গতকাল সন্ধ্যায় জেলে একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে গেল!
A strange thing happened in jail

বিচারের প্রত্যাশায় বা বিনা বিচারে জেলের মধ্যে কেমন কাটে? কেমন করে কাটাতে হয় রাজনৈতিক বন্দিদের?

সাতাত্তর সাল। বন্দিমুক্তি আন্দোলনের অভিঘাতে তখন জেলের বন্ধ গরাদ কেঁপে কেঁপে উঠছে। মাইক্রোফোনে ভেসে আসা দূরাগত এক গানের কলি বহরমপুর জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে কেমন করে যেন ঢুকে পড়েছিল। সেলবন্দী, বহুদিনের উপোসী চোখে বাইরের পৃথিবীটা দেখার আকাঙ্ক্ষা মুহূর্তের জন্য তীব্র হয়ে উঠেছিল।

সাতাত্তরে সদ্য ছাড়া পাওয়া এক ‘মিসা’বন্দির মুখে শোনা। প্রথমবার সদ্যতরুণ আনকোরা সেই ডাক্তারি-পড়ুয়া কলেজ হোস্টেলে দাদাদের পাঠচক্রে বার কয়েক যোগ দেওয়ার ‘অপরাধে’ গ্রেফতার হয়েছিল মিথ্যা অভিযোগে। ‘চটিপরা পুলিশ’ সব শাসকেরই থাকে। সবক শেখানোর দায়িত্বটা তারাই নিয়ে বেধড়ক মারে সারা শরীর রক্তাক্ত করে, সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে, অন্তর্বাসটুকুও পুড়িয়ে দিয়ে উর্দি পরা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। মাসখানেক পরে ছাড়া পাওয়া। মিথ্যা অভিযোগে অপমান নিগ্রহ সদ্য আঠেরো পেরোনো মনে এবার সত্যি সত্যিই বিপ্লবের আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করার’ আহ্বানে সাড়া দিয়ে পূর্ণোদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া। কমরেড চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার পর ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ অভিযোগে আবার গ্রেফতার হওয়া। পুলিশ অফিসার রুণু গুহ নিয়োগী বুকটা বুট দিয়ে ডলে ঘৃণাভরা তচ্ছিল্যে বলেছিল “নকশাল! বীরপুরুষ! বুকের পাঁজর গোনা যায়।” সেই ছিল প্রথম সম্ভাষণ। তারপর তো চলেছে অনেক বর্বরতা। বিনা বিচারে আটক থাকার বন্দিজীবনে ধরেই নিতে হয়েছে, যে কোনোদিন ‘এনকাউন্টারের’ নাম করে মেরে দেবে, নয়তো জেলেই পচে মরতে হবে। বাড়ির লোকজনও এরকম ভেবেই মনকে তৈরি রাখতেন। এটা নকশাল আন্দোলনে নিবেদিতপ্রাণ হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর একজনের কথা।

প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনও ছবিটা প্রায় একই। শাসকের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই ‘দেশদ্রোহী’র তকমা। সেই শাসকের পোষা গুণ্ডাবাহিনীর সবক শেখানো। ব্রিটিশ আনুগত্যের স্মারক সেই কালাকানুন-ইউএপিএ!

গত বছর সিএএ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধে’ মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন দেবাঙ্গনা কলিতা, নাতাশা নারওয়াল, সাফুরা জারগর, উমর খলিদ সহ বহু ছাত্রছাত্রী, গবেষক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মী। পঞ্চাশ বছর পরেও ছাত্রসমাজের চেহারাটা মূলগতভাবে একই রকম আছে। নাগরিকত্বের আন্দোলনে ভারতবর্ষের প্রায় প্রত্যেকটি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সমাজ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। এরপর ঘটে দিল্লীর কুখ্যাত হত্যাতাণ্ডব হিন্দুত্ববাদীদের প্রত্যক্ষ প্ররোচনায়। ‘দিল্লীর দাঙ্গায়’ জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে গত বছর ২৩ মে দেবাঙ্গনা কলিতা ও নাতাশা নারওয়ালকে গ্রেফতার করে দিল্লী পুলিশ। ‘পিঞ্জরা তোড়’-এর এই নেত্রীরা লিঙ্গ সাম্য, ছাত্র অধিকার সহ নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। জেএনইউ-এর গবেষক দেবাঙ্গনাকে প্রায় ডজনখানেক মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। বেশ কয়েকটিতে জামিন পেলেও এখনও বিনা জামিনে তিহার জেলে বন্দি আছেন। দেবাঙ্গনা কবিতা লেখেন, গোন্দ শিল্প শৈলীতে চমৎকার ছবি এঁকেছেন জেলে বসে। গত বছর তিনি এক বন্ধুকে চিঠি লেখেন জেল থেকে । কবিতার মতো সুন্দর চিঠিটির অনুবাদ নীচে দেওয়া হল। মূল লেখার সৌন্দর্য অনুবাদে অনুপস্থিত – বলাই বাহুল্য।

