সোশ্যাল মিডিয়ায় কার্ফু জারির চেষ্টা
Attempts to impose curfew on social media

আজ থেকে দু’তিন বছর আগেও ‘আইটি সেল’ শুনলেই যে কোনও বিবেকবান মানুষের শিরদাঁড়া দিয়ে এক হিমশীতল তরঙ্গ খেলে যেত। এই সেল থেকে নরমে গরমে উৎপাদিত বার্তা-বিশ্লেষণ-মিথ্যাচার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মনে হোত আমরা বুঝি এক গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। সমাজের ওপর শ্যেনদৃষ্টিতে কেউ যেন এমনভাবে তাকিয়ে রয়েছে, সামান্য এদিক-ওদিক হলেই ‘দেশদ্রোহী’ অথবা ‘আরবান নকশাল’এর তকমা পড়ে যাবে গায়ের ওপর। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তখন যেন একতরফা ‘হিন্দুরাজ’।

এই দখলদারি একদিনে শুরু হয়নি। ২০১৪ সালের আগে থেকেই এর সলতে পাকানো শুরু। ক্যাডার-ভিত্তিক একটি অনুশাসিত দল পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকে দিল্লীর ক্ষমতা দখলের দিকে। সে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যবিন্দু শুধুমাত্র দিল্লীর মসনদই ছিল না, দেশ জুড়ে এক কঠিন-সহিংস মতাদর্শগত ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য জারিরও সুগঠিত অভিসার ছিল। আর সেযাত্রায় অনেকাংশেই ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দিতেই এগিয়েছে তারা। কারণ, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নেতৃত্বহীন ও দিশেহারা কংগ্রেসের যে করুণ অবস্থা ছিল, তাতে নেহাতই আত্মসমর্পণ করে দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনও উপায়ও ছিল না। অবশ্য, কোনও কোনও রাজ্যে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতৃত্বের জোরে কিছুটা ঠেকা দেওয়া গিয়েছিল, তবুও পরে সেসব বহু জায়গাও তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে।

এই সার্বিক দখলদারির অভিযানে সোশ্যাল মিডিয়ায় তথাকথিত সেই ‘আইটি সেল’এর ভূমিকা ছিল অবিসংবাদিত। এটা সত্যি দেখার মতো যে, চরম দক্ষিণপন্থী ও ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি সামাজিক-রাজনৈতিক অস্তিত্ব হয়েও আরএসএস-বিজেপি সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তি ও কার্যকারিতাকে পুরোমাত্রায় অনুধাবন করে তাকে নিজ উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহার করে নিতে সক্ষম হয়। অথচ, তথাকথিত প্রগতিশীলেরা এক্ষেত্রে তখনও কয়েক যোজন পিছিয়ে।

আজ অবশ্য সেই সমীকরণটা পালটে গেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পালটা ঝড় উঠেছে। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ট্যুইটার, হোয়াটসআপ’এ এখন মৌলবাদ বিরোধী স্বর প্রবল শক্তিশালী। ইউটিউবার’রা মাঠে-ঘাটে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে নির্দ্বিধায় সত্যকে তুলে ধরছেন। তাদের অনুগামী ও দর্শক সংখ্যা যে কোনও মেইনস্ট্রিম মিডিয়াকে লজ্জায় ফেলে দেবে। যে সমস্ত মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, ‘আইটি সেল’এর প্রচারে মোহিত হয়েছিলেন, তাঁরা এখন কঠোর বাস্তবতাকে বুঝতে পারছেন। অতএব, গত সাত বছরে আরএসএস-বিজেপি’র বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে আজ এই মুহূর্তে এতটাই সোরগোল উঠেছে যে এখন বরং তাদেরই নড়েচড়ে বসার পালা। ইউটিউবে আপলোডেড প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’এ ‘লাইক’এর থেকে ‘ডিসলাইক’এর সংখ্যা বহুল পরিমাণে বেশি হয়ে পড়ছে। ট্যুইটারে ‘রিজাইন মোদী’ হ্যাশট্যাগ দারুণভাবে ট্রেন্ড করছে, কৃষক আন্দোলনের রোজকার খবর শেয়ার হতে হতে সোশ্যাল মিডিয়াকে ছেয়ে ফেলেছে, সম্বিত পাত্রের ফেক পোস্টের ওপর ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ ট্যাগ পড়ে যাচ্ছে। সবটা মিলিয়ে, ‘আইটি সেল’ এখন সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বত্রই রীতিমতো কোণঠাসা। এবং তার জের নির্বাচনী ফলাফলেও পড়ছে। পশ্চিমবাংলাতেই যে শুধু তারা বেজায় হেরেছে তাই নয়, উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও ভরাডুবি ও উত্তরোত্তর দলীয় কোন্দল তাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে।

