এআইপিডব্লিউ এ-র সর্বভারতীয় কনফারেন্স : নির্ভয় স্বাধীনতা’র জন্য

ঝকঝকে রোদের নীল আকাশ। শত শত শ্বেত কপোত যেন মুক্তির আনন্দে ডানা মেলেছে!

অ্যাপোয়ার সাদা নিশান নিয়ে কয়েকশো নারীর প্রতিবাদের দৃপ্ত মিছিল উদয়পুরের বিভিন্ন অঞ্চল যখন পরিক্রমা করছিল--পথের দু’ধারে তখন কাতারে কাতারে লোক। তাদের চোখভরা বিস্ময়। মিছিলে সামিল পাঁচ থেকে পঁচাশি।

জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কণ্ঠে ‘আজাদী’র শ্লোগান—ক্ষুধা দারিদ্র্য অপুষ্টি অশিক্ষা বেকারত্ব হিংসা ভয় অমর্যাদা থেকে, মনুবাদী পিতৃতন্ত্র থেকে ‘আজাদী’।

সিএএ, এনপিআর, এনআরসি’কে রুখে দেওয়ার, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার শপথে আকাশ বাতাস মুখরিত করে, দীর্ঘ পথ হেঁটে মিছিল যখন রাজস্থান কৃষি মহাবিদ্যালয়ের সবুজঘেরা চত্বরে পৌঁছালো তখন তার মেজাজই আলাদা।

অ্যাপোয়ার (সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির) অষ্টম সর্বভারতীয় সম্মেলন (৮-৯ ফেব্রুয়ারী) এবার কমরেড শ্রীলতা স্বামীনাথনের স্বপ্নপূরণের জন্য রাজস্থানের উদয়পুরে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাঁর নামাঙ্কিত সভাকক্ষে, শহীদ কালী বাঈয়ের নামাঙ্কিত মঞ্চে। কমরেড শ্রীলতা ছিলেন সকলের ভালোবাসার, আদ্যন্ত এক সংগ্রামী নেত্রী, অ্যাপোয়ার এক সময়ের সর্বভারতীয় সভানেত্রী। কিন্তু কে এই কালী বাঈ? বীরত্ব আর আত্মবলিদানের সে এক অপরূপ রূপকথা! জন্ম তার ডুংগারপুরের এক ভীলগ্রামে। ব্রিটিশ শাসনের সামন্তী ভারত। গ্রামে পড়াশুনোর চল নেই। তখন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা শিক্ষার প্রসারেও সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাদের অনুপ্রেরণায় রাস্তাপাল গ্রামে নানা ভাই এক পাঠশালা খুলে ফেললেন। সামন্ত প্রভু ব্যাপারটা মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। দলিত আদিবাসীরা শিক্ষিত হলেই নির্মম শোষণ আর অমানবিক বর্বর ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলবে, রুখে দাঁড়াবে! তিনি পাঠশালা বন্ধ করার হুকুম দিলেন। ১৯৪৭ এর ১৯ জুন। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ নিয়ে হাজির পাঠশালা বন্ধ করতে। নানা ভাই এবং পাঠশালার শিক্ষক সেঙ্গা ভাই রুখে দাঁড়ালেন। পুলিশ লাঠি, বন্দুকের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে দু’জনকে পেটাতে লাগল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নানাভাই ঘটনাস্থলেই মারা গেলেন। সেঙ্গা ভাই বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিলেন। সভ্যতাগর্বী ব্রিটিশ শাসকের পুলিশ অচেতন সেঙ্গার কোমরে দড়ি বেঁধে গাড়ির সঙ্গে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আশপাশে ভীড় জমে গেল, কিন্তু সাহস করে কেউ বাধা দিতে পারছিল না। সেই সময়ে নিজেদের জমিতে ঘাস কাটছিল বারো বছরের ভীল বালিকা কালী বাঈ। গোলমাল শুনে দৌড়ে এল কাস্তে হাতে। সেঙ্গা তার শিক্ষক, সেও পাঠশালাতে পড়তো। সেঙ্গাকে বাঁচানোর জন্যে সে গাড়ির পিছনে চিৎকার করতে করতে প্রাণপণে দৌড়ালো। পুলিশ তখন গাড়ি থামালে সে দৌড়ে গিয়ে দড়িটা কেটে দিল। অন্য মহিলাদের সেঙ্গার চেতনা ফেরাতে জল আনতে বলল। ক্ষিপ্ত পুলিশ এবার গুলিবর্ষণ শুরু করল। গুরুতর আহত কালী লুটিয়ে পড়ল। অন্য মহিলারাও আহত হলেন। হতবাক গ্রামবাসীদের এবার সম্বিত ফিরল। মারু ঢোল বাজতে লাগল উদ্দাম বেগে—যে যার মতো অস্ত্র নিয়ে পুলিশকে আক্রমণের সংকেত পেয়ে গোটা ভীল গ্রাম গর্জে উঠল। ঘরোয়া হাতিয়ার নিয়ে আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে ছুটে এল গ্রামবাসীরা। এই মারু ঢোলের ‘শত্রুকে মেরে মরার’ সংকেত পুলিশের অচেনা নয়। তৎক্ষণাৎ তারা গাড়ি নিয়ে পালিয়েছিল। গ্রামবাসীরা নানা ভাইয়ের শব আর আহতদের নিয়ে ছুটলো ডুংগারপুর হাসপাতালে। সেখানে ৪০ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে শহীদ হল কালী বাঈ। শিক্ষক তথা আদিবাসীদের শিক্ষার অধিকার রক্ষায় দুর্জয় সাহস আর আত্মবলিদানের এক অনন্য নজির গড়ে গেল স্বাধীনতার এই ক্ষুদে সেনানী। অ্যাপোয়ার অষ্টম সর্বভারতীয় সম্মেলন তাই মঞ্চটি তার নামে চিহ্নিত করে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

manch

 

