চে গেভারা ও তার সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: করোনাকালে ফিরে দেখা
Looking Back in the Corona

আন্তর্জাতিক চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করে মোদী সরকার ভারতে করোনা তান্ডব শুরু হতে সাহায্য করেছিল। আমরা বিনা চিকিৎসায় হাজার হাজার মানুষকে মরতে দেখেছি, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঐতিহাসিক দুর্দশা দেখলো বিশ্ব, দেখলো কিভাবে কোনো সরকার মানুষের জন্যে আপৎকালীন চিকিৎসা ও খাদ্যের ব্যবস্থা না করে কর্পোরেট হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলোকে মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছে, জ্বালানির দাম বাড়াচ্ছে, জিএসটি নিচ্ছে কোভিড চিকিৎসা আনুষাঙ্গিকের ওপর। দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেনের অভাবেই হাজার হাজার মানুষ মারা গেলেন, পেলেন না যথাযত চিকিৎসা। একইভাবে করোনার একদম শুরুর দিকে চীন ফেরৎ এক মার্কিনির করোনার উপসর্গ ধরা পড়ে, আত্মীয় স্বজনরা তাকে করোনা টেস্টিং-এর জন্যে নিয়ে যেতে চাইলে উনি প্রথমে যেতে চাননি, ভয় ছিল বিল মেটাতে পারবেন না। যাই হোক পরীক্ষার পর বেসরকারি ল্যাব তার ওবামা কেয়ার-এর টাকা কেটে আরো ১,০০০ ডলার তাকে বিল পাঠায়।

যে বিষয়টি নিয়ে আলোকপাত করতে চাইছি সেটা হলো সোশ্যাল মেডিসিন বা একটা সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা দেশের আপামর গরীব মানুষের রোগ মহামারী থেকে বাঁচার একমাত্র সাথী। আর এই ধারণা ১৯৩০ সালের দিকে প্রথম আসে ইউরোপ, এর প্রথম প্রয়োগের পরিকল্পনা করেন চিলির প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি ও একজন প্যাথলজিস্ট ডঃ সালভাদোর অ্যালেন্ডে।

তবে এর বাস্তব রূপায়ণ করেছিলেন ডঃ চে আর্নেস্তো গেভারা। তাই উন্নত দেশগুলি যা পারেনা গরীব দেশ হয়েও কিউবা তা অনায়াসে করে দেখায়।

পৃথিবীতে তাঁর সংক্ষিপ্ত ৩৯ বছরের জীবনে চে গেভারা তার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও বিপ্লবী মতাদর্শের জন্যে জীবন উৎসর্গ করে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের কাছে নায়কের মর্যাদা পেয়েছেন। আর এই বিষয়টি ঢেকে দেয় তার বিপ্লবী সত্বা কত গভীর সেই চেতনাকে, জনগণের প্রতি, তাদের স্বার্থের প্রতি চে’র আবেগ শুরু হয়েছিল জনস্বাস্থ্য দিয়ে। তার চিকিৎসা ও তার সার্বজনীন প্রয়োগের প্রকল্প লাতিন আমেরিকার সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উত্তরাধিকারকে রূপদান করেছিল।

এলার্জিক হাঁফানি চে’র জন্মগত রোগ। ১৯৪৭এ ডাক্তারি পড়তে গেলেন, তিন বছর পরে তাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল এই প্রচন্ড হাঁফানির কষ্ট নিয়ে, কয়েক বছর পরে একটু সুস্থ হয়ে উঠে আবার পড়তে যান এবং ১৯৫৩ সালে তার মেডিকেল ডিগ্রী সম্পূর্ণ করেন। মাঝখানের এই সময়টা বিখ্যাত হয়ে আছে তার মোটরসাইকেল ডায়েরি নামে এক অভিযানের জন্যে। চে তার বন্ধু চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী আলবার্তো গ্রানাডো জিমনেজ-এর মোটর সাইকেলের সঙ্গী হয়ে এক আন্তঃমহাদেশীয় ভ্রমণ অভিযান শুরু করেন। এই যাত্রাটিকে চে, হেনসেন-এর রোগ বা কুষ্ঠ রোগীদের মধ্যে সমীক্ষা চালানোর কাজে ব্যবহার করলেন। এই ভ্রমণের সময়ই তিনি লাতিন আমেরিকা জুড়ে আয়ের বৈষম্য এবং বর্ণ বৈষম্যের বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করলেন। এই যাত্রা তাকে শুধু সমাজতন্ত্রের অপরিহার্যতা অনুভব করালো না, পাশাপাশি একটি সার্বজনীন সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপরিহার্যতার বিষয়টিও অনুধাবনে আনলো, চে গেভারা যার নাম দিলেন ‘রেভলিউশনারী মেডিসিন’ বা ‘বৈপ্লবিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’।

