সম্পাদকীয়
নতুন বছর নিয়ে আসুক নতুন সম্ভাবনা

আমরা পা ফেলছি নতুন বছরে। যে বছরটা বিগত হল তা ছিল ভীষণ বড় বড় ঘটনা বহুল। কি দুনিয়া জুড়ে, কি আমাদের দেশের ক্ষেত্রে। এই সমস্ত ঘটনা ও প্রবণতার পর্যালোচনার গুরুত্ব রয়েছে অপরিসীম। আমরা বরং আমাদের দেশের কথায় আসি। ২০১৯ সালটা, বিশেষত লোকসভা নির্বাচন ও তার পরবর্তী সময়টা এমন গেল যা এককথায় নজীরবিহীন সংঘাতপূর্ণ। আরেকটু পেছনের পর্ব এক নজরে স্মরণ করলে সেটাও পরিস্থিতির ওঠানামার ঘাত-প্রতিঘাতে ছিল ঘটনাবহুল। জনগণের গণতন্ত্র ও জীবন-জীবিকার লুঠ-মার, দুর্নীতি ও হিন্দুত্ববাদী দুর্বৃত্তায়ন, নোটবন্দী ও জিএসটি চাপানো, কর্পোরেট পুঁজির দালালী; চলেছে সবই। পরিণামে প্রথম পর্বের প্রতারণামূলক ও অত্যাচারী মোদী জমানা পুঞ্জিভূত ক্ষোভের জনপ্রতিক্রিয়ায় পর্যবসিত হয়েছিল পতনের প্রায় খাদের কিনারায়। ঠাহর হচ্ছিল সেখান থেকে ক্ষমতায় ফেরা সম্ভব নয়। কিন্তু অত্যাশ্চর্যের মতোই ফিরে আসার হাওয়া তোলার উপায় বের করে ফেলল। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশে আমরা বুঝলাম মোদী সরকার দাঁও মেরেছে কল্পনাতীতভাবে। প্রথমে পুলুওয়ামা কান্ড ঘটাতে দিয়ে তারপর তার বদলার নামে ‘বালাকোট কান্ড’ ঘটিয়ে, দেশবাসীর জাতীয় আবেগকে উসকে দিয়ে তাকে পুঁজি করে, জনজীবনের সমস্ত জ্বলন্ত সমস্যাকে পেছনে ঠেলে দিয়ে একক গরিষ্ঠতা কব্জা করে ক্ষমতার মসনদে ফিরে আসে। আর ফিরে আসার পর থেকেই নামাতে শুরু করে একের পর এক আক্রমণ। ‘এক দেশ এক আইন’ চালুর নামে জম্মু ও কাশ্মীরের ওপর থেকে সংবিধান স্বীকৃত ৩৭০ ধারা খারিজ করা শুধু নয়, রাজ্যের মর্যাদাই কেড়ে নেয়, অসমে নামায় ‘নাগরিক পঞ্জিকরণে’র নামে লক্ষ লক্ষ নাগরিককে বে-নাগরিক করে দেওয়ার অভিযান — ‘এনআরসি’ এবং তার আগে-পরে  সিএবি তথা সিএএ-র অবিচ্ছিন্ন প্যাকেজ — দুটি পদক্ষেপই প্রবলভাবে এক অর্থে হিন্দু পক্ষপাতদুষ্ট অন্য অর্থে মুসলিম বিরোধী। এককথায় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রে অন্তর্ঘাতমূলক। এ নিয়েই সর্বোপরি দেশ  আজ  উত্তাল।

