এআইসিসিটিইউ-র ১০ম সর্বভারতীয় সম্মেলনের প্রচার-প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে

ভারতে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের শতবর্ষ ও ‘অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ট্রেড ইউনিয়নস’-এর ৩০ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই সংগঠনের দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন আগামী ২-৪ মার্চ ২০২০ নৈহাটি ঐকতান সভাগৃহে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এআইসিসিটিইউ’র প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক কমরেড স্বপন মুখার্জী ও প্রয়াত সহ-সভাপতি কমরেড ডিপি বক্সির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের নামে সভাগৃহের নামকরণ করা হয়েছে। এআইসিসিটিইউ’র সহ সভাপতি এবং উত্তর প্রদেশ রাজ্য কমিটির সম্পাদক প্রয়াত কমরেড হরি সিং এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ভূতপূর্ব সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কমরেড সুদর্শন বসুর নামে মঞ্চ নামাঙ্কিত করা হয়েছে। নৈহাটি শহরের নামকরণ করা হয়েছে প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন নেত্রী সন্তোষ কুমারী দেবীর নামে। সন্তোষ কুমারী দেবীর জন্ম ১৮৯৭ সালে এবং ৮৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

aicctuq

 

৩১ অক্টোবর ১৯২০ সালে লালা লাজপত রাইয়ের সভাপতিত্বে এআইটিইউসি গঠন হয়। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে প্রথম মহিলা কার্যকরী সদস্য হিসাবে এআইটিইউসি’তে সন্তোষ কুমারী দেবী নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি ‘বেঙ্গল জুট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন’ গড়ে তোলার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন নেতা শিবনাথ ব্যানার্জীকে প্রভুত সাহায্য করেন। ১৯২৬ সালে দমদমের ল্যান্সডাউন জুটমিলে শ্রমিকদের ধর্মঘটে তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করে ছিলেন। ১৯২৭ সালে ‘গৌরীপুর ওয়ার্কার্স এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন’ গঠন করেন। এই বছরই ‘বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে ইন্ডিয়ান লেবার ইউনিয়ন (১৯২৭)’-এর মাধ্যমে ভিবি গিরি, মুকুন্দলাল সরকার, আলতাব আলিকে সঙ্গে নিয়ে সন্তোষ কুমারী দেবী রেলওয়ে শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠিত করেন।

তিনি প্রথম দিকে জুটমিল শ্রমিকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করে ছিলেন। নৈহাটি থেকে কামারহাটি, বজবজ, বাউরিয়ায় শ্রমিকদের সংগঠিত করতে পাটকল শ্রমিকমহল্লায় যেতেন। তিনি নৈহাটি, হালিশহর, ভাটপাড়া ও সোদপুরে শ্রমিকদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতেন ও সংগঠিত হওয়ার বার্তা পৌঁছে দিতেন। শ্রমিকদের জনকল্যাণের জন্যও তিনি মিল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতেন। এরমধ্যে ছিল শ্রমিকদের চিকিৎসার সুযোগ, মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, কোয়ার্টারের সংস্কার, লাইনের পরিবেশ ইত্যাদি। তিনি শ্রমিকদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য রাতে স্কুলও চালাতেন। চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীর সাথে চাঁদপুরের কুলি লাইনে শ্রমিকদের মধ্যে তিনি দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন।

santishi

 

সন্তোষ কুমারী দেবী ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধাচরণ করা ছিল তাঁর স্বভাবজাত প্রতিক্রিয়া। তাঁর বাবা ছিলেন বৃটিশের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারি, বাবার সব নির্দেশ উপেক্ষা করেই তিনি রাজনৈতিক ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। সন্তোষ কুমারী দেবী ইতিহাসে অনেকটাই উপেক্ষিত হয়ে আছেন। এআইসিসিটিইউ’র ১০ম সর্বভারতীয় সম্মেলন আমাদের কাছে গৌরবোজ্জ্বল সেই ইতিহাসের পুনরুদ্ধার এবং সন্তোষ কুমারী দেবীকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রতিবাদের প্রতীক সন্তোষ কুমারী দেবীকে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করার উদ্দেশ্যে নৈহাটি সম্মেলন স্থলের নামকরণ করা হয়েছে ‘সন্তোষ কুমারী দেবী নগর’।

