উত্তরপ্রদেশে চলছে আতঙ্কের রাজ

“গত এক সপ্তাহ ধরে উত্তরপ্রদেশে আতঙ্ক রাজত্ব করছে”, তথ্যানুসন্ধান করে ফিরে এসে জানাচ্ছে একটি দল। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী ও প্রস্তাবিত নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের ওপর পুলিশের দমনপীড়নের বহুবিধ ঘটনার বর্ণনা সামনে এনেছে রাজনৈতিক কর্মীদের তথ্যানুসন্ধানী টিমের প্রতিবেদনটি। টিমের পক্ষে সিপিআই(এমএল) নেত্রী কবিতা কৃষ্ণান, স্বরাজ অভিযানের নেতা যোগেন্দ্র যাদব, ইউনাইটেড এগেইন্সট হেট-এর নাদিম খান ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী হর্ষ মান্দার তাঁদের সরজমিন তদন্তের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে গত ২৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, উত্তরপ্রদেশে আইনের শাসন এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে যেকোনও মুহুর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এরকম পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য পুলিশকে প্রত্যক্ষত দায়ি করেন তাঁরা। পুলিশের ভূমিকার দিকে আঙুল তুলে তাঁরা দেখিয়ে দেন যে, ভারতের বৃহত্তম জনসংখ্যার এই রাজ্যটিতে একের পর এক ঘটনায় মুসলমান ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীকে আক্রমণের নিশানা বানিয়েছে পুলিশ।

“সিএএ ও এনআরসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নাগরিকদের আতঙ্কিত ও হয়রান করতে উত্তরপ্রদেশ সরকার বেআইনী ও প্রাণঘাতী কৌশল নিয়েছে”, বলেন যোগেন্দ্র যাদব। “নির্লজ্জভাবে” মুসলমান ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের টার্গেট করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

“লক্ষ্যটা কেবল ইউপিতে সিএএ-এনআরসি বিরোধী বিক্ষোভকে দমন করাই নয়, বরং যে কোনও বিষয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে চাইলে তার বিরুদ্ধে সিগনাল দেওয়াই লক্ষ্য”, প্রেস বিবৃতিতে লিখেছেন তথ্যানুসন্ধান দলটি।

বারাণসীতে প্রতিবাদীদের ওপর পুলিশ লাঠি চালালে আট বছরের এক বালকের মৃত্যু হয়।“যাদের এভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজানো হচ্ছে। এঁদের মধ্যে একজন, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আগে রিক্সা চালাতেন। তাঁর পরিচিতিপত্রে দিল্লিতে বসবাসের কথা লেখা আছে। বর্তমানে কয়েক বছর মীরাটে থাকেন। এখন পুলিশ তাঁকে “দাঙ্গার মূল মাথা” হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। অভিযোগ আনা হয়েছে যে সেই নাকি বাইরে থেকে অনেককে এনে দাঙ্গায় নিয়োগ করেছে। এই যুবকটিকে যারা যারা চেনেন প্রত্যকেই বলেছেন যে এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা”, বললেন কবিতা কৃষ্ণান, যিনি মীরাট পরিদর্শন করে এসেছেন।

কবিতা জানিয়েছেন যে, যাদের হত্যা করা হল তাঁদের ময়নাতদন্তের রিপোর্টও পরিবারকে দেয়নি পুলিশ।

“মুসলমান বসতিগুলিতে সারা রাত বাড়ি পাহারায় থাকছে মানুষেরা। পুলিশের রেইড বা সাম্প্রদায়িক হামলার আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত তাঁরা”, বলেন কবিতা।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “এইসব পরিবারগুলিকে আর্থিক ও আইনী সাহায্য পৌঁছে দেওয়া সবার আগে জরুরি”।

কবিতা বলেন, তিনি হাবিব নামের একজনের সাথে কথা বলেছেন যাঁর ছেলে আলি পুলিশের গুলিতে মারা গেছে মীরাটে। “ওঁর মুখোমুখি হতেও আমি লজ্জিত বোধ করছিলাম। তিনি বলছিলেন যে তাঁর ছেলেটা পড়শি হিন্দুদের কোলেপিঠেই মানুষ হয়েছে। বলছিলেন যে হিন্দুদের চোখে কখনও ঘৃণা তো দেখেননি, তাহলে কেন এই সরকার তাদের বিরুদ্ধে এমন উঠে পড়ে লেগেছে।