কাল জেলে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল! গত চিঠিতে আমি বলেছিলাম, রামধনু আর জোনাকি নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে কত মজা করেছিলাম। আমি ওদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম – রামধনু কী আর তার রংগুলো কী কী। তিনটে বাচ্চা – দু’বছরও হয়নি – ওরা তো আর আমাদের মতো কথা বলতে পারে না। একটি দু’বছরের – সেটি অল্প অল্প কথা বলে। আর আছে বছর চারের কয়েকটি খুকী – তাদের মুখে তো কথার খৈ ফুটছে! আমাদের কাছে লাল ক্রেয়নের একটা ছোট্ট ভাঙা টুকরো ছিল। তাই বাকি রংগুলো আমাদের পুরোনো খবরের কাগজ থেকে খুঁজে নিতে হয়েছিল। তারপর সেগুলো ছিঁড়ে বার করে নিয়ে আমরা রামধনুর কোলাজ বানিয়েছিলাম। বাচ্চারা খুব খুশি হয়েছিল। ওদের কৌতূহলও অনন্ত। ওরা বেশ ভাবনায় পড়ে গিয়েছিল – “আকাশে এত রং কোথা থেকে আসে গো?” সবচেয়ে বড়টি জিজ্ঞাসা করেই যাচ্ছিল।

আর তারপরে, এক্কেবারে হঠাৎ সেই ঘটনাটা ঘটল! গতকাল সন্ধ্যেয়! সন্ধ্যের মুখে, সূর্যাস্তের ঠিক আগে ঝিলমিল কণাগুলো আমাদের চোখের সামনে নাচতে থাকে, মনে পড়ছে এক সন্ধ্যেয় সেই ‘আবিষ্কারের’ কথা?

আকাশটা ছিল অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি নীল আর পরিষ্কার। বিকেলের আলো ছিল নরম, মোহময়। ম্রিয়মান সূর্য কখনও মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছিল, কখনও আড়াল সরিয়ে বেরিয়ে পড়ছিল। খুব হালকা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছিল। আমার মধ্যে একটা প্রত্যাশা জাগছিল, কিন্তু আশা করতেও ভয় করছিল।

আন্টি ই ই ই! দ্যাখো *রা ম ধ নু*!! হঠাৎ সবচেয়ে বড়টি চীৎকার করে উঠল। হ্যাঁ, ওরা আমাদের ‘আন্টি’ই বলে। আমার মনে হয়, ওদের মায়েদের প্রায় সবার থেকেই, আমরা অন্তত পাঁচ বছরের বড়। ওরা (মায়েরা) সবাই আমার বেড়ে চলা রূপোলি চুলের দিকে আঙুল তুলে অনুযোগ করে, আমার চুলে রং করা উচিত। কিন্তু সবচেয়ে আগে তো চুলে চিরুনি চালাতে হবে! জেনানা ফাটকে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো, সেই চুলে জটিল বিনুনি বাঁধা, চুলে রং করা – এসব তো ‘কম্যুনাল অ্যাকটিভিটিজ’!

আরে হ্যাঁ, তাইতো! আকাশে একটা সত্যিকারের রামধনুই তো বটে! আমাদের ওয়ার্ডের সামনে আকাশ জুড়ে একটা ধনুর বিশাল টুকরো ফুটে উঠছে! বাচ্চারা উত্তেজনায় ফুটছে। সকলেই চাইছে একটু উঁচুতে তুলে ধরা হোক, আরেকটু ভালো করে তারা দেখবে! চারিদিকে হৈ হৈ, মেয়েরা চীৎকার করে এ ওকে ডাকছে, একবারটি বেরিয়ে এসে দেখার জন্যে।

