আজকের দেশব্রতী : ০১ জুলাই ২০২১ (অনলাইন সংখ্যা)
Deshabrati 01 July Issue

Save the Farmers, Save Democracy Day_0

দেশ ও দুনিয়ায় ব্যাপক সাড়া জাগানো দিল্লীর কৃষক আন্দোলন গত ২৬ জুন সাত মাস অতিক্রম করল। ৪৬ বছর আগে এদিনেই জারী করা হয়েছিল জরুরি অবস্থা। তৎকালীন পরিস্থিতির সাথে হুবহু মিল না থাকলেও আজকের সময়কালে শাসকের দমন পীড়ন আরও সর্বাত্মক, আরও গভীরে। আজ সারা দেশে চলছে যেন এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা। তখন ছিল মিসা, আর আজ ইউএপিএ, যে কোনো প্রতিবাদ করলেই সেই একই বিনা বিচারে আটক রাখার কালা আইন। এসব কিছুকে মোকাবিলা করে দেশের বুকে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে দিল্লীর বুকে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ ধর্ণা-অবস্থান কর্মসূচি এগিয়ে চলেছে।

সম্প্রতি এই কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে সুপরিচিত মার্কিন চিন্তাবিদ, ভাষাবিদ, দার্শনিক নোয়ম চমস্কি বলেছেন, “অন্ধকারের বুকে আলোকবর্তিকা”। তিনি বলেছেন, কৃষকরা শুধু নিজেদের জন্যই নয়, এক প্রগতিশীল সমাজের জন্য লড়াই করে চলেছেন যা সমস্ত নাগরিকদের অধিকার ও কল্যাণের জন্য নিয়োজিত। এই আন্দোলন কর্পোরেটদের দ্বারা কৃষকদের নিয়ন্ত্রিত করার বিরুদ্ধে। চলমান এই সংগ্রাম পুরোপুরি সঠিক। উনি আরও বলেছেন, “এই নির্মম স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় সংগ্রামী কৃষকদের নিজেদের ভূমিকার জন্য গর্বিত হওয়া উচিত। সারা দুনিয়ার সামনে এই কৃষক আন্দোলন একটা মডেল”।

কিষাণ আন্দোলনের নেতৃত্বকারী সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও এআইকেএসসিসি’র আহ্বানে ২৬ জুন সারা দেশজুড়ে পালিত হলো “কৃষি বাঁচাও গণতন্ত্র বাঁচাও” দিবস। রাজ্য রাজধানীগুলিতে রাজভবন অভিযান, রাজ্যপালের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান, জেলায় জেলায়, ব্লক সদরে বিক্ষোভ ও নানাবিধ প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়। দিল্লীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অপকৌশলকে মোকাবিলা করে কিষাণ আন্দোলন লাগাতার শক্তিশালী হয়ে চলেছে। দিল্লী, উত্তরপ্রদেশের লাগোয়া মেওয়াট অঞ্চল, মথুরা, হরিয়ানার নাহ এলাকা, রাজস্থানের ভরতপুর, আলোয়ার এলাকা – এই সমগ্র এলাকায় সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের কিষাণরা বড় সংখ্যায় আন্দোলনে যোগদান করেছেন। এখানে দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজেপি-আরএসএস বাহিনী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করার চক্রান্ত চালায়। প্রথমে স্থানীয় একটি গোলযোগে আসিফ নামে একজন যুবক খুন হয়, বিজেপির লোকেরা কিষাণ নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে, অপরাধীদের সমর্থনে মহাপঞ্চায়েত করে, কিষাণ আন্দোলনকে ভাঙ্গার চক্রান্ত চালায়। অপর একটি ঘটনায় জুনেইদ নামে এক যুবককে পুলিশ লকআপে হত্যা করা হয়। সেখানে পরিবারের লোকেরা পুলিশের নামে এফআইআর দায়ের করে কিন্তু কিষাণ নেতাদের মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এখানে হরিয়ানার বিজেপি-জেজেপি সরকারের প্ররোচনা মোকাবিলা করে কিষাণ আন্দোলনের পক্ষ থেকে এক মহাসম্মেলন আয়োজন করা হয়। সমস্ত সম্প্রদায়ের কিষাণদের অংশগ্রহণে এক বিশাল জমায়েত কর্মসূচি কিষাণ একতাকে মজবুত করতে সহায়ক হয়। চন্ডীগড়ে, হিসারে কিষাণ নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু দিল্লীর বুকে নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন, কৃষকরা নিজেদের অধিকার ও জীবনযাত্রার উপর অগ্রাধিকার দিয়েছে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনে আন্দোলনকে ভাসিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করা হবে।

২৬ জুন কর্মসূচিতে কৃষক ছাড়াও সারা দেশের শ্রমিক, ছাত্র-যুব, মহিলা ও নাগরিক সমাজের শক্তিগুলি ভালো সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে। নানারকম প্রতিবাদ কর্মসূচিতে তারা বলেন, কেন্দ্রীয় তিন কৃষি আইন কেবল দেশের কৃষিব্যবস্থাকেই ধ্বংস করবে না, কালোবাজারি ও বেকারত্ব বিপূল পরিমাণে বাড়িয়ে দেবে, ঘটাবে সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি। আজকের সময়ে দেশের সাধারণ মানুষ যা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। দেশের সমগ্র কৃষি বিপণন ও অত্যাবশ্যক পণ্য মজুত এবং সরবরাহ ব্যবস্থাকে একচেটিয়া পুঁজিপতি ও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। রেশন ব্যবস্থা, মিড-ডে-মিল বা শিশুদের খাদ্য সরবরাহ উঠিয়ে দেওয়া হবে। চুক্তিচাষের আইনি স্বীকৃতি কৃষকদের গোলামে পরিণত করবে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে ধ্বংস করে আমদানি নির্ভর করে তুলবে। কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সংসদীয় ব্যবস্থাকে নসাৎ করে গায়ের জোরে কৃষি আইন পাশ করেছে। গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান না করে দমন-পীড়ন নামিয়ে আনতে চাইছে। আন্দোলনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সামাজিক মাধ্যমগুলিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে, নেতৃত্বকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী, খালিস্তানী, করোনা সুপারস্প্রেডার অপবাদের তকমা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে আন্দোলনের পাশে সর্বস্তরের মানুষ সংহতি গড়ে তুলছে।

পশ্চিমবাংলার বুকে কৃষকরা এই আন্দোলনে সামিল হয়েছেন তাঁদের জীবন্ত দাবিগুলিকে সামনে রেখে। বর্তমানে লকডাউনের অজুহাতে ফসলের যতটুকু সীমিত সরকারি সংগ্রহ-ব্যবস্থা ছিল সেটাকে শিকেয় তোলা হয়েছে। চাষিরা ধানের অভাবী বিক্রি করছেন মাত্র ১,১০০/১,২০০ টাকা কুইন্টাল দরে, সরকারি দর যেখানে ১,৮৬৫ টাকা। দাবি ওঠেছে, দুয়ারে দুয়ারে সরকারি দরে ধান কিনতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে স্বল্প মূল্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষিদের সার, বীজ, ডিজেল, বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। সর্বোপরি লকডাউনের কর্মহীনতার পরিস্থিতিতে ১০০ দিনের কাজ চালু করতে হবে। এই ক্ষেত্রে দলবাজি, নিম্নহারে মজুরি দেওয়া চলবে না, ভাগচাষি ও চুক্তি-চাষিদের সরকারি তালিকা তৈরি করে তাদের সমস্ত সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দিতে হবে প্রভৃতি। এই দাবিগুলিকে তুলে ধরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা সদরে, ব্লকগুলিতে এআইকেএম ও আয়ারলা’র পতাকাতলে নানাবিধ প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়।

দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচির অঙ্গ হিসাবে কলকাতার ধর্মতলায় রাজভবন অভিযান সংগঠিত হয়। রাজভবনের অনতিদূরে সিধু-কানু ডহরে অনুষ্ঠিত হয় কয়েক শতাধিক কর্মীদের অংশগ্রহণে যৌথ অবস্থান ও বিক্ষোভ সভা। দু’ঘন্টা ধরে বিক্ষোভসভা চলে। দাবি তোলা হয় তিন কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল কর, এমএসপি গ্যারান্টি আইন চালু কর। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বাতিল করে কালোবাজারি মজুতদারী সৃষ্টি করা চলবে না। পাশাপাশি এরাজ্যে কৃষি আইন কার্যকরী করা স্থগিত রাখতে হবে। শ্রমআইন তুলে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা ও শ্রম কোড চালু করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে এই রাজভবন অভিযানে অংশগ্রহণ করেন বামপন্থী কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। পশ্চিমবঙ্গ কিষাণ কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতারা প্রধানত পাঞ্জাবী সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভালো সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য রাখেন এআইকেএস-এর অমল হালদার, তুষার ঘোষ, এআইকেএম-এর কার্তিক পাল, জয়তু দেশমুখ, অগ্রগামী কিষাণ সভার হরিপদ বিশ্বাস, জয় কিষাণ সংগঠনের কল্যাণ সেনগুপ্ত, পশ্চিমবঙ্গ কিষাণ কো-সংগঠনের নেতা তেজেন্দ্র সিং, চেতন সিং, পিডিএস নেতা সমীর পুততুন্ডু, এআইকেএমএস-এর সুশান্ত ঝাঁ, সিআইটিইউ নেতা অনাদি সাহু, এআইসিসিটিইউ নেতা অতনু চক্রবর্তী প্রমুখ। ছিলেন এআইকেএম নেতা দিলীপ পাল, আয়ারলা’র নবকুমার বিশ্বাস, সংযুক্ত কিষাণ সভার সুভাষ নস্কর, এমকেপি’র কুশল দেবনাথ, এআইসিসিটিইউ নেতা প্রবীর দাস, নাগরিক আন্দোলনের নেতা অমলেন্দু ভূষণ চৌধুরী প্রমুখ। এআইকেএসসিসি’র পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়।

Save the Farmers, Save Democracy Day_1

 

হুগলী

এই জেলাতেও বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে এরাজ্যের কৃষক, বিশেষত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, ভাগচাষি ও গরিব ঠিকা চাষিদের বিভিন্ন দাবিতে। সব জিনিসের দাম যখন অগ্নিমূল্য তখন ধানের দর ক্রমাগত কমছে। যেখানে বস্তাপিছু আলুর উৎপাদন খরচ প্রায় ৪০০ টাকা, তখন দাম মিলছে মাত্র ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের আর্থিক অনুদান থেকে গরিব ভাগচাষি ও ঠিকা চাষিরা বঞ্চিত। ব্যাংক বা সমবায় ঋণের সুযোগও তাদের অধরা। অবিলম্বে সরকারকে ধান, আলু সহ কৃষি ফসল কেনার উদ্যোগ নিতে হবে, ভাগচাষি ও গরিব ঠিকা চাষিদের তালিকা প্রস্তুত করে তাঁদের সরকারি প্রকল্পের সমস্ত সুযোগ দিতে হবে, কৃষকদের জন্য বিশেষ ভর্তুকিতে ডিজেল সরবরাহ করতে হবে, সার-বীজ-বিদ্যুৎ ইত্যাদি কৃষি উপকরণ সস্তায় সরবরাহ করতে হবে – এই সমস্ত দাবিতে পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিতে কোভিড বিধি মেনে মিছিল করা হয়, মিছিল শেষে জিটিরোড অবরোধ করা হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় বলাগড় ব্লকের গুপ্তিপাড়া বাজার ও ইছাপুর গ্রামে। পোলবা ব্লকের আলিনগরে কৃষকদের সাথে ভাল সংখ্যক কৃষিমজুর, আদিবাসী নারী-পুরুষ দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এআইকেএসসিসি’র শরিক সংগঠন হিসেবে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি এবং আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চও বিক্ষোভে অংশ নেয়। আধার নম্বর সংযুক্তির অজুহাতে কোনো মানুষ যেন রেশনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন সে বিষয়ে হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়। এনআরইজিএ প্রকল্পে পরিবারপিছু জবকার্ড নয়, মাথাপিছু জবকার্ড দেওয়ারও দাবি জানানো হয়।

পূর্ব বর্ধমান

জেলার পুর্বস্থলী ২নং ব্লকের ফলেয়া স্টেশন সংলগ্ন বাজারে সকালে এআইকেএসএসসি অন্তর্ভুক্ত এআইকেএম এবং আয়ারলার উদ্যোগে মিছিল বিক্ষোভ অবস্থান ও সভা করা হয়। প্ল্যাকার্ড, পতাকা, ব্যানারে মিছিল সুসজ্জিত ছিল, দাবি তোলা হয় – তিন কৃষক বিরোধী আইন বাতিল করতে হবে, বিদ্যুৎ বিল-২০২০ বাতিল করতে হবে, ১০০ দিনের কাজ দিতে হবে। ১০০ দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতি ও বঞ্চনা বন্ধ করতে হবে। গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে সর্বজনীন ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক পরিবারকে মাসিক ৭,৫০০ টাকা অনুদান দিতে হবে। সভায় বক্তব্য রাখেন অশোক চৌধুরী।

বর্ধমান শহরের কার্জন গেটের সামনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও এআইকেএম-এর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা সংগঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন এআইকেএম-এর রাজ্য সভাপতি অন্নদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও কুনাল বক্সী ও আয়ারলার জেলা কমিটির সদস্য শ্রীকান্ত রানা।

কালনা ২নং ব্লকে এআইকেএম, আয়ারলা ও আর ওয়াইএ’র পক্ষ থেকে মিছিল প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন এআইকেএম-এর জেলা কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম।

মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে এআইকেএম ও আয়ারলার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ সংগঠিত করা হয়। নেতৃত্ব দেন আয়ারলার রাজ্য কমিটির সদস্য আনসারুল আমন মন্ডল।

নদীয়া

২৬ জুন নাকাশীপাড়া ব্লকের বেথুয়াডহরিতে পার্টি অফিসের সামনে থেকে কর্মীরা মিছিল করে বেথুয়াডহরি স্ট্যাচুর মোড়ে পৌছায়, সেখানে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কৃষি বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও প্রতিবাদ দিবস পালনের এই আহ্বানকে সামনে রেখে স্লোগান ও বক্তব্য রাখা হয়। উপস্থিত ছিলেন কৃষ্ণ প্রামানিক, কাজল দত্তগুপ্ত, ইয়াদ আলি প্রমুখ।

১৯৭৫ সালের ২৬ জুন স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, তারপর সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিকে কালা দিন হিসাবে পালন করে আসছে পার্টির ধুবুলিয়া কমিটি। এই বিষয়টিকে তুলে ধরে স্থানীয় নেতাজী পার্কে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন সন্তু ভট্টাচার্য, শঙ্কর রায়, অমিত মন্ডল সহ অন্যান্যরা। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে মোদী সরকারের সমস্ত জনবিরোধী আইন ও কাজের বিরুদ্ধে ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানানো হয়। কৃষ্ণনগর শহরের ক্ষৌনিশ পার্কে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন স্বপন দাস, অমল তরফদার, প্রভাত সাহা প্রমুখ। কৃষিজমি ও গণতন্ত্র রক্ষার দাবিতে নবদ্বীপ ধাম স্টেশন থেকে তেঘরীপাড়া বাজার পর্যন্ত মিছিল করে এআইসিসিটিইউ নবদ্বীপ শাখা। অংশগ্রহণ করেন পরিক্ষিৎ পাল, তপন ভট্টাচার্য সহ অন্যান্যরা। চাকদা শহরেও অনুরূপ প্রতিবাদী কর্মসূচি সংগঠিত হয়। উপস্থিত ছিলেন লিটন কর্মকার, বিজয় সাহা, মল্লার মৈত্র।

