রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ

আগ্রাসী হিন্দুত্ব তথা ভারতীয় ফ্যাসিবাদের দানবীয় প্রতিনিধি হিসাবে যোগী আদিত্যনাথের স্বীকৃতি নিয়ে বোধকরি প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। মোহন ভাগবতদের অতীব প্রিয়পাত্র এবং মোদী-শাহর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উত্তরপ্রদেশের এই মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম-বিরোধী গর্জনে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতায় বরাবরই সীমাহীন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে মুসলিম-বিদ্বেষী ঘৃণার বচন ওগড়ানো এবং দাঙ্গার সংঘটনে প্ররোচনা যোগানোর দৃষ্টান্ত অসংখ্যই রয়েছে। তাঁর সুগভীর মুসলিম বিদ্বেষের পরিচায়ক দুটি সুপরিচিত বচনের উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না — ‘‘একজন হিন্দু মারা গেলে তার বদলায় ১০০ মুসলিমকে হত্যা করা হবে”; “একজন হিন্দু মেয়ে কোনো মুসলিমকে বিয়ে করলে ১০০ মুসলিম মেয়েকে হিন্দুদের কবজায় নিয়ে আসা হবে।” পূর্ব উত্তরপ্রদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কিয়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁর তৈরি করা বেসরকারি মিলিশিয়া হিন্দু যুব বাহিনীর ভূমিকাও এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। এছাড়া, দাঙ্গা বাধানো এবং দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে ২০০৭ সালে তাঁকে ১৪ দিন জেল খাটতেও হয়। কিন্তু বিচারবিভাগ সহ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অকৃপণ আনুকূল্য বর্ষণে আদিত্যনাথের মত হিন্দুত্বর মারমুখী ধ্বজাধারীরা গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে সংবিধানের সীমা লঙ্ঘনে বারবারই স্পর্ধিত হয়েছেন। এরকম এক মুখ্যমন্ত্রীর অধীনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের প্রশাসন যে রাজ্যের মুসলিমদের শত্রু জ্ঞান করে তাদের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধে রত হবে তা বোধহয় বিস্ময়ের কোনো ব্যাপার নয়। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বিরোধী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরপ্রদেশ তার প্রকট সাক্ষ্য বহন করছে। কেন্দ্রের তৈরি হিন্দুত্ববাদী আইন সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ জ্ঞান করে সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারীদের, বিশেষভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষদের শিক্ষা দিতে, নির্মমভাবে তাদের দমনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।

অন্তর্বস্তুতে হিন্দুত্ববাদী এবং সুস্পষ্টরূপেই মুসলিম-বিরোধী সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মোকাবিলা কোন পথে হবে তা আদিত্যনাথের একরকম ঠিক করা ছিল বলেই মনে হয়। কেউ হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা করলে তাঁর প্রতিক্রিয়া কি ধরনের হবে, সে প্রসঙ্গে তাঁর একটি মন্তব্য স্মর্তব্য— “এর (হিন্দুত্বের) বিরুদ্ধে আক্রমণ হলে তা হলোকস্টই (গণহত্যা, নাজিদের ইহুদি নিধন যজ্ঞ) ডেকে আনবে।” কিছুদিন আগেই দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে তাঁর মন্তব্য ছিল — “প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শ্রীযুক্ত মোদী সন্ত্রাসবাদীদের বিরিয়ানি না খাইয়ে গুলি করে হত্যা করছেন।” সমস্ত মুসলিমই তাঁর মতো হিন্দুত্ববাদীদের কাছে যেখানে সন্ত্রাসবাদী, তাদের মোকাবিলায় মোদী যে তাঁর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবেন, ‘গুলি’, ‘গণনিধন’ই যে তাঁর আরাধ্য পথ হবে সেটাই স্বাভাবিক। উত্তরপ্রদেশে প্রথম পর্যায়ের সিএএ বিরোধী আন্দোলনের পরপরই ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি বললেন, “এই হিংসায় জড়িত প্রত্যেকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে, এবং যে সরকারী সম্পত্তি নষ্ট করা হয়েছে তার জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে। ওদের সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ভিডিওতে এবং সিসিটিভি ফুটেজে ওদের চেনা যাচ্ছে। ওদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আমরা প্রতিশোধ নেব, আমি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।” এই বক্তব্যের মর্মার্থ অনুধাবনে প্রশাসনিক এবং পুলিশ কর্তাদের একটুও অসুবিধে হল না। এরপর থেকেই উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন যা হয়ে উঠল তাকে ‘প্রতিশোধ’ জমানা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

police

 

