নৈহাটিতে এআইসিসিটিইউ-র সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষ্যে

শিকল ছেড়া হাতের খোঁজে

২-৪ মার্চ, ২০২০ এআইসিসিটিইউ-র ১০ম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল নৈহাটিতে, ‘ঐকতান’ সভাগৃহে। সম্মেলন উপলক্ষে ‘নৈহাটি’র নামকরণ করা হয় ‘সন্তোষ কুমারী দেবী নগর’। ‘ডিপি বক্সী-স্বপন মুখার্জি’ সভাগৃহ, আর মঞ্চ নামাঙ্কিত হয় ‘হরি সিং-সুদর্শন বসু’র নামে।

সময় কীটের মতো কুরে কুরে খায় আমাদের দেশ

আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্সফ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ৯৫.৩ কোটি নাগরিকের মোট সম্পত্তির ৪ গুণেরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে মাত্র ৬৩ জন ধনকুবেরের হাতে। এই ধনকুবেরদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ২৪,৪২,২০০ কোটি টাকার কেন্দ্রীয় বাজেটের থেকেও বেশি। গত বছরে যত সম্পত্তি তৈরি হয়েছিল তার ৭৩% কুক্ষিগত করেছে দেশের ১% ধনীতম ব্যাক্তিরা।

অন্যদিকে ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’র রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে ভারতে বেকারত্বের হার বেড়েছে ৭.৫%। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিতদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার অভাবনীয়, প্রায় ৬০%। খুচরো মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.৫%। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এই অন্ধকার বাস্তবতাকে চাপা দিতে বিজেপি-আরএসএস পরিচালিত এনডিএ-২ তথা মোদি-শাহ সরকার ‘দেশের স্বার্থ’, ‘জনতার স্বার্থ’-র জিগির তুলে দেশবাসী ও জনতার উপর চালাচ্ছে লাগাতার আগ্রাসন। বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশানার কেন্দ্রে রেখেছে তারা। হামলা নামছে নিম্ন শ্রেণী, নিম্নবর্ণ, উপজাতি, আদিবাসী, নারী ও ছাত্র-যুব সমাজের ওপর। হামলা করা হচ্ছে নাগরিক মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরও। মরীয়া চেষ্টা চলছে ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে পাল্টে দেওয়ার। এক্ষেত্রে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ স্লোগানকে সামনে নিয়ে আসা ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকের নয়া হাতিয়ার হোল সিএএ, এনপিআর, এনআরসি মার্কা ‘নাগরিকত্ব নির্ণয়ের’ ইস্যু। এগুলির টার্গেট বিশেষ করে দেশভাগের যন্ত্রণাবিদ্ধ বাঙালি। রাষ্ট্র, কোটি কোটি টাকা লগ্নি করছে নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ধাঁচায় ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নির্মাণে, যেখানে ওরা মজুত করে রাখতে পারবে নাগরিকত্বহীন, ন্যূনতম অধিকার-বিহীন এক সুবিশাল সস্তার শ্রমশক্তিকে, যা কিনা কর্পোরেট মসীহা মোদী রাজের স্বপ্নের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’কে বাস্তবায়িত করে তুলবে। এই বাস্তব অনুষঙ্গের পরিপূরক হিসাবেই চলছে একদিকে ছদ্ম দেশভক্তির নির্লজ্জ চর্চা, সামরিক রাষ্ট্রবাদের ঢক্কানিনাদ; অন্যদিকে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পক্ষেত্রগুলির লাগামছাড়া বিলগ্নিকরণ ও বেসরকারিকরণ।

অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়েই শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারের কিছু কিছু রক্ষাকবচ ছিল প্রচলিত শ্রমআইনগুলিতে। তাকে ভেঙ্গেচুরে কর্পোরেট স্বার্থানুযায়ী নবায়ন অর্থাৎ অসাধু শিল্পপতিদের লুটের স্বার্থে ‘বেআইনির আইনিকরণ’ ইত্যাদি ইত্যাদি এখন শুরু হয়েছে প্রবল গতিতে। এই আবহেই অনুষ্ঠিত হল এআইসিসিটিইউ-র ১০ম সর্বভারতীয় সম্মেলন নৈহাটিতে।

aicctu

 