মুর্শিদাবাদ

বহরমপুর শহরের কুঞ্জঘাটা বাজারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের উদ্যোগে এআইকেএসএসসি’র ডাকা দেশ জুড়ে “কৃষক বাঁচাও ও গণতন্ত্র বাঁচাও” দিবসের অংশ হিসেবে সকালে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হল। প্ল্যাকার্ড, ব্যানার সুসজ্জিত সভায় শ্লোগান তোলেন অপুর্ব লাহিড়ী। দাবি ছিল তিনটি কৃষক-বিরোধী ও জন-বিরোধী কৃষি আইন ও বিদ্যুত বিল-২০২০ বাতিল করতে হবে। সমস্ত মানুষকে অবিলম্বে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা করা বন্ধ কর। বক্তব্য রাখেন রাজীব রায়।

Spider Net_0

মানুষ হয়রান হচ্ছে ভ্যাকসিনের জন্য। কেন্দ্রের মর্জি-মাতব্বরিতে এক ধরনের ভ্যাকসিন প্রতারণা চলছে, রাজ্যের চাহিদার তীব্রতা ও ব্যাপক জনসংখ্যা অনুপাতে সরবরাহ মিলছে অত্যন্ত ঢিমেতালে এবং বহু কম পরিমাণে। তার ওপর আরেক ধরনের ভ্যাকসিন প্রতারণা হাতে-নাতে ধরা পড়ল, ঘটেছে একাধিক ভূয়ো ভ্যাকসিন শিবির থেকে কয়েকশো মানুষকে ভূয়ো ভ্যাকসিন দিয়ে দেওয়ার ঘটনা। নাটের গুরুটি নামেও ‘দেবাঞ্জন’, আর ওস্তাদী দেখানোর ক্ষমতাও রপ্ত করেছিলেন মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো! নিজেকে পরিচিত করাতেন কলকাতা কর্পোরেশনের এক ‘যুগ্ম কমিশনার’! হয়ে উঠেছিলেন হরেক লেনাদেনার কারবারী। সবই ভূয়ো নথি দেখিয়ে। বেসরকারি ব্যাঙ্কে আট-দশটা একাউন্ট খুলে ফেলেছেন, কামিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা, ‘ভ্যাকসিন চার্জ’ বাবদ শুধুমাত্র নয়, আরও অনেক রকমের কারসাজি করে। সেই টাকার কিছু ঢেলেছেন ‘দান-অনুদানে’, থুড়ি, বড় মাপের ধান্দা ফাঁদতে, আর বাকি টাকা সরিয়েছেন ভ্যানিশ করে। পুলিশ প্রতারক দেবা ও তার কিছু সাগরেদকে গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু আত্মসাৎ করা বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারের কোনও কিনারা এখনও করে উঠতে পারেনি। সবচেয়ে হাড়হিম ধরানো প্রশ্ন হল, কর্পোরেশন-পুলিশ-প্রশাসন ও শাসকদলের নেতা- মাথাদের নাকের ডগায় একটার পর একটা ভূয়ো শিবির করে ভূয়ো টিকা দেওয়ার ক্ষমতা গজিয়ে উঠল কিভাবে? ‘ভূয়ো’ ভায়াল থেকে দেওয়া হয়েছে এক রকমের অ্যান্টিবায়োটিক। যা শরীরে অহেতুক প্রবেশ করলে গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। হবে না এমন নিশ্চয়তা নেই, আশু না হোক বিলম্বে ক্ষতি হতে পারে। সেই অ্যান্টিবায়োটিক কেনা হয় সাজানো নথিপত্র দেখিয়ে, সইসাবুদ জালিয়াতি করে। অবশেষে ‘সেম সাইড’ হয়ে গিয়ে প্রতারণার প্রাথমিক পর্দা ফাঁস হল। এখনও সবটা প্রকাশ হয়নি। যে গুণধর এত সুপরিকল্পিত ও সুনিপুণভাবে এতদিন ধরে এত রকমের কারবার চালিয়ে এসেছেন, তিনি এমন কাঁচাভাবে ধরা পড়ে গেলেন কি করে! কারণ, ‘ভ্যাকসিন সাফল্যের সাথে দেওয়া হয়েছে’ ভূয়ো বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। তবু মরীয়া হয়েছিলেন উতরে যাওয়ায়। ভরসা ছিল শাসকদল-পুলিশ-প্রশাসনের কাছে তাঁর এযাবৎ নানা কিছু সরবরাহের বিনিময়ে বিজ্ঞাপনী ‘ভাবমূর্তি’ নির্মাণের ওপর, যা তৈরি হয়েছিল শাসন ব্যবস্থার প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়িয়ে।

এইখান থেকেই প্রশ্ন উঠেছে প্রতারণা কান্ডের অপর উৎস স্থল সম্পর্কে। সেই প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য উত্তরের দাবিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা চিল-চিৎকার করে উঠছেন ধৃত প্রতারককে ‘চিনি না, জানি না’! পরিষ্কার আঁত্কে ওঠার প্রতিক্রিয়া। যাবতীয় ফটোগ্রাফিক সঙ্গ-তথ্যকে স্রেফ ‘কতই না অচেনা মানুষের সাথে সেলফি তোলার আব্দার মেটাতে হয়’ বলে লঘু করে দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হচ্ছে! কিন্তু শুধু তো ফটোদোষ নয়, এক সমান্তরাল ভূয়ো প্রতিষ্ঠান ও তার পরিচালনার প্রশ্নাতীত ভাবমূর্তি তৈরির সমস্ত নকল সরঞ্জাম প্রতারকটি যোগাড় করে ফেললেন কি করে? কলকাতা কর্পোরেশনে কতজন কমিশনার পদের অফিসার আছেন যে মেয়র-ডেপুটি মেয়র ও তাদের পারিষদবর্গের পক্ষে এহেন জালি অফিসার চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি! মুখ্যমন্ত্রী এই প্রতারণার প্রসঙ্গ ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’, প্রতারকটি ‘টেররিস্ট’ প্রকৃতির, ‘কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত’, ‘পুলিশ-পুরসভার কেউ জড়িত থাকলে ছাড় পাবেন না’ বলেছেন। বিশেষ পুলিশী তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু দলের নাম জড়ানো নেতা ও ভারপ্রাপ্তদের ব্যাপারে উল্লেখ করে কোনও কথা বললেন না। উল্টে সেই ক্ষমতাবান নেতারা তদন্ত শুরুর আগেই যেভাবে দায়সারা গলাবাজি করে চলেছেন তাতে পুলিশী তদন্তের ওপর পক্ষপাতদুষ্টতার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিছু চুনোপুঁটি ধরেই তদন্তের জাল গুটিয়ে ফেলা হবে না তো? অথবা তদন্ত কেবল চলতেই থাকবে না তো? শঙ্কা থাকবে। কারণ, তৃণমূল আমলে ‘সারদা’র আর্থিক প্রতারণার কারবার বিশাল হয়ে ওঠার পেছনে আজও জড়িয়ে রয়েছে শাসকদলের গুচ্ছের নেতাদের নাম।

রাজ্যের সিআইডি-র সারদা তদন্তের দৌড়ও সবার বোঝা হয়ে গেছে। বিজেপির সিবিআই তদন্তের দাবি তোলার পেছনে উদ্দেশ্যই হল কেবল কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ ডেকে আন। সারদা জড়িত এক প্রাক্তন তৃণমূলী চাঁই এখন বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা বিজেপির। এক প্রতারণায় জড়িয়ে যাওয়া রাজনৈতিক নেতা ও তার আশ্রয়দাতা মদতদাতা দলের নৈতিক অধিকার থাকতে পারে না আরেকটি প্রতারণার তদন্ত প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করার। তাই উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির মাধ্যমে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিলে সেটাই হোত প্রশ্নাতীত নিরপেক্ষতার পরিচয়। আসলে নানান অপরাধের সাথে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরে সংশ্লিষ্ট পুলিশ-প্রশাসন ও শাসক নেতা-মন্ত্রীদের নাম জড়ানোর প্রবণতা খুবই বাড়ছে। তাই বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব বাড়ানোর দাবি জোরদার হচ্ছে। যদিও এপ্রশ্নে কোনও স্তরের আদালত গুরুতর ত্রুটিমুক্ত নয়। কর্পোরেট প্রভাব, শাসকের প্রভাব ও বিচারকের নৈতিক স্খলনের প্রভাবে বিচারের নামে অবিচার হয়। তবু ন্যায়বিচারের আশায় বিচার ব্যবস্থাই এখনও মূল ভরসা। তবে আদালতী ব্যবস্থার যে অপ্রতুলতা ক্রমশ বাড়ছে, মামলার পাহাড় জমছে, তাতে জনস্বার্থ জড়িত তদন্ত ও বিচারের বিষয়গুলিতে বিকল্প তদন্ত ও বিচারের পদক্ষেপ করাই শ্রেয়। রাজ্য সরকারের ওপর এই চাপ তোলা প্রয়োজন।

BJP's Bengali division

নির্বাচনের পরে বাংলা ভাগের একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। একটা কেন, বলা উচিত কয়েকটা। উত্তর থেকে আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বার্লা আওয়াজ তুলেছেন উত্তরবঙ্গকে আলাদা করতে হবে। বিষ্ণুপুর থেকে পদ্মফুলের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ ডাক তুলেছেন আলাদা রাঢ়বঙ্গ গঠনের। কেউ নাম দিচ্ছেন জঙ্গলমহল। এগুলো আলাদা রাজ্য হবে নাকি কেন্দ্রশাসিত এলাকা হবে, ঠিক কোন কোন এলাকা নিয়ে হবে, এসব এখনও অস্পষ্ট। যেটা স্পষ্ট সেটা হলো বিজেপি বাংলাকে ভাগ করতে চায়। দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপবাবু অবশ্য বলছেন, এটা দলের অ্যাজেন্ডা নয়। কিছু সাংসদ ও নেতার ‘ব্যক্তিগত মত’।

দলের অ্যাজেন্ডা নয়, অথচ দলের নেতারা এই দাবিগুলো নিয়ে বাজার গরম করছেন আর দল কিছু বলছে না, এই রাজনীতিটা মানুষ বোঝে। এর মানে হচ্ছে এই প্রশ্নগুলো বাজারে ছেড়ে দেওয়া, দেখা যাক এর কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, আর এই দাবিগুলো নিয়ে রাজ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করা, সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করা। পদ্ধতি যাই হোক, যেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তা হল এই বুদ্ধিটা এসেছে নির্বাচনের পরে। এই দাবিগুলো যদি বিজেপির কাছে সত্যি আশু জরুরি দাবি হত তাহলে দলের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে তা স্থান পেত। এই দাবিগুলো তুলেই বিজেপি ভোট চাইত। তা মোটেই হয়নি। নির্বাচনে বিজেপি জিতে গেলে এই দাবিগুলো যে এখন মোটেও উঠত না সেটাও বোঝা কঠিন নয়।

নতুন নতুন রাজ্য গঠনের দাবি বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি কিন্তু আমাদের দেশে বা রাজ্যে নতুন নয়। দাবিগুলোর পেছনে যে কোন ভিত্তি নেই তাও নয়। গোর্খাল্যান্ডের দাবি দীর্ঘদিনের। সেখানে সবার আগে আছে নেপালী ভাষার প্রশ্ন। কামতাপুরী ভাষা বা রাজবংশী সামাজিক পরিচিতির ভিত্তিতে রাজ্য বা স্বায়ত্তশাসনের দাবিও বিগত দু’তিন দশক ধরে উঠে আসছে। গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে রয়েছে আঞ্চলিক বৈষম্যের অভিযোগ। বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার আদিবাসী জনগণের কাছে ভাষা সংস্কৃতি ছাড়াও রয়েছে উন্নয়নের ক্ষেত্রে উপেক্ষা ও বঞ্চনার প্রশ্ন। কিন্তু এই মুহূর্তে বিজেপির এই দাবির পেছনে রয়েছে নির্বাচনের ফলাফল। এই অঞ্চলে নিজের সাফল্যকে সংহত করতেই বিজেপির এই নির্বাচনোত্তর রণকৌশল।

এই সব প্রশ্ন শুধু পশ্চিমবঙ্গে নেই, গোটা দেশ জুড়েই রয়েছে। সুষম উন্নয়ন ও এত বড় দেশের বিবিধতা ও বৈচিত্র্যের পূর্ণ সম্মান ও সমন্বয়ের জন্য নতুন রাজ্য গঠন ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে তাই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় একটি রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন এই ব্যাপারে ব্যাপক অধ্যয়ন ও মতামত সংগ্রহের ভিত্তিতে কোনো প্রস্তাব অবশ্যই দিতে পারে। কিন্তু বিজেপি এই আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন থেকে উঠে আসা দাবিগুলো নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতির খেলা খেলছে। ওদের কাছে মূল লক্ষ্য হল কেন্দ্রের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত এলাকাগুলোকে কেন্দ্রের উপনিবেশ বানিয়ে দেওয়া।

দু’বছর আগে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সাংবিধানিক অধিকার হরণের মাধ্যমে আমরা এই ক্ষমতা কেন্দ্রিকরণের আগ্রাসী রূপ দেখতে পাই। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে রাতারাতি একটা রাজ্যকে দুটো কেন্দ্রশাসিত এলাকা বানিয়ে দেওয়া হল। দিল্লীতে নির্বাচিত সরকার থাকলেও রাজ্যের অধিকার ছেঁটে দিয়ে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে সব ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। পুদুচেরিতে গভর্নরের হস্তক্ষেপ বাড়াতে বাড়াতে সেখানে এখন বিজেপি সরকার চলে এসেছে। আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য লাক্ষাদ্বীপ। উত্তরপ্রদেশেও নির্বাচনের আগে রাজ্য ভাগের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। গোটা দেশটাকে ছোট ছোট রাজ্য ও বেশ কিছু কেন্দ্রশাসিত এলাকায় ভাগ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বদলে স্থায়ী কেন্দ্রীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিশাসিত প্রণালী প্রবর্তন বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা।

বাংলার মাটিতে অবশ্যই ক্ষমতার আরও বেশি বিকেন্দ্রীকরণ চাই। উন্নয়নের প্রশ্নে আঞ্চলিক বৈষম্যের অবসান চাই। বাংলার পাশাপাশি নেপালী, সাঁওতালি ও অন্যান্য ভাষা ও সংস্কৃতির পর্যাপ্ত সংবর্ধন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা চাই। বাংলার মাটিতে বন অধিকার আইন ও পঞ্চম তফসিল প্রয়োগের সম্ভাব্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। দ্বিতীয় রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করে দেশের অন্যান্য রাজ্যের সাথে পশ্চিমবঙ্গেও প্রয়োজনীয় পুনর্গঠনের প্রয়োজন ও সম্ভাবনা নিয়েও কথা হতেই পারে। কিন্তু বিজেপির বাংলা ভাগের দুরভিসন্ধিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আর শুধু বাংলা ভাগের চক্রান্ত নয়, ব্যর্থ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংসদীয় প্রণালীকে বদলে ফেলার যাবতীয় চক্রান্ত।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য  

AISA came to the streets of Kolkata

“বড়ো লোকে গাড়ি চড়ে
গরিব লোকে হেঁটে মরে
এই অবিচার আর না !”