সম্মেলন-মঞ্চটিকে বলিষ্ঠভাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কয়েক মাসের প্রচার পর্বে উঠে এসেছে আরও কয়েকটি নাম, সমাজ বদলের স্বপ্ন ও অনন্য জেদে, ত্যাগে, সাহসিকতায়, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতায় যারা ভারতীয় নারীর সংগ্রামী ঐতিহ্য বহন করছেন। যেমন সাবিত্রী বাঈ ফুলে (৩ জানুয়ারি ১৮৩১-১০ মার্চ ১৮৯৭)। ১৮৪০-এ দলিত পরিবারের দুই সন্তান, নয় বছরের সাবিত্রীর সঙ্গে বারো বছরের জ্যোতি রাও-এর বিবাহসূত্রে যে বন্ধন গড়ে উঠেছিল, তা যে ভারতের নারীশিক্ষা তথা দলিত অধিকারের ক্ষেত্রে এক অনন্য ইতিহাস তৈরি করবে তা কে জানতো? ১৮৪৮ সালে তরুণ দম্পতি পুণের ভিদে ওয়াদায় ভারতের প্রথম মেয়েদের তথা দলিতদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। আর তার জন্যে সমাজের রক্তচক্ষু তো বটেই, বাড়ি থেকেও বিতাড়িত হলেন। সেই স্কুলের শিক্ষিকা সাবিত্রী ও ফতেমা শেখকে স্কুল(যেখানে মুসলিম বালিকারাও পড়তো) যাওয়ার পথে মানুষের ছোঁড়া পাঁক, পাথরের দৈনিক ‘আপ্যায়ন’ নির্বিকার ভাবে হজম করতে হত, সঙ্গে রাখতে হত আরেক প্রস্থ শাড়ি! ফুলে দম্পতি সমাজের এই ‘উষ্ণ অভ্যর্থনা’র মধ্যেও ১৮টি স্কুলই শুধু গড়ে তোলেননি, রক্ষণশীল সমাজের ব্যাভিচারের শিকার ধর্ষিতা নারী ও তাদের সন্তানদের জন্য কেয়ার সেন্টার বা আশ্রমও গড়ে তুলেছিলেন! ভাবা যায়! আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে! সাবিত্রী সমাজের বৈষম্য নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। অসাধারণ এই বর্ণময় জীবন শেষ হয় প্লেগ-আক্রান্তদের সেবা করতে গিয়ে সংক্রমণে, পুণেতেই। সাবিত্রী-ফতেমার এই সংগ্রামী সখ্য সেই সময়ে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যেরও এক অপূর্ব নজির। আরও আছেন রাণী লক্ষ্মী বাঈ, বেগম হজরত মহল। হজরত মহল (১৮২০-৭এপ্রিল ১৮৭৯) অযোধ্যার বেগম, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের দ্বিতীয়া স্ত্রী। ১৮৫৭-র সিপাহী বিদ্রোহে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি মহিলাদের নিয়ে এক নারী বাহিনী গড়ে তোলেন যার অধিনায়িকা ছিলেন উদা দেবী। তীব্র লড়াই করেও হজরত ইংরেজ বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে নেপালে আত্মগোপন করেন, সেখানেই মারা যান। পুরুষ-শাসিত সমাজে এই বীরাঙ্গনা অপূর্ব সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।

ভারতীয় নারীর এই সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এই অষ্টম সর্বভারতীয় সম্মেলনের মঞ্চে এবার মূল বার্তাটি ছিল—ভারতের গণতন্ত্র তথা সংবিধান রক্ষা এবং সেই লক্ষ্যে দেশজোড়া সিএএ, এনপিআর, এনআরসি বিরোধিতাকে আরও তীব্র ও ব্যাপক করে তোলা। দেশের প্রতিটি কোণে কোণে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষকে একজোট করে নারী জাগরণের প্রতীক অসংখ্য ‘শাহীনবাগ’ গড়ে তোলা, গড়ে ওঠা প্রতিটি ‘শাহীনবাগের’ পাশে দাঁড়ানো, নাগরিকত্ব আন্দোলনে কর্ণাটকের বিদার, মহীশূর এবং মুম্বাই সহ সমস্ত অঞ্চলে আরোপিত ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ প্রত্যাহার করতে হবে। প্রত্যেকটি রাজ্য সরকারকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এনপিআর, এনআরসি প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। এই সম্মেলনের ঘোষণা, কাশ্মীর থেকে অবিলম্বে ‘লক ডাউন’ তুলে নিয়ে সেখানকার জনগণকে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অংশগ্রহণ করতে দিতে হবে। এই সম্মেলন, ভারতীয় আদালতের সাম্প্রতিক কালে নারী-বিরোধী ও সংবিধান-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রভাবশালী ধর্ষকদের জামিন, কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সিএএ, এনপিআর, এনআরসি এবং জামিয়া ও জেএনইউ-তে দুষ্কৃতী-আক্রমণ নিয়ে শীর্ষ আদালতের ঔদাসীন্যও সকলকে উৎকণ্ঠিত করেছে।