১৯৫৫ সালে চে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা করলেন এবং কিউবার স্বাধীনতার জন্যে বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসের এক সকালে বিশ্ববাসী জানলো মার্কিন বসম্বদ স্বৈরতান্ত্রিক শাসক ফ্লুজনিয়ো বাতিস্তাকে উচ্ছেদ করে কিউবার বিপ্লব সফল হয়েছে। পরবর্তীতে এই বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ধ্যানধারণার আরো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন বিপ্লবের অন্যতম নেতা চে গেভারা। চে কেবল কাস্ত্রোর আর্থসামাজিক পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, তাকে সমভাবে স্বাস্থ্যনীতিকেও আমূল পরিবর্তনের ভাবনায় প্রভাবিত করে ফেললেন। এবং সেই পথের অনুসরণ আজ শুধু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তই নয় করোনার প্রতিটি মারক আঘাতের বিরুদ্ধে কিউবার রুখে দাঁড়ানো, করোনার থাবায় ধুঁকতে থাকা শিল্পোন্নত দেশগুলিতে ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো গেভারার সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বোধকে আরো আরো তত্বগতভাবে শক্তিশালী করে চলেছে, পুঁজিবাদের ফাঁপা বেলুন ক্রমশ চুপসে যাচ্ছে। সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সর্বোত্তম উদাহরণগুলি লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতেই দৃশ্যমান। ইংরেজি ভাষী বিশ্বে দীর্ঘকাল অবহেলিত এই সামাজিক স্বাস্থব্যবস্থার কার্যকারিতা এখন প্যাথলজি ও মহামারী সংক্রান্ত বিষয়ে সমগ্র বিশ্বে গবেষণা, শিক্ষা ও অনুশীলনের বিষয়।

চে মেক্সিকোতে একটি এলার্জি কনফারেন্সে ‘অর্ধ পাচ্য এন্টিজেন’ সম্বন্ধীয় একটি পেপার দাখিল করেন, যা অত্যন্ত প্রশংসা পায়, তার গবেষণা ও সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিবর্তনের রূপরেখা বিচ্ছিন্ন গবেষণার চেয়ে রাজনৈতিকভাবে সমাজ পরিবর্তনকে বা সেই সম্বন্ধীয় প্রকল্পকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। তিনি একটি ম্যাগাজিনের জন্য নিবন্ধে লিখেছিলেন “আমরা আমাদের প্রিয় লাতিন আমেরিকার মহামারীগুলির জন্য আমাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে ঔষধ আবিষ্কারের কিছু সূত্র প্রয়োগ করেছি, যা দ্রুত বৈজ্ঞানিক সত্যের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।” আজ কিন্তু কিউবা বা কিছুটা হলেও আর্জেন্টিনা সেই পরিকল্পনার সুফল উপভোগ করছে। বলতে গেলে এই করোনাকালে সমগ্র বিশ্বই এর প্রয়োজনীয়তাকে বারবার অনুভব করছে।  

সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাস্থ্য, রোগ এবং চিকিৎসা চর্চাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। জনস্বাস্থ্য সামাজিক সংপৃক্তির বিষয়, যা আমরা আমাদের দেশে দেখতে পাইনা, জনস্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয় সবচেয়ে কম, মহামারী হলে সেখানে থেকেও টাকা কামায় কর্পোরেট। আর সেখানে চে’র রূপায়িত সার্বজনীন সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্বন্দ্বের উপর ভিত্তি করে একটি মার্কসবাদী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। সামাজিক চিকিৎসা সামাজিক শ্রেণীর উপর জোর দেয়, যেমন অর্থনৈতিক উৎপাদন সম্পর্কের দ্বারা সংজ্ঞায়িত। সামাজিক চিকিৎসার অনুশীলনকারীরা দেখিয়েছেন যে কিভাবে শ্রমের শোষণ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বঞ্চনার অন্তর্নিহিত শর্ত হিসাবে থেকেই যায়। তাই এই সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য বা অসুস্থতাকে একটি দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা হয় যা পুঁজিবাদে একচেটিয়া ব্যবসার বাজার তৈরির উপাদান। সোজা কথায় একদিকে মানবিকতা, পরিবেশ, সমগ্র সমাজকে নিয়ে ভাবনা, যার প্রয়োগ আমরা কিউবা ছাড়াও ভিয়েতনামে ও অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি। এছাড়া জাপান ও নরওয়েতে অনেকটাই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র একটা ঘটনায় এই পদ্ধতির ছোঁয়া পাওয়া যায়। কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কম শৈলজা চীনে করোনা দেখা দেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই ব্লকে ব্লকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার তৈরি করা শুরু করেছিলেন, তখন মোদী ট্রাম্পকে নিয়ে আমেদাবাদের রাস্তায় দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। এর উল্টো দিকে শুধু শোষণ, বঞ্চনা ও অনৈতিক অর্থের বৈভব। কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, শুধু ভারতবর্ষে করোনার দুটো ঢেউতে মোদী সরকার কী কী করেছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মানুষের কি হাল হয়েছে একটু খেয়াল করলেই সেটা বোঝা যায়। করোনা অতিমারী আমাদের দেখিয়ে গেলো চে গেভারা এবং তার রূপায়িত বৈপ্লবিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কর্পোরেট অত্যাচারে জর্জরিত দরিদ্র, মধ্যবিত্তকে বাঁচানোর একমাত্র পথ। এবছর চে’র ৯৩তম জন্মবার্ষিকী। লাল সেলাম  কমরেড চে গেভারা।

-- মৃনাল 

খণ্ড-28
সংখ্যা-23