অবিলম্বে কোভিড বিধি মেনে সমস্ত গণপরিবহন চালু করার দাবিতে ২৫ জুন আইসা’র কলকাতা জেলা কমিটির ডাকে প্রতিবাদ দিবসে বেহালা জোনাল কমিটির উদ্যোগে বেহালা ট্রাম ডিপোতে, উত্তর কলকাতা জোনালের উদ্যোগে মৌলালীতে ও যাদবপুর ইউনিভার্সিটি ইউনিটের উদ্যোগে যাদবপুর স্টেশনে কর্মসূচি পালন করা হল। এর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন প্রান্তের সদস্যরা অনলাইন প্রতিবাদও জানায়। খেটে খাওয়া মানুষের যাতায়াতের ও কাজের সুবিধার্থে, কোভিড বিধি মেনে অবিলম্বে গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দাবি তোলা হয়,

(১) অবিলম্বে কোভিড বিধি মেনে গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে,

(২) লোকাল ট্রেন, মেট্রো, বাস, অটো, টোটো সহ সমস্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে,

(৩) সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে অবিলম্বে লোকাল ট্রেন চালু করতে হবে।

Protests in Nadia against price hike

লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ, যে নামেই বলা হোক না কেন, মেহনতি মানুষ আজ বড় অসহায়। কাজ নেই, হাতে পয়সা নেই, ওদিকে প্রতিটি জিনিসের দাম আগুন! বিগত একবছরে লকডাইনের সময়কালে পেট্রোলের দাম বেড়েছে ২৮ টাকা, ডিজেল ২৬ টাকা! ফলে মূল্যবৃদ্ধি কোমরভাঙা। এর বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ দিবসের অঙ্গ হিসাবে গত ২২ জুন নদীয়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় মিছিল ও সভা করা হয়। রেল সহ বিভিন্ন গণপরিবহন চালু করা, গরিবদেরকে ঘরে ঘরে রেশন পৌছে দেওয়ার দাবি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পক্ষ থেকে নবদ্বীপের রাধাবাজারে প্রতিবাদসভা পথ চলতি ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বক্তব্য রাখেন জেলা কমিটি সদস্য পরিক্ষিৎ পাল, স্থানীয় সংগঠক তপন ভট্টাচার্য, দেবাশীষ সিংহ প্রমুখ। চাকদা শহরের বাজার এলাকায় হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে শ্লোগান সহকারে প্রতিবাদী কর্মসূচি হয়। এই এলাকায় মাইক্রোফিনান্স কোম্পানির ঋণগ্রস্ত গরিব মহিলাদের উপর জুলুমবাজির বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনের দাবিগুলিও সামনে উঠে আসে। উপস্থিত ছিলেন জেলা কমিটির সদস্য বিজয় সাহা, লিটন কর্মকার, মল্লার মৈত্র প্রমুখ।

ধুবুলিয়া বাজারে মিছিল ও প্রচারসভা সংগঠিত হয়। পার্টির দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে এক দৃপ্ত মিছিল গোটা বাজার এলাকা পরিক্রমা করে, যা ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শ্লোগান ওঠে, পেট্রোল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি কার স্বার্থে, আম্বানিদের দালাল মোদী সরকার জবাব দাও, সকল মানুষকে করোনা টিকাকরণের সময় বেঁধে দিতে হবে, কোভিড চিকিৎসার সমস্ত উপকরণের উপর থেকে জিএসটি প্রত্যাহার করতে হবে, চাষিদের দুয়ারে দুয়ারে সরকারি দরে ধান কেনা, ১০০ দিনের কাজ চালু করা, চাষিদের ভর্তুকি দিয়ে সার ডিজেল সরবরাহের দাবি তুলে ধরা হয়। পরিশেষে, নেতাজী পার্কে নেতৃবৃন্দ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন পার্টির জেলা সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, জেলা কমিটি সদস্য সন্তু ভট্টাচার্য, বেলা দে, এলাকা সম্পাদক শংকর রায়, স্থানীয় নেতা বাবুলাল দাস, বাবর আলি সেখ, যুব সংগঠক অমিত মন্ডল প্রমুখ। নাকাশীপাড়া ব্লকের গাছা বাজারে মিছিল করে প্রচার করা হয়, বাসস্ট্যান্ডে বক্তব্য রাখা হয়। বক্তব্য রাখেন কৃষ্ণপদ প্রামানিক ও কাজল দত্তগুপ্ত।

এই প্রচার কর্মসূচিগুলিতে নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, লকডাউনে গরিব মানুষের সংকটের বিপরীতে দেখা যাচ্ছে বিদেশী সুইস ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ভারতীয় ধনকুবেরদের সঞ্চিত অর্থ গত ১৩ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বিগত এক বছরে জমার অঙ্ক বেড়েছে ২৮৬%। ব্যাক্তিগতভাবে জমা দেওয়া টাকার অংক বেড়েছে ৩৯%। অর্থাৎ একদিকে ধনীরা মুনাফার পাহাড় গড়ছে, আর সাধারণ জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংকটের বোঝা। কৃষিকাজ খুবই সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। অসম্ভব শ্রমে ঘামে কোনোক্রমে দিন গুজরান করে চলেছে আমাদের অন্নদাতা চাষিরা। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে শ্রমজীবীদের কোনো কাজ নেই। কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্পের বড় বড় সরকারি ঘোষণা শূন্যগর্ভ। কাগজে কলমে চুরি হয়ে যাচ্ছে মজুরের প্রাপ্য টাকা। লকডাউনের নীরবতা ভেঙে সজোরে আওয়াজ তুলে ধরতে হবে।

Programs in Kamarhati

কামারহাটিতে ২৫ জুন আগরপাড়া জুট মিলের নতুন কোয়ার্টার লাইনে বিসিএমএফ-এর নেতৃত্বে শ্রমিকদের বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। বিষয় ছিল, চার শ্রমকোড বাতিল করতে হবে, কাঁচা পাটের অভাবে বন্ধ এবং করোনা কারণে আধা খোলা মিলে শ্রমিকদের লে-অফ দিতে হবে, প্রতিটি মিলে শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে দ্রুত কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন দিতে হবে। বক্তব্য রাখেন মাজাহার খান, শিবগুহরায় এবং নবেন্দু দাশগুপ্ত।

বেলঘরিয়ায় ২৬ জুন দেশপ্রিয়নগরে দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কৃষক বাঁচাও দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও দাবিতে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি পালন করা হয়। বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান চলে।

Hull Day in the tribal village

নাকাশিপাড়া ব্লকে আদিবাসী গ্রাম মীরাইপুরে হুল দিবস পালন করা হয় ৩০ জুন। গ্রামের স্কুল মাঠের কাছে বটতলায় লাল পতাকা টাঙিয়ে, সিধু, কানুর ছবি দিয়ে, মাইক খাটিয়ে সভার আয়োজন করা হয়। পাশের আদিবাসী গ্রাম লোহাগাছার মহিলা কমরেডরা সহ আদিবাসী নয় এমন গ্রামের কমরেডরা সভায় উপস্থিত হন। বক্তারা গ্রামের আদিবাসী জনগণকে সাঁওতাল বিদ্রোহের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। জমিদার, সুদখোর, ব্যবসাদার, মহাজনদের চরম শোষণের বিরুদ্ধে, পুলিশ ও সরকারি কর্মচারীদের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। অবশেষে এই লড়াই ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে পরিণত হয়। বীরত্বপূর্ণ এই লড়াইয়ে আদিবাসী মানুষের জীবন দান থেকে শিক্ষা নিতে হবে কিভাবে সংগঠিত হয়ে দেশীয় শোষকের বিরুদ্ধে, বিদেশি শোষক শাসকের বিরুদ্ধে লড়তে হয়। স্বাধীন ভারতের সংবিধানে রক্ষিত আদিবাসীদের অধিকারগুলো বর্তমান শাসক মোদি সরকার বড় বড় পুঁজিপতিদের স্বার্থে একের পর এক কেড়ে নিচ্ছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে ইউএপি নামক আইনে জেলে আটকে রাখা হচ্ছে। তবুও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলছে।

ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আদিবাসী গ্রামগুলিতে বেশিরভাগ মানুষ কৃষি মজুর। ১০০ দিনের কাজ হয় না বলেই চলে। মহামারীর এই সময়ে আদিবাসী কৃষি মজুরদের অবস্থা আরো খারাপ। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি ক্রমাগত আদিবাসী সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিজেপি-আরএসএস এব্যাপারে সক্রিয়। এখনো প্রচুর জমি আছে যা আদিবাসীদের নামে থাকলেও তাদের দখলে নেই। একসময় পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সমিতি সংগঠিত হয়ে এই জমি দখল করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। আগামীদিনে আবার সেই আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এমএল) জেলা কমিটির সম্পাদক জয়তু দেশমুখ, কৃষ্ণপদ প্রামানিক, কাজল দত্ত গুপ্ত। গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান বিকাশ বিশ্বাস।

Remembering comrades

কমরেড রামযতন শর্মা ও কমরেড অরবিন্দ সিং-এর মৃত্যুতে আমরা হারিয়েছি আমাদের চমৎকার দুই কমরেডকে যাদের কমিউনিস্ট হিসাবে যাত্রা শুরু হয়েছিল তুমুল আলোড়ন জাগানো সত্তরের দশকে। কমরেড রামযতন শর্মা ছোট ভাই কমরেড সুরেশের (সিদ্ধেশ্বর শর্মা) শহীদের মৃত্যু বরণের পর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সরকারি চাকরি ছেড়ে সর্বক্ষণের সংগঠক হিসাবে আন্দোলনে যোগ দেন। কমরেড সুরেশ কলেজে পড়ার সময় সিপিআই(এমএল)-এ যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের ৪ মে ভাগলপুর জেলভাঙার অভিযানে শহীদ হন। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কমরেড অরবিন্দ সিং জরুরি অবস্থার সময় সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে যুক্ত হন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েও আমৃত্যু তিনি ছিলেন এক একনিষ্ঠ পার্টি কর্মী।

সত্তরের দশকের শুরুতে প্রাথমিক ধাক্কার পর, দশকের শেষের দিকে বিহারের মাটিতেই সিপিআই(এমএল) নতুন করে উঠে দাঁড়ায়। কমরেড জহরের (সুব্রত দত্ত) নেতৃত্বে কমরেড চারু মজুমদারের শহীদের মৃত্যু বরণের দ্বিতীয় বার্ষিকীতে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হয়। ১৯৭৫’র ২৯ নভেম্বর ভোজপুরের এক গ্রামে কমরেড জহর ভারতীয় রাষ্ট্রশক্তির সামরিক নৃশংসতার বলি হওয়ার পরও পার্টি ভেঙে যায়নি, কমরেড বিনোদ মিশ্রের নেতৃত্বে গয়ায় দ্বিতীয় কংগ্রেস করার পথে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যায়। রাষ্ট্র যদি ভেবে থাকে তার নিপীড়নই শেষ কথা, বিপ্লবী আন্দোলনেরও জানা ছিল কীভাবে এক দৃষ্টান্তমূলক কৌশলী অধ্যবসায়ে তাকে অতিক্রম করতে হয়।

১৯৭০’র শেষার্ধ সিপিআই(এমএল)-এর ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামের এক ইতিহাস হয়ে আছে। পাটনা হয়ে উঠেছিল ১৯৭৪ সালের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু, যে আন্দোলন নকশালবাড়ির বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের পর, যুক্তিগ্রাহ্যভাবেই হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতা-উত্তর দ্বিতীয় বৃহত্তম যুব জাগরণ। যখন পাটনার রাজপথে যুব আন্দোলন ফুঁসছে, তখন নিপীড়িত গ্রামীণ জনতার বিদ্রোহ পাটনার গ্রামাঞ্চলে আর সংলগ্ন জেলা শাহবাদ ও মগধে ছড়িয়ে পড়ছে। দুই আন্দোলন অনিবার্যভাবেই পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছিল। জরুরি অবস্থার জমানায় জেলগুলো হয়ে উঠেছিল বৈঠকের চমৎকার জায়গা। আর ১৯৭৭-এ কংগ্রেস উৎখাতের বিরাট স্বস্তি ও ক্ষণস্থায়ী জনতা পার্টির প্রতি মোহমুক্তি এই কথাবার্তার সঠিক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিল।

সিপিআই(এমএল) এই পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির নীরব দর্শক ছিল না। ১৯৭৪’র আন্দোলন এবং ১৯৭৭’র নির্বাচনী অভ্যুত্থান থেকে বিপুল অনুপ্রেরণা নিয়ে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে পার্টি নিজের শক্তি বাড়িয়েছিল। পার্টির কৌশলগত পন্থা, গণকার্যকলাপ, গণসংগ্রাম এবং গণসংগঠনের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন পার্টির ভাবনায়, মতাদর্শগত উপলব্ধিতে ও অনুশীলনে এক নতুন গতি ও প্রাণশক্তি ভীষণভাবে দাবি করছিল। ১৯৭৯এ সংগঠনের বিশেষ সম্মেলনের পর, পার্টির গণমুখী প্রচার ও প্রসার নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ পথে বাড়তে শুরু করে এবং চিন্তার সৃজনশীল মন্থন, নতুন নতুন উদ্যোগের বিকাশ, প্রাত্যহিক কাজকর্মের সুসংবদ্ধতা এবং সাংগঠনিক জীবনের নিয়মানুগ হয়ে ওঠার মাঝে পার্টিও এক ক্রমবর্ধমান সর্বভারতীয় চরিত্র অর্জনের পথে এগিয়ে যায়।

কমরেড রামযতনজী এবং কমরেড অরবিন্দজী আপন আপন স্বকীয়তায়, ১৯৭৯ পরবর্তী পর্যায়ে সিপিআই(এমএল)-এর এই আলোড়ন ও বিস্তারের পর্বের আদর্শ প্রতিনিধি ও সংগঠক হয়ে ওঠেন। রামযতনজী, পাটনার কমরেডদের কাছে যিনি আলোকজী নামেই পরিচিত ছিলেন, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে থেকে কমরেডদের নিয়ে তাদের বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। আর অরবিন্দজী, কোর-টিম যা জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনমত’ প্রকাশ করত তার সদস্য হিসেবে, হিন্দি প্রকাশনার ক্ষেত্রে পার্টির প্রবেশকে সম্ভব করেছিলেন নিশ্চিত স্থির প্রত্যয়ে, গভীর অধ্যবসায়ে। আলোকজী হয়ে উঠেছিলেন ভার্মাজী এবং উত্তর প্রদেশের পার্টি সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি যথাক্রমে ছত্তিশগড় ও ঝাড়খণ্ডের দায়িত্ব সামলে আবার ফিরে আসেন বিহারে। প্রথমে রাজ্য সম্পাদক হিসেবে ও পরে মগধ অঞ্চলের ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রামযতনজী পার্টির কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ছিলেন। আর ২০১৮-তে কমরেড অরবিন্দজীও পার্টির এই শীর্ষ শৃঙ্খলারক্ষা সংস্থার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