উত্তরপ্রদেশে সিএএ-বিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে আদিত্যনাথ সরকারের পুলিশ ও প্রশাসন কি ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা নিয়ে একাধিক তথ্যানুসন্ধানী দল তদন্ত করেছে। নিহতদের পরিবারের লোকজন, আহত ব্যক্তি এবং স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন মহল্লা পরিদর্শন করে তারা যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তাতে সন্ত্রাসের বিভীষিকার ছবিই ফুটে ওঠে। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর আক্রমণে মুসলিমদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে। সরকারী হিসেবেই নিহত প্রতিবাদকারীর সংখ্যা ২২, যা অন্য সমস্ত রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। বাছবিচারহীনভাবে এবং অবাধে গ্ৰেপ্তারি চালানো ও আটক করা হয়েছে। পুলিশের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্ৰেপ্তারির সংখ্যা ৯২৫, এবং নিবর্তনমূলক আটক ব্যক্তির সংখ্যা হল ৫৫০০। এবং নানা অভিযোগে এফআইআর করা হয়েছে ৮৮৩ জনের বিরুদ্ধে। এই হারে গ্ৰেপ্তারি ও আটক এবং এই বিপুল মাত্রায় এফআইআর এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সংকেতই দেয়। গ্ৰেপ্তারি ও আটক থেকে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবীরাও বাদ যায়নি। গ্ৰেপ্তার ও আটক করা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য এবং এমনকি বন্ধুবান্ধবদেরও হেনস্থা ঘটানো ও হুমকি দেওয়া হয়েছে, এবং কোনো-কোনো ক্ষেত্রে আটক করাও হয়েছে। প্রতিবাদ এবং সমাবেশ যাতে ঘটতে না পারে তার জন্য যথেচ্ছ ভাবে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পুলিশি নিপীড়নের খবর ছড়িয়ে পড়াকে আটকাতে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে। একটি অডিও টেপ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যাতে এক পুলিশ কর্তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে — বিক্ষোভ যারা দেখাচ্ছে তাদের নির্দয়ভাবে প্রহার করার নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন এবং তার জন্য পুলিশ কর্মীদের কোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হবে না। মানবিকতাকে প্রহসনে পরিণত করে বেসরকারি হাসপাতালগুলো সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গুলিবিদ্ধদের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেছে।

উত্তরপ্রদেশের রাজ্য সরকারের চালানো সন্ত্রাসের ছবিকে তুলে ধরতে কাওয়ান-ই-মহব্বত তথ্যানুসন্ধানী দলের পেশ করা রিপোর্ট থেকে অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। পুলিশের গুলি চালনা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে:

“এই চারটি শহরে (মুজাফ্ফরনগর, মিরাট, সম্ভল ও ফৈজাবাদ) নিহতদের পরিবারগুলির সাথে আমরা দেখা করেছি — নিহতদের মোট সংখ্যা হল ১৬। উত্তরপ্রদেশের পশ্চিম অঞ্চলে নিহত এই ১৬ জনের সবাই শ্রমিক শ্রেণীর পরিবারের তরুণ সদস্য। প্রায় প্রতিটি পরিবারই জানিয়েছে, নিহতদের কেউই মিছিলে যোগ দেয়নি, তারা ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল মাত্র। বুলেট লেগেই ওদের মৃত্যু হয়েছে। যে ১৬ জনের তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে, তাদের মধ্যে ১৪ জনের গুলি লেগেছে কোমরের ওপরে — বুকে, মুখে, মাথায়, ঘাড়ে। ...”

কোনো বিক্ষোভকারীর মৃত্যুই পুলিশের গুলিতে হয়নি বলে আদিত্যনাথ দাবি করলেও বিজনৌরে এক পুলিশ কর্তা কিন্তু পুলিশের গুলিতে এক জনের নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

মুসলিমদের বাড়ি-ঘরের উপর আক্রমণ সম্পর্কে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে:

“আমরা সেই সমস্ত বাড়ি পরিদর্শন করেছি যেগুলোকে এমনভাবে তছনছ ও ভাঙচুর করা হয়েছে যে সেগুলোকে মেরামত করা আর সম্ভব নয়। মুজাফ্ফরনগরে যে দুটি মুসলিম মহল্লা আমরা পরিদর্শন করি, যেখানের বাড়িগুলোর ওপর ২০ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ আক্রমণ চালায়, সেই বাড়িগুলোতে ভাঙচুরের একটা নির্দিষ্ট ধরন দেখা যায় — পুলিশ কিছুটা স্বচ্ছল পরিবারের বাড়িগুলোর ওপরই আক্রমণ চালায়। যে চারটি বাড়ি আমরা পরিদর্শন করি, সেগুলোতে প্রণালিবদ্ধ ভাবে সেইসব জিনিসপত্র পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছিল যেগুলো ভাঙচুর করা যায়। পুলিশ রান্নাঘরের আলমারি ভেঙে দেয় যার ফলে সমস্ত কাপ, ডিস ইত্যাদি চূর্ণ হয়, মশলাপাতি মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়, বেসিন চূর্ণবিচূর্ণ করে এবং কল ভেঙে দেয় যার ফলে রান্নাঘর জলে থইথই করে; বাথরুমের জিনিসপত্র, টেলিভিশন সেট, ফ্রিজ, ঠাণ্ডা মেশিন, ওয়াশিং মেশিন, চেয়ার-টেবিল, সুইচ বোর্ড চূর্ণ করা হয়; ওরা সব বাড়ির থালা-বাসন রাখার আলমারি, গাড়ি উল্টে দেয়। আর একটা বাড়িতে এই ধ্বংসকাণ্ড চালানোর সময় পুলিশ জয় শ্রীরাম শ্লোগানও দেয়। পরিবারের গয়নাগাটি লুট করা হয়, এবং দুটি বাড়ি থেকে নগদ টাকাও চুরি করা হয়।…”