সম্মেলনের অতিথি ও প্রতিনিধিদের সিএএ, এনপিআর, এনআরসি বিরোধিতার রেশ রয়ে গেল সম্মেলন শেষেও। ঘর-ফিরতি বিহারের কমরেডরা সম্মেলন চত্বরেই নাচে-গানে মেতে উঠলেন। ভীড় ঠেলে এগিয়ে দেখি, এক সত্তরোর্ধ ‘তরুণী’ সিএএ নিয়ে বাঁধা গানের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নেচে চলেছেন, তাকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন বয়সী অন্যান্যরা তাকে উৎসাহ দিতে দিতে হেসে গড়িয়ে পড়ছেন।

এই তো প্রাণের উৎসব! উৎসাহ, উদ্দীপনা, মন খুলে কথা আর প্রাণের আনন্দে মেতে ওঠা চত্বরই বলে দিল সম্মেলন কতটা সফল! সম্মেলনের প্রতিটি মুহূর্তে যাদের নিঃশব্দ এবং অদৃশ্য উপস্থিতি সকলে অনুভব করেছেন, তাঁরা হলেন রাজস্থানের ছাত্র যুব এবং মহিলা সংগঠনের একগুচ্ছ তরুণ-তরুণী (প্রবীণরা তো আছেনই)। এঁদের দীর্ঘ সময়ের দরদী অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া এত বড় অনুষ্ঠানটি এত সুন্দর সুশৃঙ্খল বর্ণময় ও প্রাণবন্ত কি হয়ে উঠতে পারত! কুর্নিশ জানাই তাঁদের ভালোবাসাসিক্ত দায়বদ্ধতাকে।

rally

উদ্বোধনী অধিবেশন

মিছিলের সময় আম্বেদকরের মূর্তিতে অ্যাপোয়ার নেত্রীরা শ্রদ্ধা জানান। মিছিল শেষে সম্মেলন কক্ষের বাইরে অ্যাপোয়ার পতাকা উত্তোলন করেন সহ সভানেত্রী অধ্যাপিকা ভারতী এস কুমার। নারী আন্দোলনের শহীদ এবং প্রয়াত কমরেডদের স্মৃতিতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

এরপর রাজস্থানের তরুণ শিল্পীদের ‘শহীদগীতি’ ও শ্রীলতা স্বামীনাথন রচিত ‘অ্যাপোয়া জিন্দাবাদ’ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অধিবেশন শুরু হয়। সভাপতিত্ব করেন অ্যাপোয়ার সভানেত্রী ডঃ রতি রাও, সঞ্চালনায় ছিলেন অ্যাপোয়া সম্পাদক কবিতা কৃষ্ণাণ। অ্যাপোয়ার সাধারণ সম্পাদক মীনা তেওয়ারি অতিথি এবং উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীকে বিদ্রোহিনী সন্ত-কবি মীরা বাঈয়ের ভূমি রাজস্থানে আন্তরিক স্বাগত জানান। মীরা রাজ অন্তঃপুরের কঠোর বিধিনিয়ন্ত্রিত বৈভবের জীবন ছেড়ে নেমে এসেছিলেন সাধিকার সরল অনাড়ম্বর জীবনে। মীনা তার ভাষণে উল্লেখ করেন ফতেমা শেখ এবং সাবিত্রী বাঈ ফুলের দলিত আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ কঠোর প্রচেষ্টার কথা। মনুবাদের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের কথা। সেই মনুস্মৃতিকেই আজ ভারতীয় সংবিধানের জায়গায় বসানোর চেষ্টা চলছে যাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতীয় নারীসমাজ। আর তাই সাবিত্রী-ফতেমার সেই সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় তারাই আজ ভারতীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পুরোভাগে।

পিইউসিএল-এর সংগঠক কবিতা শ্রীবাস্তব বলেন, আমাদের বর্তমান লড়াই শুধু আমাদের ‘সন্দেহজনক’ ও বিপন্ন নাগরিকত্বকে ‘স্বীকৃত’ ও ‘সম্মানজনক’ করে তোলার জন্যই  নয়; আমাদের প্রত্যেকটি নাগরিককে যেসব অধিকার ও সুরক্ষা দানে রাষ্ট্র প্রতিশ্রুত—সকলের জন্য সম্মানজনক কর্মসংস্থান, অবৈতনিক উৎকৃষ্টমানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিচর্যা এবং ন্যায় ও সমতা—সেগুলো পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করার দাবিতেও এই আন্দোলন। প্রাক্তন এআইডিডব্লুএ নেত্রী সুমিত্রা চোপড়া এবং এনএফআইডব্লু নেত্রী নিশা সিদ্ধুও সম্মেলনকে উষ্ণ অভিনন্দন জানান। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্রী সুমাইয়া সেখানে নির্যাতন প্রতিরোধে এএমইউ-এর ছাত্র ছাত্রীদের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। এরপর, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া-র দুই ছাত্রী আখতারিস্তা আনসারি এবং চন্দা যাদব, সেই চারজন ছাত্রীর দুজন, যারা সাহসভরে পুলিশের ব্যাটন থেকে এক ছাত্রকে বাঁচিয়ে গোটা দেশের কাছে এক অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন, তারাও হাজার বিপত্তির মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

কবিতা কৃষ্ণাণ তার সঞ্চালনায় তুলে ধরেন, আসাম এনআরসি’তে প্রামাণ্য নথির অভাবে নাগরিকত্ব খুইয়েছেন যারা তাদের ৭০%ই মহিলা। মহিলাদের জন্য নথির ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রমাণের ফলাফল খুবই বিপজ্জনক।