কমরেড রামযতন শর্মা তরুণ কমরেডদের সামিল করে মার্কসবাদী চিন্তাধারাকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং মার্কসীয় পাঠচক্র পরিচালনার ব্যাপারে দারুণ আগ্রহী ছিলেন। পার্টির ধারাবাহিক গণবিস্তারকে ধরে রাখা ও সুসংহত করার জন্য চাই পার্টি ক্যাডারদের মতাদর্শগতভাবে অনুপ্রাণিত ও সুসজ্জিত বাহিনী। আর রামযতনজী সদাসতর্ক তীক্ষ্ম মনোযোগে রেখেছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রায়শ উপেক্ষিত এই বিষয়টিকে। একাধিক প্রজন্মের অনেক পার্টি ক্যাডার যাদের মধ্যে নেত্রীরাও আছেন, কমরেড রামযতনজীকে শ্রদ্ধাভরে মনে রেখেছেন ক্যাডারদের গড়ে তোলা ও পার্টি শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর তন্নিষ্ঠ মনোযোগের জন্য। ইদানিং এই অতিমারী আবহে যখন যোগাযোগ ও বৈঠকের স্বাভাবিক ধরনগুলি ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে, তিনি মার্কসবাদী শিক্ষা ও প্রেরণা ছড়িয়ে দেওয়া অব্যাহত রাখতে দারুণ আগ্রহে ডিজিট্যাল প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করছিলেন।

আন্দোলনে পোড়খাওয়া এই সংগ্রামী নেতাদের বিদায় জানানোর মুহূর্তে, কমিউনিস্ট সংগঠক হিসাবে তাঁদের আদর্শ গুণগুলি তাঁদের ক্লান্তিহীন কর্মোৎসাহ, জনগণের প্রতি আশা ও ভরসা এবং বিপ্লবী কমিউনিস্ট ব্রতের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা আমাদের নিজেদের জীবনেও অবশ্যই আয়ত্ত ও আত্মস্থ করার অঙ্গীকার নিতে হবে।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য  

About Farmer Friend Project_0

কৃষক বন্ধু প্রকল্পে পাঁচ হাজার টাকা বাড়ানো হল, কিন্তু চাষিদের সংকট বা লোকসান আদৌ কমল না।

ভাগচাষি ও কৃষি শ্রমিকদের প্রতি থাকছে সীমাহীন বঞ্চনা ও প্রতারণা।

রাজ্যের তৃণমূল সরকার ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে চাষিদের বছরে পাঁচ হাজারের বদলে দশ হাজার টাকার সাহায্য ঘোষণা করেছে। এক একরের ঊর্ধ্বে জমি থাকলে দশ হাজার, আর তার নীচে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রায় ৮০ ভাগ ক্ষুদ্র চাষিরা পাবেন মাত্র চার হাজার টাকা বা তার সামান্য বেশি! এই যৎসামান্য সহায়তার মধ্য দিয়ে সরকার আসলে স্বীকার করে নিল এরাজ্যের চাষিদের ব্যাপক লোকসান চলছে, চাষিরা মোটেই ভালো নেই। চাষিদের আয় ‘তিনগুন’ হয়ে গেছে – এই সরকারি প্রচারের আদৌ কোনো বাস্তবতা নেই। এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে চাষিদের সংকট আদৌ কমল না, উল্টে বছরের পর বছর চাষিরা ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেন, সেখান থেকে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হল। যেমন বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে এক কুইন্টাল ধান বিক্রি হচ্ছে ১,১০০ থেকে ১,২০০ টাকায়, অথচ সরকারি দর ১,৮৬৫ টাকা, আগামী মরশুম থেকে আরও ৭০ টাকা বাড়ছে। অর্থাৎ চাষিদের লোকসান কুইন্টাল পিছু ৬৫০ টাকারও বেশি। বিপরীতে সার, বীজ, বিদ্যুতের দাম অর্থাৎ চাষের খরচের বিপুল বৃদ্ধি হয়ে চলেছে। তাহলে চাষিদের আয় বাড়ছে কোথায়? দেশব্যাপী চাষিদের যে দাবি আজ সর্বস্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে তা হল উৎপাদিত ফসল উৎপাদন খরচের দেড়গুণ দামে কিনতে হবে। কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার সেই গ্যারান্টি করার আইন বা বিধি তৈরি করছে না কেন? রাজ্য সরকারের অর্থসাহায্যের টাকা বাস্তবে যারা পাবেন তাদের বড় অংশই অ-কৃষক জমির মালিক।

মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন বর্গাদার অথবা ভাগচাষি এমনকি যারা নথীভুক্ত নয়, তারাও নাকি এই সহায়তা পাবেন। যে সব ভাগচাষিদের জমির কাগজপত্র নেই তাঁরা একটা হলফনামা দিলেই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন –  সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী একথা বলেছেন। বাস্তবে ‘কাগজহীন’ কৃষকদের কাছে প্রকল্পটি সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। সরকারি নির্দেশিকার প্রথমেই বলা হয়েছে, আরওআর (রাইটস অফ রেকর্ডস) / পরচা সংগ্রহে অসুবিধা হয় বলে কৃষকদের স্বঘোষিত হলফনামা গ্রাহ্য হবে। অর্থাৎ জমির মালিকানা অথবা দখলিসত্ব থাকতেই হবে। স্বেচ্ছাপ্রদত্ত নথি যাচাই করে ব্লকের ভূমি আধিকারিকরা ব্যবস্থা নেবে। যার জমিই (বা দখলিসত্ব) নেই তার তদন্ত রিপোর্ট তো নেতিবাচক হবেই। সরকারি আদেশনামার এক জায়গায় পরিষ্কার লেখা রয়েছে, “যারা এখনও নথিভুক্ত হননি ... তারা জমির মালিকানা বা দখলনামার তথ্য দিয়ে আবেদন করতে পারবেন।” সুতরাং কাগজহীন ঠিকা বা চুক্তি চাষিরা এই প্রকল্প থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন, দরখাস্ত ফর্মে লেখা রয়েছে ‘স্বঘোষণা পত্র সহ নথি’। নথি বলতে সেইতো মালিকানা বা দখলনামার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া জমির দাগ নং সহ অন্যান্য তথ্য অনথীভূক্ত ভাগচাষিরা পাবে কোথায়? জমির মালিকরা বিনাস্বার্থে কি তা দেবে? বর্গা হয়ে যেতে পারে এই আশংকা থেকে মালিকরা কি চাইবে যে ভাগচাষিরা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করুক! একমাত্র সরকার যদি সরেজমিন তদন্ত করে এদের তালিকা তৈরি করে কেবল তাহলেই অনথিভূক্ত ভাগচাষিরা যোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারবে। তাই অবিলম্বে সরকারকে অনথীভূক্ত ভাগচাষি-চুক্তিচাষিদের তালিকা তৈরি করতে হবে, এদের সরকারি সমস্ত প্রকল্পের সুবিধা দিতে হবে।

ওদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে (সি+ ৫০%) কারচুপি করছে। চাষিদের সম্পদ লুঠ হয়ে চলেছে। যথা ধানের কুইন্টাল পিছু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য হওয়া উচিত ২,৩৫০ টাকা, অথচ কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে ১,৮৬৫ টাকা! এদিকে রাজ্য সরকার ফসল কেনার কোনো পরিকাঠামো গড়ে না তুলে চাষিদের ঠেলে দিচ্ছে অভাবী বিক্রির পথে। ফলে চাষিরা বিপুল লোকসানে ব্যবসায়ীদের কাছে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আওয়াজ উঠেছে যৎসামান্য দান খয়রাতি নয়, ফসলের প্রকৃত সংগ্রহ মূল্য গ্যারান্টি কর, কম দামে ভর্তুকি দিয়ে সার-বীজ-বিদ্যুৎ সরবরাহ কর। ধান কেনার জন্য টাকা বরাদ্দ কর, গ্রামে দুয়ারে দুয়ারে ধান কেনার ব্যবস্থা কর। দিল্লীর চলমান কৃষক আন্দোলনে এটা অন্যতম প্রধান দাবি। এরাজ্যেও সেই দাবি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

সর্বোপরি গ্রামের কৃষি ও অন্যান্য মজুররা কোনোরকম সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন না। এই লকডাউনের কর্মহীন পরিস্থিতিতে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প বন্ধ। সমস্ত জবকার্ডধারী গ্রামীণ মজুরদের ৫০ দিনের মজুরি নগদে দিতে হবে। জবকার্ডধারীরা বা গ্রামীণ শ্রমিকরা “৫০ দিন কাজ করেছেন” ধরে নিয়ে সেই মজুরি লকডাউন পরিস্থিতিতে আশু ত্রাণ হিসেবে দিতে হবে। এই মর্মে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠাবে সারা ভারত কিষাণ মহাসভা।

- জয়তু দেশমুখ 

Democracy-will-not-come-to-Kashmir

২০১৯ সালের ৫ আগস্ট জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল ও তার রাজ্য মর্যাদা হরণের প্রায় দু’বছর পর নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহদের মনে হল, সেখানকার রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসানে কিছু উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তাঁরা জম্মু ও কাশ্মীরের আটটা দলের ১৪ জন নেতা-নেত্রীকে দিল্লীতে ডেকে বৈঠক করলেন, নিজেদের ‌কিছু প্রস্তাব রাখলেন, আহূত নেতাদের মনের কথা জানাতে দিলেন এবং তাঁদের কথা শুনলেন। বৈঠকের পর এর লক্ষ্য সম্পর্কে টুইট করে নরেন্দ্র মোদী জানালেন, “জম্মু-কাশ্মীরে তৃণমূলস্তরে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করাই সরকারের লক্ষ্য”। তিনি আরও শুনিয়েছেন “দিল্লী কি দূরী আউর দিল কি দূরী”, অর্থাৎ, কাশ্মীরের সঙ্গে দিল্লীর হৃদয়ের দূরত্ব ঘোচানোর বচন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যা বলছেন তারমধ্যে কি চূড়ান্ত পরিহাস নিহিত নেই? কাশ্মীরের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে সেনাদের বন্দুকের ডগায় ও বুটের তলায় পিষে দিতে যাঁরা চূড়ান্ত সক্রিয়তা দেখিয়েছেন, আজ তাঁদের মুখে কাশ্মীরে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার কথা শুনলে তা কতটা আন্তরিক মনে হতে পারে? তবে কি নরেন্দ্র মোদীদের হৃদয়ে কোনো রূপান্তরণ ঘটেছে? নাগপুরের পাঠশালায় মতাদর্শের পাঠ নেওয়া নেতাদের পক্ষে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের জনগণের জন্য সহমর্মিতাবোধ কতটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? প্রশ্নটা অতএব গিয়ে দাঁড়াচ্ছে নরেন্দ্র মোদীদের গণতান্ত্রিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। আর তাই একটু পিছন ফিরে তাকানো যাক। ৩৭০ ধারা বিলোপ ও রাজ্যের মর্যাদা হরণের নরেন্দ্র মোদীদের পদক্ষেপ কাশ্মীরের জনগণের জন্য কোন গণতান্ত্রিক পরিণতি নিয়ে এসেছিল তা বিচার করা যাক।

কাশ্মীরের সমস্যা মূলগতভাবে যে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বঞ্চনা, ভারতীয় শাসকরা কোনোদিনই তা স্বীকার করতে চাননি। শাসকদের কাশ্মীর নীতিতে পাকিস্তান প্রসঙ্গ নির্ধারক গুরুত্ব অর্জন করায় প্রকৃতই এক রাজনৈতিক প্রশ্নের সামরিক সমাধান করতে চাওয়া হল। ফলে, জম্মু ও কাশ্মীর হয়ে উঠল সামরিক বাহিনীর পীড়ন ভোগ করা পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন অঞ্চলগুলোর অন্যতম। দু’বছর আগে ৩৭০ ধারা বিলোপ ও রাজ্য মর্যাদা হরণের আগে প্রতিবাদ দমনের লক্ষ্যে কাশ্মীরে পাঠানো হল আরও ৩৮,০০০ সেনা। কাশ্মীরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির বাইরেই আধা সেনারা টহল দিতে থাকল। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতাদের গৃহবন্দী করা হল, আরও শত-শত রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীদের জেলে পোরা হল। কাশ্মীরের বাইরের বিরোধী নেতাদের কাশ্মীরে ঢুকতে দেওয়া হলনা। ৩৭০ ধারা জম্মু ও কাশ্মীকে তার নিজস্ব যে সংবিধান দিয়েছিল, তাকে মুলতুবি করা হল।

কাশ্মীরে নামে ১৪৪ ধারা জারির কথা বলা হলেও কার্যত তা কারফিউ কায়েমেই পর্যবসিত হল। চলাচল সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যে রাস্তাগুলোকে কাঁটাতার বিছিয়ে অবরুদ্ধ করা হল। দোকানপাট, স্কুল-কলেজ, সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক -- সমস্ত প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেল। বহু শতাব্দী ধরে চলা কাশ্মীরের সুপ্রসিদ্ধ কুটিরশিল্প ক্রেতার অভাবে ধুঁকতে থাকল। রপ্তানি ব্যাপক বাধার মধ্যে পড়ায় কয়েক হাজার কোটি টাকার আপেল ব্যাবসা চরম ক্ষতির মুখোমুখি হল। কাশ্মীরের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলে জনগণের রুটি-রুজিকে সংকটাপন্ন করে তোলা হল।

মোবাইল, ল্যান্ডফোন, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ায় সংযোগ, পারস্পরিক বার্তা বিনিময় থেকে কাশ্মীরী জনগণ মাসের পর মাস বঞ্চিত রইলেন যা তাঁদের বিচ্ছিন্নতাকে প্রকটতর করল। টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ রইল। জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরিক অধিকার সংগঠন ‘দ্য জম্মু কাশ্মীর কোয়ালিশন অব সিভিল সোসাইটি’র ওপর হানাদারি চালালো এনআইএ, উদ্দেশ্য কাশ্মীরে দমন-পীড়ন নিয়ে তারা যেন বেশি সক্রিয়তা না দেখায়। হামলা হল সংবাদপত্রর অফিসে। কাশ্মীরের জন্য বানানো হল নতুন মিডিয়ানীতি যাতে প্রশাসনকে, অর্থাৎ, সরকারি আমলাদের ক্ষমতা দেওয়া হল --  তাঁরা সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরগুলো পড়ে বিচার করবেন সেগুলোর মধ্যে ‘ভুয়ো’, ‘অন্যের লেখা থেকে চুরি করে ছাপানো’, ‘অনৈতিক’ এবং ‘দেশদ্রোহমূলক’ সংবাদ আছে কি না। এবং আমলাদের বিচারে যদি সেরকম কিছু থাকে তবে তা প্রকাশের জন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে “আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার” বিধান জারি হল। সাংবাদিকদের জেলে পোরা হল, তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ’র মতো দানবীয় আইনের প্রয়োগ হল। কাজেই, প্রশাসন যেমনটা চায় সেরকম লাইন অনুসরণের হুঁশিয়ারি সংবাদ জগতকে দেওয়া হল, যার প্রকৃত অর্থ গিয়ে দাঁড়াল এক অঘোষিত সেন্সরসিপে, সংবাদপত্র যেন কাশ্মীরের প্রশাসন-বিরোধী কোনো সংবাদ প্রকাশ না করে।