আমাদের হৃদয়ের শস্য যেথা মরে

কেন নৈহাটিতে? এ সঙ্গত প্রশ্ন উঠতেই পারে। আসুন এই লগ্নে একবার ফিরে দেখি নৈহাটি সহ এই বিস্তৃত বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের দিকে। শুধু যদি এককালের বহু শিল্প-অধ্যুষিত নৈহাটির দিকে দেখি, তাহলে দেখব – একে একে বন্ধ কন্টেনার্স এন্ড ক্লোজার্স, গৌরিপুর থার্মাল পাওয়ার স্টেশন, গৌরিপুর জুট মিল, জেনসন এন্ড নিকলসন, ইন্ডিয়ান পেপার পাল্প, নদীয়া জুট মিল। দশকের পর দশক ধরে রঙ-বেরঙের সরকারের শিল্পায়নের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ঢক্কানিনাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, উল্টোদিকে বরঞ্চ সরকারী বিশিল্পায়নের নীতির পথ বেয়ে নৈহাটি-গরিফার একদা শিল্পগর্ব অস্তমিত।যে সাইরেনের ভোঁ-এর শব্দে একদা এই চটকল শহর জেগে উঠত ও ঘুমোতে যেত, সেই সরব চলমান অস্তিত্ব একটুও চিৎকার না করে, একটুও প্রতিরোধ না তুলে, এই সব শিল্পের ‘মালিকের-দালাল’ নানা বর্ণের, নানা শাসক পার্টির বাবু নেতাদের সাথে সহমত হতে বাধ্য হয়ে শ্রমিক হাতজোড় করে ভিক্ষা মাঙছে – একটা কাজ, ঘামের বিনিময়ে যৎসামান্য মূল্য; অন্তত দুটো পোড়া রুটি কিংবা আধপেটা ভাতের দাম। কিন্তু ‘হা অন্ন’-শ্রমিকের কান্না মিলায় বাতাসে। পুরো বারাকপুর শিল্পাঞ্চলটাই এককথায় ঘনায়মান ক্ষিদের রাজ্য। উঞ্ছবৃত্তির অর্থনীতিই এখানকার মূল চালিকাশক্তি। স্বভাবতই এই নিম্ন অর্থনৈতিক বাতাবরণে, পশ্চিমবঙ্গের আপাত অনুকূল পরিস্থিতিতে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-ওয়ালারা আসরে নেমে পরেছে। খুবই সফলতার সাথে সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধির অপসংস্কৃতিকে এই মিশ্র শ্রমিক অঞ্চলে লোকপ্রিয় করে তুলেছে। এককালের সৌহার্দ্যর সংস্কৃতি এক্ষণে এই অঞ্চলে অন্তর্হিত।

ফিরে দেখা - অঞ্চলের ধূসর পাণ্ডুলিপি

১৬৩২ সালে যখন সাতগাঁ (সপ্তগ্রাম) থেকে বাংলার রাজধানী পরিবর্তিত হয়ে হুগলীতে চলে এল, তখন হুগলীর অপর পার নৈহাটিতেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ আসতে শুরু করল। এই ঘটনার দু’শতকের পর ১৮৬২ সালে ‘ম্যাকলীন বেরী’র গৌরীপুর জুট মিল এবং শিয়ালদহ-কুষ্টিয়া রেলপথ স্থাপনা এবং ১৮৮৭ সালে জুবিলী ব্রীজ নির্মাণ; নৈহাটি-গরিফায় সৃষ্টি করল এক সুবৃহৎ শ্রমবাজার। আজকের নৈহাটি-গরিফার জনবিন্যাসে যে বিচিত্র বুনন আমরা দেখি, তার বয়সও নয় নয় করে ১৫০ বছর পার হতে চলল। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ পরবর্তী বৃটিশ সাম্রাজ্যের আপাত স্থায়িত্বের সূত্র ধরে, সংগঠিত ব্রিটিশ বিনিয়োগের পথ বেয়ে আজকের নৈহাটি-গরিফা আকার নিতে শুরু করেছিল। তার আগে গুড়ের ব্যাবসাকেন্দ্র হিসাবে বেড়ে ওঠা তৎকালীন ‘গৌরিভা’ বা ‘গৌরিয়হাট’ ধীরে ধীরে চলে গিয়েছিল ঔপনিবেশিক সময়ের তৎকালীন আধুনিক শিল্পের উঁচু উঁচু প্রাচীরের আড়ালে। নৈহাটি-গরিফার সস্তা-শ্রমভিত্তিক অর্থনীতির এতটাই স্থিতিস্থাপকতা ছিল যে ১৯৪৭ এবং ১৯৭০-এর উপমহাদেশের ঐতিহাসিক এপিসোডের পরবর্তী ছিন্নমূল-উদ্বাস্তু জনস্ফীতির চাপ বহন করেছিল সে অনায়াসে। এইরকম একটি মিশ্র সাংস্কৃতিক প্রতিবেশে বৌদ্ধিক উত্তরাধিকারের ইতিহাসও কম গৌরবজনক নয়। ১৮৬২তে গৌরিপুর জুটমিল প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, আর ঠিক সেইসময়েই “৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন”— বাংলা ভাষার প্রথম বিশিষ্ট উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নৈহাটির অধিবাসী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করছে। [দুর্গেশনন্দিনী - আনুমানিক ১৮৬২-১৮৬৪ সালে লিখিত, ১৮৬৫-তে প্রকাশিত] যে ভাষায় আমরা আজ লিখি, কথা বলি সেই নির্দিষ্ট প্রশ্নে বঙ্কিমের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আমরা এখন আমাদের সর্বভারতীয় শ্রমিক সম্মেলনের প্রাসঙ্গিকতায় নৈহাটির যে বৌদ্ধিক উত্তরাধিকার-সেই নির্দিষ্ট গণ্ডীর মাঝেই আমাদের এই স্মরণিকাকে সীমাবদ্ধ রাখবো।