মোদী-যোগী-শাহ চক্র মরীয়া হয়েছে বিভেদ-বিদ্বেষ-বিভাজনের বিষ ছড়িয়ে আর বর্বর দমন নামিয়ে ভয়াতঙ্কের শাসন কায়েম করতে। কিন্তু তা বিবিধের মাঝে মিলনে থাকতে চাওয়া মানবিক শক্তিকে প্ররোচিত করেছে। ভয় ভেঙে ঐ ক্ষমতার দানবিক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। এক পাল্টা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে। সেই মতোই শুরু হয়েছে এক সাড়া জাগানো প্রতিরোধের আন্দোলন। যে আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে নতুন প্রজন্মের ছাত্রী-ছাত্ররা। সঙ্গে পথে থাকছে যুব শক্তি। আন্দোলনে নামছে বিভিন্ন বিরোধী সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি। নানা হুমকির সম্মুখীন হয়েও ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন দেশের প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। আন্দোলন চলছে নানা বিন্যাসে, নানা রূপে, নানা পরিধানে সেজে ওঠা রণসাজে। আন্দোলনের ঢেউ দেখে উল্টে এখন ভয় পাচ্ছে গেরুয়া ঝান্ডার ফ্যাসিস্টরাই। সেই ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে ওরা নতুন করে দ্বৈত পন্থা নিচ্ছে। একদিকে উন্মত্ত হয়ে নৃশংস দমন নামাচ্ছে, যার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক নমুনা মিলছে উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের রাজত্বে, মুখ্যমন্ত্রী ‘আদি’ গেরুয়া বসনধারী মুন্ডিত মস্তকরূপ ধারণ করলেও নিজেই নিজেকে উন্মোচিত করছেন আদৌ যোগী নন, এক সাম্প্রদায়িক জহ্লাদ। পাশাপাশি এই ফ্যাসিস্টরা তাদের বিরুদ্ধে ফেটে পড়া আন্দোলনকে বাইরে  থেকে ভাঙতে শুরু করেছে নরমে-গরমে বক্রোক্তি মায়  কুৎসা প্রচার। কথায় কথায় হুমকির হিস-হিসানি  শোনাচ্ছে  বাড়াবাড়ি করলে ‘গুজরাট বানিয়ে দেব’। ২০০২-এর দুই সহস্রাধিক সংখ্যালঘু মানুষের গণহত্যার পর থেকে গুজরাটবাসী মুসলিমরা আজও রয়েছেন ভীত সন্ত্রস্ত। তাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক অবস্থানে, জীবন কাটে ঘেটোয়, চিত্রিত করা ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে। ২০১৫-র একটি তথ্য স্মরণ করাই যথেষ্ট। মোদী এবং এক মার্কিন রাষ্ট্রসচিবের বৈঠকের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রস্তুতি মহড়ায় নকল ‘জঙ্গীর রূপ’ সাজানো হয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রথাগত মাথার টুপি পরিয়ে। তবে গুজরাট গণহত্যার সময় যে আদিবাসী সম্প্রদায়কে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবহারে বিজেপি সমর্থ হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনে আর ঘটাতে পারেনি। আদিবাসী-চেতনার উত্তরণ বরং বিজেপি-র জাতি, সম্প্রদায় ও বর্ণভেদের কৌশলের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।

বিশাল আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় মোদী-অমিত শাহরা উঠেপড়ে লেগেছেন ঝড় সামলাতে। আবার সেই বুলি আউরাচ্ছে ‘আন্দোলনের নামে চলছে জনতাকে ভুল বোঝানোর নষ্টামী, আর তার জন্য দায়ী সমস্ত বিরোধী দল সহ ‘শহুরে নকশালরা’, ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’রা। বিভাজনের বিষাক্ত রাজনীতি চিনে মানুষ যত বিরোধিতায় অবিচল একাকার হচ্ছে; ততই মোদীর দল মরীয়া হচ্ছে মানুষের উদ্দশ্যে উল্টোপাল্টা বলে নিজেদের সাফাই গাওয়ার অভিযানে। তারা এতই বেপরোয়া যে অবসর নেওয়ার প্রাক মুহুর্তেও প্রাক্তন সেনাপ্রধানকে পর্যন্ত তাদের অসাধু উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে ছাড়ল না।  প্রতিরোধের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়াকে নিন্দাবর্ষণ করিয়েছে প্রকাশ্যে।

বাংলায় বিজেপি বলাবাহুল্য পাখীর চোখ করেছে ২০২১-এর নির্বাচনকে। কিন্তু এখানেও এনআরসি বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে, ক্রমশ গণচরিত্র পাচ্ছে। সব দেখে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব ফ্যাসিস্ট খুনে সর্দারদের মতই আচরণ করছে। যথারীতি পাকিস্তান-বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া বা উত্তরপ্রদেশের মতো লাশ ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। এর পাশাপাশি জনসংযোগ করতে ও জনতার ‘ভুল ভাঙাতে’ অভিযানে নামাচ্ছে দলের ‘প্রচারক-বিস্তারক’ বাহিনীকে। বিশেষ টার্গেট করছে আদিবাসী ও তপসিলি জাতি-উপজাতি ও বামপন্থায় আস্থা হারানো শক্তিকে, যে ভোট গত নির্বাচনে মুফতে পেয়েছিল তা ধরে রাখতে। বিজেপি বুঝতে পারছে হাল দাঁড়াচ্ছে দিনদিন খারাপ থেকে আরও খারাপ। বাংলায় তার অস্তিত্ব এখন  গত লোকসভা নির্বাচনের পরপরের অবস্থার মতো ঠিক নেই। হাওয়া ঘুরছে এনআরসি-র প্রতিক্রিয়াতেই। এক নতুন বিরুদ্ধতার মুখে পড়তে হচ্ছে।

নতুন প্রজন্মের নতুন চেতনার দৌলতে এই দেশে এই রাজ্যেও সবচেয়ে আলোড়ন তোলা শ্লোগান এখ ন— ‘‘আজাদী”! “ভাজপা সে মাঙ্ আজাদী”! বিজেপির থেকে মুক্তি চাই! এটাই এখন প্রকৃত দেশপ্রেমের সবচেয়ে তুফান তোলা শ্লোগান। দেশের মানুষকে ভালোবাসার সবচেয়ে জীবন্ত শ্লোগান। নাগরিক ভারতের সবচেয়ে প্রিয় শ্লোগান। আমাদের আশা হোক আকাশছোঁয়া। নতুন বছর নিয়ে আসুক লড়াইয়ের নতুন সম্ভাবনা।

খণ্ড-27
সংখ্যা-1