নরেন্দ্র মোদীদের কথায় যা ছিল ‘সম্পূর্ণ সংহতি’র উদ্যোগ, তা এইভাবে কাশ্মীরী জনগণের পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতায় পরিণতি লাভ করল। কাশ্মীরী জনগণের কাছে কাশ্মীর সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এক বড় কারাগার বলে মনে হল। জনৈক নাগরিকের মন্তব্যে ফুটে উঠল সাধারণ কাশ্মীরবাসীর এই মনোভাব – “সরকার আমাদের, কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে ক্রীতদাসের মতোই আচরণ করেছে, আমরা যখন বন্দী তখন আমাদের জীবন এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়েছে”। জয়প্রকাশ নারায়ণ ১৯৬৬ সালে যা বলেছিলেন, বিশেষ মর্যাদা হরণের পরবর্তী পর্যায়ে তা চূড়ান্ত রূপে মূর্ত হয়ে উঠল – “আমরা গণতন্ত্রের অঙ্গীকার করি, কিন্তু বলপ্রয়োগ করে কাশ্মীর শাসন করি। …”

ওপরে যা তুলে ধরা হল তা দেখাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কাশ্মীরী জনগণের গণতন্ত্র খোলামকুচি সদৃশ বস্তু মাত্র। তাঁদের চোখে কাশ্মীরী জনগণ উপনিবেশের প্রজার মতো, ঔপনিবেশিক শাসকের হুকুম মাফিক যাদের চলতে হবে, অধিকার চাইলে দমনের পরিণাম যাদের ভোগ করতে হবে, সেনাদের রক্তচক্ষুর মুখোমুখি হয়েই যাদের নিত্যদিন অতিবাহিত করতে হবে। কাশ্মীরী জনগণের গণতন্ত্র প্রাপ্তির প্রাথমিক শর্ত অতএব হল স্বাধীন দেশের অবশীভূত নাগরিকের মর্যাদা লাভ। নরেন্দ্র মোদীরা তাঁদের কতটা গণতান্ত্রিক অধিকার বিশিষ্ট নাগরিক হিসাবে গণ্য করতে রাজি? কাশ্মীরের ভূখণ্ডের ওপর অধিকারকে একচ্ছত্র করার সাথে-সাথে সেখানকার নাগরিকদের ভারতের অন্যান্য রাজ্যোর নাগরিকদের সমতুল্য বলে বিচার করতে তাঁরা কতটা প্রস্তুত? কাশ্মীরের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে -- তাঁরা লোকসভা ও বিধানসভা ক্ষেত্রগুলির পুনর্বিন্যাসে ও বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা করলে নির্বাচনের পর রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হতে পারে। আর ৩৭০ ধারা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে তাঁরা রাজি হননি, বিষয়টা সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন বলে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু কাশ্মীরের গণতন্ত্রকে কেন নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাসে সহযোগিতার সঙ্গে শর্তযুক্ত করা হবে? এটা ঠিকই যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস তথা আসন সংখ্যার বৃদ্ধি আবশ্যক হয়ে পড়ে। অন্য সমস্ত রাজ্যে নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস যেখানে ২০২৬ সালে হবে বলে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে, তখন কাশ্মীরের নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাস নিয়ে এখনই জেরাজেরি কেন? আর এটাওতো ঘটনা যে, ২০০১ সালের জনগণনার পর জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা আইন পাস করে নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাসকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ওমর আবদুল্লা যথার্থভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন, “নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলোর পুনর্বিন্যাসের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরকেই বেছে নেওয়া হচ্ছে কেন? অন্যান্য রাজ্যে পুনর্বিন্যাস হবে ২০২৬ সালে। জম্মু ও কাশ্মীরকেই শুধু বেছে নেওয়া হচ্ছে কেন?” তবে কি এর পিছনে কোনো গূঢ় অভিসন্ধি রয়েছে? জম্মু ও কাশ্মীরে বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৮৩, যারমধ্যে কাশ্মীর উপত্যকার জন্য নির্দিষ্ট ৪৬টি এবং জম্মুর জন্য নির্দিষ্ট ৩৭টি আসন। পুনর্বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে হিন্দু আধিপত্য সমন্বিত ও বিজেপির প্রভাবান্বিত জম্মুর আসন সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার কোনো দুরভিসন্ধি কি কাজ করছে? সে রকমটা ঘটলে জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য নরেন্দ্র মোদীদের গণতান্ত্রিক দরদের কপটতাই শুধু প্রকট হবে না, তা কাশ্মীরে নতুন করে আগুন জ্বালিয়েও তুলবে।

আর, ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে দেওয়া হবে নাই বা কেন? সরকার চাইলে সুপ্রিম কোর্ট বরং এব্যাপারে সহায়কই হতে পারে। নরেন্দ্র মোদীরা সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেও সরকারের দুয়ারে কান পাতলে শোনা যায়, ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নাকি ‘অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা’। কেন? আরএসএস-এর এজেণ্ডা বলে? ৩৭০ ধারা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে এবং কাশ্মীরী জনগণের অত্যন্ত আকাঙ্খিত এক অধিকার। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতির মন্তব্যে কাশ্মীরী জনগণের এই আকাঙ্খারই প্রতিফলন, “জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট থেকে যন্ত্রণায় রয়েছেন। অসাংবিধানিক, অনৈতিক ও অবৈধভাবে ৩৭০ ধারা বাতিলকে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণ মেনে নিতে রাজি নন। এর পুনরুদ্ধারের জন্য আমার দল শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে লড়াই করবে, মাসের পর মাস বা বছরের পর বছর লাগলেও তা করবে। এটা আমাদের পরিচিতির ব্যাপার। ৩৭০ ধারা এমন একটা বিষয় যা পাকিস্তান আমাদের দেয়নি।”

শোনা যাচ্ছে, কাশ্মীরী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর পিছনে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কাজ করেছে। পিছনের দরজা দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গেও নাকি কথাবার্তা চলছে। তবে, কাশ্মীরের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরুর পিছনে যে কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত বিবেচনাই কাজ করে থাকুক না কেন, কাশ্মীরের জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও সেখানের নেতানেত্রীদের অভিমত প্রাথমিক গুরুত্ব না পেলে কাশ্মীরে গণতন্ত্র শক্তিশালী করার যে কোনো উদ্যোগই যে পণ্ডশ্রম হবে তা বুঝতে বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না।

সবশেষে আর একটা কথা। কাশ্মীরের জনগণ এবং নেতানেত্রীদের কিন্তু শ্রদ্ধা ও মর্যাদাও প্রাপ্য। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা গত ২৪ জুন যাঁদের সঙ্গে বৈঠক করলেন, তাঁদেরই এক সময় “জাতীয়তা বিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল”। কাশ্মীরের যে পাঁচটি দল ‘গুপকর জোট’ বানিয়ে ৩৭০ ধারা বিলোপ ও রাজ্য মর্যাদা হরণের বিরুদ্ধে লড়ছেন, অমিত শাহ তাঁদের ‘গুপকর চক্র’ বলে অভিহিত করেছিলেন। যে সময় বিশেষ মর্যাদা হরণ করা হয়েছিল, শাসক শিবিরের ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে সে সময় শোনা গিয়েছিল কাশ্মীরের নারীদের সম্পর্কে এই অপমানজনক মন্তব্য -- কাশ্মীরের নারীদের এবার গৃহবধূ করে হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশে নিয়ে যাওয়া যাবে। কাশ্মীরের নারীরা কি এতই সস্তা যে, যার যখন ইচ্ছা হবে তখনই শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে কাশ্মীরের নারীদের পেয়ে যাবে? শ্রদ্ধা ও মর্যাদা গণতান্ত্রিক বোধের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে যুক্ত। এই শ্রদ্ধা ও মর্যাদা যে কাশ্মীরী জনগণের প্রাপ্য, সেই বোধও নরেন্দ্র মোদীদের আয়ত্ত করতে হবে। অন্যথায়, কাশ্মীরের গণতন্ত্র নিয়ে তাঁদের সমস্ত কথাবার্তাই “দিল্লী কি দূরী আউর দিল কি দূরী”র মতো বাক চাতুরী হয়ে দেখা দেবে।

-- জয়দীপ মিত্র 

Hurricane_search of a permanent solution_1

আমাদের চারপাশের অজৈব পরিবেশটি একটি বৃহৎ বাস্তুতন্ত্রের অংশ। কিন্তু তা যেন আর জড় বস্তুটির মতো আচরণ করছে না। তারা ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে। গরগর করছে, থাবা ঘসছে। তারপর আছড়ে পড়ছে সমস্ত জগত সংসারের উপর। কেন? জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ বিশেষ করে কিছু লোভী-স্বার্থান্বেষী মানুষ তাকে যত্রতত্র যেমন খুশি আঘাত করছে, হত্যা করছে। বৃক্ষনিধনে উষর মরুভূমি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বরফ গলছে। সমুদ্র জল-তলের উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গরমে এসি চলছে, ফ্রীজ তো আছেই। এরা বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ করছে। আর তা গ্রীন হাউস রক্ষাকারী ওজোন স্তর ফুটো করে দিচ্ছে। পৃথিবীতে প্রবেশ করছে অতিবেগুনী রশ্মি। জল বাতাস মাটি আজ সব দূষিত। আমপান, ইয়াস ইত্যাদি যা দেখছি তা সেই নিধনেরই সন্তান। যেন শোধ নিচ্ছে অন্যায় অত্যাচারের। কিন্তু শোধটা যে ভুল জায়গায় পড়ছে। অসহায় গরিব মানুষ তো কোনো অন্যায় করেনি। অথচ তাদের নাকের উপর দিয়ে জল যাচ্ছে।আর আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “সমুদ্রে যদি বিপ্লব হয়, নদীতে যদি বিদ্রোহ হয় আর গাছে যদি তাণ্ডব হয় - তাহলে তার থেকে কী করে উদ্ধার পেতে হয় তা একমাত্র আল্লা-ঈশ্বরই জানেন।” ভক্তদের মতো বলতে হয়, পরিবেশের কাছে মানুষের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে। এবার একজন যুগাবতারের আবির্ভাব প্রয়োজন। না, তিনি তো এসেই গেছেন। এসেছেন বিভিন্ন রূপে। যেমন, বজ্রপাত, ঘুর্ণিঝড়, প্লাবন, টর্নেডো, সুনামী, ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি। এ পৃথিবীতে প্রত্যেকেরই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তা সে জৈবই হোক আর অজৈবই হোক।

ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে সমুদ্রোপকুলবর্তী হতদরিদ্র মানুষের হাহাকারে বাতাস এখনও ভারী। তারমধ্যেই আবার ভারী বৃষ্টির সতর্কতা জারি হল। এই অসহায় নির্দোষ মানুষের কী হবে? উদ্ধার, ত্রাণ? সে নিয়েও অনেক কথা আছে। কিন্তু স্থায়ী ব্যবস্থা? এরজন্য পরিকল্পনা আছে সরকারের। তবে তা পুঁথিবন্ধ হয়ে ফসিলে পরিণত হচ্ছে। এই স্থায়ী ব্যবস্থার প্রথম ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল – স্থানীয় মানুষকে নিয়ে পরিকল্পনাকে জীবন্ত করার। আরও একটি সমস্যা হল, কথায় বলে “বিশ্ব নিয়ে ভাবো আর কাজ কর স্থানীয়ভাবে”। আমরা শহুরে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করছি নিজের ঘরে পাখার তলায় বসে। এটা করাতে আমার অধিকার আছে কি? খুব অসহায় বোধ করছি। তবুও কিছু কথা পরিকল্পনার পাতা থেকে নিয়ে ও নিজেদের ভাবনাচিন্তার মিশেল দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করা যাক।

স্থায়ী ব্যবস্থাগুলি হল, ম্যানগ্রোভ বা বাদাবনের পুনঃসৃজন, আইন মেনে কিছু বাছাই নদীর পাড় বাঁধাই, ফসল চাষ হয় এমন জমিতে নুন ও বালি ঢুকে যায় সেই মাটিকে চাষযোগ্য করে তোলা, এলাকার মানুষদের হাতে সারা বছর ধরে কাজ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইলেকট্রিক ব্যবস্থা চালু রাখা, ইকোট্যুরিজিম ইত্যাদি।

ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন পুনঃসৃজন

ম্যানগ্রোভ হল এমন কিছু গাছ যা নোনাজল ও মিষ্টি জলের মিলনস্থলে বেড়ে ওঠে। সুন্দরবন অঞ্চলে গাছগুলির নাম সুন্দরী, গেওয়া ও গরান। একসময় এই বাদাবন কতদূর বিস্তৃত ছিল জানলে বিস্মিত হতে হয়। সে বৃটিশ শাসনের সময়। গ্রাম পত্তন হবে। নাহলে তাদের পুরীষ সাফ করবে কে? কোনো মহিলাকে ধরে এনে অত্যাচার করবে? কাটা হতে লাগল বাদাবন। কাটতে কাটতে থামল ক্যানিং-এ এসে। সাহেবরা বাংলো খুলে বসে গেল। আজ যদি সেই পরিমাণ বাদাবন থাকত তাহলে ঘূর্ণিঝড় নিশ্চয় একটু ভাবতো। কী এমন ক্ষমতা আছে এই জঙ্গুলে গাছগুলোর, যা তীব্র গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়ের গতিরোধ করতে পারে?