এবার তাই ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের পালটা প্রত্যাঘাতের পালা। যে সোশ্যাল মিডিয়া এতদিন ছিল তাদের প্রিয়তম দোসর, বিচরণের একচেটিয়া আয়েস-ভূমি, এখন তারাই হয়ে উঠেছে চক্ষুশূল। ফেসবুকের প্রাক্তন আঞ্চলিক অধিকর্তা আঁখি দাস সেদিনও মোদীর দলের সঙ্গে তাদের সখ্যের কথা সগর্বে জানিয়েছিলেন। কিন্তু, ‘কাহারও সমান নাহি যায়’। এখন সেসব সুখের দিন গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেইজ্জত হয়ে তারা এখন সোশ্যাল মিডিয়াগুলির বিরুদ্ধেই একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।

ঘটনার শুরু ট্যুইটারকে দিয়ে। যেখানে সম্বিত পাত্র একটি ফেক টুলকিট প্রকাশ করে কংগ্রেসের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ট্যুইট করেছিলেন। তা ট্যুইটার কর্তৃপক্ষের নজরে আসতেই তারা ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে যখন নিশ্চিত হয় যে টুলকিটটি ফেক, তখন সম্বিত পাত্রের ট্যুইটের ওপর ‘ম্যানিপুলেটেড মিডিয়া’ বলে একটি ছাপ্পা মেরে দেয়। ব্যস, তাতেই চটে লাল ‘আইটি সেল’। তারা ট্যুইটারের কাছে দরবার করে ওই ছাপ্পাটি তুলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রমাণিত একটি প্রতারণাপূর্ণ ট্যুইট থেকে সে ট্যাগ ট্যুইটার কেন সরাবে? তাহলে তো সেই ট্যুইটের মিথ্যাচারিতাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়! ট্যুইটার কর্তৃপক্ষ রাজী না হওয়ায় দিল্লীর পুলিশ গিয়ে ট্যুইটারের ভারতীয় অফিসে রেইড করে ও কর্মচারীদের ভয় দেখায়। তবুও ট্যুইটার তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকায় কেন্দ্রের সরকার নানারকম আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দেখায়।

