দিল্লীতে শান্তি ফিরিয়ে আনো! হত্যার কারবারীদের শাস্তি দাও! নিরাপত্তাহীন মানুষের জীবন ও অধিকার রক্ষা করো!

মোদী-শাহ বাহিনী যখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আতিথেয়তায় ব্যস্ত, দিল্লী তখন জ্বলছে নির্দিষ্টভাবে মুসলিম বিরোধী সুপরিকল্পিত এক হত্যা অভিযানের আগুনে, যাকে জ্বালিয়ে তুলেছিল, ইন্ধন জুগিয়েছিল দিল্লীর কিছু বিজেপি নেতা। পুলিশ সেই অভিযানে সরাসরি অংশ না নিলেও, ছিল নীরব দর্শক! চার দিন কেটে গেছে, এই নারকীয় তাণ্ডবলীলা ইতিমধ্যেই কেড়ে নিয়েছে ত্রিশটিরও বেশি প্রাণ, গুরুতর আহত হয়েছেন আরও অনেক বেশি মানুষ। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ নিরাশ্রয়, তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, জীবিকা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিহতের তালিকায় কয়েকটি হিন্দু নাম রয়েছে, যার মধ্যে আছেন একজন পুলিশ কনস্টেবল এবং একজন ইনটেলিজেন্স অফিসার। কিন্তু অনস্বীকার্য তথ্যটি হল – অত্যন্ত দুঃখের হলেও, এই হিংসার লক্ষ্য ছিল দিল্লীর মুসলিম সম্প্রদায়ের দরিদ্রতর অংশ, এবং মুসলিমদের আক্রমণকারী জনতা দিল্লী পুলিশ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। দিল্লী পুলিশ এমনকি সিসি টিভি’র ক্যামেরা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলছে, সম্ভবত ঐ সাম্প্রদায়িক ভীড়ের মধ্যেকার নেতাদের চিহ্নিত করা যাতে সম্ভব না হয় সেই লক্ষ্যে। দিল্লী হাইকোর্টের পক্ষ থেকে দিল্লী পুলিশকে নির্দেশ দিতে হয়েছে যাতে অ্যাম্বুল্যান্সগুলি বাধাহীনভাবে আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসার সুবিধা সম্পন্ন হাসপাতালে স্থানান্তরিত করতে পারে। ঐ বিপন্ন মুহূর্তে, হাইকোর্টই একমাত্র সংস্থা যা তার সাংবিধানিক ভূমিকা পালন করেছে।

এই পরিকল্পিত হত্যালীলা ১৯৮৪-র দিল্লী বা ২০০২-এর আহমেদাবাদ-গুজরাটের স্মৃতিকে উস্কে দেয়। সেখানেও প্রশাসন হিংসা-উন্মত্ত জনতাকে যথেচ্ছ হত্যা লুঠ ধর্ষণে ঢালাও সুবিধা করে দিয়েছিল। ২০২০র দিল্লীকে ১৯৮৪ বা ২০০২-এর ধ্বংসের ভয়াবহতায় পৌঁছানো থেকে রক্ষা করা আজ প্রত্যেকটি শান্তি ও ন্যায়কামী মানুষের কাছে এক চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে অবশ্য একটি বড় ফারাক রয়েছে। ১৯৮৪ এবং ২০০২, এই দুটি ক্ষেত্রেই বলা হয় হত্যাকাণ্ডের পিছনে কারণ ছিল। ১৯৮৪-তে ইন্দিরা গান্ধী হত্যা এবং ২০০২-এ মর্মান্তিক গোধরা অগ্নিকাণ্ডের ‘প্ররোচনা’ ছিল। কিন্তু দিল্লীর বর্তমান এই হত্যালীলায় কোন ‘প্ররোচনা’ ছিল? মনে হচ্ছে দুটি বিষয় এই বাহিনীকে ‘প্ররোচিত’ করে থাকতে পারে: (ক) সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-এর বিরুদ্ধে দেশজোড়া প্রতিবাদের উত্তাল ঢেউ, যার আবেগদৃপ্ত বলিষ্ঠ দুর্গ হয়ে উঠেছিল দিল্লী এবং (খ) বিজেপি’র ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক নির্বাচনী প্রচারকে দিল্লীর ভোটদাতাদের তরফ থেকে তাক-লাগানো, অবজ্ঞাভরা প্রত্যাখ্যান। এই হত্যা অভিযান ছিল বিজেপি’র “গোলি মারো” আহ্বানের (বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারো) চরম পরিণতি। আর এটাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, গণহত্যার কেন্দ্রগুলো ছিল সুনির্দিষ্টভাবে সেইসব অঞ্চল যেখানে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিততে পেরেছে। এই হত্যাভিযান ছিল সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদ ও দিল্লী জনাদেশের বদলায় বিজেপি’র উত্তর। এই ঘৃণ্য চক্রান্তকে যে কোনো মূল্যে ব্যর্থ করতে হবে।

del

 