devi

 

স্ফুলিঙ্গ তার পাখায় পেল ক্ষণকালের ছন্দ-সন্তোষ কুমারী দেবী

নৈহাটির অধিবাসী বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক, অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘বিকিকিনির হাট’ থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা যাক। “এর পরের গল্প বলেছিল মতিচাঁদ-ব্রজেশ্বরী দেবীর গল্প। ব্রজেশ্বরী দেবীকে এখন আর নবগঞ্জের কেউ চেনে না। নাম বললে হাঁ করে থাকবে-কে তিনি? কিন্তু একদিন নবগঞ্জের মানুষ ব্রজেশ্বরী দেবীর নামে যুক্ত করা হত। রাস্তা দিয়ে ব্রজেশ্বরী দেবী হেঁটে গেলে দু-পাশের নিচুতলার লোক একদিন ‘সেলাম মাইজী’ বলে হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়াত”। [‘বিকিকিনির হাট-পৃ-১০৮]

উপন্যাসের ‘নবগঞ্জ’ আসলে নৈহাটি, উপন্যাসের ‘ব্রজেশ্বরী দেবী’ হলেন বাংলা তথা ভারতের প্রথম মহিলা শ্রমিক নেত্রী সন্তোষকুমারী দেবী। গৌরিপুর জুট মিল ধরেই তিনি তাঁর ইউনিয়ন কার্যকলাপ শুরু করেছিলেন। থাকতেন গরিফার রায়পাড়ায়। এখনও তাঁর বাড়ি গরিফায় রয়েছে। নৈহাটি-গরিফার খুব অল্পসংখ্যক মানুষই এই মহীয়সী রমণীর অবদান সম্পর্কে অবহিত। এদেশে তিনিই প্রথম মহিলা নেত্রী যিনি সফল ভাবে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। কিন্তু এই তেজস্বিনী নেত্রী সেদিন গরিব মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করতে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন একা। জন্ম ১৮৯৭ সালে, ব্রহ্মদেশে। ছোটবেলা থেকেই সন্তোষকুমারী বিদ্রোহী ও স্বধীনচেতা ও দেশপ্রেমিক। বর্মা থেকে ফিরে মায়ের সাথে তখন নৈহাটির উপকণ্ঠে গৌরিপুরের কাছে রায়পাড়ায় থাকছেন সন্তোষকুমারী। চটকল শ্রমিকদের যন্ত্রণা তিনি প্রত্যক্ষ করছেন। আজন্ম প্রতিবাদী সত্ত্বাই তাঁকে এগিয়ে দিল ধর্মঘটে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিষ্পত্তি করার জন্য। দাবি আদায় করতে সমর্থও হলেন। তারপর আর তাঁকে থেমে থাকতে হয়নি। ১৯২১-১৯২৭ সন্তোষকুমারী এক ধুমকেতুর মতো বাংলার তথা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের নয়নমণি হয়ে উঠেছিলেন। হাজিনগর-গৌরীপুর থেকে বজবজ-বাউরিয়া চটকল মজুরদের সংগঠিত করেছেন। এর মধ্যেই শ্রমিকদের জন্য নাইট স্কুল স্থাপন করেছেন। ১৯২৪-এ কলকাতা পৌরসভার এডুকেশন অ্যাডভাইসারি কমিটির সদস্য হয়ে অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলেছেন। ঐ সালেই সম্পাদনা করেছেন ‘শ্রমিক’ পত্রিকা।

