লক্ষদ্বীপে ফ্যাসিস্ত হানা
Lakshadweep

কেন্দ্রশাসিত লক্ষদ্বীপের বর্তমান ঘটনাবলী গভীর উদ্বেগপূর্ণ। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে পূর্বতন প্রশাসক দীনেশ্বর শর্মার মৃত্যুর পর প্রশাসকের পদে আসেন গুজরাটের প্রাক্তন গৃহমন্ত্রী প্রফুল প্যাটেল এবং তারপর থেকে এই উদ্বেগজনক মতলব সামনে আসতে থাকে। তিনি ২০২০ ডিসেম্বরে প্রশাসক পদে নিয়োজিত হবার আগে পর্যন্ত এই দ্বীপপুঞ্জে কোভিড সংক্রমণকে ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল কিন্তু বর্তমান প্রশাসক করোনা বিধি হাল্কা করে দেওয়ার ফলে দ্রুতই প্রায় ৫,০০০ কোভিড কেস নথিভূক্ত হয় যেখানে আগের বছরে কেউই সংক্রমিত হননি।

সরকারের জাতীয় অপরাধ পঞ্জীকরণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী এখানে একটিও হত্যার ঘটনা ঘটেনি এবং এই দ্বীপপুঞ্জ সবথেকে কম অপরাধ অঞ্চল বলে স্বীকৃত হয়েছে। অথচ সরকারের অভিপ্রায় এখানে ‘গুন্ডা আইন’ চালু করা হবে, যার মাধ্যমে নাগরিকদের বিনা বিচারে আটক করা যাবে। এটা পরিষ্কার যে, এই অঞ্চলে সরকার হিংসার আশ্রয় নেবে যা এতদিন শান্তিপূর্ণ ছিল। ২০২০-র মার্চ থেকে প্রচার চালানো হচ্ছে যে লক্ষদ্বীপ থেকে কেরালায় অস্ত্র ও মাদক দ্রব্য পাচার করা হচ্ছে যা ভারতীয় নৌবাহিনী আটক করেছে। তথ্য পরীক্ষক সংস্থা এইসব চিত্রর প্রকৃত সত্য উন্মোচিত করে বলেছে এগুলি ‘আল জাজিরা’-র প্রশান্ত মহাসাগরের রিপোর্ট। যে জলযানগুলি ভারতীয় নৌবাহিনী আটক করেছে সেগুলি প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কাগামী জলযান। লক্ষদ্বীপের উপকূল থেকে ৯০ নটিক্যাল মাইল দূরে (রাষ্ট্রপুন্জের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রাধীন জলসীমা উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত) নৌবাহিনী জলযান আটক করে।

কর্তৃত্ববাদী প্রশাসক দ্বারা প্রণীত আইনগুলির মধ্যে অন্যতম হল ‘ড্রাফট লক্ষদ্বীপ ডেভেলপমেন্ট অথারিটি রেগুলেশন ২০২১ (এলডিএআর)’-এর দ্বারা প্রশাসক শহরের প্ল্যানিং বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের জন্য জমি অধিগ্রহণ, দ্বীপবাসীদের সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, স্থানান্তরিত করতে পারবেন।

অপর একটি আইন ‘সমাজ-বিরোধী কার্যকলাপ নিরোধক আইন (পিএএসএ)’ জানুয়ারী ২০২১-এ লাগু হয়েছে - এর মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তিকে বিনা ওয়ারেন্টে ১ বছর পর্যন্ত আটক করা যাবে। আরেকটি আইন হল খসড়া ‘পঞ্চায়েত নোটিফিকেশন’ যার বলে, কোনো ব্যক্তির দুটির বেশি সন্তান হলে তার পঞ্চায়েত মেম্বার পদ খারিজ করা যাবে, এবং পঞ্চায়েতের ক্ষমতা খর্ব করে কেন্দ্রীয় প্রশাসক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাছ চাষ, পশুপালন – এর এলাকা অধিগ্রহণ করতে পারবেন।

দ্বীপপুঞ্জের খাদ্যাভ্যাসের ওপর চরম আঘাত হেনেছে ‘ড্রাফট লক্ষদ্বীপ পশু সংরক্ষণ আইন’, যা আসলে দানবীয় গোমাংস ভক্ষণে নিষেধাগ্গা এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে স্কুলের টিফিনের জন্য আমিষ খাদ্যর ওপরও নিষেধাজ্ঞা –  যেখানে দ্বীপবাসীদের পুষ্টি ও জীবিকা নির্ভর করে সামুদ্রিক মাছের ওপর।