মেঘ সরে যেতেই পরিষ্কার নীল আকাশ আরও উন্মুক্ত হল-আস্ত একটা রামধনু! এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত-গোটা ধনুটি ফুটে উঠতেই সব চেয়ে কুট্টিটা-এক ব্রাজিলিয়ান বাচ্চাছেলে-চীৎকার করে বলে উঠল “হাল্লেলুজা”---তার মুখে প্রথম উচ্চারিত শব্দ! সবাই হতবাক! আফ্রিকান বন্দিদের জন্য যিশুর উপাসনা অনুষ্ঠান হয়,বেশ জাঁকালো অনুষ্ঠান, কয়েক মাস আগে সেখান থেকেই হয়তো সে এটা শুনে রপ্ত করেছে।

রামধনু, আস্ত রামধনু দেখার আনন্দটা একটা প্রগাঢ় উত্তেজনা, একটা ঐকান্তিকতায় যেন সকলকে সংক্রমিত করে ফেললো।

আবেগ যেন উপচে পড়ছে। কেউ তদ্গত হয়ে উচ্চকণ্ঠে প্রার্থনা শুরু করল। কেউ আকাশের দিকে দু-হাত তুলে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। কেউ চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। কেউ আবার নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো স্মিতমুখে। কেউ তীব্রসুরে ‘দুয়া’ জানাতে লাগল। কেউ আবেগে ঈশ্বরকে ডেকে উঠল। কে আবার যেন অভিশাপ দিয়ে উঠল কাকে! কেউ চোখ পিটপিট করে সাতটা রং গোনার চেষ্টা করতে থাকল। সেগুলো কি তখন ওখানে ছিল? সত্যিই কি আসলটি তখন ওখানে ছিল? কেউ হাত দুটো আড়াআড়ি রেখে ‘উইশ’ করল। রামধনুর গায়ে একঝাঁক উড়ন্ত পাখির সিল্যুয়েট। যেমনটা শীতের গোধূলিতে নদীর ধারে দেখা যায়, আমার মনে পড়ে গেল।

অনেক বন্দির কাছেই এটা প্রথম রামধনু দেখা – “কখনও ভাবিনি জেলে এসে প্রথম রামধনু দেখব!” বাচ্চারা অবশ্য সবাই এই প্রথম দেখল। তাদের এক বন্ধু বলেছিল, “এটা আমাদের স্বাধীনতার টিকিট”

– আমাদের পথ-আমাদের খুঁজতে হবে এর শেষটা কোথায় শুরু হচ্ছে।

আশা ছিল, প্রবল আশা! বিচিত্র কোলাহলের মধ্যে ধ্বনিত অসম্ভব আশা! সব কিছু যেন মুহূর্তের জন্য থমকে দিয়ে শুধু এক আনন্দের লহর ভেসে বেড়ালো!

আমি ভীষণ মুষড়ে পড়লাম। একটা পরাজয়-রামধনুর ‘আশাপূরণের’ অক্ষমতায়-ওর অনিবার্য ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’। ওর ক্ষণস্থায়িত্ব আমাকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল।

কয়েক মুহূর্ত পরে আমাদের তালাবন্দি হওয়ার সময়। এটা জেনেই বোধ হয় রামধনু আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। বাচ্চারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল “আন্টি, ও কোথায় চলে গেল? “ও কেন চলে গেল?” “ও কাল আসবে?” বিরামহীন প্রশ্নের অবরোধে পড়ে গেলাম। ওদের খুশি করা উত্তর থোড়ি দিতে পারলাম! এমনকি আবহমান কালের একটা প্রশ্ন, “ও কেন আসে?” – তারও উত্তর দিতে পারিনি! একটা রামধনু কেন আসে, কীভাবে আসে আর কেনই বা চলে যায়। তোমার মনে আছে?

আজ বিকেলে বাচ্চারা পার্কে অনেক আশা নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসেছিল তাদের ছোট্ট মেরী গো রাউন্ডে, “ও কি আজ আসবে?”

আমি সেই ছোট্ট বিজ্ঞ ছেলেটির কথা ভাবছিলাম, যার সঙ্গে এক শীতে, মহল্লায় আমাদের দেখা হয়েছিল। আর ভাবছিলাম, পুরোনো শহরটার আকাশে সে কি শেষপর্যন্ত রামধনু দেখতে পেয়েছিল!

২০২০-তে সাজানো মিথ্যে অভিযোগে ইউএপিএ-তে গ্রেফতার হওয়া আর এই একই বছরে রামধনুর মুখোমুখি হওয়া! পুরোনো শহরের দূষিত আকাশে, এমনকি জেলেও একটা আস্ত ‘রামধনু’ দেখতে পাওয়া! এখন আমরা একটি জোনাকির অপেক্ষায়!”

(ইংরেজিতে লেখা মূল চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছে RAIOT ২৩ মে, ২০২১ সংখ্যায়)

-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-20