বঞ্চিত চটকলের শ্রমিকরা
Deprived Chatkal workers

মূলত কাঁচাপাটের অভাবে নির্বাচনের পরপরই ১৭টা চটকল বন্ধ হয়েছে। কাঁচাপাটের অভাবের কারণ, পাট চাষ কম হওয়া এবং এক শ্রেণির অসাধু মালিক ও আড়তদারদের বে-আইনি মজুত। রাজ্য সরকারের নির্দেশে বাকি মিলগুলো অর্ধেক খোলা। কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে রাজ্য সরকার ‘বিধিনিষেধ’ (অঘোষিত লকডাউন) আরোপ করেছে। রাজ্যে চটকলের উপর নির্ভরশীল ২.৫ লক্ষ শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা করোনা আতঙ্ক, অভাব, অর্ধাহারে দিশাহারা। এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মিল কোয়ার্টার্স ও সংলগ্ন পাড়াগুলোতে।

গোদের উপর বিষফোঁড়া কেন্দ্রীয় শ্রমদপ্তর ‘মিনিস্ট্রি অব লেবার এন্ড এমপ্লয়মেন্ট ব্যুরো’র হিসাব অনুযায়ী চটকল শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা এই নিদারুণ মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেও কমে গেছে। মালিকপক্ষের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’ ইতিমধ্যে প্রত্যেক মিলে মহার্ঘভাতা কমার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। শ্রমিকরা জুন, জুলাই, আগস্ট এই তিনমাস দৈনিক ১৯.৫১ টাকা করে কম মজুরি পাবেন।

চটকলে প্রতি ত্রৈমাসিক অন্তর (নভেম্বর-জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল, মে-জুলাই এবং আগস্ট-অক্টোবর) কেন্দ্রীয় শ্রম ব্যুরো মহার্ঘভাতা ঘোষণা করে। ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচকের উপর মহার্ঘভাতা বাড়ে বা কমে।

কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স (সিপিআই)। এই ‘উপভোক্তা মূল্যসূচক’ শহর, গ্রাম, কৃষি ও শিল্প শ্রমিকের পারিবারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটি বস্তুর ব্যবহারের উপর নির্ধারিত হয়। এখানে চটকল শ্রমিকদের সমস্যাটাই তুলে ধরছি।

সাধারণভাবে সাতটা শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারি এবং তাদের পরিবারকে সিপিআই-এর আওতায় রাখা হয়েছে। এই সাতটা শিল্প ক্ষেত্র হল – কারখানা, খনি, বাগিচা, মোটর পরিবহণ, বন্দর, রেল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবারহ।

যে যে বস্তুর মূল্য ওঠানামার উপর ভিত্তি করে হিসাব কষা হয় তা হল,

(১) খাদ্য ও পানীয়। (২) পান তামাক এবং নেশার দ্রব্য। (৩) পোশাক ও জুতো। (৪) বাসস্থান। (৫) জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। (৬) বিবিধ – এরমধ্যে আছে শিক্ষা, আমোদ প্রমোদ, পরিবহণ ও চিকিৎসা ইত্যাদি।

উপভোক্তা এই সব জিনিসগুলো কত পরিমাণে ব্যবহার করেছেন এবং কি মূল্যে কিনেছেন তার উপর ভিত্তি করে উপভোক্তা মূল্যসূচক নির্ধারিত হয় এবং শ্রমিক কর্মচারিদের মহার্ঘভাতা ঠিক হয়। প্রাইভেট সেক্টারে মহার্ঘভাতা পরিবর্তনশীল (Variable)। ডিএ’র সাথে যুক্ত আছে মজুরি, বেতন এবং পেনশন।

উপরে বর্ণিত বস্তুগুলোর বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী। পেট্রল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম কোথায় গিয়ে থামবে সরকারও জানেনা। চিকিৎসা, শিক্ষা, পরিবহন প্রভৃতির খরচ বহুগুণ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার কি মুদ্রাস্ফীতিকে আড়াল করতে চাইছে? এটা কি আর এক জুমলা? এতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন শ্রমিক ও কর্মচারিরা।

কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব অনুযায়ী চটকল শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা কমলো ২৬৭ পয়েন্টস। চটকল শ্রমিকদের প্রতি পয়েন্টে ১.৯০ টাকা করে মহার্ঘভাতা মজুরির সাথে যুক্ত হয় বা বাদ যায়। মে-জুলাই এই তিন মাস, প্রতি মাসে (২৬দিন) ৫০৭.৩০ টাকা করে মজুরি কম পাবেন।

শ্রম কেন্দ্র ও রাজ্যের যুগ্ম তালিকাভুক্ত। রাজ্য সরকার নিজেদের আইনগত অধিকারের উপর দাঁড়িয়েই শ্রমিক স্বার্থে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। গত ১ জুন চটকলে কর্মরত ২১টি ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রমমন্ত্রী বেচারাম মান্নার সাথে ভার্চ্যুয়াল মিটিং হয়ে গেল। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়,

Deprived Chatkal Mazdur

 

(১) অবিলম্বে বন্ধ মিলগুলো খুলতে হবে। (২) কাঁচাপাটের মজুত উদ্ধার কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে করতে হবে। (৩) করোনা কালে ডিএ থেকে যেন ৫০৭.৩০ টাকা কেটে না নেওয়া হয়। (৪) চটকল অত্যাবশকীয় পণ্য আইনের আওতায় পড়ে, প্রত্যেকটা মিলে ফ্রন্টলাইন কোভিড যোদ্ধা হিসাবে শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে দ্রুত টিকাকরণ করা হোক। (৫) শ্রমবিরোধ আইনে রাজ্য সরকারের হাতে প্রভূত ক্ষমতা আছে শ্রমিক সমস্যা সমাধানের।

রাজ্য সরকারের নির্দেশে মিলগুলো ৪০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এরফলে লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ থেকে বসে গেছেন। রাজ্য শ্রমদপ্তর শ্রমবিরোধ আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের লে-অফ দেওয়ার জন্যে ‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’এর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ জারি করতে পারে।

‘ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’ যে স্ট্যান্ডিং অর্ডার আছে তাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে লে-অফ কি কি কারণে দেওয়া যেতে পারে।

কাজ বন্ধ হলে

১২(ক) নিয়োগকর্তা যে কোনো সময়েই পারে অগ্নিকান্ড, বিপর্যয়, যন্ত্রপাতির গোলযোগ বা বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন, মহামারি, নাগরিক জীবনে অশান্তি নেমে আসা, কয়লা বা কাঁচা মাল বা অত্যাবশকীয় জিনিষপত্রের ঘাটতি, উৎপাদনের ধরনে পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য কোনো কারণবশত যদি কোনো একটা বিভাগ বা অনেকগুলো বিভাগ পুরোপুরি বা আংশিক সময়ের জন্য বা দীর্ঘ সময়ের জন্য আগাম বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই বন্ধ রাখে।

১২(খ) এই সমস্ত ক্ষেত্রে কাজ বন্ধ থাকলে শ্রমিকেরা শিল্প বিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ধারা অনুযায়ী মজুরি পাবেন।

লে-অফ’এর ক্ষতিপূরণ পাওয়া শ্রমিকদের অধিকার মধ্যেই পড়ে। শ্রমবিরোধ আইনের ২৫(সি) ধারা অনুযায়ী, লে-অফ ঘোষিত হলে শ্রমিকরা লে-অফ পর্যায়ে মোট মজুরি ও মহার্ঘ ভাতার ৫০ শতাংশ পাবেন।

শ্রমিকরা লকডাউনের জন্য কাজ পাচ্ছেন না, সরকারী কোনো সাহায্য নেই, আবার নিজেদের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। নতুন ৪টি শ্রমকোড এবং বিধি এখনো লাগু হয়নি, তাই আগের শ্রম-বিরোধ আইনের কার্যকারিতা এখনো থাকছে। আইনগতভাবে প্রাপ্য লে-অফ থেকে কপর্দক শূন্য শ্রমিকরা যদি মজুরির ৫০ শতাংশ হাতে পান, অন্তত কিছুটা কষ্ট তাদের লাঘব হয়। রাজ্য সরকার বিপন্ন শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান।

- নবেন্দু দাশগুপ্ত 

খণ্ড-28
সংখ্যা-21