“কুসংস্কারগ্রস্ত একটি সরকারকে, মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ-বিষে পূর্ণ একটি সরকারকে, ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের মধ্যে দিয়ে ঠিক করতে দেওয়া চলে না যে কে সন্দেহজনক নাগরিক আর কে নয়। নিজের জনতার ওপর ভয়ানক মাত্রার দমনপীড়ন থেকে জনতার দৃষ্টি সরাতে সরকার কখনও একটা পাথর ছোঁড়ার ভিডিও, কখনও বা বিক্ষোভের মধ্যে একটা অস্ত্রধারী বা দুস্কৃতির ভিডিও ছড়াচ্ছে। এরকম দুএকটি ছবি তুলে ধরে কি এত বড়ো ও নৃশংস পুলিশী দমনপীড়নকে কি বৈধতা দেওয়া চলে? এই প্রশ্ন অবশ্যই আমাদের তুলতে হবে”, বলেন কবিতা।

রাজনৈতিক আশ্রয় সংক্রান্ত বর্তমান আইনের মধ্যে দিয়ে শরণার্থীরা ভারতে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন জানাতে পারে বলে উল্লেখ করেন কবিতা কৃষ্ণান, “এই মুহূর্তে সিএএ-এর মতো একটি বৈষম্যমূলক আইনের কোনও প্রয়োজন কোথাও ছিল না। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা ছাড়া সরকারের আর কোনও উদ্দেশ্যই আপনারা ভেবে বের করতে পারবেন না”।

তথ্যানুসন্ধান দলটির প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, “মীরাটে সবচেয়ে খারাপ বিষয় যেটা ঘটছে তা হল গরিব ও চিরবঞ্চিত মানুষদেরই হত্যা করা হয়েছে এবং সর্বোপরি, মামলা করা হয়েছে সেইসব নিহত মানুষগুলোর বিরুদ্ধেই। এই মানুষগুলো ছিলেন তাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। এইসব বিপন্ন পরিবারগুলির কোনওরকম অভিযোগও জমা নেয়নি পুলিশ”।

নাদিম খান বলেন, অধিকাংশ আক্রমণগুলিই মুসলমানদের ওপর হয়েছে, তবে বারাণসী ও লক্ষ্ণৌতে বহু সংখ্যক অধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। “উত্তরপ্রদেশে সমগ্র রাজ্য জুড়ে দখতে পাবেন পুলিশ অসংখ্য হোর্ডিং টাঙিয়েছে অ্যাক্টিভিস্টদের সম্পর্কে তথ্য চেয়ে। এই অ্যাক্নিভিস্টরা সকলেই সুপরিচিত। তবু পুলিশ সাধারণ মানুষকে বলছে তাঁদের সম্পর্কে তথ্য দিতে। উচ্চ পদস্থ পুলিশদের মধ্যে যেন কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেছে কে কত বেশি এফআইআর দায়ের করতে পারে”, বলেন নাদিম।

গত এক সপ্তাহে ইউপিতে এক লক্ষের বেশি এফআইআর হয়েছে অনামী ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে। শুধুমাত্র কানপুরেই ২২,৫০০০ এফআইআর, মুজফ্ফরনগরে ৫,৫০০, মীরাটে ৫,০০০, বাহরাইচে ২,২০০। যাকে খুশি আটক করার কাজে এইসব নামহীন অভিযোগগুলিকে ব্যবহার করছে পুলিশ”। গোটা মুসলমান সমাজ উদ্বেগে আছে।

“আতঙ্ক এতটাই যে মানুষ বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। অনেক জায়গায় পুলিশ প্রথমে অভিযোগ দায়ের করছে, তারপর আর্থিক অবস্থা বুঝে মুক্তির জন্য ঘুষ চাইছে”, বলেন নাদিম খান।

আরও জরুরি বিষয় হলো, তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেবলমাত্র ইউপি আসাম কর্ণাটকের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতেই অথবা কেন্দ্রের বিজেপি নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশের দ্বারাই এই ধরনের ঘটনাগুলি ঘটছে কেন?