নির্বাচনের সময় বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর এবং পরবেশ সিং ভার্মা “গোলি মারো” রণহুঙ্কারটি তুলেছিলেন, কপিল মিশ্র প্রকাশ্যে পুলিশকে হুমকি দিয়েছিলেন যে তার লোকজনই আইন হাতে তুলে নেবে। আর হিংসা-উন্মত্ত জনতা খুব নির্ভুলভাবেই সেটা করে দেখিয়েছে। এই বিষয়ে আরও সুনিশ্চিত হওয়া যায় যখন দেখা যায় দিল্লী হাইকোর্ট এই ঘৃণাবর্ষী ভাষণ ও প্রকাশ্য হিংসার আগুন জ্বালিয়ে তোলার বিষয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে বলছে, পুলিশের প্রতিনিধি এই অপরাধ সম্পর্কে অজ্ঞতা জানালে তাকে আদালতে ভিডিওগুলি দেখতে বাধ্য করা হয় এবং পুলিশকে এই বিদ্বেষমূলক অপরাধের সংঘটকদের শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দেয়। মুসলিম বক্তাদের গনগনে ভাষণের জন্য তাদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে; কর্ণাটকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিভেদ এবং বৈষম্যমূলক প্রকৃতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য স্কুলের বাচ্চাদের দোষী সাব্যস্ত করার চক্রান্ত চলছে; কিন্তু এক্ষেত্রে ভারতের রাজধানীতে শাসকদলের দায়িত্বশীল মন্ত্রী এবং জনপ্রতিনিধিরা প্রকাশ্যে হিংসাকে মদত দিলেও, উন্মত্ত জনতাকে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্ররোচনা দিলেও তাদের সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়া হয়েছে! এবং যখন দিল্লী হাইকোর্টের একজন বিচারপতি তাঁর যথাযথ সাংবিধানিক ভূমিকা পালন করলেন, রাতারাতি তাঁকে পাঞ্জাবে বদলি করে এই বাহিনী তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করল।

ভারতের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সংকট কখনও এত ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি।

দিল্লীতে অবিলম্বে শান্তি ফিরিয়ে আনার উপর জোর দেওয়ার সঙ্গে আমাদের অবশ্যই ন্যায়ের জন্য সমান দৃঢ়তায় লড়তে হবে। এই পরিকল্পিত হত্যা অভিযানের প্ররোচনা সৃষ্টিকারী ও সংঘটকদের শাস্তি দিতে হবে। আহতদের রক্ষা করতে হবে এবং যথাযথ চিকিৎসা পরিষেবা দিতে হবে। তাণ্ডবের শিকার পরিবারগুলিকে পুনর্বাসন দিতে হবে এবং হারানো জীবন ও জীবিকার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দিল্লীর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে এতবড় ব্যর্থতার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। এই সংকটের মুহূর্তে ‘আপ’-এর ভূমিকা, দিল্লীর একটি নির্বাচিত সরকার হিসেবে এবং একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক। এটা ঠিক যে দিল্লী পুলিশের উপর দিল্লীর রাজ্য সরকারের কোনো কর্তৃত্ব নেই, কিন্তু এই বিষয়টা সরকার এবং আপ-নেতৃত্বকে দিল্লীর মানুষের প্রতি তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে পারে না, দেবে না। প্রতিষ্ঠানগুলো যখন মানুষের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন মানুষকেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে, হত্যার কারবারিদের পরাস্ত করতে হবে এবং দিল্লীতে শান্তি ও সম্প্রীতিকে সুনিশ্চিত করতে হবে। এমনকি এই সাম্প্রদায়িক হত্যা অভিযানের মধ্যেও মুসলিম প্রতিবেশিদের রক্ষা করার জন্য হিন্দুদের আন্তরিক উদ্যোগ, তাণ্ডবের শিকার হয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য শিখ গুরুদোয়ারাগুলির দরজা খুলে দেওয়া ইত্যাদি অনেক হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টান্ত রয়েছে। ঠিক যেভাবে সংবিধান বাঁচানোর চলমান গণ আন্দোলনের ‘রাজধানী’ হিসেবে উঠে এসেছে দিল্লী, সেভাবেই দিল্লীর সচেতন ও বিবেকবান নাগরিকদের এবং প্রগতিশীল সমাজকর্মীদের শান্তি ফেরানোর সংগ্রামে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হবে।

(এম এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০)

খণ্ড-27
সংখ্যা-6