খবরা-খবর
সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস ও কিষাণ শহীদ স্মরণে সংকল্প দিবস
Complete Revolution Day

৫ জুন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও এআইকেএসসিসির আহ্বানে সারা দেশে পালিত হলো ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’। ১৯৭৪ সালের এদিনেই ইন্দিরা গান্ধীর জমানার ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের দাবিতে বিহারের বুকে সংগঠিত হয়েছিল এক গণবিস্ফোরণ, ছাত্র-যুবদের তুমুল বিদ্রোহ। যা গোটা দেশকে আলোড়িত করে তুলেছিলো। পরবর্তীকালে আসে জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলি। মানুষের প্রতিবাদ প্রতিরোধে ইন্দিরা জমানার পতন হয়। সেই ঐতিহ্যকে পাথেয় করে আজ দেশব্যাপী অভূতপূর্ব কৃষক জাগরণকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, মোদী হঠাও আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলার লক্ষ্যে এই আহ্বান জানানো হয়।

৬ জুন, এই দিনটি হলো কৃষক আন্দোলনের এক সন্ধিক্ষণ। পড়ে পড়ে মার খাওয়া অন্নদাতারা সেদিন ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। আজ থেকে চার বছর আগে মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌর, যেখানে মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছিলো দুটো দল। একদিকে উৎপাদিত শস্যের দাম না পাওয়া ঋণগ্রস্ত কৃষক, অপরদিকে কর্পোরেটের পা চাটা দালাল ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকার। কৃষকরা ছুঁড়ে দিয়েছিলো চ্যালেঞ্জ। লক্ষ লক্ষ কৃষকের আত্মহত্যার কালো মেঘ সরিয়ে ঝলকে উঠেছিল সোনালী আলোর রেখা। ছড়িয়ে দিয়েছিল কৃষক প্রতিরোধের বার্তা। শাসকেরা ভয় পেয়েছিল। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ওরা হত্যা করলো ছয় জন কৃষককে, গুরুতর আহত কয়েক হাজার। যার মধ্যে ছিলো একেবারে সামনের সারিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একসারি নওজোয়ান কৃষক। কিন্তু শহীদের রক্ত ব্যর্থ হয়নি। হত্যাকাণ্ডের একমাসের মধ্যে রাজধানী দিল্লীতে সমাবেশিত হয়ে আড়াইশোর বেশি কৃষক সংগঠন গড়ে তুলেছে সর্বভারতীয় কৃষক সমন্বয় সমিতি। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে কৃষক জাগরণের নতুন এক অধ্যায়। পার্লামেন্ট ঘেরাও, প্রকাশ্যে দিল্লীর বুকে কিষাণ পার্লামেন্ট, প্রভৃতি চলমান সংগ্রামের নানান কার্যক্রম। ফসলের দেড়গুণ দাম, ঋণমুক্তির দাবি সহ কৃষকের নানাবিধ বাঁচার দাবিগুলি আজ দেশের সর্বস্তরে মান্যতা লাভ করেছে, রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে এসে হাজির হয়েছে। বিজেপি সরকার কৃষককে গোলাম বানাবার চক্রান্ত করছে। সংসদীয় ব্যবস্থা, সংবিধানকে নাকচ করে মাত্র ছয় ঘণ্টায় তিনটি কৃষি আইন পাস করে দিয়েছে। কিন্তু না, ১৮২ দিন হয়ে গেলো, লক্ষ লক্ষ কৃষক আজ দিল্লীর উপকণ্ঠে। নয়া কৃষি আইন, বিদ্যুৎ বিল বাতিল, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন প্রণয়নের দাবিতে, আন্দোলনের ময়দানে। সম্প্রতি বাংলা-বিহারের গণরায় মোদীর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জবাব দিয়ে দিয়েছে, এ রায় নিশ্চিতভাবে কালা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে। তাই অন্নদাতাদের পাশে দাঁড়িয়ে মন্দসৌর ও দিল্লীর কিষাণ আন্দোলনের রণভূমিতে প্রয়াত পাঁচ শতাধিক শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৬ জুন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে উদযাপিত হলো শহীদ স্মরণ ও সংকল্প দিবস। ৫ জুন সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবসে আয়োজিত হলো নানাবিধ কর্মসূচী।

Resolution Day in memory of Kisan Shaheed

 