সম্মেলনের অন্যতম অতিথি ছিলেন কন্নড় লেখিকা এবং নাট্যব্যক্তিত্ব ডি সরস্বতী। তিনি তাঁর ভাষণে দলিত এবং শ্রমজীবী মহিলাদের কঠিন জীবন এবং কঠোর সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। বুদ্ধের জীবন থেকে, আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক, এমন দুটি গল্প তিনি শ্রোতাদের শুনিয়েছেন।

rana

 

অনুষ্ঠানের মুখ্য বক্তা সাংবাদিক রাণা আয়ুব তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেন কীভাবে কন্যাশিশুদের শৈশব থেকেই বৈষম্যের শিকার হতে হয়, কীভাবে ভারতীয় মুসলিম সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সাম্প্রদায়িক হিংসা এক স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করেছে। তিনি জানান যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাহস এবং সত্যবদ্ধতা এক অপরিহার্য শর্ত। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজের এক দুঃসাহসিক তদন্ত-কাহিনি শোনান। ২০১০ সাল, তখন তিনি মাত্র ২৬ বছরের এক তরুণী। ‘ফেক এনকাউন্টারের’ শিকার সোহরাবুদ্দীনের স্ত্রী কৌসর বাইকে যে গণধর্ষণের পর ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছিল, তা তিনি আদালতে প্রমাণ করেন এই তদন্তের মাধ্যমে এবং গুজরাটের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে, খুনের অভিযোগে জেলে পাঠাতে পেরেছিলেন। তিনি ভারত জুড়ে অসংখ্য ‘শাহীনবাগ’-এর লড়াকু নারীদের কুর্নিশ জানান যারা ভারতবর্ষের গণতন্ত্র এবং অস্তিত্বরক্ষার জন্য এক মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্মেলনের অতিথিরা সকলেই জানিয়েছেন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লড়াইটা সকলকে একজোট হয়েই লড়তে হবে এবং তারা ও তাদের সংগঠন অ্যাপোয়ার আন্দোলনের পাশে আছেন।

রাজস্থানের কমরেডরা অতিথিদের হাতে সম্মেলনের স্মারক তুলে দেন। অ্যাপোয়ার সহ সভানেত্রী ও রাজস্থান অ্যাপোয়ার রাজ্য সম্পাদক কমরেড সুধা চৌধুরী সমস্ত অতিথি এবং উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীকে উদ্বোধনী অধিবেশনকে সফল করে তোলার জন্য ধন্যবাদ জানান।

young aipwa

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

৮ তারিখ রাতে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল প্রতিনিধিদের বাড়তি পাওনা। রাজস্থানের ‘তেরা তালি’ সংস্থা ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ও লোকনৃত্য পরিবেশন করে। এক তরুণী শিল্পীর গাগরিনৃত্য উপস্থিত সকলের মনোহরণ করে। মাথার উপর নয় নয় করে ন’টি ঘড়া চাপিয়ে অনায়াস সাবলীলতায় যখন নেচে চলেছে মেয়েটি—দর্শকদের মধ্যে কিন্তু তখন উৎকণ্ঠা! আসলে এ তো বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। ধূসর ঊষর খরাপ্রবণ রাজস্থানের হাজার হাজার নারীকে বহু পথ হেঁটে এইভাবেই অসীম ক্লেশ সয়ে পানীয় ও গৃহস্থালির ব্যবহার্য জল সংগ্রহ করতে হয়। দৈনন্দিন সেই কষ্ট, যন্ত্রণাই শিল্প আঙ্গিকে উত্তীর্ণ হয়েছে অপূর্ব সুষমায়। এরপর কর্ণাটকের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ডি সরস্বতী তাঁর বহুপ্রশংসিত ‘শান্তিম্মি রামায়ণ’ মঞ্চস্থ করেন। এখানে সীতা ও রামায়ণের গল্প বলা হয়েছে এক শ্রমজীবী দলিত নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে। এই কাহিনিতে বহু চেনা রামায়ণের অনেক অচেনা মুহূর্তে আলোক সম্পাত করা হয়েছে। এক দলিত নারীর চোখে, বড় অদ্ভুত পুরুষদের নিজেদের অহং তৃপ্তির জন্য পৃথিবীর উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া—বড় স্বাভাবিক নারীর একান্ত আবেগ অনুভূতির ভিত্তিতে সীতা-শূর্পণখার সখ্য। এ দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কমরেডদের সুন্দর একটি সাঁওতালি নৃত্য। পরের দিন ৯ ফেব্রুয়ারী প্রতিনিধি সম্মেলন শুরুতে বিহারের ‘কোরাস’ সংস্থা গান ও নাগরিকত্ব নিয়ে একটি নাটিকা মঞ্চস্থ করার পর হাওড়ার কমরেডরা চমৎকার দুটি গণসংগীত পরিবেশন করেন।

প্রতিনিধি সম্মেলন

hall

 

