প্রতিবেদন
প্রতিবাদীকে আক্রমণ = প্রতিবাদের সংক্রমণ

ক্ষতস্থান খোঁচালে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে — চিকিৎসকের এই পরামর্শ মানুষের বোঝার কথা, নামানুষের নয়। ফল যা হওয়ার তাই হল, আগে জেএনইউ ছিল একটাই, এখন চতুর্দিকে! মাত্র কয়েকদিন আগেই প্রাক্তন সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত (তখনও তিনি প্রাক্তন হননি) আগুপিছু না ভেবে নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে এমন একটা ভুলভাল বোমা ফাটালেন যে তার নিজেরই বুদ্ধিসুদ্ধির ভাণ্ডাফোঁড় হয়ে গেল। ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিংদের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে নাকি বলছে, দেশে সব আন্দোলনের নেতৃত্ব ছাত্ররা দিচ্ছে কেন? আন্দোলনের কোনো নেতা নেই! আচ্ছা মিঃ রাওয়াত আপনি/আপনারা কি নেতা বলতে কেবলই দাদু আর গুণ্ডা বলতে নাতিদের বোঝেন? যে কারণে বোধহয় একমাত্র মোদী, অমিত শাহরাই আপনার নেতা আর নাতির বয়সী লুম্পেনরা মুখে কাপড় বেঁধে রাতের আঁধারে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা হস্টেলে দেদার ভাঙচুর চালায়, ছাত্রীছাত্র ও অধ্যাপিকাদের রক্তাক্ত করতে পারে। জেএনইউ বরাবরই সব শাসকের কাছে সমস্যার, অস্বস্তির কারণ ছিল। মোদী সরকারের আমলেও তার ব্যতিক্রম তো হয়ইনি বরং আরো বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিষয়টা। দেশ দুনিয়ার বিচিত্র অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিঃসংশয়ে মুখ খোলাটাই বিশ্ববিদ্যালয়টির ঐতিহ্য। কিন্তু যা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিষয় তাকেই দমন করতে গিয়ে বারবার আরো বাইরে এনে ফেলছে আরএসএস ও বিজেপি পরিচালিত মোদী সরকার ও তাদের গুণ্ডাবাহিনী এবিভিপি। যদিও বিষয়টাকে একান্তই জেএনইউ-এর নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ বিষয় বলাটাও ঠিক হবে না কারণ দিনকে দিন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সরকারের দায়ভার ঝেড়ে ফেলে যেভাবে তাকে আদানি-আম্বানিদের কিম্বা বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার মুনাফা লোটার পণ্য বানানোর তোড়জোড় চলছে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে, তার পরম্পরাতেই এসেছে ‘নয়া শিক্ষানীতি ২০১৯’।

কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্বশাসনের নাম করে সেগুলোর জন্য সরকারী ব্যয়বরাদ্দ কমানো হল, তারপর বিচিত্র সেল্ফ-ফিনান্সড কোর্সসমূহ চালু করে ক্যাম্পাসগুলোকে আরো একধাপ বাজারে পরিণত করার দিকে এগিয়ে দেওয়া হল। এই কার্যক্রমেই জেএনইউ-এর হস্টেল ফি বেড়ে গেলো প্রায় ১০০০ শতাংশ। অন্যান্য অনেক অবিচারের মতো এক্ষেত্রেও পথে নামলো ক্যাম্পাসের স্টুডেন্টরা। প্রথমে দিল্লী পুলিশ দিয়ে রাজপথে প্রতিবাদী পড়ুয়াদের নির্বিচারে গ্রেফতার, আটক করা হল। কিন্তু ছাত্রনেতাদের আটকে রেখেই কি দাবানল আটকানো যায়? নেতা তৈরির সূতিকাগার হল শিক্ষার্থীসমাজ। এর মধ্যেই সংবিধান বিরোধী, দাঙ্গাবাজির নতুন ছক সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) এসে পড়ায় যেন আগুনে পড়লো ঘি ... বিরুদ্ধতার যত ঢেউ — চারপাশে যেন জেএনইউ! প্রতিবাদ, প্রতিরোধের শিকড়টা যে কত গভীরে তা কি করে গেরুয়া বনসাইরা বুঝবে? সুতরাং থামাতে ঝড়, ভরসা খড় — এই হল তাদের বুদ্ধি। পরপর দুদিন রড, লাঠি, অ্যাসিড, পাথর নিয়ে জেএনইউ ছাত্রসংসদের নেতৃত্ব ও বামপন্থী শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলা এবিভিপির। প্রথমদিন ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও আইসার নেতা কমরেড সতীশ চন্দ্র যাদব সহ আরো কিছু সাথীকে মারধোর, আইসার সদস্যা কমরেড দৃপ্তা সারঙ্গীর পা ভেঙে দেওয়া আর দ্বিতীয়দিন ছাত্রসংসদ সভাপতি ও এসএফআই নেত্রী কমরেড ঐশী ঘোষের মাথা ফাটানো, অধ্যাপিকা সুচরিতা সেনকে ক্ষতবিক্ষত করা সহ গার্লস হস্টেলে দেদার ভাঙচুর করে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষাজগতের ওপর নজিরবিহীন আক্রমণ। নরেন্দ্র মোদী ও তার বশংবদদের এখন মনে হয়নি যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করা হয়েছে! কিন্তু মার দিয়ে কি মার্ক্সের নাম ভোলানো যায় নাকি আম্বেদকরকে মোছা যায়? সংক্রমণের মতো প্রতিবাদ ছড়ালো। তবে এবার শুধু অন্যান্য ক্যাম্পাসে নয়, সাথে সাথে ফেটে পড়লো সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্প ও বাণিজ্য মহলও। আর ক্যাম্পাসগুলোয় নজিরবিহীন ছাত্রঐক্য দেখা গেলো দলমত নির্বিশেষে। এমনকি এতদিন মোদী সরকারের চাটুকারিতা যে কিছু পরিচিত মুখকে করতে দেখা যেত তারাও কেউ কেউ এই ঘটনার নিন্দা না করে থাকতে পারেনি। এই তীব্র মেরুকরণের সময়ে অদ্ভুত লাগে যখন বিজেপির বিরুদ্ধে যাদবপুরের প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের উপর রাজ্যের তৃণমূল সরকারের পুলিশকেও লাঠি চালাতে দেখা যায়! মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী পারলে একবার গণআন্দোলনের আয়নায় নিজেদের মুখটাও দেখে নিলে হয় না?

খণ্ড-27
সংখ্যা-2