স্বল্প সময়ে অজস্র কাজ করেছেন। শ্রমিক আন্দোলনের পুরোধা তো ছিলেনই, এর সাথে বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন, খিলাফৎ আন্দোলন, নারী স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর উজ্জ্বল নেতৃত্বকারী ভূমিকা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা বাংলার একমাত্র হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ছিল খিলাফৎ আন্দোলন। সেখানে সন্তোষকুমারী দেবীর অসামান্য অসাম্প্রদায়িক ভূমিকার জন্যই মুসলমান সম্প্রদায় শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে ‘খিলাফৎ মেমসাব’ বলে সম্বোধিত করত। আজকের এই আকালে আমরা সন্তোষকুমারী দেবীকে কিছুতেই ভুলতে পারি না। জানি দীর্ঘ সময়ের বাঁকে “ছাইয়ে যে-আগুন ছিল সেই সবও হয়ে যায় ছাই! তবুও (আসুন) আরেকবার সব ভস্মে অন্তরের আগুন ধরাই”। [জীবনানন্দ, ধূসর পাণ্ডুলিপি] আজকের এই ফ্যাসীবাদ আক্রান্ত ভারতে সন্তোষকুমারী দেবী এক চির অম্লান অগ্নিশিখা।

অথ ‘সুলভ সমাচার’ কথা

নৈহাটি সংলগ্ন গরিফায় মামার বাড়িতে বড় হয়ে উঠেছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর একজন স্বনামধন্য বাঙালি সুপণ্ডিত ও ধর্মীয় সংস্কারক কেশব চন্দ্র সেন। তাঁর নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সাধারণ পাঠাগার গরিফায় আছে। কিন্তু যেটা সর্বস্তরে জানা নেই যে তাঁরই প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭০-এ বাংলা ভাষায় শ্রমজীবীদের নিয়ে প্রথম পত্রিকা ‘সুলভ সমাচার’।

nai

 

আগে দেখি নাই ফিরে, তাই বারংবার

বাংলার অপ্রতিদ্বন্দী উপন্যাসিক নৈহাটি নিবাসী সমরেশ বসু। তাঁর অনেক উপন্যাসেই নৈহাটি-আতপুর-জগদ্দলের চটশিল্প অধ্যুষিত অঞ্চলের জনজীবনের চালচিত্রকে প্রত্যক্ষ করা যায়। জীবনে জীবন যোগ করার রূপকার তাঁর চারণভূমিকে অমর করে রেখেছেন তাঁর অজস্র উপন্যাসের পাতায় পাতায়। নির্দিষ্টভাবে দুটি উপন্যাসের নাম উল্লেখ করা যাক- ১) উত্তরঙ্গ ২) বিটি’ রোডের ধারে। এ প্রশ্নে আমরা নৈহাটি অঞ্চলের বিখ্যাত অন্যধারার সাহিত্য সমালোচক ও চলচিত্র বোদ্ধা যিনি কিনা তাঁর অঞ্চলের অভিজ্ঞতার আলোকে ঘোষণা করতে পেরেছিলেন বাংলায় কৃষক-শ্রমিকদের নিয়ে একটিও চলচিত্র তৈরি হয়নি সেই অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি প্রণিধানযোগ্য উদ্ধৃতিকে উল্লেখ করব। সমরেশ বসুর ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলছেন – হিন্দি বলয় থেকে বৃটিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা সিপাহি “হীরালাল লখাই হলেও তাঁর অতীতের চেতনায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, ব্রিটিশদের শত্রু হিসাবে সে দেখে। সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই ১৯৫৭-র বীরত্বপূর্ণ লড়াই অবসিত হয় বৃটিশ সাম্রাজ্যের স্বীকরণে, ঔপনিবেশিক অর্থনীতির জোয়াল চেপে বসায়। চট এই অর্থনীতির একটা প্রধান উপাদান উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। উৎসন্ন চাষি তাঁতি এর সস্তা মজুর, পাট বুনতে পারলে কাঁচা মালও প্রচুর। হুগলী নদীর তীরে তীরে প্রায় সম্পূর্ণ ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত চটশিল্প খাঁটি ঔপনিবেশিক শিল্প। পূর্ব ভারতে হীরালালের এই অঞ্চলে লখাইয়ে রূপান্তর তাই প্রতীকী। তার শেষ অসহায়তাও যুগান্তরের তাৎপর্যে অঙ্কিত। সমগ্র ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটি এতে ধরা পড়ে” [সময়ের চিহ্নঃ সমরেশ বসু]। তাই নৈহাটির শ্রম মহল্লার এই দুর্দিনে তাঁর সৃষ্টি-সৃজনকে ফিরে দেখি বার বার।

