প্রতিবেদন
পার্ক সার্কাস ময়দানে দ্বিতীয় শাহিনবাগ

সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর-এর বিরোধিতা করতে অবস্থান বিক্ষোভ করছেন কলকাতার বহু মানুষ। আরম্ভ করেছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী মহিলারা, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন শয়ে শয়ে হিন্দু মহিলা ও পুরুষ। দলীয় কোনও পতাকা ছাড়াই এই অবস্থান চলবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য, পার্ক সার্কাসের উন্মুক্ত ময়দান চত্বরে। শুরুটা অত সহজ ছিল না। ছিল না পুলিশের পারমিশন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের অপছন্দ ছিল এই বিক্ষোভ; কিন্তু কোনও প্রতিবন্ধকতা দমাতে পারেনি এই লড়াকু মহিলাদের। শীতের রাতে বাচ্চা কোলে নিয়ে মা যেমন বসে রয়েছেন তেমনি স্লোগানে গলা মেলাচ্ছেন বৃদ্ধারাও। এই লড়াই তাঁদের কাছে অস্তিত্বের লড়াই। এই অহিংস যুদ্ধ হল শাসকের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। এ হল সংবিধান বাঁচানোর লড়াই। মুসলমান মহিলাদের নেতৃত্বে এমন অবস্থান বিক্ষোভ নজিরবিহীন অবশ্য নয়। পক্ষ কাল ধরে দিল্লির শাহিন বাগেও চলছে অনুরূপ অবস্থান বিক্ষোভ।

ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাও এই অবস্থান বিক্ষোভকে সঠিক ও যুক্তিপূর্ণ বলেই মনে করছেন। মুসলমান নারীদের আন্দোলন করা ঠিক কিনা, এই প্রশ্ন তুলেছিলেন দু একজন। ইসলামে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা রয়েছে। ইসলাম নয়, পিতৃতন্ত্র আন্দোলনকেও পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। অসমে এনআরসি-র পর দেখা গিয়েছে, ১৯ লক্ষ বে-নাগরিকের বেশির ভাগ হলেন মহিলা। কেন এমন? কারণ, মহিলারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পিতার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত। তাই এনআরসি-তে উত্তরাধিকার প্রমাণ করতে গিয়ে তাঁদের অনেকেই কোনও দলিল পেশ করতে পারেননি। পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর। গৃহহীন মানুষ, যাযাবর মানুষ রাষ্ট্রের এক কলমের খোঁচায় বে-নাগরিক হয়ে সস্তার শ্রমিক কিংবা ক্রীতদাসী বা দাস হয়ে যাবেন এই দেশে। তাঁদের বেচেও দেওয়া হতে পারে অন্য দেশে, যেমন ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ রাজপুরুষরা কলকাতা থেকে ক্রীতদাস পাঠাতেন বিভিন্ন দেশে। কেউ অ-মুসলমান বলে বেঁচে যাবেন, এই আশা বাতুলতা। গরিব মানুষদের রয়েছে প্রয়োজনীয় নথির অভাব। এই দেশ হিন্দুর বা মুসলমানের নয়, এই দেশ হল খেটে খাওয়া মানুষদের — এই আওয়াজ তুলেছেন ময়দানে জড়ো হওয়া মহিলারা।  দেশের মানুষ যখন অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে ভুগছেন, তখন রাষ্ট্র নাগরিককে সেই অধিকার দেওয়ার বদলে তাঁকে বে-নাগরিক করতে চাইছে। এই ষড়যন্ত্র রুখতে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন মহিলারা।

circus

 

এক বিক্ষোভকারী জানালেন, পার্ক সার্কাস ময়দানের এই অবস্থান বিক্ষোভ নারীদের কিন্তু এ হল এমন এক নারী আন্দোলন যেখানে শুধু নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলা হচ্ছে না, শিশু-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গ — সমস্ত মানুষের অধিকার নিয়ে সরব হয়েছেন গৃহবধূ থেকে কলেজ ছাত্রী পর্যন্ত।

পার্ক সার্কাস ময়দানে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে নানা সভা, বিক্ষোভ, আলোচনা হয়েছে। তার পর এই ময়দানকে কলকাতার লোকেরা চিনতেন শীতের সার্কাসক্ষেত্র হিসাবে। ট্রাপিজের খেলা কিংবা জোকারের স্থূল রসিকতা দেখতে বা যাত্রাপালা উপভোগ করতেও মানুষ ভীড় জমিয়েছেন কয়েক বছর আগে পর্যন্ত। কিন্তু ২০২০-র শীতকাল পার্ক সার্কাস ময়দানকে তার অতীত গরিমা ফিরিয়ে দিয়েছে। প্রায় এক শো বছর আগে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল দিনের কথা স্মরণ করাচ্ছেন পার্ক সার্কাস ময়দানের মহিলারা। এ যেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, কুশাসন ও হিংস্রতার বিরুদ্ধে আজাদির লড়াই।

- শামিম আহমেদ, সাহিত্যিক

খণ্ড-27
সংখ্যা-2