সম্প্রতি দ্বীপের নার্সরা ন্যূনতম বেতনের দাবিতে ধর্মঘট করলে তাদের দাবিতে কর্ণপাত না করেই গ্রেপ্তার করা হয়। এনআরসি, এনপিআর এবং সিএএ-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সরকারী অফিসের শত শত কন্ট্রাক্ট ও ক্যাজুয়াল কর্মীরা কর্মচ্যুত হয়েছে, এছাড়া মিড-ডে-মিল কর্মী, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকদেরও ছাঁটাই করা হয়েছে। ৩৮ অঙ্গনওয়াড়ি বন্ধ করা হয়েছে। কেরলের বেপোর বন্দরের মাধ্যমে মাল পরিবহনের যে ঐতিহ্যবাহী বন্ধন ছিল তা রদ করা হয়েছে। পূর্ব প্রশাসকের অনুমতিতে মত্সজীবীদের মাছ ধরার জাল, যন্ত্রপাতি রাখার জন্য গড়ে তোলা অস্থায়ী শেডগুলি ভেঙে ফেলা হয়েছে, যেখানে দ্বীপবাসীদের প্রধান জীবিকা হল মাছ ধরা। দ্বীপপুঞ্জের লোক সংখ্যা কম হওয়ায় যান পরিবহনের জন্য রাস্তা চওড়া করার কোনো প্রয়োজনই যেখানে নেই সেখানে রাস্তা চওড়া করার যে প্রস্তাব প্রশাসক এনেছে তাতে বহু বাড়ি, ইমারত ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এই এজেন্ডার দ্বারা এটা পরিষ্কার যে লক্ষদ্বীপের জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হবে এবং কর্পোরেটদের অত্যাচার মসৃণভাবে চলবে।

বার লাইসেন্স দেওয়ার ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা বিতর্কিত। লক্ষণীয় ব্যাপার হল তিনি যখন গুজরাটের গৃহমন্ত্রী ছিলেন তখন গুজরাটে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল এবং তিনি ভুলেও সেখানে এই দাবি তোলেননি। এটা দৃশ্যত পরিষ্কার যে এই প্রশাসক বালি-মাফিয়াদের সঙ্গে এবং সমুদ্র শসা (এক ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী যার ট্রেডিং ভারতে নিষিদ্ধ) পাচারকারীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে চলছেন এবং প্রতিবাদকারী স্থানীয় মানুষদের বাধা দিচ্ছেন। লক্ষদ্বীপের ডেয়ারী-ফার্মগুলি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে গুজরাটের ‘আমূল’ প্রোডাক্টের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য।

প্রফুল প্যাটেল অপরাধী হিসাবে সন্দেহভাজন হয়ে উঠছেন এবং এই প্রথমবার তাঁর নাম সামনে আসছে এমনটা নয়। ফ্রেব্রুয়ারী মাসে দাদরা এবং নগর হাভেলির এমপি মোহন দেলকর আত্মহত্যা করেন। তাঁর স্যুইসাইড নোটে অন্যান্যদের নামের সঙ্গে প্যাটেলের নামও উল্লেখ করেন তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসাবে। দেলকরের পুত্র অভিনব পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন তাঁর পিতার কাছে ২৫ কোটি টাকা চেয়ে প্যাটেল তাঁকে হেনস্থা করেন, ‘সমাজবিরোধী কার্যকলাপ নিরোধক আইন’-এ মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয়ও দেখান টাকা না দিলে। একজন আদিবাসী নেতা প্যাটেলকে এই আত্মহত্যার জন্য দায়ী করে পুলিশের কাছে ‘এসসি/এসটি উত্পীড়ন নিরোধক আইন’-এর অধীনে এফ আই আর দায়ের করেন। প্রশাসক পদটি বহুকাল ধরেই আইএএস অথবা আইপিএস-দের জন্য সংরক্ষিত ছিল – সেখানে প্যাটেলের প্রশাসক হিসাবে নিয়োগটা সন্দেহজনক।

প্রফুল প্যাটেল দাবি করেন যে তাঁর একমাত্র এজেন্ডা হল “উন্নয়ন” – কিন্তু বাস্তবিক এই ‘উন্নয়ন’ আদৌ জনমুখী মঙ্গলদায়ক নয় বরং একটি “হিন্দুত্ব- কর্পোরেট”-এর লাভজনক উন্নয়ন। দ্বীপের জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশ মুসলমান এবং কোনোদিন কোনো সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেনি। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের আগ্রাসী বলে যে অপবাদ দেয় তা একটি ডাঁহা মিথ্যা। আরএসএস-এর পত্রিকা ‘অর্গানাইজার’-এ অভিযোগ করা হয়েছে দ্বীপের বাসিন্দাদের প্রশাসকের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করছে মুসলিম মৌলবাদীরা এবং এর জন্য এই কেন্দ্র শাসিত দ্বীপের ইন্টারনেট বন্ধ হতে পারে। দ্বীপবাসীরা কর্পোরেট-মুখী এই সংস্কারের বিরোধিতা করছেন এবং ট্যুইটারে “#লক্ষদ্বীপ বাঁচাও” ট্রেন্ড ছড়িয়ে দিয়েছেন। সারা ভারতকে আজ এই লক্ষদ্বীপের পাশে দাঁড়াতে হবে।

(লিবারেশন, জুন ২০২১ সংখ্যা থেকে)

– ঐশিক সাহা

খণ্ড-28
সংখ্যা-20