পুলিশি হেফাজতে চালানো হিংসা সম্পর্কে রিপোর্ট জানিয়েছে:

“চারটি শহরের পুলিশি হেফাজতে নিপীড়নের মাত্রা ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছিল। নাবালকদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি — পুলিশ মুজাফ্ফরনগরের অনাথ আশ্রমের এক মাদ্রাসা থেকে ৪০ জন নাবালককে গ্ৰেপ্তার করে তাদের বেধড়ক মারধর করে। মাদ্রাসার মৌলানাকে এমন প্রহার করা হয় যে তাঁর পা এবং অন্যান্য অঙ্গ ভেঙে যায়। পুলিশ থানার ভেতরে নাবালকদের জামাকাপড় খুলে মারধর করে।…”

রিপোর্টের বাইরে নির্যাতনের শিকার দুই নাবালকের কথা শোনা যাক:

বিজনৌরে আটক ১৭ বছরের এক নাবালক কিশোর জানিয়েছে — “ওরা প্রধানত আমাদের শরীরের নীচের দিকে মেরেছে। আমি ১৫ দিন ঠিক ভাবে হাঁটতে পারিনি। পুলিশ আমাকে শুক্রবার ধরে এবং ছাড়ে রবিবার রাতে। ততক্ষণ পর্যন্ত আমি হেফাজতে ছিলাম যেখানে ওরা আমাকে নির্মম ভাবে প্রহার করে।”

আর এক নাবালক জানিয়েছে — “আমাকে একটা বড় হলঘরে ঢোকানো হল যেখানে প্রায় ১৫০ জন লোককে আটকে রেখে মারা হচ্ছিল। আমি দেখলাম তাদের মধ্যে ১৫-১৬ বছরের অনেক ছেলে রয়েছে। পুলিশ হলঘরের সবাইকে মারছিল। একজন পুলিশ আটক লোকগুলোর হাত ধরে রাখছিল আর অন্য এক পুলিশ তাদের খোলা গায়ে নির্দয় ভাবে লাঠিবর্ষণ করছিল।”

“সম্ভলে পুলিশ এক তরুণের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় শুধু এই কারণে যে সে হল জামিয়া মিলিয়ার ছাত্র। পুলিশ তাকে নগ্ন করে বেল্ট ও লাঠি দিয়ে নির্মম ভাবে প্রহার করে।

“ফিরোজাবাদে পুলিশ বিভিন্ন স্থান থেকে ১৪ জনকে ধরে রসুলপুর থানায় এবং সেখান থেকে মাখনপুর থানায় নিয়ে যায়। রসুলপুর থানায় তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর পর মাখনপুর থানাতেও অত্যাচার করা হয়।

পৈশাচিকতার মাত্রা এমনই ছিল যে, আহত ব্যক্তি একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী এবং তার পা ভাঙা, এ কথা জানা সত্ত্বেও পুলিশ তার ওপর নির্দয় নির্যাতন চালায় এবং গ্ৰেপ্তারের তিনদিন পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। …

“মিরাটে পুলিশ ১০০রও বেশি মানুষকে গ্ৰেপ্তার করে এবং তারা এখনও রাতে মিরাটের মুসলিম পাড়ার রাস্তাগুলোতে ঘুরে বেড়ায় এবং আরো মানুষকে গ্ৰেপ্তার করার হুমকি দেয়। …

