ভাগ করে শাসন করার মোদী কৌশলের বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি

২০১৯ সাল যখন শেষ হয়ে আসছে ভারত তখন যথার্থ অর্থেই এক মোড়ের মুখে : এখান থেকে একটা রাস্তা যাচ্ছে আর এস এস-এর হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নের দিকে, আর অন্য রাস্তাটা আমাদের অবশ্যই নিয়ে যাবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের এক উচ্চতর স্তরে। দ্বিতীয় বারের জন্য পুননির্বাচিত হয়ে মোদী সরকার আরএসএস-এর দীর্ঘকালীন এজেন্ডার সামগ্ৰিক আয়ুধকেই দ্রুত নামিয়ে এনেছে, এবং তা ‘হলে এখন আর না হলে কখনই নয়’ এমন একটা মরিয়া আগ্ৰাসী ভাব ও তীব্রতার সঙ্গে। অর্থনীতি যখন বৃদ্ধির প্রবল মন্থরতা, ভোগব্যয়ের সংকোচন এবং ক্রমবর্ধমান বেকারির ভারে টলমল করছে, লক্ষ-লক্ষ মানুষ তীব্র অনাহারের কবলে, সরকার তখন তার চক্রান্তমূলক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই ব্যস্ত থেকেছে। প্রথমে সে জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক এবং এমনকি রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেয় এবং অতি তাড়ায় নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনে যা আমাদের নাগরিকত্বের শর্ত এবং প্রজাতন্ত্রের চরিত্রকেই পাল্টে দেবে।

সংবিধান শুরু হচ্ছে একটা প্রস্তাবনা দিয়ে যা আবার শুরু হচ্ছে ‘আমরা, ভারতের জনগণ’ এই সুনির্দিষ্ট শব্দগুলো উল্লেখ করে। সমস্ত ক্ষমতাই বেরিয়ে আসছে জনগণের থেকে এবং ন্যস্তও থাকছে তাদের কাছে যারাই হল ভারতের সার্বভৌমত্বের দৃঢ় ভিত্তি। জনগণ সংবিধান অনুসারে সরকার নির্বাচিত করে এবং সংবিধানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাটা সরকারগুলোর অবশ্য কর্তব্য। জনগণের কাছেই সরকারকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে, এই সম্পর্ককে সম্পূর্ণ রূপে পাল্টে দিয়ে এখন আমরা দেখছি সরকার লাগাতার জনগণের কাছে দাবি করে যাচ্ছে। তাদের কাছে থাকা টাকা বৈধ (বিমুদ্রাকরণ), তারা সন্ত্রাসবাদী নয় অথবা অবৈধ ক্রিয়াকলাপে যুক্ত নয় (ইউএপিএ) এবং এখন আবার তারা এই দেশের বৈধ নাগরিক (সিএএ-এনআরসি) — জবাবদিহির দায় জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের এখন এই সমস্ত কিছু প্রমাণ করতে বলা হচ্ছে। এই এজেন্ডাকে চাপিয়ে দিতে গিয়ে বিজেপি সরকারগুলো কেবলমাত্র নির্ভেজাল মিথ্যা এবং ঘৃণাভরা প্রচারের আশ্রয়ই নিচ্ছে না, তারা পৈশাচিক দমন নামাচ্ছে এবং গণতন্ত্রের নির্বিচার মুলতুবি ঘটাচ্ছে। ফলে ‘প্রশাসন’ ক্রমেই আরো বেশি করে এক আপাদমস্তক পুলিশ রাষ্ট্রের উপসর্গগুলো আয়ত্ত করছে। ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্যে পুলিশ যখন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশোধ নেওয়ার নির্দেশকে বাস্তবায়িত করছে তখন তারা গণপিটুনিতে অভ্যস্ত এক সংগঠিত, সরকারি বাহিনী রূপেই দেখা দিচ্ছে।