উদ্বোধনী অধিবেশনের পর কমরেড মীনা তেওয়ারি বিগত বছরগুলির কাজের খতিয়ান পেশ করেন।এর পর বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য রাখেন। কর্ণাটক  থেকে নির্মলা বলেন, বহু মহিলার কাছেই কোন পরিচয়পত্র নেই,তাই সিএএ, এনপিআর, এনআরসি’র বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সাফাই কর্মীদের চিকিৎসা পরিষেবার জন্যও তারা লড়ছেন। উত্তরপ্রদেশ থেকে মীনা বলেন, নারীর উপর বর্বরতার নানা ঘটনার বিরুদ্ধে যেমন, তেমনি নাগরিকত্ব নিয়েও, হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা লড়াই জারি রেখেছেন। গত বছর ১৯ ডিসেম্বর লখনৌয়ের বুকে যে ভাজপা ও পুলিশের বর্বরতা চলেছে তার বিরুদ্ধে তারা রাজ্যপাল ও মানবাধিকার কমিশনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। পুনম মাহাতো (ঝাড়খণ্ড) জানান,জাতীয় নানা সমস্যা, ‘স্বচ্ছ ভারত’ দুর্নীতি, কস্তুরবা বিদ্যালয়ে অ্যাসিড আক্রমণ, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সমস্যা, জনৈক বিধায়কের নিকটাত্মীয় কর্তৃক ধর্ষণ—এসব নিয়ে অ্যাপোয়ার আন্দোলন চলছে। পাঞ্জাবের নরিন্দর কৌরের মুখে শোনা গেল কীভাবে অ্যাপোয়ার নেতৃত্বে রেশন-দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সরকারি সাহায্য বন্টন (৯৫ লক্ষ টাকা), মোবাইল টাওয়ার সরানো ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিপুল সংখ্যক মহিলা সন্তানসহ কখনও প্রচণ্ড গরমে, কখনও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় দীর্ঘ ধর্ণা অবস্থানে সামিল হয়ে লড়েছেন ও জিতেছেন। কার্বি আঙলঙ-এর বাণী তেরাং বলেন, মহিলা বিশেষ করে শিশু ও বালিকাদের উপর বলাৎকারের বেশ কিছু ঘটনায় অ্যাপোয়ার নেতৃত্বে আন্দোলন হয়েছে, এক ধর্ষককে জেলে পোরাও সম্ভব হয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলের মহিলা সংগঠনগুলো এ ব্যাপারে নীরব থাকে। তবে কার্বি আঙলঙ উইমেন্স জাস্টিস ফোরাম তাদের লড়াইয়ের দীর্ঘদিনের সাথী। সিএএ, এনআরসি নিয়ে আন্দোলন হলেও কিছুটা কম। এখানে মানুষকে ভুল বোঝানো হচ্ছে যে শিডিউলড এরিয়া বলে এখানে কিছু হবে না। আর বিজয়া (পুদুচেরী) বলেন, শেল্টার হোমে নাবালিকা ধর্ষণ, ইন্দিরা গান্ধী হাসপাতালে কর্মীদের প্রসবকালীন ছুটি, পেনশন, রেশন—এ সব নিয়ে অ্যাপোয়া লড়ছে। সদস্যকরণের অভিযান চলছে। দিল্লী অ্যাপোয়ার মালা বলেন, তাদের লক্ষ্য ১০০০ সদস্য। মহারাষ্ট্রের পূজা শাওন জানান, অ্যাপোয়া বাঁধোয়া মজদুরদের জন্য লড়ছে। শ্রমিক মহিলা মোর্চা তাদের সঙ্গী। রাজস্থানের মঞ্জুলতা বলেন, জয়পুর অ্যাপোয়া আশপাশের গ্রামপঞ্চায়েতগুলিতে দোকানঘর বাঁচানোর আন্দোলনে সামিল হয়েছে। ‘২৬ বোনের সংগঠন’ লড়াইটা শুরু করেছিলেন। এখন ‘বোনের’ সংখ্যা প্রায় ৩০০। তারা অ্যাপোয়ার সঙ্গে আছেন। তিনি বলেন, গ্রামীণ ভারতকে ঘরের বাইরে আনতে হবে, লড়াইয়ে সামিল করাতে হবে, তবেই সংগঠন মজবুত হবে। জামিয়া মিলিয়ার ছাত্রী বলেন, এই সরকার দলিত বিরোধী, মুসলিম বিরোধী, জন-বিরোধী। আলিগড় ও জামিয়াতে সংখ্যালঘুদের দমনের জন্য তাদের এক পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ছিল। পুলিশ লাইব্রেরিতে ঢুকে পর্যন্ত মেরেছে। লাঠি, টিয়ার গ্যাস, বুলেট চলেছে। আজ নাগরিকত্বের জন্য মহিলারা বোরখার আড়াল সরিয়ে রাস্তায় নেমেছেন, লড়ছেন, পথ দেখাচ্ছেন। সংবিধান, সংসদ আমাদের। তাকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। আসাম থেকে কমরেড বালি কুমারী বলেন, ভাষা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংগঠন গড়ার কাজ চলছে। আইনী সহায়তার জন্য সব জেলায় ‘লিগাল ক্যাম্প’ গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ডিটেনশন ক্যাম্পে পুলিশ মহিলাদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করে। এর বিরুদ্ধে এবং এনআরসি’তে যারা নাগরিকত্ব খুইয়েছেন তাদের জন্য অ্যাপোয়া লড়বে। ওড়িশা থেকে সবিতা বলেন, নাগরিকত্ব, স্থানীয় সমস্যা, প্রকল্প কর্মীদের সমস্যা, গৃহহিংসা—এসব নিয়ে অ্যাপোয়া লড়ছে। উত্তরপ্রদেশ থেকে কুসুম বলেন, প্রবল দমন পীড়ন সত্ত্বেও নাগরিকত্ব নিয়ে লড়াই চলছে। দেওবন্ধে হিন্দু মহিলারাও অবস্থানে বসছেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে, বিশেষ করে গ্রামীণ ভারতকে সঙ্গে নিয়ে, একজোট হয়ে সংবিধান রক্ষার জন্য অ্যাপোয়াকে লড়তে হবে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে স্বপ্না চক্রবর্তী বলেন, কালী বাঈ, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, ফতেমা শেখ, চিন্নাম্মা—এই সব মহীয়সী মহিলাদের সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। এঁদের নিয়ে একটি ছোট ফোল্ডার থাকলে ভালো হত। শ্রমজীবী বিশেষ করে পরিচারিকাদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য কোন আইন নেই, থাকলেও তা কার্যকর করা কঠিন। এটা নিয়ে ভাবতে হবে। দেশ জুড়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। কখনো ফাঁসির সাজা হচ্ছে। হায়দরাবাদে তরুণ পশুচিকিৎসককে গণধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারা হল। পুলিশ আবার ধৃত অভিযুক্তদের এনকাউন্টারের নামে মেরে ফেলল। এই ঘটনাকে নিন্দা করে অ্যাপোয়াই প্রথম  বিবৃতি দেয়। আমাদের সেটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুলে ধরা উচিত কারণ মহিলাদের মধ্যে এ ব্যাপারে ভুল ধারণা রয়ে গেছে। তবে কীভাবে ধর্ষণ কমানো যায় সেই কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েও ভাবতে হবে। বর্তমান প্রতিবেদকের পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য-নাগরিকত্ব নিয়ে ধর্ণা অবস্থানে অকালপ্রয়াতদের শহিদের মর্যাদা প্রাপ্য। সংস্কৃতি নিয়ে দলিলে কিছু উল্লেখ নেই। অ্যাপোয়ার সংবিধান ও কর্মসূচি যেন সহজলভ্য হয়। রাজস্থানের প্রতিনিধি: দলিতদের জমির লড়াই, দাঙ্গা প্রতিরোধের লড়াইয়ে অ্যাপোয়া সঙ্গে থেকেছে। রসোঁইয়া সংগঠনের বীণা আগরওয়াল বক্তব্য রাখেন। অ্যাপোয়া কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গীতা মণ্ডল বলেন, শাহিনবাগ যাতে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ না হয়ে ওঠে, সে জন্য লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে। মহিলাদের রাজনীতিকরণের জন্য ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করতে হবে। মোদী তার অ্যাজেন্ডাগুলি একের পর এক আমাদের ওপর চাপাচ্ছে। আমাদের শ্রমজীবী মহিলাদের সংগঠনগুলিতে যে অ্যাপোয়ার টিম আছে তার মাধ্যমে পাল্টা প্রচার রাখতে হবে। মহারাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলেন, আহম্মদনগরে ১২০০ একর জমি থেকে আদিবাসীদের উৎখাত করার ও তাদের বান্ধোয়া বানানোর চক্রান্ত চলছে। এর বিরুদ্ধে অ্যাপোয়া আন্দোলন করছে। শশী যাদব (বিহার) বলেন, আজ আজাদীর লড়াই আমাদের প্রতি মুহূর্তের লড়াই। কিন্তু শ্রমজীবী মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে শোষিত ও বঞ্চিত প্রকল্প কর্মীদের মধ্যে এই সময়ে অ্যাপোয়ার সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। বিহারে যে ভাবে এটা করা সম্ভব হয়েছে অন্য রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে সেই চেষ্টায় খামতি আছে। মোট ৩২জন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। সেখানে মাইক্রো ফিনান্স, মহিলা প্রোজেক্ট কর্মীদের সমস্যা ইত্যাদিও উঠে আসে।