“মুজাফ্ফরনগরে জামিলের সঙ্গে কথা বলার সময় আতঙ্ক মূর্ত হয়ে উঠল। শীর্ণ শরীরে ২০ দিন পরও তাকে ভয়ত্রস্ত দেখাচ্ছিল এবং আটক থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে কি ধরনের আচরণ করা হয়েছিল সে কথা সে বিশদে বর্ণনা করল। গণ্ডগোলের মধ্যে ভাইকে খুঁজতে গিয়ে সে পুলিশের হাতে পড়ল এবং নির্মমভাবে প্রহার করার পর ওরা একটা গরম লোহার রড দিয়ে ওর হাতে ছেঁকা দিল। এরপর ওকে একটা গাড়িতে চাপানো হল এবং সেখানেও মারা হল। বেআইনিভাবে ব্যারাকে আটকে রেখে ওকে দুদিন কিছু খেতে দেওয়া হয়নি — এবং থানাগুলোতে সমস্ত আটক ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা একই। ...”

police2

 

পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভাবধারা কি প্রবল মাত্রায় চাড়িয়েছে, তথ্যানুসন্ধানী দলের রিপোর্টে সে কথাও ফুটে উঠেছে। বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশকে দেখা গেছে তারা মুসলিম জনগণের বাড়িতে, দোকানে আগুন লাগাতে হিন্দু জনতাকে উৎসাহিত এবং এমনকি প্ররোচিতও করছে। হিন্দু জনতার উদ্দেশ্যে পুলিশ কর্মীদের কয়েকটি কথা ছিল এরকম— “আমরাও হিন্দু, তোমরাও হিন্দু, মারো ওদের।” “আমাদের ভাইয়েরা এই মিঁয়াগুলোকে (মুসলিমদের) রেখেছে, না হলে কোন কথা বলার অধিকারই ওদের থাকত না।” “আমাদের মাত্র দু-ঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছে, দুদিন সময় দিলে বুঝিয়ে দিতাম আমরা কে।” “এই কালো আর নীল পট্টি বাঁধা লোকগুলোকে পাকিস্তানে চলে যেতে বল।”

সম্ভলে স্থানীয় মানুষদের কাছে একটা টেপ আছে যাতে জেলা শাসককে কিছু হিন্দু সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যাচ্ছে যে তাঁরা কেন জেহাদিদের সাহায্য করছেন।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আদিত্যনাথ বিধানসভায় সিএএ বিরোধী বিক্ষোভকারীদের প্রসঙ্গে বললেন, “যদি কেউ মরতে আসে, তাহলে সে বেঁচে ফিরবে কীভাবে?” তাঁর এই কথা এটাই বোঝাচ্ছে যে — প্রতিবাদ জানাতে, বিক্ষোভ দেখাতে মানুষ উত্তরপ্রদেশের রাস্তায় নামলে নিহত, আহত হওয়াটাই তাদের ভবিতব্য হবে। তাঁর কথা থেকে যেন এই সুরই বেরিয়ে আসছে যে, এত মানুষ নিহত ও আহত হওয়ায়, এত মানুষের গ্ৰেপ্তারি ও আটকের ঘটনায় তিনি আনন্দ উপভোগ করেছেন, তৃপ্তির আস্বাদ পেয়েছেন। এর মধ্যে দিল্লী বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি মন্ত্রীর সেই বহু চর্চিত উক্তিরই প্রতিধ্বনী—‘‘গোলি মারো শালোঁ কো।” আদিত্যনাথ যখন বিধানসভায় আরো বলেন, “ওরা যে ভাষা বোঝে আমরা সেই ভাষাতেই ওদের সঙ্গে কথা বলব”, তখন তাঁর কথা গণতন্ত্রে নির্বাচিত কোন মুখ্য প্রশাসকের স্বর হওয়ার চেয়ে এক বাহুবলী মাস্তানের হুমকিবাজির মতোই শোনায়। এত নগ্ন সাম্প্রদায়িক উচ্চারণ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী ছাড়া আর কারো কাছ থেকে শোনা যায়নি। তবে মোদী-শাহ-আদিত্যনাথরা হাজারো চেষ্টা করা সত্বেও সন্ত্রাসের পরিমণ্ডলকে স্থায়ী করে রাখতে পারছেন না। তাঁরা ভেবেছিলেন, মেরুকরণের কৌশলই সিএএ-এনআরসির পথকে অবাধ ও মসৃণ করার নির্ধারক কসরৎ হয়ে উঠবে। কিন্তু সন্ত্রাসের চোখরাঙানিকে অগ্ৰাহ্য করে মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভের সাহস দেখাচ্ছেন, দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে হাজার-হাজার মানুষ অসমদর্শী সিএএ আইন বাতিলের দাবিতে পথে নামছেন, স্বৈর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, সংখ্যাগুরুবাদী একাধিপতত্যের বিপরীতে সমাজকে বহুত্ববাদী, বৈচিত্র্যময় করে তোলার আহ্বান জানাচ্ছেন। স্বৈরাচার, সন্ত্রাসের তমসের মধ্যে এই রুপোলি রেখা অবশ্যই আশ্বাসের।

খণ্ড-27
সংখ্যা-6