আগস্ট মাসে মোদী-শাহ জুটি যখন কাশ্মীরের ওপর মোক্ষম আঘাতটা হানলেন, তখনও অনেকে তার মধ্যে আইনি অভিন্নতা আনার আয়োজন, ‘এক দেশ, এক আইন’ ব্যবস্থার দিকে এক নিরীহ পদক্ষেপকেই দেখতে পেলেন। রাজ্যটাকে ভেঙ্গে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে পরিণত করার ব্যাপারটা অবশ্য অনেককে বিস্মিত করল, যেমন অসন্তুষ্ট করল কাশ্মীরের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ নাগরিকদের গণ-গ্ৰেপ্তারি এবং উপত্যকায় সংযোগ ও গণতন্ত্রকে পুরোপুরি মুলতুবি করে দেওয়ার ক্ষেত্রে। এ সত্ত্বেও অধিকাংশ সাধারণ ভারতবাসীর কাছে কাশ্মীর দূরের ব্যাপার হয়েই রইল। এর কয়েক সপ্তাহ পর এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকা থেকে আসামে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ যখন বাদ পড়ল এবং আসামের বন্দী শিবিরগুলো থেকে মৃত্যুর খবর বেরিয়ে জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে পৌঁছতে শুরু করল, তখন বাকি দেশ বিস্মিত হয়ে ভাবতে শুরু করল আসামে ঠিক কি ঘটছে। এর পরও কিন্তু অনেকের কাছেই আসাম উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটা রাজ্য মাত্র হয়েই রইল।

তবে, অমিত শাহ সারা ভারতে এনআরসি চালু করার বিজেপির এজেন্ডার উপর অত্যন্ত জোর দেওয়ায় এবং ৭২ ঘন্টারও কম সময়ে চূড়ান্ত দ্রুততায় নাগরিকত্ব আইনে সাম্প্রদায়িক, বৈষম্যমূলক এবং সংবিধান-বিরোধী সংশোধন আনায় গোটা ভারতই সমগ্ৰ নকশাটার ভয়াবহ তাৎপর্যকে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। এবং ইন্টারনেট ঘনঘন বন্ধের মুখে পড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবং জনগণের ঘরে পুলিশের নির্মম হামলা নামায় এবং সারা দেশে, বিশেষভাবে বিজেপি রাজ্যগুলোতে এবং জাতীয় রাজধানীতে  চলা প্রতিবাদগুলোর ওপর মারমুখী আক্রমণ নেমে আসায় কাশ্মীর ও আসামের অভিজ্ঞতা বোধকরি আর খুব দূরের ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে না।

বিশেষভাবে উত্তরপ্রদেশে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা অবস্থায় পুলিশ মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর সন্ত্রাস ও লুন্ঠন নামায়। ২০০২ সালের গুজরাটের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। হরিয়ানার কৈথাল-এর বিজেপি বিধায়ক তাঁর ভাষণে নিজের দলের গণহত্যার অভিপ্রায়কে সুস্পষ্ট করে দিয়ে বলেন, “এটা নেহরু ও মনমোহন সিং-এর ভারত নয়, এটা মোদী ও শাহর ভারত। মিয়াঁজি (বিদ্রুপের ঢঙে মুসলিমদের এই সম্ভাষণে ডাকা হয়) শোন, সংকেত পেলে আমরা তোমাদের এক ঘণ্টায় নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি।”

দীর্ঘদিন ধরেই মোদী সরকার এবং সংঘ-বিজেপি বাহিনী আমাদের জটিল ও বৈচিত্রময় সমাজের ঐক্যনাশক বিভাজন রেখাগুলোকে বাড়িয়ে তুলে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অধ্যায়গুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে চাইছে। সে যাই হোক, আমরা অবশেষে দেখতে পাচ্ছি যে দেশ পাল্টা লড়াই করে স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংবিধানের অতুলনীয় স্বপ্ন ও মূল্যবোধগুলোর পাশে শামিল হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক আগুনকে উসকিয়ে তোলার লক্ষ্যে বিজেপি সবকিছুকে সাম্প্রদায়িক রঙে চিত্রিত করতেই অভ্যস্ত। সেই বিজেপি এখন আমাদের বলতে চাইছে যে, কেবলমাত্র ‘জেহাদি মুসলিমদের’ কিছু অংশ এবং ‘শহুরে নকশালরাই’ জনগণকে এনআরসি এবং সিএএ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত না করে তাদের এগুলোর বিরুদ্ধে অন্যায় প্রতিবাদের পথে চালিত করছে। তবে একবারের জন্যে হলেও জনগণকে প্রতারিত করাটা বিজেপির পক্ষে এবার কঠিন হচ্ছে এবং এনআরসি ও সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরো ছড়িয়ে পড়ছে এবং সেগুলো নির্ভীক ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হচ্ছে। ফ্যাসিবাদী হিন্দু রাষ্ট্রের মাথাচাড়া দেওয়া বিপদ অবশেষে কিছু মাত্রায় দৃঢ় গণপ্রতিরোধের মুখে পড়েছে।