বিদায়ী সাধারণ সম্পাদকের জবাবী ভাষণ মীনা তেওয়ারি: সম্মেলের আগে অনেক জায়গায়, (যেমন ছত্তিশগড় ও গুজরাটে) নতুন কমিটি তৈরি হয়েছে। অনেক রাজ্যে জেলা ও স্থানীয় সম্মেলন হয়েছে। এবারের সম্মেলনে অনেক নতুন তরুণ মুখ (বিশেষ করে বিহার, বাংলা, ঝাড়খণ্ড থেকে) উৎসাহ জাগাচ্ছে। গোটা দেশের জন্য লক্ষ্য ছিল — ৪ লক্ষ সদস্য। সেখানে হয়েছে — ২ লক্ষ ৬০ হাজার ৬৬ জন। এনআরইজিএ-র ক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা ও মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে  লড়তে হবে। বিহারের ভোজপুরে মহিলাদের অনেক লড়াই-আন্দোলনের ফলে এখন মজুরি অনুপাত ২০০ : ১৫০। তবে ভোজপুরের সব জায়গায় অবশ্য চালু হয়নি। অন্ধ্রে স্বনির্ভরগোষ্ঠীগুলির ভ্রষ্টাচার ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যৌথ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেমন লক্ষ্ণৌতে। এখানে আন্দোলন যত ব্যাপক হবে, তত ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু যৌথ আন্দোলনের ক্ষেত্রে অ্যাপোয়াকে নির্ধারক ভূমিকায় যেতে হবে। দিশা দেখাতে হবে উদ্দেশ্যহীনভাবে শক্তিক্ষয় করলে হবে না। সিএএ, এনআরসি-বিরোধিতা আজকের প্রধান লড়াই। কিন্তু শিক্ষা স্বাস্থ্য এসব মৌলিক অধিকারগুলির জন্যও লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের যে দীর্ঘদিনের গণভিত্তি আছে, সেখানে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। আমরা ধর্মবিশ্বাসী নই। কিন্তু সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার প্রশ্নে, মর্যাদার প্রশ্নে আমরা শ্রদ্ধাশীল। দীর্ঘ ও স্থায়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। স্বল্প সময়ের আন্দোলনে জয় হলে, সাময়িক আত্মতৃপ্তি পাওয়া গেলেও বা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাৎক্ষণিক প্রচার পেলেও প্রকৃত লাভ হবে না। বিহারে দিকাকে নিয়ে আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য না এলেও, ব্যাপক দলিত আদিবাসী গরিব মানুষ, ছাত্র ছাত্রী, মহিলাদের মধ্যে একটা বার্তা গেছে। অ্যাপোয়া একটা পরিচিতি পেয়েছে। এনআরসি-বিরোধী ধর্ণা অবস্থানে সাধারণ মহিলাদের মধ্যে বেশি বেশি করে যেতে হবে, অ্যাপোয়ার কথা বলতে হবে, তাদের সদস্য করতে হবে। গরিব দলিত আদিবাসী মহিলারা এনআরসি’র প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন — এটা তুলে ধরতে হবে। বিহারে অবস্থান থেকে অনেককে সদস্য করা হয়েছে। আমাদের পত্রিকার (আধি জমিন, প্রতিবিধানের) বিক্রি বাড়ছে না কেন— ভাবতে হবে। সংগঠনের সর্বস্তরে নতুন তরুণ মুখগুলিকে ধরে রাখার জন্য সংগঠনের কাঠামোয় সংস্থান রাখতে হবে, যুব সেল তৈরি করতে হবে। বামপন্থী মহিলাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। আমাদের লড়াই শুধু আর্থিক প্রশ্নে নয়, সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নেও। মোদী সরকার ধর্মের আধারে সমাজের বুকে বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়াচ্ছে। এর বিরুদ্ধে লড়তে হবে। গৃহহিংসাকে একটি রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসাবে দেখতে হবে। আরএসএস-বিজেপি’র ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অফিস ব্যবস্থা চালু করা, নথি সংরক্ষণ করা-এগুলোর ওপর জোর দিতে হবে।

