প্রতিবেদন
রণাঙ্গনে ‘পরাজিত’ সৈনিক : হেরে যাওয়া মানুষের ‘প্রতিবাদ’

(ক)

সম্প্রতি দুই প্রসূতির মৃত্যুকে ঘিরে চিকিৎসা পরিষেবা, দু-ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। ঘটনাগুলো আরো কত ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছে। কত মানুষের  বিচিত্র মনোভাবের বহিঃপ্রকাশকে সামনে এনেছে ও আনছে।

মুর্শিদাবাদ জেলার লালবাগ হাসপাতালে, এক প্রসূতির অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে মৃতার সামনে মালা পরিয়ে বলা হয় ‘ভারত মাতার শ্রেষ্ঠ সন্তান’!

আর কলকাতার সিএমআরআই হাসপাতালে সিজার হওয়া প্রথম প্রসূতির অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় মৃতার স্বামী, চিকিৎসককে চড় মারেন।

চিকিৎসা পরিষেবাতে এই দুই ঘটনা নিয়ে আমাদের আলোচনা। দুটি ঘটনাই মর্মান্তিক, অস্বাভাবিক ও অনাকাঙ্খিত। যা সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

(খ)

চিকিৎসকরা মানুষের রোগ-ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, রোগীর সহযোদ্ধা। একজন সৈনিক। মূল লড়াইটা রোগীরা নিজেরা করেন। রোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে, চিকিৎসকরা রোগীদের সহযোগিতা করেন। ডাক্তাররা হচ্ছেন চিকিৎসা পরিষেবা-ব্যবস্থাপনার রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি!

পরিষেবাতে একজন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত ভূমিকা কতটুকু? পরিষেবার পরিকাঠামো, তার কর্মীবাহিনী, সরকার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চিকিৎসকরা মানুষের  রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। কিন্তু সমাজের মানুষ চিকিৎসক-সেনাপতিকে সামনে থেকে দেখেন। চলমান সমাজের বর্তমান ব্যবস্থাপনা, এভাবেই একজন চিকিৎসককে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!

(গ)

চিকিৎসকরা মানুষ। রোগীরাও মানুষ। দুই মানুষের সামাজিক অবস্থান আলাদা। দুই মানুষের অদৃশ্য বন্ধন, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক নিয়ে, সমাজে হাজির  হয়েছে।

সমাজ সৃষ্টির ঊষাকালে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক যে রকম ছিল আজকে তা একই রকম নেই। চলমান সমাজের অগ্রগতিতে, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক, রূপ-রস-গন্ধের কত বৈচিত্রময় রূপান্তর নিয়ে হাজির হয়েছে!

রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও বুর্জোয়া সমাজের মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদী সমাজে, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক নগদ মূল্যে জারিত। এ সমাজ চিকিৎসকদের করে তুলেছে ‘প্রযুক্তি শ্রমিক’ (মার্ক্স-এঙ্গেলস)। তাই আজ রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চিকিৎসকরা হয়েছেন রোগীদের পরিষেবা প্রদানকারী ‘ভাড়াটে সৈনিক’!

চিকিৎসার বাজারী ব্যবস্থাপনা একজন চিকিৎসককে রোগীদের জীবন যুদ্ধের লড়াইয়ে ‘নিজস্ব সৈনিক’-এর বদলে ‘ভাড়াটে সৈনিক’ হিসেবে গড়ে তুলেছে। ফলে পরাজিত সৈনিকের প্রতি রোগী বা মানুষের রাগ গিয়ে পড়ে। চিকিৎসকের পরাজিত হওয়াকে যুদ্ধের স্বাভাবিক পরিণতি বা নিয়ম বলে মানুষ মেনে নিতে পারেন না।

(ঘ)

মাটিতে শায়িত মৃত প্রসূতির সামনে ‘চিকিৎসকের গলায় মালা’ পরানো বা পেট কেটে বাচ্চা হওয়া প্রথম প্রসূতির অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ডাক্তারকে ‘স্বামীর চড়’ কি কোনোদিন প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে? না। সমাজে এ কাজ কি চিকিৎসকদের ‘যুদ্ধ জয়ের’ নিশ্চয়তা দিতে পারে? না। লড়াইয়ে পরাজয় এড়াতে পারে? না। ফিরিয়ে দিতে পারবে প্রতিটি মানুষের জীবন? না। ‘চড় মারা’ বা : মালা পরানো’র ঘটনা কেবলই অসহায় পরাজিত মানুষের সংশয়, অশ্রদ্ধা, ক্ষোভ, রাগ, ঘৃণা, বঞ্চনা, অপমান ও সব হারানো জীবনের ক্ষণস্থায়ী বহিঃপ্রকাশ হতে পারে!

বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে  এগিয়ে চলা  সমাজ, আমাদের ইচ্ছানিরপেক্ষ ভাবে, আলোচিত দুটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এই দুই ঘটনার কারিগর কি কেবলই রোগী ও চিকিৎসক? না। একে ঘিরে রয়েছে  বিরুদ্ধতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা সমাজ।

প্রতিদিন হাসপাতাল রণাঙ্গনে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে! মানুষ স্বাভাবিক আচরণে তা মেনে নিয়েছেন। কেবল দু একটি ঘটনায় রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক এ ধরনের বিরুদ্ধতা নিয়ে হাজির হয়েছে! এই ঘটনাগুলো দিয়ে চলমান সমাজের সব কিছু বিচার করা যাবে না!

(ঙ)

সমাজ মাধ্যমে অনেকে ডাক্তারকে ‘চড় মারা’ বা ‘গলায় মালা পরানো’ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এঁদের মধ্যে চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ আছেন।

চিকিৎসকদের অনেকে ভাবছেন, ‘ডাক্তার হওয়া উচিত হয়নি’, ‘সন্তানদের কোন দিন ডাক্তারি পড়াবেন  না’, ‘সেতু ভেঙে পড়ার জন্য ইঞ্জিনিয়ার কেন চড় খাবে না’, ‘পাড়ার মস্তান কে আটকানোর জন্য মানুষের ‘চড়’ কোথায় ইত্যাদি।

কেউ কেউ উঠতি বুর্জোয়া যুগের রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের সাথে আজকের মুমূর্ষু পুঁজিবাদের (মুমূর্ষু সাম্রাজ্যবাদ-লেখক) যুগের রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক মেলাতে গিয়ে হতাশার বর্ণমালা সাজিয়েছেন!

আমাদের মনে রাখতে হবে, যাঁরা চিকিৎসা পেশায় এসেছেন তাঁরা স্বেচ্ছায় এসেছেন। তাঁদের ‘ইচ্ছা’ আকাশ থেকে পড়েনি বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের চাপিয়ে দেওয়া নয়। তাঁদের ডাক্তার হওয়া ‘ইচ্ছা’র জন্ম, বিকাশ ও এগিয়ে চলা সমকালীন সমাজের চলনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে।

বেশির ভাগ সংবেদনশীল মানুষ কেবলই রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ ও সমাধান খুঁজছেন। কিন্তু রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক তো, যে কোনো সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে। বিকাশ লাভ করে। যে কোনো ঘটনার মূল্যায়ণ করতে হলে চলমান সমাজের বিরুদ্ধতার বিশ্লেষণ জরুরী।

সৌজন্য : সোসাইটি ফর সোসাল ফার্মাকোলজি। পশ্চিমবঙ্গ।
- স্বপন জানা

খণ্ড-27
সংখ্যা-5