সিএএ-এনআরসি বিরোধিতাকে দেশদ্রোহিতা বলে অভিহিত করে এবং নির্লজ্জভাবে ইসলাম আতঙ্ককে উসকিয়ে তুলে —প্রতিবাদকারীদের ‘পোশাক দিয়ে চেনা যাচ্ছে’ বলে মোদী মন্তব্য করেছেন — মোদী ঐ বিরোধিতাকে দমন করতে চাইছেন। তাঁদের অধীনে থাকা পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে অমিত শাহ ও যোগী সমস্ত স্থানেই সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে প্রতিবাদকারীদের উপর আক্রমণ হানছেন। যে ১৪৪ ধারা আইন ও শৃঙ্খলার সম্ভাবনাময় লঙ্ঘনকে প্রতিহত করতে নির্দিষ্ট এলাকায় মানুষের সচলতাকে নিয়ন্ত্রিত করার ঔপনিবেশিক যুগের আইন, তাকে বড়-বড় এলাকা জুড়ে স্বেচ্ছাচারীভাবে ও অনির্দিষ্টকাল ধরে লাগু করা হচ্ছে এবং ইন্টারনেটও বারবারই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এ সব সত্ত্বেও এই খোলাখুলি স্বৈরতন্ত্রকে অগ্ৰাহ্য করে সারা ভারতেই প্রতিবাদ আছড়ে পড়ছে যা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সংহতির মতো শব্দগুলোতে এক নতুন প্রাণচঞ্চল অর্থ ও বলিষ্ঠতা যুক্ত করছে।

গণপ্রতিবাদের এই উদ্দীপনা নির্বাচনী ক্ষেত্রেও তার উপস্থিতি ঘোষণা করছে। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের পর এই উদ্দীপনার শক্তিশালী প্রভাব আমরা ঝাড়খণ্ড নির্বাচনেও দেখতে পেলাম। হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল যেখানে নির্বাচনী অপরাজেয়তার বিজেপির দাবিকে একটু টোল খাইয়েছিল, ঝাড়খণ্ড সেখানে বিজেপির নির্বাচনী যন্ত্রে এক মোক্ষম আঘাত দিয়েছে। মোদী, শাহ এবং যোগী এরা সবাই তাদের যাবতীয় বুকনিবাজি উজার করে তাতে যাবতীয় চাল চালেন, কাশ্মীর থেকে অযোধ্যা, এবং এনআরসি থেকে সিএএ সমস্ত তুরুপের তাসই খেলেন। তবুও তাঁরা অনাহার ও আতঙ্ক, দুর্নীতি ও নির্যাতনের সমার্থক হয়ে ওঠা রঘুবর সরকারকে অব্যর্থ পরাজয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি।

জনগণের উদ্দীপিত প্রতিবাদ এবং নির্বাচনে বড় ধরনের প্রত্যাখ্যান — এই দুয়ের সম্মিলনকে লক্ষ্যে রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। জনগণের প্রতিরোধে ধাক্কা খেয়ে সরকার এনআরসি নিয়ে নরম হওয়ার, এমনকি যেন একে প্রত্যাখ্যান করার ভড়ং করছে। তারা মনে করছে যে, আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক ও সংবিধান-বিরোধী সিএএ-কে শরণার্থীদের ক্ষমতায়ন বলে আড়াল করতে সক্ষম হবে। তার অন্তর্বস্তুতে সিএএ হল প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ, ধর্মীয় পরিচিতি নিরপেক্ষে সমস্ত নাগরিকের সমতার বুনিয়াদি সাংবিধানিক নীতির প্রহসন এবং ভারতের জাতীয় ঐক্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের প্রধান ভিত্তি হিসাবে কাজ করা হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্বের নেতিকরণ। সরকার যতদিন না এই বিভেদমূলক ও সংবিধান-বিরোধী এনআরসি-সিএএ প্যাকেজকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হচ্ছে, ততদিন আমাদের সিএএ-র স্বরূপকে উন্মোচিত করে যেতে এবং সেটা যা তার জন্য তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যেতে হবে। গণ প্রতিবাদ এবং বিজেপির নির্বাচনী পরাজয়ের এক আশা জাগানো বার্তার মধ্যে দিয়ে ২০১৯ শেষ হচ্ছে। এই উদ্দীপনার মধ্যে দিয়েই, ৮ জানুয়ারী-র সারা-ভারত ধর্মঘটের শক্তি প্রকাশ এবং দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির আর একটা ক্ষমতা খর্বকারী পরাজয়ের মধ্যে দিয়েই ২০২০ সাল শুরু হোক।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯)

খণ্ড-27
সংখ্যা-1