বর্ষীয়সী অ্যাপোয়া তথা সিপিআই(এমএল) নেত্রী কমরেড মীরাজী সম্মেলন মঞ্চে সম্বর্ধনার উত্তরে বলেন—বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধির মধ্যে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাধিক্য দেখে খুব ভালো লাগছে। অ্যাপোয়া একটা লড়াইয়ের প্রতীক। তার বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তগুলি নতুনদের বুঝতে হবে। লক্ষ্য ঠিক রেখে, একে অন্যকে সাহায্যের মানসিকতা নিয়ে একজোট হয়ে লড়তে হবে। তিনি  আরও বলেন, সমাজ এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রকৃত বিপ্লবী সংগ্রাম পারে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সংগ্রামকে আয়যুক্ত করতে।

শাহীনবাগ

shaheen

 

শাহীনবাগে মধ্যরাতে আজাদীর শ্লোগান, আবৃত্তি, গানে যখন সম্পূর্ণ অন্যভাবে ২০২০কে স্বাগত জানানো হয়েছিল, তখনই উদ্বেল হয়ে উঠেছিলাম। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় অবগুুণ্ঠিতারা আজ পথে নেমেছেন, সন্তানকোলে পথেই রাত জাগছেন। এবং অবধারিত ভাবেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে দিকনির্দেশ করছেন। ইতিহাসের নতুন অধ্যায় লিখছেন।

সেই শাহিনবাগকে কুর্নিশ জানাতে, সম্মেলন-ফেরত উদয়পুর থেকে নিজামুদ্দিন পৌঁছে দুপুরে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। কোন অটোই যেতে নারাজ। রাস্তায় নাকি অনেক ‘জ্যাম’। প্রায় ঘন্টাখানেক এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে অবশেষে দুটি অটো রিজার্ভ করে ছুটলাম। সেদিন ছিল দিল্লী বিধানসভার ফল ঘোষণার দিন। প্রধান সড়ক ধরে যাচ্ছিলাম বলেই হয়তো পথে কোন উত্তাপ, উত্তেজনা, আবির-উচ্ছ্বাস—কিছুই চোখে পড়ল না। যেন কোথাও কিছুই হয়নি। হু হু করে অটো ছুটছিল — কোথাও কোনো জ্যাম নেই। দীর্ঘ পথ গিয়ে অটো হঠাৎ থেমে গেল। সামনে পুলিশের ব্যারিকেড। অটো নামিয়ে দিল। পুলিশ নির্বিকার ভাবে জানালো, ‘যেতে হয়, ঘুরপথে যাও’। হাঁটা শুরু করলাম। এক সুবেশা তরুণীর সাহায্য চাইলে তর্জনী উঁচিয়ে তিনি বললেন “কেন যাবেন ওখানে? ওরা শুধু পাবলিককে হ্যারাস করছে — সরকারের ওদের তুলে দেওয়া উচিত’’। আমরা ওকে এড়িয়ে এগোলাম। বুঝতে পারছি না, কোনদিকে যাবো, কতটা যেতে হবে। কমরেড অর্চনার অভিজ্ঞ চোখ বলল, সামনের মাঝবয়সী এক মহিলা সম্ভবত ধর্ণায় বসতে যাচ্ছেন। ঠিক! ওঁর সঙ্গ ধরে, ওঁর সৌজন্যে, বেশ খানিকটা হেঁটে শাহীনবাগ মেট্রো স্টেশনে উঠে, রুগ্ন জীর্ণ খাল তুল্য  যমুনা পেরিয়ে ১০ টাকা করে অটো ভাড়া দিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম আমাদের ‘স্বপ্নভূমি’ শাহীনবাগে!