গান্ধী নগরে রাত্রি

বাংলায় তৃতীয় ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, এই চটকল শহরে বাস করা বাংলার অন্যতম কবি মনিভূষণ ভট্টাচার্য। এই ব্রাহ্মণ্যবাদ আক্রান্ত বাংলায় কি করে আমরা ভুলব তাঁর কবিতার চটকলের ছকুমিয়াকে –  “চটকলের ছকুমিয়া, ‘এবার প্যাঁদাবো শালা হারামি ওসি-কে।’ উনুন জ্বলেনি আর, বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটের তেজী রক্তধারা, গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা”। [গান্ধী নগরে রাত্রি]

নৈহাটির আরেকজন প্রথিতযশা মানুষকে স্মরণ করি। তাঁর নাম হরপ্রসাদ ভট্টাচার্য শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১)। এই মুহূর্তে ভারতের অঙ্গরাজ্য এই বাংলা অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সিএএ, এনপিআর ও এনআরসি-আক্রান্ত। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবার বাঙালিকে ঠেলে দিচ্ছে আরেকবার নাগরিকত্ব হারিয়ে ছিন্নমূল করার দিকে,করতে চাইছে ৪৭-এর পর আরেকবার ভিটেমাটি ছাড়া উদ্বাস্তু। ৪৭-এ বিজেপির তৎকালীন পূর্বসূরিরা ওদের ‘হিন্দু ভারত’ ও ‘মুসলিম পাকিস্তান’ যে এজেন্ডা সম্পূর্ণ করতে পারেনি আজ ওদের পক্ষে অনূকুল বাতাবরণে সেই অসম্পূর্ণতাকে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। সমস্যা হল, ওদের তোলা ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ স্লোগানের পেছনে এই ২১ শতকের দ্বিতীয় দশকেও ছুটছে কিছু ‘কুলীন-কুল সর্বস্ব’ ‘হুতোম’-সংজ্ঞায়িত ‘মেড়া বাঙালি’। সে কারণেই হরপ্রসাদ উত্থাপিত ‘খাঁটি বাংলা’ ও ‘খাঁটি বাঙালি’ তত্ত্বকে নতুন নবউদ্দীপনায় আজ একবার না দেখলেই নয়। বাঙালির ইতিহাস অন্বেষণের আদি পুরুষ বঙ্কিমচন্দ্র, যাঁর থেকে আজকের আরএসএস-বিজেপি বাংলায় হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের ঐতিহাসিক রসদ সংগ্রহ করে, তিনি মনে করতেন — “বাঙালি সমাজের নিম্নস্তরেই বাঙালি অনার্য বা মিশ্রিত আর্য ও বাঙালি মুসলমান, উপরের স্তরে কেবলই আর্য। এই জন্য দূর হইতে দেখিতে বাঙালিজাতি অমিশ্রিত আর্য জাতি বলিয়াই বোধ হয় এবং বাঙলার ইতিহাস এক আর্যবংশীয় জাতির ইতিহাস বলিয়া লিখিত হয়”। (বাঙালির উৎপত্তি-বিবিধ প্রবন্ধ)