এই বাদাবনের গাছ ছোট্টবেলা থেকেই সমুদ্রের জোয়ার ভাটায় ঢেউয়ের সাথে দুলে দুলে খেলাধুলো করতে করতে সৈনিকের প্রশিক্ষণ নেয়। নোনাজল ছাড়াও এরা মাটিতে, বালিতে, পাথুরে জমিতেও বাঁচতে পারে। জলে পা ডুবিয়ে প্রবালের উপরও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। এদের শ্বাসমূল মাটির উপর উঠে শ্বাস প্রশ্বাস নেয়। পৃথিবীর সমুদ্র তীরবর্তী অনেক দেশে এর জঙ্গল দেখা যায়। ছোটো জঙ্গুলে গাছ ১০ মিটার উচ্চতাও হতে পারে। বাঁচে ১০০ বছরেরও বেশি। যখন বন্যা বা ঝড়ে সমুদ্র ও নদী ফুঁসে ওঠে তখন এই গাছগুলো তাদের মোটা শক্তিশালী ঘন সন্নিবিষ্ট গুঁড়ি বা ঠেসমূল দিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। জল থেকে বালি ও মাটি সরিয়ে পরিশ্রুত করে। এভাবে মিষ্টি জল সৃষ্টি করে সংলগ্ন নদীতে সরবরাহ করে।

এই গাছ নিজেই একটি প্রাকৃতিক বাস্তুব্যবস্থা সৃষ্টি করে। এখানে মাছ, ঝিনুক, নানারকম চিংড়ি ইত্যাদি পাওয়া যায়। এমনকি গাছগুলো বড় হলে তা জলের উপরে এসে পড়ে। তখন কিছু আনুবীক্ষণিক জীব তা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। মৎস্যজীবিদের কাছে এমন জায়গা হল স্বর্গ। মাছ দিয়ে হাজার রকম খাদ্য হয়। এর কাঠ দিয়ে নৌকা হয়, জ্বালানির কাঠ হয়। এরসাথে ফল-ফুলের চাষ যদি করা যায়, তাহলে পাখি-কীটপতঙ্গও আসবে। এভাবে মধুর চাষও হবে। সুন্দরবনে নাকি ফল ফলানো গাছ নেই। তাই এখানে পাখিদের কাকলিও নেই। বলেছিলেন স্থানীয় একজন গাইড। পশু-চারণভূমি হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

আমরা গর্বিত যে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চল হল আমাদের সুন্দরবন অঞ্চল। কিন্তু অবিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে জীবজগতের পরমবন্ধু অসাধারণ গুণসম্পন্ন এই বৃক্ষরাজি। সরকার বলছে স্থানীয় লোকেরা এরজন্য দায়ী। অথচ সত্যিটা হল এই যে, ভারতীয় জলাভূমির ৪০০ লক্ষ একর (এক একর = তিন বিঘা) ম্যানগ্রোভ বন সরকার নিজেই অন্য কাজে ব্যবহার করছে। ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সৃজন একটা সরকারি প্রকল্প। কিন্তু তা করতে হবে স্থানীয় মানুষকে সাথে নিয়ে। অর্থাৎ সামাজিকীকরণ করতে হবে। সেই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন বীজতলা করবে, গাছ বসাবে ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। সমুদ্র বা নদীর ধারে ধরে এই জঙ্গল সৃষ্টি হবে। যা এখানকার মানুষের হাতে লাভের কড়ি তুলে দেবে। সমুদ্রজাত মাছ রপ্তানি করা যায়। এভাবে প্রতি একর জমিতে কয়েক লক্ষ টাকা আয় আসতে পারে। ফল, ফুল ও মধু চাষ করেও আয় বাড়াতে পারবেন। কিন্তু প্রাথমিক ও নিয়মিত ফান্ডিং তো সরকারকেই করতে হবে। যার কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। অথচ সুন্দরবনের সুন্দরী, গরান, গেওয়া গাছেরা কিন্তু শেষ নিশ্বাস নিচ্ছে।

in search of a permanent solution

 

নদীর পাড় বাঁধাই

এটি নিয়ে বিতর্ক চলছেই। কারণ এতে জলের স্বাভাবিক জীববৈচিত্র নষ্ট হয়। পাড় বাঁধালে বাদাবন-সৃজন ব্যাহত হবে। পরিবেশবিদরা মাটির বাঁধ তৈরির পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রবল জলোচ্ছ্বাস খুব সহজে এটি ভেঙে দেয়। পাড়ের মাটির চাঙড় নিয়ে ঝুপ-ঝুপ করে মাটির বাঁধ ভেঙে পড়ে। তারপর আবার তা নির্মাণ করতে কৃষকের জমি ধরে টানাটানি হয়। আর ক্ষতিপূরণের ঠিকঠাক পয়সাও মেলে না। এসব মাটি হল পৃথিবীর উপরিভাগের মাটি, যা চাষের জন্য সর্বোত্তম ও উর্বরও। কিছু ঘরোয়া কাজেও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ঝড়ে ভাঙা বানে ভাসা মানুষকেও তো বাঁচতে ও বাঁচাতে হবে।

তাই কয়েকটি শর্ত মেনে কিছু বাছাই নদীর পাড় বাঁধানোর ব্যবস্থা করাই যায়। যেমন, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে কোনোমতেই কোনো ক্ষতি করা যাবে না। ‘কোস্টাল রেগুলেশন অঞ্চল’ খুঁজে বের করে সেখানে পাড় বাঁধানোর কাজ করতে হবে। এবিষয়ে আইনও আছে। আমাদের দেশের সমুদ্রপোকুলবর্তী অঞ্চলের ৭,৫০০ কিমি ধরে ৯টি রাজ্যে কাজটি হচ্ছে। তবে তা কতটা আইন মেনে হচ্ছে তাতে সন্দেহ। এর নির্দিষ্ট উচ্চতা ও অন্যান্য দিকগুলি মেনে বানাতে হবে। মাটির বাঁধ একেবারেই চলবে না। পাড়ে লোহার জালে পাথর ভরে ফেলতে হবে। এর উপরে মাটি ফেলেও ঘাস রোপন করা যায়। যাতে ক্ষয় কম হয়। চাষের ও পশু-চারণ এলাকার ক্ষতি করা যাবে না। বাইরের কোনো নোংরা মেশানো চলবে না। স্লুইস গেটগুলি ঠিক সাইজে ও কাঠামোয় বানাতে হবে। নির্মাণে স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করতে হবে। সেই জিনিষগুলি ব্যবহারের আগে পরীক্ষা করে নিতে হবে। বাইরের ঢালে ঘাস লাগাতে হবে। ফুল ও ফলের গাছ লাগানো যায়। যেখানে পাখি ও ছোটো প্রাণীরা তাদের বসবাসের জায়গা পেয়ে যায়। মাছের ভেড়ি করা যায়। এভাবে এলাকার মানুষের আয়েরও কিছু ব্যবস্থা হয়। পাড় বাঁধালেই কিন্তু কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছেনা। দরকার নিয়মিত দেখভাল। ফাটলের খোঁজ রাখা ও তা দ্রুত সারাই করা প্রয়োজন। জলে কোনো বাধা সৃষ্টি হচ্ছে কিনা, নোংরা জমছে কিনা, কোনো জল দুষণ হয়ে জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা, রোপিত বৃক্ষগুলি, ঘাসজমি ইত্যাদি অক্ষত থাকছে কিনা, এসবও নিয়মিত দেখভালের দাবি রাখে।

অতিরিক্ত জলের জন্য জায়গা ছেড়ে রাখা

সমুদ্র বা নদীতে যে জলোচ্ছ্বাস হয়ে জল পাড়ে উপচে পড়ে তারজন্য কিছু পরিমাণ জমি ছেড়ে দিতে হবে। মাঠের তুলনায় তা হবে নিচু ও ছড়ানো। ছড়ানো হলে তা শুকিয়ে উঠবে দ্রুত। স্লুইস গেটগুলো যেখানে থাকবে তা খুলে দিতে হবে সময়ে সময়ে। এই জল বসতবাড়িতেও ঢুকে পড়ে। সেক্ষেত্রে বাড়ির সামনে একটি পুকুর কেটে রাখে অনেকে। যা উঠোনের তুলনায় নিচু। জলোচ্ছ্বাসের জল বাড়ি ঢুকতেই সেই পুকুরে পড়বে। কিন্তু এতটা জায়গা কি এভাবে নষ্ট করা উচিৎ? তাই পুকুরের পাড়ে জাল বিছিয়ে লতা শ্রেণীর সবজি চাষ করা যায়। জাল বিস্তৃত হয়ে পুকুরের উপর কিছুটা বাড়িয়ে নিতে হবে। মশারির ছাদের মতো। লাউ, শশা, পুঁইশাক যত বাড়বে তা ওই জালের উপর চলে যাবে। জালের নিচে দিয়ে লাউ বা শশা কেটে নেওয়াও যাবে।

নোনামাটিকে চাষের উপযুক্ত করা

এটি সাইক্লোন পরবর্তী একটি প্রয়োজনীয় কাজ। মাটি থেকে নুন সরানো খুবই সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ৫ থেকে ৭ বছর সময় প্রয়োজন হয়। নানানভাবে এই নুন মাটি থেকে বের করে দেওয়ার প্রস্তাব আছে সরকারের। যেমন মাটি চেঁচে ফেলা বা লাগাতার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা, বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা, ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো কোনো কাজের নয়। যেমন, জল ঢেলে বা জমিয়ে মাটি ধোওয়ার কথাও আছে। কিন্তু জলের সাথে মাটিও তো চলে যাবে! যাকে বলে ভূমিক্ষয়। যার ফল, ফসলের ক্ষতি ও শেষমেশ আর্থিক ক্ষতি। বরং অনেক আগে নোনা মাটিতে আমাদের প্রপ্রপিতামহরা যে চাষআবাদগুলি করতেন, সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

যেমন বেশিমাত্রায় নুন থাকলে সেই মাটিতে খেজুর, বিট, বার্লি, তুলো, পালং, সূর্যমুখী ইত্যাদি চাষ করা যায়। নুনের ভাগ মধ্যমমানের হলে সেখানে গম, ধান, টমেটো, ওটস, কপি, গাজর, আলু, পেঁয়াজ, শশা, ডুমুর, আলু, বেদানা, চাষ করা যেতে পারে। এভাবে কয়েকটি চাষ ওঠাবার পর জমির নোনাভাব নিজেই চলে যাবে।

বৃক্ষরোপন

এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। এটা করতেই হবে। নদী বা সমুদ্রের কাছাকাছি বাড়ি হলে এই দুই-এর মধ্যবর্তী স্থানে সারি সারি গাছ লাগাতে হবে। এরা হবে ঝড়ের সামনে সৈন্যসারি। ঝড়ের গতি যাবে কমে। কম হবে ক্ষয়ক্ষতি।

স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ

ঝড়ের সাথে ঝুঝতে পারে এমন বাড়ি চাই। সরকারি আবাস যোজনা আছে। কিন্তু আবাস নির্মাণ হয়নি বা তার মান অত্যন্ত খারাপ। কোনো কোনো স্থানে কয়েকটি করে বাড়ি দেখা গেছে। ইটের গাঁথনি দিয়ে দেওয়াল তোলা। ছাদে টিন বা টালি বা অ্যাসবেসটস।

অথচ, সুন্দরবনের বনাঞ্চল ও সমুদ্রোপকুলবর্তী কিন্তু জঙ্গল নয় এমন জায়গায় বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারকে পাকা বাসস্থান বাবদ ১ লাখ ৯৪ হাজার টাকা দেওয়ার কথা রাজ্য সরকারের।

সে বাড়ি কেমন হবে? বিদেশে গ্রানাইটের বাড়ি এখন।

আমাদের জন্য ইট, বালি আর সিমেন্ট। আরসিসি একটি নতুন টেকনোলজি। অনেক বেশি টেকসই এটা। কিন্তু আমাদের জন্য দরজা তৈরি হবে ধাতুর পিপে কেটে, স্ক্রু দিয়ে জোড়া দিয়ে। জানালাতেও ওই ব্যাপার। না হলে জালের বিনুনি পেঁচিয়ে। অভঙ্গুর কাঁচের ব্যবহার আমাদের বিলাসিতা হয়ে যাবে। ছাদ হবে পিরামিডের মতো ও তার মাথাটি সরু হয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে যাবে। জল বেরোনোর নালাগুলো ঠিক কাজ করছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। মেঝে থাকবে পরিষ্কার, যাতে চলাচলের সুবিধা থাকে। এরসাথে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, গ্রামের মানুষদের এরকম বাড়ি বানাতে উৎসাহিত করতে হবে, বাড়িটি কোথায় হবে সেই স্থানটি খুঁজে বের করা হবে প্রথম কাজ এবং বাড়ির চারপাশে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক।

আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা

ঝড় বা বন্যার সতর্কতা জারি হলে আশ্রয়স্থল নির্মাণ করার তৎপরতা দেখা যায়। কেন? এটা সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নয় কি? অস্থায়ীর থেকেও অস্থায়ী একধরনের আশ্রয়স্থল সরকারি গাইডলাইনে আছে। এগুলি কেমন? ঘর থেকে তুলে উঁচু জায়গায় রাখা। খুব বেশি হলে একটা তাঁবু মিলতে পারে। এবার নাকি ৪,০০০ আশ্রয়স্থল তৈরি হয়েছে। কোভিডের কারণে বেশি সংখ্যায় করে। আবার বলছে, ২০ লক্ষ মানুষকে সরানো হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে ৫০০ জন পিছু এক একটি আশ্রয়স্থলে ছিল বা আছে। কোভিডের বাজারে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই কাঠামোগুলিও অবশ্য আগে থেকেই করে রাখা দরকার। তাছাড়া গ্রামের স্কুল, পুজো মন্ডপ বা আটচালাগুলোও ব্যবহার করা যায়।

গৃহপালিত প্রাণীগুলোর জন্যও কিছু আশ্রয় ও খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এরা গরিবের সন্তানতুল্য। আয়ের উৎসস্থলও। এটা আমরা ভুলে না যাই।

বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা অক্ষত রাখা

এ নিয়ে সরকারি নির্দেশ আছে। কিন্তু সেও তাত্ত্বিক। যেমন, মাটির নিচে দিয়ে কেবল নিয়ে যাওয়া। এর প্রধান অসুবিধা হল অত্যধিক চড়া দাম। যেখানে নতুন আবাসন শহর আছে, অর্থাৎ অধিবাসীদের ঘনত্ব যথেষ্ট বেশি, সেখানে চড়া দামটা উঠিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু গ্রামে দূরে দূরে এক একটা বাড়ি। সেখানে ফ্রীজ, এসি এসব কোথায়! সেখানে এটা করা মানে বিদ্যুৎ কোম্পানির বিশাল আর্থিক ক্ষতি। এর ওপর সমস্যা হল কেবল্ চুরি। এ ঠেকানো মুশকিল। ইঁদুরেরাও কেটে দিতে পারে। টেলিফোনের যোগাযোগ থেকে কম শক্তিশালী বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে ফাইবার অপটিক লিঙ্কের মাধ্যমে আসতে হবে যাতে গ্লাস মাধ্যম প্রয়োজন। কিন্তু এটাও অসম্ভব। কারণ কাঁচ তৎক্ষনাৎ ফেটে যায়। বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারগুলো উঁচুতে তুলে দেওয়া যায়। কিন্তু সেগুলো খুবই কম ক্ষমতা সম্পন্ন। তাহলে সৌরশক্তি কি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে? সেক্ষেত্রে প্রাথমিক খরচটা বেশি হলেও পরের খরচ সামান্য। এখানে একটা সমস্যা – সৌরশক্তিকে ব্যাটারির মাধ্যমে ধরে রাখা যায়। কিন্তু ব্যাটারিগুলোর মূল্য যথেষ্ট চড়া। আর তাই তা চুরিও হয়। কিন্তু দিনের বেলা স্কুলে, বা ঘরে পাখা চালাতে ব্যবহার করা যায়। সমস্তটা বিচার করলে মাটির নিচে কেবল-ই সব থেকে কার্যকরি। তবে সরকারকে একটু বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। গ্রামগুলিতে না হলেও শহর বা শহরতলি অঞ্চলে মাটির নিচে কেবল্ পাতা যেতে পারে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা

সড়কপথে যাতায়াত করার রাস্তাগুলো নির্দিষ্ট করতে হবে। বাস, অ্যাম্বুলেন্স, টোটো এগুলোও হাতের কাছে রাখা উচিত।

টেলিযোগাযোগ

ইয়াসে তেমন গাছ পড়েনি। কিন্তু আমপানে সেটাই যেন ছিল ভয়াবহ। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়েছিল। আলো না হলেও চলে। কিন্তু জল? কাকে জানাবে? কীভাবে জানাবে? টেলি-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। রাজ্যজুড়ে মানুষের বিক্ষোভ। বিএসএনএল’কে সরকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে জিও’কে জীবন দিচ্ছে, সেই বিএসএনএল’কে দায়িত্ব দেওয়া হল। পরে জিও এসে বলল, “৭০% কাজ আমরা করে দিয়েছি”।

তিনটি কোম্পানি মিলে একটি অস্থায়ী মোবাইল স্টেশন করেছে এরাজ্যের কোথাও কোথাও। একে বলে ‘ইন্টার সার্কল রোমিং’ (আইসিআর)। যার ফোনে বিএসএনএল-এর সিম, তিনি হয়তো সে লাইনটি পাচ্ছেন না। তখন আইসিআর-এর মাধ্যমে ওই তিনটি কোম্পানির যে কোনো একটির যোগাযোগ পেতে পারেন। এই তিনটি কোম্পানি হল জিও, এয়ারটেল ও ভোডাফোন। তবে দীর্ঘ সময় বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ব্যহত হলে এই ব্যবস্থা কার্যকরি হবে না। এসব অতিরিক্ত কাজ করতে অতিরিক্ত সেলও হুইলে চাপানো দরকার। আর তা করতে যথেষ্ট পরিমাণে ডিজেল ও ব্যাটারি স্টোর করতে হবে। আরও যা লাগবে তা হল টেলিকম টেকনিশিয়ান। এরা সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লাগাতার খেয়াল রাখবেন ওভারহেড ফাইবার অপটিক কেবল্-এ কোনো ত্রুটি দেখা দিচ্ছে কিনা। তাহলে তারা সাথে সাথেই সেটা সারিয়ে তুলবেন। এই কাজগুলি যারা করবেন তাদের শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাবে বিপুল গতিসম্পন্ন ঝোড়ো হাওয়া। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে হবে তাদের। তাই তারা কাজের এলাকার কাছাকাছি আশ্রয় ও খাদ্যবস্তুর দাবি তুলেছেন।

আমপানে যে বিক্ষোভ হয়েছিল তা নাকি উপরতলা ও নিচেরতলার মধ্যে বোঝাবুঝির অভাবজনিত। আসলে বিষয়টা হল অতিরিক্ত টিম হাতে ছিল না। এছাড়া মাইকিং, হ্যান্ড মাইক, হুইসেল ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।

সরকার কী কী করছে

সরকার প্রচুর প্রচার করেছিল। মানুষকে কী কী করতে হবে সেসবও জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার নিজে কী কী দায়িত্ব পালন করেছে? সুন্দরবনে যারা গেছে ত্রাণ ইত্যাদি দিতে তারা তেমন কোনো আশ্রয়স্থল দেখতে পায়নি, খাবার জল নেই, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা দু’একদিন বাদে-বাদে খিচুড়ি দিয়ে গেছে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘দুয়ারে ত্রাণ’ হয়ত এসে ফিরে গেছে, দুয়ার খুঁজে পায়নি কিনা! কিন্তু সবথেকে বড় অপরাধ করেছেন তিনি, দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। আমজনতার সামনে তিনি বলেছেন যে, ব্রিজগুলো এত তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ল কেন? ১৩৫টা ফাটল কেন হল? দু’বছর হয়ে গেল ব্রিজ তৈরি হল না কেন? অনেকে মনে করলেন, এই তো মুখ্যমন্ত্রী এবার নড়ে বসেছেন। এবার একটা কিছু হবে। কিন্তু দু’দিন পরই যখন মাননীয়া দলত্যাগী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করে বললেন যে, রাজীব কিছুই করেনি, চুরি করা ছাড়া – তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে ।

search of a permanent solution_0

 

আমাদের অন্যভাবে ভাবতে হবে

১) যে পরিকল্পনাই হোক না কেন, সেখানে বেশ কিছু স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে রাখতে হবে।

২) আমাদের সরকারের উচিত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের এক বিরাট প্রতিনিধিত্ব সহ কৃষি বিজ্ঞানী, ম্যানগ্রোভ বিশেষজ্ঞ, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ, বিদ্যুৎ ও টেলিকম বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এখনই একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম ও কর্মসূচি বানানো।

৩) বাদাবনের পুনঃসৃজন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ওইসব এলাকার মানুষদের জীবনও পুনঃস্থাপনের কর্মসূচি বানাতে হবে। সুন্দরবনের বহু দ্বীপ আছে যা ক্রমশ জলের নীচে চলে যাচ্ছে। সেখানকার মানুষদের আগে উদ্ধার করতে হবে। সাইক্লোনপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষদের তুলে আনতে হবে এবং ধীরে ধীরে সব মানুষকেই সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।

৪) সরকার তাদের জমি নির্দিষ্ট মূল্যে ক্রয় করে বৃক্ষরোপণ করতে পারে।

৫) শহরের কাছাকাছি আবাসন নির্মাণ করে শুরু হবে তাদের নতুন জীবন। সেখানে স্কুল, বাজার, সড়ক যোগাযোগ থাকবে।

৬) পেশা কী হবে? ম্যানগ্রোভ বনসৃজনই তো বিরাট শ্রমনিবিড় এক কর্মকাণ্ড। তাছাড়া মাছধরা, মধুসংগ্রহ এগুলোও থাকবে।

৭) ইকোটুরিজম – সুন্দরবনের সৌন্দর্য শুধু নয়নের সুখ নয়, অনেক শিক্ষাও নেওয়ার আছে ওদের কাছ থেকে। লঞ্চে ঘুরতে ঘুরতে চা পান করে যেই না কাপটা জলে ছুঁড়তে গেছি, গাইড ছেলেটি চেচিয়ে উঠল, “না না জলে না, আমাকে দিন”। নদীতে কিছু ফেলা নিষিদ্ধ, ফেললে ওদের ফি থেকে কেটে নেবে কর্তৃপক্ষ। ছোটো ছোটো চা দোকানেরও একই ছবি। অন্যান্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলিতেও তাই। আমরা অবাক! আমরা শহুরে তো! যখন ফিরে আসছি তখন জোয়ারের টলটলে জলে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ। গাছগুলো সব জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মধ্যে কাগজ পড়ে থাকলে এই ছবিটার তাল কেটে যেত। সরকারি থাকার জায়গা আরও করা দরকার। কলকাতার এত কাছে, সেরকম হলে ভ্রমণপাগল বাঙালি ছুটবে।

৮) স্থানীয়দের সচেতন করা – এমন কিছু কঠিন ব্যাপার বলে মনে হয়নি।

আমরা যদি সত্যিই কিছু করতে চাই তাহলে আমাদের অকুস্থলে যেতে হবে। হুড়মুড় না করে ধৈর্য ধরে ওখানকার মানুষদের কথা শুনতে হবে, দেখতে হবে কী কী ব্যবস্থা বর্তমানে কী অবস্থায় আছে। এরজন্য ওখানে থাকা প্রয়োজন। ওখানে বেশ কয়েকটি জায়গায় আমাদের সাথীরা যখন যাচ্ছেন অনেক নতুন মানুষের মধ্যে তার প্রভাব পড়ছে। এগুলো আমাদের সাহায্য করবে।

শহরাঞ্চলে আলোচনা বা সেমিনারও করা যায়। কারণ অনেক বিতর্কিত বিষয় আছে। সেগুলো বুঝে নেওয়া দরকার। আর হ্যাঁ, সেখানে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদেরও নিতে হবে।

- অশনি সাংকৃত্যায়ন
(সহযোগিতায় : অনির্বাণ চক্রবর্তী, কৃষি বিজ্ঞানী ও অর্চিস্মান রায়, প্রযুক্তিবিদ, বিদ্যুৎ বিভাগ)

important to open school

দিন দুয়েক আগে স্কুলে গিয়েছিলাম। জরুরি কাজে। কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হল। স্কুলে না আসতে পারা, ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা জনিত কষ্টের কথা বলছিলেন কেউ কেউ। কেউ আবার বলছিলেন আমাদের অনেক বাচ্চা আর স্কুলে ফিরবে না। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে তারা। আমি একটু কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলাম, একথা কেন মনে হচ্ছে আপনার? তিনি যা বললেন তা মারাত্মক। এখন স্কুলে স্কুলে স্বচ্ছ ভারত অভিযানের তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। অভিভাবককে ফোন করে জেনে নিতে হচ্ছে বাড়িতে শৌচালয় আছে নাকি সর্বসাধারণের শৌচাগার ব্যবহার করেন। ফোন করলেই অনেক অভিভাবক জানাচ্ছেন তার ছেলে বা মেয়ে আর স্কুলে যাবে না। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। কাজ ধরেছে। অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রের মা নাকি জানিয়েছে এখন তো মোবাইলে স্কুল হয়। ছেলেকে মোবাইল কিনে দেবার পয়সা নেই। তাই স্কুলে নাম রাখার কোনো মানে নেই। সব ক্লাসের একই অবস্থা। এই চিত্র শুধু আমার স্কুলের নয়। গোটা রাজ্যের। সমগ্র দেশের। বিশাল সংখ্যক ছাত্র ইতিমধ্যেই স্কুল ছুটের দলে নাম লিখিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে প্রায় ৪০ লক্ষ পড়ুয়া পড়াশোনার বাইরে চলে গেছে।

করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর স্কুল বন্ধ। ছেলেমেয়েরা স্কুলের বাইরে। ভয়ংকর দুরবস্থার মধ্যে ছোটরা দিন কাটাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। অনেকে আবার অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। নেশায় ডুবে যাচ্ছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে স্কুল হল ছাত্রছাত্রীদের জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ। শুধু লেখাপড়ার জায়গা নয়, বিদ্যালয় অনুভূতিক এবং সামাজিক (socio-emotional) বিকাশের আদর্শ পরিসর, অন্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের কৌশল, কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করার উপায়; এসব সহপাঠীদের সঙ্গে সাবলীল মেলামেশায় আয়ত্ত করে নেওয়ার সুযোগ থাকে। নিজের জীবনের জটিল পরিস্থিতি প্রিয় বন্ধু বা মাস্টারমশাইয়ের সান্নিধ্যে সমাধানের পথ খুঁজে পায়। আমরা যদি আমাদের শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করি তাহলে দেখব অনেক কথা যা বাড়িতে বলা নিষিদ্ধ তা অবলীলায় সহপাঠীর সঙ্গে বলেছি। শুধু বলিনি, সেখান থেকে একটা সামাধানের পথ খুঁজে বের করেছি। আর যৌথ-দুষ্টুমির অনাবিল আনন্দ এখনও স্মৃতিতে আবিল হয়ে আছে আজও তা অমূল্য সম্পদ, আদরের ধন, বার্ধ্যকের বারাণসি। এই কারণেই তো বিখ্যাত গজল শিল্পী জগজিৎ সিংহ লিখেছেন –  আমার সম্পদ নিয়ে নাও। যশ, খ্যাতি প্রতিপত্তি সব নিয়ে নাও। তার বিনিময়ে আমার শৈশব ফিরিয়ে দাও। কাগজের নৌকা বানিয়ে আমি যে জলে ভাসাতাম তা আমি ফিরে পেতে চাই। আসাধারণ সেই আকূতি। সেই কারণেই বলছি বাচ্চাদের উদ্বেগ, বিষন্নতা বা মন খারাপ অনেকটা প্রশমিত হয় বন্ধুর সাহচর্যে। সহপাঠীকে সব কথা উজার করে বলতে পেরে, প্রতিকূল পরিবেশে বন্ধুর লড়াই করার গল্প শুনে তারা অনুপ্রেরণিত হওয়ার অবসর পায়। স্কুল এই সুযোগ করে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সক্ষমতাকে নাম দিয়েছে Life Skills বা জীবন শৈলী যা শৈশবে এবং বয়ঃসন্ধিতে পুরোটাই স্কুল থেকেই শেখার কথা।

WHO-র প্রতিবেদনে লেখা রয়েছে জীবন শৈলী হল, “adaptive and positive behaviour that enable individuals to deal effectively with the demands and challenges of everyday life.”

সিদ্ধান্ত নির্মাণ, সমস্যার সমাধান, সৃজনশীল চিন্তা, জটিল চিন্তা, কার্যকরি যোগাযোগ, পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের শৈলী, আত্ম সচেতনতা, সমানুভূতি, মানসিক চাপ এবং অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা এই দশ মহাবিদ্যা শেখার সুযোগ মানুষ স্কুল জীবনেই পায়। সর্বোপরি অভিভাবকতুল্য শিক্ষিকা-শিক্ষকদের পরিচর্যা এবং স্নেহ-স্পর্শ ছাত্রদের রূপান্তরের সুযোগ করে দেয়। মনের ভেতর জমে থাকা ক্লেদ-কালিমা ধুয়ে মুছে যায় মাস্টারমশাইয়ের সামান্য প্রশ্রয় পেলে।

করোনা আবহে স্কুল বন্ধ। বাড়িতে বন্দী শিক্ষার্থীরা। নিষেধের বেড়াজালে তাদের প্রাণ হাফিয়ে উঠেছে। বন্ধুর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ নেই। আড্ডা, মজা, দুষ্টুমি সব অতীত। কতদিনে শেষ হবে অতিমারীর প্রকোপ তা তাদের অজানা। বড়োরাও কোনো দিশা দিতে পারছেনা। কোনো পরিকল্পনা করে ওঠা সম্ভব হচ্ছেনা। পড়াশোনা নিয়ে ঘোরতর অনিশ্চয়তা। বেসরকারি স্কুলের সম্পন্ন ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাস চলছে। সেখানে অনিচ্ছা থাকলেও ‘অন’ হতে হচ্ছে দিনের মধ্যে একাধিক বার। চলছে পড়াশোনার ঝকমারি। লেখাপড়ার হদ্দ মুদ্দ। সোনার খাঁচায় বন্দী করে ইন্টারনেটের ডগা দিয়ে শিশুর মুখে ঢুসে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা। ‘তোতাকাহিনী’র খবর যেমন কেউ রাখেনি, এখানে বাচ্চাদের খবর কেউ রাখছে না। এ অবস্থায় উদ্বেগ তো জমাট বাঁধবেই ছোট্ট মনে। রাগও হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অসহ্য উৎকন্ঠা-রাগ বেরিয়ে আসতে না পেরে অবসাদ জন্ম নিচ্ছে শিশু মনে। তারমধ্যে আগে থেকেই যাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা রয়েছে তাদের অবস্থা আরো দুর্বিষহ। তাই এই মুহূর্তে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটা বড়ো স্বস্তির জায়গা হয়ে উঠতে পারে। স্কুল ভালো লাগার পরিসর। অসহ্যতাকে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার নিরীক্ষাগার। অসংযত অনুভূতিকে আয়ত্তে রেখে মূল স্রোতে ভেসে থাকার পরিমন্ডল।