“ভারত জুড়ে বড়ো বড়ো প্রতিবাদ জমায়েতগুলি হয়েছে — নাগপুর, মুম্বাই, কলকাতা, জয়পুর বহু জায়গায় – কোথাও একটি কোনও হিংস্র ঘটনার কোনও রিপোর্ট নাই। বোঝা যায় যে, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অশান্তির ছবি তৈরি করার পেছনে বিজেপি সরকারের সাথ আছে”, বলেন নাদিম।

যোগেন্দ্র যাদব বলেন, এমনই আতঙ্কের রাজত্ব যে লখ্নৌতে প্রেস মিট করতেও নিষেধ করা হয় তাঁদের।

“আমরা খবর পাই যে মীরাট ও মুজফ্ফরনগরে সমস্ত প্রাভেট হাসপাতালকে পুলিশ কড়া নির্দেশ দিয়েছে যাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত কাউকে ভর্তি করা না হয়। কেবলমাত্র সরকারি হাসপাতালেই এইসব আহতদের ভর্তি করা হয় এবং সেখানে আহতদের পরিবারের কাউকেই আহতদের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি”, বলেন যাদব। তিনি বলেন ইউপিতে মুসলমানদের বিদেশী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য এমনকি আইনি সহযোগিতাও অস্বীকার করা হচ্ছে। “ভিক্টিমদের সহযোগিতায় যে সব অইনজীবী পৌঁছেছিলেন, তাঁদেরকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে”। যোগেন্দ্র বলেন, “মোদি জনতাকে আত্মসমীক্ষা করতে বলছেন! কিন্তু মোদি কি ভারতের যুব সমাজের কথায় একটু কর্ণপাত করে আত্মসমীক্ষা করবেন? এনপিআর-এনআরসি তো পরের ব্যাপার, তার আগেই তো মুসলমানদের প্রতিবাদ করার মৌলিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে”।

হর্ষ মান্দার বলেন যে, মোদি সরকার জনতার সাথে ধারাবাহিকভাবে নির্জলা মিথ্যা কথা বলে চলেছে এবং ত্রিমুখী খেলা খেলছে, তারা প্রথমে ইস্যুকে সাম্প্রদায়িক রং দিচ্ছে, তারপর ফেক নিউজে ভাসিয়ে দিচ্ছে এবং শেষে সরকারী বল কাজে লাগিয়ে নির্মম দমন নামাচ্ছে।

তথ্যানুসন্ধান দলটি সমস্ত আটক ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তি এবং সুপ্রিম কোর্টের তত্বাবধানে পুলিশের কার্যকলাপের তদন্ত দাবি করেন। তাঁরা আরও বলে যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের জরুরি কর্তব্য হওয়া উচিৎ রাজ্য সরকারের এই বাড়াবাড়িকে স্বতপ্রণোদিতভাবে নজরে এনে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া।

তথ্যানুসন্ধানী দলটি আরও বলে যে, প্রতিবাদী মিছিল সমাবেশগুলিতে যদি কোনও দুস্কৃতি থাকে তাহলে পুলিশের উচিত সমস্ত তথ্য জোগাড় করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, সারা রাজ্যে ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা নয়। “রাজ্য সরকারের একথা বোঝা উচিত যে গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিকের বিক্ষোভ পোষণ ও প্রতিবাদ প্রদর্শনের অধিকার আছে। তা কখনই পুলিশী দমনপীড়নের বাহানা হতে পারে না যেমনটা ইউপিতে ঘটছে”।

সংবাদ সম্মেলনের শেষে চলচ্চিত্র জগতের প্রতিবাদী ব্যক্তিত্ব স্বরা ভাস্কর ও জীশান আয়ুব একটি আবেদন পাঠ করেন যেখানে ভারতের বিচার বিভাগের কাছে আর্তি জানান হয় উত্তরপ্রদেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বতপ্রণোদিত উদ্যোগে মামলা করার ও জীবনহানি, অঙ্গহানী ও সম্পত্তিহানির তদন্ত করার।

(দ্যা অয়্যার, দ্যা টেলিগ্রাফ ওটাইমস অব ইন্ডিয়ার রিপোর্ট থেকে সংকলিত)

খণ্ড-27
সংখ্যা-1