প্রতিবেদন
মোদি সরকার কেন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিলো?
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

জম্মু এবং কাশ্মীর হচ্ছে একটা সম্পদশালী দেশ। এখানে পাওয়া যায় কয়লা, বক্সাইট, লিগনাইট, তামা, সিসা, নিকেল, চুনাপাথর বা লাইমস্টোন, বোরাক্স, এবং বহুমূল্য পাথর। জম্মু এবং কাশ্মীরের খনিজ সম্পদের বিস্তৃত পরিমাণটা নিম্নরূপঃ

t-1

 

এছাড়া আছে অরণ্য সম্পদ। আছে জলসম্পদ। ঝিলম, ইন্দু, চেনাব, তাওয়াই ছাড়াও রয়েছে অজস্র ঝোরা, লেক ইত্যাদি। জল, বায়ু এবং সৌরালোক থেকে প্রতি বছর অন্তত ১০ গিগাওয়াট শক্তি এখানে পাওয়া যায়। উদ্যান পালন (horticulture) এবং ফুলের চাষ (floriculture) গ্রামীণ ব্যাপক জনগণকে এখানে কর্মসংস্থান যোগায়। আপেল চাষে বিশ্ববাজারে রপ্তানিতে এখানকার ভাগ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১২-১৩ সালে যা ছিল ৬৫.৯৭ শতাংশ তা বেড়ে ২০১৪-১৫ সালে হয়েছিল ৬৯.১৫ শতাংশ। এই রাজ্য আখরোট রপ্তানিতেও একটা বড় ভাগীদার। আন্তর্জাতিক বিশ্বের ৭ শতাংশ আখরোট রপ্তানি করে জম্মু এবং কাশ্মীর। হস্তশিল্প থেকেও এখানে মানুষের ব্যাপক অন্নসংস্থান হয়ে থাকে। এই শিল্পটি ক্রমবর্ধমান। ১৯৯০-৯১ সালে এই শিল্পে যেখানে কাজ করতেন ২.২৫ লক্ষ মানুষ ২০০৭-০৮-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩.৫০৫ লক্ষে। ১৯৯০-৯১ সালে এই শিল্পদ্রব্যকে বাইরে রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৩৪.৬০ কোটি, ২০০৭-০৮-এ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২০০.৪৭ কোটি টাকা। এছাড়াও ট্যুরিজমকে ঘিরে যে একটা বড় অর্থ লেনদেন হয় কাশ্মীরে সেটা তো স্বাভাবিক। একে ঘিরে হোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসর্টের ব্যবসার পাশাপাশি চলে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসাও। এতো অশান্তির মধ্যেও স্রেফ ২০১৫ সালেই এখানে বেড়াতে এসেছেন ৫৮,৫৬৮ জন। এই যাবতীয় ব্যবসা এবং সম্পদের মালিকানা পাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এ ধারার যে বাধাটুকু ছিল সেটাকে ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির জন্য হঠিয়ে দেওয়াই মোদি-অমিত শাহদের লক্ষ্য। যদিও এতদিন ভারতীয় বৃহৎ পুঁজি নানাভাবে লিজ ইত্যাদি নিয়ে তাকে একটা মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু কাশ্মীরের বাজার, কাশ্মীরের সম্পদ এবং কাশ্মীরে সস্তা শ্রমের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারতীয় বৃহৎ পুঁজির এই কাশ্মীর নীতি, গোটা কাশ্মীরকে জেলখানায় পরিণত করে, যা মোদি-শাহদের মাধ্যমে তারা লাগু করল। ‘বিজনেস ইকোনমি’র ১২ নভেম্বরের ’১৯ রিপোর্ট জানাচ্ছে কাশ্মীরের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাসট্রি-র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এখানে অর্থনীতির অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, লোকসানের বহর গত ৫ আগস্ট থেকে বীভৎস মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর কারণ হিসেবে থেকে গিয়েছে সরকারের তরফে জারি করা ইন্টারনেট, প্রিপেড মোবাইল ফোন, এসএমএস পরিষেবা বন্ধের আদেশ। গত ১০০ দিন ধরে এই অরাজকতার সাক্ষী থেকেছে কাশ্মীর।

t-2

 