সম্প্রতিক পরিস্থিতিতে ছাত্রছাত্রীদের মানসিক সংকটের কথা মাথায় রেখে এবং পাঠদানের কাজকে সচল রাখার জন্য কিছু শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করছেন। স্বল্প হলেও সাধু উদ্যোগ। তবে অন্যদিকে এই অবস্থায় ছাত্রদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনাটা অত্যন্ত জরুরি। তা নাহলে হয়ত অনেক কুঁড়িকে ঝরে যেতে দেখতে হবে আমাদের। মানসিক স্বাস্থ্যে মহামারির জন্য দায়ী থাকতে হবে। সরকারের উচিত সমস্তরকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্রদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুল ফিরিয়ে দেওয়া। অন্তত আর পাঁচটা পরিষেবার মতো পড়াশোনাও যে অত্যন্ত জরুরি এটা সরকার মান্যতা দিক এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনায় বসুক। সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল কীভাবে খোলা যায় তার চর্চা হোক।

- কমল কুমার দাশ  

Time education is to take time

আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তারমধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো নির্বাচন যদি হয়ে থাকে তা হল ২০২১’র পশ্চিমবাংলার নির্বাচন, যেখানে বাংলা দখল করার জন্য বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এবারের নির্বাচনটা পশ্চিমবাংলায় কেবল রাজ্য প্রেক্ষিতে ছিল না, এই নির্বাচন ছিল গোটা দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, গোটা দেশের লড়াই হয়ে গেছিল। এবং এই কারণেই হয়েছিল, ২০১৪ সালে বিজেপি যখন ক্ষমতায় এলো অমিত শাহ একটা কথা বলেছিলেন, ‘যে আমরা ৫০ বছর রাজত্ব করব’। সুতরাং ওদের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে কোনোভাবে ক্ষমতাটা দখল করে নাও। যদি মেজরিটি পাওয়া গেল তাহলে ক্ষমতা তো চলেই এলো, আর যদি তা নাও পাওয়া যায় তবু শক্তি তো বাড়ানো যাবে, উত্তর-পূর্ব ভারতে এমন রাজ্যও আছে যেখানে বিজেপির কাছে রয়েছে দু’টো আসন কিন্তু সরকারটা বিজেপির হাতে। তাই যে কোনো মূল্যে গোটা দেশে সংসদের ক্ষমতা থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা, সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হবে। এইজন্য কুক্ষিগত করতে হবে, যাতে সেই ক্ষমতায় বসে যেটা প্রায় ১০০ বছর ধরে আরএসএস স্বপ্ন দেখেছে ভারতবর্ষের চরিত্রটাকে বদলে দেওয়া, এই দেশটাকে হিটলারের-মুসোলিনির আদর্শে হিটলারি কায়দায় একটা সমাজ, একটা দেশ, একটা রাষ্ট্র এখানে গড়তে হবে। এই যে ওদের একটা স্বপ্ন, ১০০ বছরের পুরনো স্বপ্ন, যেটা আসলে একটা চক্রান্ত, সেই চক্রান্তকে বাস্তবায়িত করার জন্য ওদের ক্ষমতা দখলের লক্ষ্য। সেইজন্য বাংলাটা এত গুরুত্বপূর্ণ। ওরা এখনো পর্যন্ত যে ক্ষমতা দখল করেছে তা মূলত হিন্দী বলয়ে। সেখানেও কিন্তু ওরা দেখতে পারছে সেই সমস্ত জায়গায় ধীরে ধীরে মানুষ ওদের ‘জুমলা’, ওদের স্বৈরতান্ত্রিকতা টের পাচ্ছে।

সিপিআই(এম) এবারের নির্বাচনে একটা অদ্ভুত বিষয় যোগ করল, “বিজেপিকে হারাতে গেলে আগে তৃণমূলকে হারাতে হবে”! এই এ্যাজেন্ডাটা সিপিআই(এম) তার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বেঁধে দিয়েছিল এবং তা জনগণের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার সবটুকু চেষ্টা করেছিল। আর তৃণমূলের বাইরে যে সমস্ত বামপন্থী, লিবারাল মানুষ বিজেপিকে প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিলেন বা ‘নো-ভোট-টু-বিজেপি’র’ প্রচার করেছিলেন তাদের সাথেই সিপিআই(এম) নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়েছে। যার পরিণামে পশ্চিমবঙ্গে এবারের নির্বাচনে বিজেপির মতো একটা সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিষ্ট দলের বিরুদ্ধে বামপন্থী শিবির একজোট হতে পারল না। বিজেপির সাথে অন্য কোনো পার্টির তুলনা হয়না। এটা একটা সম্পূর্ণ অন্য পার্টি, অন্য আদর্শ। একটা অন্য চক্রান্ত, যেটা হচ্ছে ভারতবর্ষকে, সংবিধানকে, গণতন্ত্রকে ধংস করে দেওয়ার জন্য, আর গোটা দেশে ‘কোম্পানিরাজ’ অর্থাৎ আদানি-আম্বানিদের রাজত্ব করে দেওয়ার জন্য। তৃণমূলের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অবশ্যই বিরোধিতা করার দরকার রয়েছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের সন্ত্রাস অবশ্যই বিজেপিকে এরাজ্যে বাড়তি জায়গা করে দিয়েছে, কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ১৮টি আসন ও ৪০ শতাংশ ভোটের বিপরীতে তৃণমূলের দখলে থাকা ২২টি আসন ও ৪৩ শতাংশ ভোটকে বিজেপির সাথে একাকার করে দিয়ে ‘বিজেমূল’ আখ্যা দেওয়াটা চরম নেতিবাচক পদক্ষেপ। বিজেপির ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের বিপরীতে একটি বিরোধী দল পরিচালিত সরকার ও রাজনীতিকে বিজেপির সাথে মিলিয়ে দেখাটা কোনো বাস্তববাদী বিশ্লেষণ হতে পারেনা। ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরী দিয়ে বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করে বামপন্থী রাজনীতি এগোতে পারে না।

একদিকে এই প্রথম পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় একজনও বাম প্রতিনিধি না থাকাটা যতটা দুর্ভাগ্যজনক, ঠিক ততটাই বিপজ্জনক একটা বড় সংখ্যক ফ্যাসিস্ট-সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিনিধি থাকাটা। আর নির্বাচন মিটে যাওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে রাজ্যে একটা নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত, ঘুষ বা আমলাকান্ডের ছুতোয় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আঘাত হানার মতো অপচেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আর এসমস্ত ঘটনায় যারা ‘গায়ের জ্বালা মেটানোর’ আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন তাদের জানা উচিত যে, বিজেপির মূল শত্রু রাজনৈতিকভাবে কমিউনিস্টরা ও ধর্মীয়ভাবে মুসলিমরা। এছাড়াও আছেন দলিতরা যারা ব্রাহ্মণ্যবাদী সামন্ততান্ত্রিক সমাজের রক্ষকদের অন্যতম শত্রু।

একবার রুখে দেওয়া গেলেও তৃণমূলের মতো আদ্যন্ত একটি ক্ষমতাকেন্দ্রীক দল যে আগামীদিনে বিজেপির বিপদকে মোকাবিলা করতে পারবে এবিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কোনো সন্দেহ নেই যে, ওদের কাছে রাজনীতিটা ‘করে-কম্মে খাওয়ার’ বা ‘আখের গোছানোর জায়গা’ এবং তা আর একবার পরিস্কার হয়ে গেছে নির্বাচনের আগে বা পরে দলবদলের হিড়িক দেখে। সিপিআই(এম)ও ভেবেছিল তৃণমূলের ভোট লুঠ, দুর্নীতি, সর্বক্ষেত্রে নৈরাজ্য, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলিই নির্বাচনের প্রধান বিষয় হয়ে উঠবে। লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, সারা দেশে গড়ে ওঠা কৃষিআইন-বিরোধী একটানা ঐতিহাসিক আন্দোলন, উত্তরপ্রদেশ-ত্রিপুরা-আসামে রামরাজ্যের নমুনা, রান্নার গ্যাস-পেট্রোল-ডিজেল সহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিকদের নূন্যতম অধিকারগুলো কেড়ে নিতে নতুন শ্রমকোড, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টের নামে নির্লজ্জ ধৃষ্টতা, নতুন শিক্ষানীতির নামে শিক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে পণ্যে পরিণত করার দাম্ভিকতা, সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জা করে ফেলা, সর্বোপরি সিএএ-এনআরসি’র নামে দেশের নাগরিককে বেনাগরিক বানানোর ষড়যন্ত্রর মতো বিষয়গুলো তথা বিজেপিই যে সাধারণ মানুষের কাছে প্রধান বিপদ বলে চিহ্নিত হবে সেটা একবারের জন্যও সিপিআই(এম) ভাবতে পারেনি তা তাদের নির্বাচন পরবর্তী বিবৃতি থেকেই পরিষ্কার।

তৃণমূলের বাইরে যে বা যারা বিজেপির বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাদেরই ‘চাল চোর’, ‘চটিচাটা’ ইত্যাদি বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। অতীতে কোনো বামপন্থী দলকে জনগণের প্রতি এই ধরনের বাক্য বা শব্দবন্ধ ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। সিপিআই(এম)-এর তথাকথিত সমর্থকরা এবার যেটা করে দেখালেন, তা বিজেপির মতো ভয়ঙ্কর একটা দলের আইটি সেলের বিদ্বেষ-বিভাজন-কুৎসিত আক্রমণের ধারার পাশাপাশি আরেক ধরনের কুৎসার পরিবেশ তৈরি করে। দীর্ঘকালের কর্তৃত্ববাদী মতাদর্শ ও ক্ষমতার রাজনীতি সমাজে একশ্রেণীর সুবিধাভোগী তৈরি করে, এগুলো তারই ফসল। আর এই কারণেই ভারতবর্ষ‌ জুড়ে কর্পোরেট সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের বর্শামুখ নির্দিষ্ট করার আহ্বান জানালে তা ওদের কাছে দালালি বা গোপন বোঝাপড়া বলে মূল্যায়ন হয়। জনগণকে এই বিপজ্জনক রাজনীতি সম্পর্কে জরুরি ভিত্তিতে সতর্ক করাটা আশু কর্তব্য, আর এর দায়ভার বামপন্থীদেরই। ওদের বোধহয় জানাই নেই, জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা এই কাজটা ভালো করে উঠতে পারেনি বলেই হিটলারের উত্থান দেখতে হয়েছিল। বাংলার বামপন্থীদের অবশ্যই আশা রাখতে হবে, ইতিবাচক-নেতিবাচক শিক্ষা নিয়ে সংগ্রামের পথে সংগঠিত হতে হবে।

- শ্রীকান্ত লাহা

Peru at a historic juncture_0

ল্যাটিন আমেরিকার দেশ পেরুতে সম্প্রতি প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে মার্কিন মদতপুষ্ট দক্ষিণপন্থী নয়া-উদারবাদীদের বিরুদ্ধে বামেদের পুনরুন্মেষের মাধ্যমে ঐতিহাসিক জয় হয়েছে।

পেড্রো কাস্তিল্লো পেশায় গ্রামীণ স্কুল শিক্ষক ও ইউনিয়ন নেতা পেরুর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন এবং এই নিয়ে দ্বিতীয়বার গ্রামীণ সমাজ থেকেও একজন ভূমিজ মানুষ প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন। এই রায় ছিল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেত্রী কেইকো ফুজিমোরি যিনি অত্যাচারী আলবার্তো ফুজিমোরির কন্যা, তার অত্যাচারের যোগ্য জবাব দিতে পেরুর বামপন্থীদের এই পুনরুত্থান।

২০১৭ সালে দু’মাস ব্যাপী শিক্ষকদের বর্দ্ধিত বেতন, সামাজিক ঋণ মকুব, বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি দাবিতে ব্যাপক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন পেড্রো কাস্তিল্লো। তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট পেড্রো পাবলো বাধ্য হন দাবিগুলি মেনে চুক্তিবদ্ধ হতে।

কাস্তিল্লো, দক্ষিণপন্থী স্বৈরতান্ত্রিক কেইকো ফুজিমোরির ‘ফুজিমোরিবাদ’এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সমাবেশের মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক নয়া-উদারবাদী পলিসিগুলির মুখোশ ক্রমাগত খুলতে থাকেন এবং এরফলে নির্বাচনের এজেন্ডা পাল্টে যায়। শ্রমিকশ্রেণি, দরিদ্র ও উদার গণতান্ত্রিক মানুষ ঐক্যবদ্ধ হন। অন্যদিকে ফুজিমোরি কমিউনিস্ট-বিরোধী বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রচার চালান এবং তার পিতার ‘শক্তিশালী সরকার’কে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিতে থাকেন।

১৯৯০’র দশক জুড়ে আলবার্তো ফুজিমোরি মার্কিন মদতে বামপন্থী ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সংগঠকদের বিরুদ্ধে পাশবিক অত্যাচার ও প্রচার চালান এবং এর পাশাপাশি নয়া-উদারবাদী, ব্যয় সংকোচন পলিসিরও (কুখ্যাত ফুজিশক্) প্রচার চালান। এই পলিসিগুলি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন সরকারের ট্রেজারি দপ্তরের ল্যাটিন আমেরিকান দেশের জন্য পলিসির অন্যতম অংশ ছিল। ২০০৯ সালে ফুজিমোরি তার কুখ্যাত হন্তারক ‘গ্রুপো কোলিনো’র মানবতা-বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা এবং জোর করে হাজারে হাজারে পুরুষ ও মহিলাদের নির্বীজকরণ ও বন্ধ্যাকরণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন। আলবার্তোর পর যারা ক্ষমতায় আসেন তাঁরা ‘ফুজিমোরিবাদের’ বিরোধীতার নামে নয়া-উদারবাদী এজেন্ডাকেই অনুসরণ করেন। বর্তমানে কোভিড-১৯’র জন্য পেরুতে সামাজিক বৈষম্য দ্রুতহারে বাড়ছে, দারিদ্রতার হার ৩০ শতাংশ, ২০ লক্ষ মানুষ কাজ হারা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এমতাবস্থায় কাস্তিল্লোর সামনে কঠিন পরীক্ষা।

- পুলক ভট্টাচার্য 

"Swajan Smaran" in East Burdwan

পূর্বস্থলী ২নং ব্লকের চন্ডীপুর গ্রামে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পূর্বস্থলী লোকাল কমিটির উদ্যোগে প্রয়াত কমরেড সুবোধ মজুমদারের স্মৃতিসৌধের সামনে জমায়েত হয়ে করোনা মহামারী ও কৃষক আন্দোলনের প্রয়াত সমস্ত স্বজন হারানোর স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে স্মরণ কর্মসূচি সংগঠিত করা হয়। গ্রামের ৫০ জনের বেশি মানুষ এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ মোদী সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন অশোক চৌধুরী।

স্মরণ অনুষ্ঠান হয় মন্তেশ্বর ব্লকের কুলুট গ্রামে, কালনা ২নং ব্লকের সাহাপুর গ্রামে, সদর ২নং ব্লকের শক্তিগড়ে ও বর্ধমান শহরে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-24