এর আগেই সরকারের তরফে জানানো হয় যে, কোনও ‘আপত্তিকর’ পোস্টের দায় শুধুমাত্র প্রেরকের ওপর থাকবে না, তা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ওপরেও এসে বর্তাবে। অর্থাৎ, সরকার যদি মনে করে কোনও পোস্ট বা মেসেজ ‘দেশ ও দশের পক্ষে হানিকর’, তাহলে সেই মোতাবেক সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ পাওয়ার ৭২ ঘন্টার মধ্যে সেই পোস্ট সরিয়ে দিতে হবে এবং শুধুমাত্র তাই নয়, তারজন্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের নির্দিষ্ট অফিসার দায়ী হবেন এবং সেই পোস্টের উৎস কে, তাও জানাতে হবে। উল্লেখ্য, গত ফেব্রুয়ারিতে ‘ইনফরমেশন টেকনোলজি (ইন্টারমিডিয়ারি গাইডলাইন্স অ্যান্ড মিডিয়া এথিকস কোড) রুলস’ জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার প্রত্যকেটি প্ল্যাটফর্মকে তিনজন করে অফিসার নিয়োগ করতে বলেছে, যারা যে কোনও নিয়মনীতি লঙ্ঘিত হলে তারজন্য সরাসরি দায়ী থাকবে। মেসেজের উৎস জানানোর নির্দেশের বিরুদ্ধে হোয়াটসআপ দিল্লী আদালতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। কারণ, তাদের প্ল্যাটফর্ম হল ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’এর ভিত্তিতে এমন ভাবে গ্রথিত যে তারা নিজেরাও ব্যবহারকারীদের দ্বারা প্রেরিত মেসেজগুলি উন্মুক্ত করে পড়তে পারে না। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার্থে তারা সেই প্রযুক্তিগত আঙ্গিকেই তাদের প্ল্যাটফর্মকে নির্মাণ করেছে। এই এনক্রিপশন তারা স্বভাবতই ভাঙতে পারবে না, কারণ, এই ভিত্তির ওপরেই তাদের বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক চরিত্র দাঁড়িয়ে আছে। এই নির্মাণ-কৌশলকে ভাঙলে তাদের বাণিজ্যের মৌলিক অবস্থানটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য, তাই বলে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে সোশ্যাল মিডিয়াগুলি সুবোধ বালকের মতো আচরণ করে। অনেক সময় তারাও ব্যবহারকারীদের তথ্য বাজারে বিক্রি করে অন্যায় মুনাফা সংগ্রহ করতে পিছপা হয়না। এ ব্যাতিরেকেও, গ্রাহক বা ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের নয় সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক রায়ে জানিয়েছিল - সংবিধানের ২১ ধারা মোতাবেক গোপনীয়তার অধিকার এক মৌলিক অধিকার।

দেখা যাচ্ছে, জনমতে পর্যুদস্ত হয়ে মরীয়া বিজেপিকুল এখন উঠে পড়ে লেগেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিরুদ্ধ মতকে শায়েস্তা করতে। তথ্যমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছেন, গোপনীয়তার অধিকারকেও ‘যুক্তিযুক্ত নিয়ন্ত্রণ’এর অধীনে থাকতে হবে। অর্থাৎ, মানুষের যাবতীয় ব্যক্তিগত প্রয়াস বা চলন গেরুয়া ‘যুক্তি’র অধীনে থাকবে। এ এক ভয়ঙ্কর মনোভাব। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, যে কোনও সরকারি বিরুদ্ধ মত প্রকাশকেই তারা ‘দেশদ্রোহ’ বলে দেগে দিতে কুন্ঠা বোধ করে না। লক্ষদ্বীপ নিয়ে চিত্র পরিচালক আইশা সুলতানা একটি মতামত প্রকাশ করায় তাঁর বিরুদ্ধে লাগু হয়েছে দেশদ্রোহী আইন। এইসব আক্রমণের বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়ন তো উঠেছেই, বিভিন্ন গণসংগঠনও প্রতিবাদে সামিল হয়েছে। যেমন, ডিজিটাল স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ‘অ্যাকসেস নাও’ সহ ১৪টি সংগঠন (যেমন, ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’, ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’, ‘আর্টিকেল ১৯’ প্রভৃতি) কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এক আবেদনে সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কিত অসাংবিধানিক নতুন বিধিগুলিকে বাতিল করতে বলেছে। তাদের মতে, এই বিধিগুলি আর কিছুই নয়, বিরোধী মতকে দমন করার এক কৌশল বিশেষ। এখন দেখার, চারিদিক থেকে নানাবিধ চাপে পড়ে সরকার পিছু হঠে কিনা। কিন্তু বিষয়টা অত মসৃণ নয় বলেই অনুমান। ফ্যাসিবাদীরা অত সহজে জমি ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না।

-- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

খণ্ড-28
সংখ্যা-22