উত্তর ২৪ পরগণা

৬ জুন ২০২১ বেলঘরিয়া। ঝড় বৃষ্টি হয়েছে, রাস্তার আলো নিভে গেছে। আমাদের মনটা খারাপ হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত ঘরে বসে দীপ জ্বালাতে হবে। বৃষ্টি কমার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে ‘স্বজনের স্মৃতি’তে শ্রদ্ধা লেখা ব্যানার নিয়ে রাস্তার ধারে টেবিল নিয়ে বসা হল। নিজেরাই মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলাম। এরমধ্যেই গুটিগুটি পায়ে এসে প্রায় সব বয়সের, সব শ্রেণি, সব স্তর, সব ধর্মের, সব ভাষার এবং সব দলের রাজনৈতিক কর্মীরা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিজেদের আপনজনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে গেলেন। অনেকেই জল কাদার মধ্যেই জুতো, চটি খুলে স্মরণ করলেন প্রিয় জনদের। মানুষ গণমৃত্যু ও গণচিতা দেখছেন, তাদের শোক ও ক্রোধ প্রকাশ করার একটা পরিসর তাঁরা এই দিন হাতের কাছে পেয়েছিলেন।

৫ জুন ২০২১ তারিখ, শনিবার সকাল সাতটায় হালিসহর সরকার বাজার অঞ্চলে বীজপুর আঞ্চলিক কমিটির ডাকে বিভিন্ন দাবি ধরে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালন করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৭৪ সালে ৫ জুন পাটনায় এক বৃহৎ জনসমাবেশে প্রয়াত লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ সমস্ত ভারতবাসীর কাছে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি আন্দোলন’এর ডাক দিয়েছিলেন। সেই দিনটিকে স্মরণ করে উত্তম দাস ও রবী সেন সংযুক্ত কৃষাণ মোর্চ্চার দীর্ঘদিনব্যাপী কৃষক আন্দোলনের বিষয় ও অন্যান্য দাবির যৌক্তিকতার বিষয়ে বক্তব্য পেশ করেন। এই দুঃসময়ে বাজার অঞ্চলের সাধারণ মানুষ আজকের এই সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস পালনে আলোড়িত হয় এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় আজকের কর্মসূচী শেষ হয়।

৫ জুন সকাল ৮ টায় ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালিত হলো বন্ধ নৈহাটি জুট মিল গেটে এআইসিসিটিইউ ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের যৌথ উদ্যোগে। শ্রমিক মহল্লাতেও শ্লোগান দিয়ে স্কোয়াড মিছিল করা হয়। জনবিরোধী কৃষিআইন ও শ্রমকোড বাতিলের দাবি তুলে ধরার পাশাপাশি নৈহাটি জুট মিল খোলা ও শ্রমিক পরিবারের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনের দাবিও তুলে ধরা হয়।

মধ্যমগ্রামে সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবসের কর্মসূচী ব্যানার-পোস্টার-শ্লোগান সহ পালিত হয়। এআইকেএসসিসি’র ডাকে বারাসাত কোর্ট চত্তরে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালন করা হয়। কালা কৃষি বিল প্রত্যাহার, এমএসপি লাগু করা এবং শ্রমকোড বাতিলের দাবিতে পথসভা এবং কৃষিবিলের প্রতীকী প্রতিলিপি পোড়ানো হয়। সভার শুরুতে মিছিল সহ এলাকা পরিক্রমা করা হয়। এআইপিএফ, এপিডিআর এবং গণ-প্রতিবাদী মঞ্চ যুক্তভাবে এই কর্মসূচী পালন করে।
উ: ২৪পরগণা জেলার শ্রীকৃষ্ণপুর অঞ্চলে এআইএআরএলএ ও সিপিআই(এমএল) লিবারেশন যৌথভাবে এই দিনটি পালন করে। নৈহাটি শিবদাসপুর গ্রামীণ অঞ্চলে চিনের মোড়েও পালিত হয় ৫ জুনের কর্মসূচী।

হুগলী

হুগলী জেলার পান্ডুয়া ব্লকে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’। ‘ইন্দিরাই ভারত, ভারতই ইন্দিরা’-স্তাবককুলের মুখে যখন এমন স্তুতিবাক্য তখন উৎসাহিত হয়ে আরো বেশি বেশি করে সমস্ত গণআন্দোলন ও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন করছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু প্রতিবাদকে স্তব্ধ করা যায়নি। বরং ৫ জুন ১৯৭৪ লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’র আহ্বান যুব সমাজকে উত্তাল করে তোলে। ৪৯ বছর পরে, গণতন্ত্রের শ্বাসরোধকারী ফ্যাসিস্ট মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ৫ জুন আর একবার ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালনের আহ্বান রাখে সারা ভারত কিষাণ সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতি (এআইকেএসসিসি)।

সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে পান্ডুয়া ব্লকের বৈঁচিগ্রাম রেল স্টেশন বাজারে সকাল দশটায় তিন কৃষিআইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। বর্ণময় বিভিন্ন পোস্টার ও ব্যানারে সজ্জিত বিক্ষোভ কর্মসূচী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শ্লোগান ও বক্তব্যে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ সামলাতে নতুন করে জারি হওয়া লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত মেহনতি ও গরিব কৃষক পরিবারগুলিকে মাসিক ৭,৫০০ টাকা নগদ অর্থ প্রদান, গ্রামে গ্রামে ক্যাম্প করে প্রকৃত কৃষকদের নিকট থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান কেনা, বিদ্যুৎ বিল ২০২০ বাতিল, সার-বীজ-ডিজেল ইত্যাদি কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি রোধ ইত্যাদি দাবিগুলি তুলে ধরা হয়। এছাড়া বিনা পয়সায় সর্বজনীন টিকাকরণের দাবিও জানানো হয়। পার্টির বৈঁচি লোকাল কমিটি সদস্য সেখ হানিফ, পাভেল কুমার ও এআইকেএম নেতা মহঃ ইউসুফ মন্ডল কর্মসূচীটি পরিচালনা করেন। উল্লেখ্য, ৫ জুন ছিল “বিশ্ব পরিবেশ দিবস”। সে কারণে বিক্ষোভ কর্মসূচীর শেষে বৈঁচিগ্রাম রেলওয়ে বুকিং কাউন্টারের অনতিদূরে কৃষক কর্মীরা বট, কদম ইত্যাদি বৃক্ষ রোপণ করেন।

এআইকেএসসিসি’র আহ্বানে সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস পালন করা হয় হুগলীর বলাগড়ের গুপ্তিপাড়ায়। স্লোগান প্ল্যাকার্ড সহ কর্মীরা প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করে।

Complete Revolution Day


বাঁকুড়া জেলা

বাঁকুড়া জেলার পুয়াবাগান মোড়ে ৬ জুন কৃষক সংগঠনগুলি এক যৌথ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। এইদিন মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে গুলি চালিয়ে কৃষক হত্যার দিনটিতে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানিয়ে যৌথ মিছিল ও কালা কৃষি আইনের প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। নেতৃবৃন্দ খালি গলায় বক্তব্য রাখেন। একই দিনে সকালে ওন্দা থানার নিকুঞ্জপুর হাটতলায় কিষাণ মহাসভা ও আয়ারলার পক্ষ থেকে এক মিছিল সংগঠিত হয়। নয়া কৃষি আইন বাতিলের দাবি তুলে প্রতিলিপি জ্বালানো হয়। নেতৃত্বে ছিলেন বাবলু ব্যানার্জী, বৈদ্যনাথ চীনা, আদিত্য ধবল, অজিত দাস প্রমূখ। বিষ্ণুপুর শহরে অনুরূপ কর্মসূচীতে নেতৃত্ব দেন ফারহান খান।

হাওড়া জেলা

হাওড়া জেলা ঘোড়াঘাটায় ৫ জুন সকালে এআইকেএম, আয়ারলা ও পার্টির পক্ষ থেকে এক বিক্ষোভ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। মোদী সরকারের কৃষক বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখা হয়, তিন কৃষি আইন বাতিল, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন চালু করা, সার ডিজেল সহ মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়, যা ব্যপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নেতৃত্ব দেন সনাতন বনিক সহ অন্যান্যরা৷ একই দিনে বাগনানে এক প্রতিবাদ সভা করা হয়, নেতৃত্বে ছিলেন নবীন সামন্ত, দিলীপ দে।

জলপাইগুড়ি

৫ জুন জলপাইগুড়ি শহরে কদমতলায় এআইকেএসসিসি’র পক্ষ থেকে কালা কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস পালিত হয় ও কৃষি আইনের কপি পোড়ানো হয়। নেতৃত্বে ছিলেন আয়ারলার শ্যামল ভৌমিক। এছাড়াও ছিলেন অন্যান্য সংগঠনের নেতা রবি রায়, পরিতোষ ভৌমিক প্রমূখ।

নদীয়া

গত ৫ জুন সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আহ্বানে দেশব্যাপী ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি দিবস’ পালনের কর্মসূচী নদীয়া জেলায় সংগঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিহারে উত্তাল গণ-আন্দোলনের এই দিনটিকে স্মরণ করা হয় আজকের সময়ে মোদী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে চলমান কৃষক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসাবে। এইদিন কৃষকদের কর্পোরেটদের গোলামে পরিণত করার বিরুদ্ধে আওয়াজকে তুলে ধরে নাকাশীপাড়ার খিদিরপুর পার্টি অফিসে সমবেত কর্মীরা প্রচার করে। সকলের হাতে ছিলো স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। তুলে ধরা হয় কৃষকের আজাদীর স্লোগান, নয়া কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল বাতিলের দাবি। বিগত ছ’মাসব্যাপী দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের শহীদ পাঁচ শতাধিক কৃষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

একই দিনে চাকদা শহরের জনবহুল স্থানে পার্টি কর্মীরা সমাবেশিত হয়ে স্লোগান দিয়ে দিবসটিকে উদযাপন করেন। দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের সংহতিতে সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান জানান। এই কর্মসূচী ব্যাপক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

খণ্ড-28
সংখ্যা-21