মোদী-শাহদের কাশ্মীর দখলের পিছনে আছে এদেশের বৃহৎ পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির প্রতি প্রেম।

ইতিহাসবিদ পার্থ চ্যাটার্জী তাঁর ‘কাশ্মীর ইজ দ্য টেস্ট বেড ফর আ নিউ মডেল অব ইন্টারনাল কোলোনিয়ালিজম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে ৩৭০ নং ধারা বাতিলের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যখ্যা করতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিককে তুলে ধরেছেন। তিনি  লিখেছেনঃ এটা চিন্তাভাবনার যথেষ্ট কারণ আছে কেন বিজেপি সরকার কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু এবং কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করে সরাসরি সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। আফগানিস্তান এবং আমেরিকার মধ্যে রণনৈতিক সুবিধাজনক স্বার্থে আফগানিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য আসন্ন চুক্তির প্রেক্ষিতে পাছে পাকিস্তান কোনও বিশেষ সুবিধা পেতে পারে এই আশঙ্কাই কি ভারত সরকারকে ভাবিত করেছিল? এতে করে কি কাশ্মীরের রাজনীতি এবং ভৌগোলিক প্রশ্নে কোনও আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল? এসব ঘিরেই কি একটা উদ্বেগাকুল এবং হতাশাজনক পরিস্থিতির আবর্ত তৈরি হচ্ছিল যার জন্যে তড়িঘড়ি সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে? অবশ্যই এই সিদ্ধান্তের বৈধতা খুঁটিয়ে দেখার বিষয়। কিন্তু এই সূত্রে সরকার কাশ্মীরে যে  রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তার অনুশীলন করে চলেছে তা সেখানকার জনসাধারণকে এক সন্ত্রাসশাসিত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

রাজনৈতিকভাবে বিজেপির যুক্তি, এক দেশে অন্য আইন চলবে কেন? কিন্তু শুধু কাশ্মীর নয়, ৩৭১ ধারা অনুসারে যারা হিমাচলপ্রদেশের বাসিন্দা নন তারা সেই রাজ্যের জমি কিনতে পারবেন না। একইভাবে ৩৭১-এ ধারা অনুযায়ী নাগাল্যান্ড, ৩৭১-এফ অনুযায়ী সিকিম, ৩৭১-জি অনুযায়ী মিজোরাম, ৩৭০-এইচ অনুযায়ী অরুণাচল প্রদেশ এবং ৩৭১-আই অনুসারে গোয়া — সবাই সংবিধানের বিশেষ ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। বিজেপির এই যুক্তি অনুযায়ী কিন্তু এই রাজ্যগুলোর বিশেষ অধিকারও একদিন তাদের কেড়ে নেওয়ার কথা। মনে হয় বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ত শক্তির  ক্ষমতা আরো বাড়লে সে সব বাস্তবায়িত করতেই পারে যদি এদেশের বৃহৎ পুঁজি আরো সংকটে পড়ে। আজকের সংকটে আপাতত তারা কাশ্মীরকেই বেছে নিচ্ছে, যেহেতু কাশ্মীরের সংখ্যাগুরু জনতাই মুসলিম এবং রাজ্যটি পাকিস্তানের প্রতিবেশী। তাদের উগ্রবাদী বলে তাদের দাগিয়ে দেওয়া সুবিধাজনক, তাই কাশ্মীর দিয়েই প্রথম পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজটা তারা শুরু  করল। কিন্তু এটাও ঠিক তাদের এই ফ্যাসিস্ত কার্যকলাপ তারা কতোদিন চালাতে পারবে তা নির্ভর করছে কাশ্মীর সহ সারা ভারতের জনতার সংগ্রামের উপর। এই অবিমৃশ্যকারিতার পরিণতি শেষমেশ অবশ্যই খারাপ হতে বাধ্য।

(সমাপ্ত)
- অভিজ্ঞান সরকার

খণ্ড-27
সংখ্যা-2