সেদিন গান্ধীজীর ছবি সামনে রেখে চলছিল মৌনব্রত। সবার মুখে কাপড় বাঁধা, হাতে ধরা রয়েছে হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড। একেবারে পিছনে এসে বসামাত্র জলের পাউচ এবং বিস্কুটের প্যাকেটের উষ্ণ আতিথ্য পেলাম! কলকাতা থেকে আসছি শুনে ওরা খুব উৎসাহিত হলেন। এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, আজ তারা নীরবে আল্লার কাছে কেজরিওয়ালের জন্য দুয়া মাঙছেন। এক বয়স্কার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার ‘সরেস’ হিন্দিতে তেমন সুবিধা করা গেল না। উদ্ধার করলেন স্বপ্না, শীলা, মৈত্রেয়ীদি।

মহিলা বললেন, ‘‘মোদী সরকার গরিব মানুষকে শুধু কষ্টই দিয়ে চলেছে। নোটবন্দি, জিএসটি—এখন এনআরসি—এক কালা কানুন গরিবদের আরও বিপদে ফেলবে। জিনিসপত্র মাঙ্গাই, ঘর চালানো মুস্কিল। এনআরসি চাই না বলেই রোজ এখানে আসি—” এর মধ্যে একটি ছেলে এসে কথা বলতে বারণ করে গেল। আমাদের পথপ্রদর্শিকা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম-আপনি তো হিন্দু, আপনিও কি এনআরসি থেকে একই বিপদের আশঙ্কা করছেন? উনি বললেন, ‘‘নিশ্চয়ই। আগে মুসলিম, দলিত, তারপর এসসি, এসটি সবাইকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে এরা ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাজ কায়েম করবে। থাকবে শুধু ব্রাহ্মণ।” উনি শনি-রবিবার ধর্ণায় বসতে আসেন। স্বামীও আসেন। ঐ দিনও অফিস ফেরত আসার কথা। আমাদের নাছোড়বান্দা দেখে ছেলেটি আবার এসে বলে গেল, “শুধু এনআরসি নিয়ে কথা বলুন, আজকের ব্যাপারে (নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে) কিন্তু একটি কথাও নয়।” আমরা তাকে আশ্বস্ত করলাম। কাজল কিছুটা অসুস্থ ছিল। ও শুয়ে পড়েছিল। একজন ওকে সুন্দর করে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অন্ধকার হয়ে আসছিল। আমরা উঠে পড়লাম। এর মধ্যে রেণুজীর স্বামী এসে গেলেন, ধর্ণায় বসার জন্যেই এসেছিলেন। কিন্তু আমরা কিছু চিনি না শুনে, ফেরার পথে আমাদের সঙ্গী হলেন দু’জন। চত্বরে এক পাশে লাইব্রেরি চলছে। সিএএ, এনআরসি’র বিরুদ্ধে আন্দোলনে ভাজপা ও পুলিশি বর্বরতা নিয়ে, শাহিনবাগ আন্দোলনের নানা মুহূর্ত নিয়ে এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীও চলছে। ফ্রি চায়ের মস্ত লাইন। গোটা মহল্লা জুড়ে এক প্রাণের উচ্ছ্বাস। চলছে নানা কর্মকাণ্ড। আম্বেদকরপন্থী ঐ দম্পতি আমাদের সোজা সরল শর্টকাট রাস্তা ধরে বাসে তুলে নিজেরাও উঠে পড়লেন। আমরা অভিভূত! ওরাও অনেকটা দূর যাবেন। ফেরার পথে ডানদিকে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের চত্বরেও ছাত্রছাত্রীদের প্ল্যাকার্ড হাতে অবস্থানে দেখা গেল। আমাদের মাঝপথে নেমে যেতে হবে। এর মধ্যে কাজল আরও অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওরা আমাদের নামিয়ে দিয়ে অটো ধরতে বললেন। ভাড়া ১০০টাকা । বুঝলাম অনেকটা পথই বাকি আছে। প্রচণ্ড জ্যাম।কলকাতার জ্যাম কোথায় লাগে! বিদায় শাহিনবাগ! বহু প্রশ্ন অনুচ্চারিত থেকে গেল। বহু উত্তর অজানা রয়ে গেল। কিন্তু তোমাকে আমৃত্যু মনে থাকবে! সংগ্রামের এক কালজয়ী প্রতীক তুমি! এবার  শুধু চিন্তা কীভাবে আমাদের অসুস্থ সাথীকে নিয়ে অস্থায়ী ডেরায় পৌঁছাবো। অবশেষে পৌঁছালাম। দেখি, অন্য অটোয় থাকা আমাদের তিন সাথী অনেক আগে পৌঁছেও ঠায় রাস্তায় আমাদের, কাজলের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে চিন্তিত মুখে।

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত
(সম্মেলনের প্রতিবেদন : এমএল আপডেট অনুসরণে)

খণ্ড-27
সংখ্যা-5