পক্ষান্তরে হরপ্রসাদ ধারণা ছিল — “দেশ-জাতি-ভাষা-সাহিত্য প্রসঙ্গে শাস্ত্রীমশায় বারবার ‘খাঁটি বাংলা’ কথাটা তোলেন। তাঁর চিন্তা ও গবেষনায় ‘খাঁটি বাংলা’ কথাটির তাৎপর্য খুব ব্যাপক ও গভীর। ‘খাঁটি বাংলা’ বলতে তিনি বাঙালি জাতি এবং বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতির যে মৌল বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করেন, আর্য-ভারতবর্ষ বা ব্রাহ্মণ্য-আশ্রিত ভারতবর্ষ থেকে তা স্বরূপে আলাদা।শুরু থেকেই মোহমুক্তভাবে তিনি বাঙালির জীবন-প্রকৃতির যাবতীয় অভিব্যাক্তির মূলে এখানকার আদি জনবৃত্তের বনিয়াদটি সত্য বলে মেনে নেন। বাংলায় “আর্যের মাত্রা বড়ই কম, দেশীয় মাত্রা অনেক বেশি” (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৭৬), বাঙালি মূলত বর্ণসংকর। ব্রাহ্মন্য উপাদান, বৌদ্ধ উপাদান, ইসলামের উপাদান-যা কিছু এখানে এসেছে কিছুই মূলের শুদ্ধতা বজায় রাখতে পারেনি। বরং এখানকার আদি জনবৃত্তের ধ্যান-ধারণার আনুগত্য মেনে নিয়েছে। বাঙালির এই খাঁটিত্ব তাই শাস্ত্রীমশায়ের সব ভাবনার ভিত্তিতত্ত্ব”। [১৯৮১ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ প্রণীত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহের ২য় খন্ডের সম্পাদকীয় ভূমিকাংশ] “শক, হুনদল, পাঠান, মোগল একদেহে হ’ল লীন”-এর যে ধারণাগত বৈশিষ্ঠ্যকে আমরা উর্ধ্বে তুলে ধরি হরপ্রসাদ ভাবনায় আমরা তার উত্তরাধিকার খুঁজে পাই। তাই নৈহাটিতে ‘অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেডইউনিয়ন’-এর এই দশম সর্বভারতীয় সম্মেলনেও চিন্তার প্রগতিশীল মৌলিকত্বর জায়গা থেকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে বিশেষভাবে স্মরণ করা স্বার্থক।

বিজেপির সহযোগী আরএসএস বিগত কয়েক বছর ধরে এতদ অঞ্চলের ডেমোগ্রাফি অর্থাৎ কিনা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারকে নিজ লক্ষ্যে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার বহুবিধ প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই নিয়েছে এবং কিছু কিছু সফলতাও তারা পেয়েছে। বেশিরভাগ অভিবাসী হিন্দিভাষীদের মধ্যে অমিত শাহ উচ্চারিত ‘ঘুসপেটিয়া’ শব্দ খুবই জনপ্রিয়। বাংলাদেশ থেকে আগত মুসলমান ও হিন্দু বাঙালি-ঘুসপেটিয়া সরে গেলে তাদের সুবিধা হয় – এরকম ধরনের এক সর্বজনীন বোধ তৈরি হয়েছে। যে আশ্চর্য সম্মিলনের বাস্তব বাতাবরণকে চিত্রিত করে লেখক সমরেশ ‘উত্তরঙ্গ’ উপন্যাসে উত্তরভারত থেকে আগত হীরালালকে, চটকল শহর হিসাবে বেড়ে ওঠা জগদ্দলের লখাই বা লক্ষ্মীন্দর করে তুলেছিলেন কিংবা ‘আদাব’ গল্পের সেই হিন্দু সুতাকল শ্রমিক ও মুসলমান মাঝিকে এক দাঙ্গাবিধ্বস্ত রাতের পটভূমিকায় সমব্যাথী বন্ধুতায় বেঁধেছিলেন — সেই শাশ্বত, চিরসত্য ঐতিহাসিক মনুষ্যবোধকে জাগরিত করে শ্রেণীর মধ্যে এই বিভাজনের নেতিবাচক প্রবণতাকে রুখে দেয়ার লক্ষেই ‘অল ইন্ডিয়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল অফ ট্রেডইউনিয়ন’-এর এই দশম সর্বভারতীয় সম্মেলন করা হয়েছে সংঘপরিবারের মানুষে মানুষে বিভেদ ও ঘৃণা তৈরি করার নয়া ল্যাবরেটরি এই ধুঁকতে থাকা চটকল শহরে। আওয়াজ তোলা হয়েছে ‘মজুরি-অধিকার-মর্যাদা ছিনিয়ে নাও, সাম্প্রদায়িক বিভাজন রুখে দাও’। অত্যন্ত নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে — ‘সিএএ-এনপিআর-এনআরসি আমরা চাইনা; কাগজ আমরা দেখাব না’।

(এআইসিসিটিইউ-র ১০ম সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষ্য নৈহাটির ‘‘অগ্নিবীণা সাংস্কৃতিক সংস্থা’’-র প্রকাশিত প্রচারপত্র)

খণ্ড-27
সংখ্যা-6