এআইসিসিটিইউ ১০ম সর্বভারতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে পাহাড় থেকে সাগর — রাজ্যব্যাপী ইউনিয়নের কর্মব্যস্ততা চলছে। চা বাগানের ইউনিয়ন তাদের সদস্য সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ, দেওয়াল লিখন সহ প্রচার চালাচ্ছে। নির্মাণ, ইটভাটা, হকার ইউনিয়ন সহ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো প্রচারে ব্যস্ত। বিড়ি, মিড-ডে-মিল, চটকল ফেডারেশন নিজেদের রাজ্য সম্মেলন শেষ করে সর্বভারতীয় সম্মেলনের প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছে। রেল ও প্রতিরক্ষা ইউনিয়ন সাধারণ সভা, গেট মিটিং, প্রচার, পত্রিকা প্রকাশ, আর্থিক সহযোগিতা করে সম্মেলনের আয়োজনে তাদের ভূমিকা পালন করছে। ইউনিয়নগুলি সদস্যদের চাঁদা ও হাট বাজারে অর্থ সংগ্রহ করে সম্মেলন সফল করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

naihati

 

নৈহাটিতে আইসা’র ছাত্ররা, পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের চিত্রকর থেকে গায়ক, সবাই প্রচারে শামিল হয়েছেন। গানের মহড়া, চিত্র প্রদর্শনীর কাজের প্রস্তুতি চলছে। বীজপুর রেলওয়ার্ক শপে, নৈহাটি, কাঁকিনাড়া, জগদ্দল মিলে, শিবদাসপুর ইটভাটায় দেওয়াল লিখন চলছে। নৈহাটিতে শ্রমিক, ছাত্র-যুব, সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে ছোট ছোট জনসভা, পথসভা, শ্রমিক মহল্লায় বাড়ি বাড়ি প্রচার চলছে। অশোকনগরে পথসভা হয়েছে। দেওয়াল লিখন হয়েছে অশোকনগর, বসিরহাট, কামারহাটি সহ অন্যত্র। প্রচার চলছে খড়দহ, দমদম, রাজারহাট, মধ্যমগ্রাম, বারাসাত, গাইঘটা, বনগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে। ইউনিয়নগুলি নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সম্মেলন সফল করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। যেখানে যেখানে ইউনিয়ন দুর্বল বা এখনও ইউনিয়ন গড়ে ওঠেনি সেখানে স্থানীয় পার্টি কমিটি আন্তরিকতার সাথে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্মেলন সফল করার উদ্দেশ্যে পার্টির জেলা কমিটি সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে। ট্রেড ইউনিয়ন ও পার্টির সমন্বয়ের মাধ্যমে সব কিছু এগিয়ে চলেছে। আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন বাকি আছে। এর মধ্যেই সব কাজ শেষ করতে হবে। ইউনিয়নের যে জরুরি কাজ এখন তা হল প্রতিনিধি নির্বাচন। প্রতি ৫০০ জনে ১ জন অনুপাতে প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হবে। এর মধ্যে আবার কম বয়সী শ্রমিকদের প্রাধান্য দিতে হবে, যাতে নতুন কমিটিতে নতুন প্রজন্মের শ্রমিকরা সামনে এগিয়ে আসতে পারেন। প্রচারের শেষ লগ্নে নৈহাটি থেকে অশোকনগর, বেলঘরিয়া ইউনিয়ন ও পার্টি কার্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজের ব্যস্ততা। আর ক’দিনের মধ্যেই নৈহাটি ও তার সংলগ্ন এলাকা চেইন, ফ্ল্যাগ, ফেস্টুনে সেজে উঠবে, লালে লাল হয়ে উঠবে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল লোকসভা নির্বাচনের পর গেরুয়া বাহিনীর মাত্রাছাড়া বিদ্বেষ, বিভাজন ও সন্ত্রাসের রজনীতির বিরুদ্ধে এই সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সম্মেলন ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলবে।

আসন্ন সম্মেলনকে সর্বাঙ্গীণ সফল করে তোলার জন্য সবার কাছে আহ্বান রইলো।

খণ্ড-27
সংখ্যা-4