর উপন্যাস পড়েছি। ছোটগল্প এখনো প্রচুর পড়ি, কিন্তু উপন্যাস পড়তে তো একটানা লম্বা সময় লাগে। আমার মনে হয় উপন্যাস পড়ার জন্য আরও সময় ব্যয় করা উচিত। আমি পড়ার জন্য আরও সময় চাই। কিন্তু মনে হয় না যে আমি তা পাব।

(সমাপ্ত)
ইংরেজি থেকে মূল ভাষান্তর : মশিউল আলম

খণ্ড-27
সংখ্যা-1