ভাষণ নয়, রেশন দাও
Give rations

অবশেষে পশ্চিমবাংলার সরকার ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ ব্যবস্থা চালু করবে বলে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ মেনে নিয়েছে। এতদিন এই ব্যাপারে আপত্তির যে কারণ দেখিয়ে এসেছে তার কোনো যুক্তি ছিল না। এরাজ্যে রেশনে কেন্দ্রের চেয়ে রাজ্য সরকারের সরবরাহ করা খাদ্যশস্যের মান ভালো, ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ হলে ভিন্ রাজ্য থেকে আসা পরিযায়ী শ্রমিকরা তাতে ভাগ বসাবে, ফলে ভাঁড়ারে টান পড়বে, সেই কারণে আপত্তি! প্রথমত, এটা ন্যক্কারজনক সংকীর্ণতার অবস্থান। দ্বিতীয়ত প্রকৃত বাস্তবতা হল, এরাজ্য থেকে মেহনতি অংশ যে সংখ্যায় দেশের অন্যত্র পরিযায়ী হয় তার চেয়ে বাইরে থেকে এখানে পরিযায়ী হয়ে আসা সংখ্যা অনেক কম। এবং রাজ্য সরকারের দাবি মতো এখানে ১০ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ যদি রেশনের আওতায় থাকে, তবে তাতে তুলনায় অনেক কম পরিযায়ী হয়ে আসা মানুষেরা ভাঁড়ারে কি করে টান পড়ার কারণ হবে! এসব আসলে বাহানা! অগত্যা রাজ্য সরকার দেশব্যাপী এক কার্ডের প্রয়োজনীয়তা দেরীতে মানলেও এটা সুলক্ষণ।

কেন্দ্রীয় সরকারও যে সহজে এই পদক্ষেপ করেছে তাও নয়। টানা অতিমারী পরিস্থিতিতে জনগণের জ্বলন্ত দাবিগুলো দুঃসহ বঞ্চনার শিকার হয়ে চলেছে। তা নিয়ে যথেষ্ট সোরগোল ওঠার পর কেন্দ্রের টনক নড়েছে কেবল রেশন বিষয়ে। সেটাও অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের চাপ খেয়ে। জরুরি প্রথম তিনটি দাবি হল, বিনা মূল্যে রেশন, হাতে নগদ অর্থের যোগান এবং বিনা মূল্যে ভ্যাকসিন। কেন্দ্র কেবল রেশনে কিছু সুলভে সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করেছে, ভ্যাকসিন নিয়ে বৈষম্য চালিয়ে যদিও বা বিনা মূল্যে দেওয়ার দাবি মেনে নিয়েছে, তবু চালিয়ে যাচ্ছে নানা টালবাহানা। যত পারা যায় রাজ্যগুলোর ওপর দায় চাপানো এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও টিকা উৎপাদন সংস্থাগুলোকে মুনাফা লোটার সুযোগ করে দেওয়া। নগদ অর্থ যোগানোর নাম করছে না। এইসবই হচ্ছে কেন্দ্রের মতলব।

রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে “দুয়ারে রেশন” - ‘দুয়ারে ত্রাণ’ কর্মসূচী, কিছু কিছু শুরু করেছে। বলছে সর্বত্র করতে সময় লাগবে। তা সেসব না হয় দেখতে হবে। রেশন গ্রহিতাদের নতুন করে যোগবিয়োগ করে তথ্যভান্ডার তৈরি করা, খাদ্যশস্যের সংগ্রহভান্ডার গড়ে তোলা, বিলিবন্টণের পরিকাঠামো ঢেলে সাজানো, এসবের প্রস্তুতিতেও সরকার সময় চাইছে, কিন্তু গয়ংগচ্ছ রীতি চলবে না, রেশন দেওয়া স্থগিত না রেখে সবই করতে হবে যুদ্ধকালীন উপায়ে।

সমস্যা জমেছে আরও। পাঁচ মাস যাবত রাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি উপভোক্তাদের অধিকাংশের খাদ্য সামগ্রী মেলেনি। বন্ধ ছিল বিলিবন্টণ গত ফেব্রুয়ারি থেকে। রাজ্য সরকারের বক্তব্য হল, এ কয়মাস কেন্দ্র কিছুই পাঠায়নি, গত বছরেও উপভোক্তাদের সংখ্যাবৃদ্ধির তুলনায় কেন্দ্রের সরবরাহ কোটায় ঘাটতি ছিল, এবার উপর্যুপরি বেড়েছে ঘাটতি। তবে দেরীতে হলেও চলতি অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসের কোটা এসেছে। যদিও এতে মোট কোটার বরাদ্দ কেন্দ্র এখনও বাড়ায়নি।

অন্যদিকে, কেন্দ্রের মোদী সরকার হুঁশিয়ার! কথায় ও কাজে বিপরীত আচরণ করলে চলবে না। কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যকার যুক্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের দায়দায়িত্বকে নিছক বিজেপি ও টিএমসি -- দুই শাসকদলের গোয়ার্তুমির সংঘাতে পরিণত করা চলবে না। মোদী সদ্য পুনরায় ঘোষণা করেছেন, দেশের গরিব ৮০ কোটি রেশন গ্রহিতাদের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা’ আগামী নভেম্বর পর্যন্ত থাকবে। এই খাতে মাথা পিছু প্রতি মাসে বিনা মূল্যে ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হবে। এটা খাদ্য সুরক্ষা আইনে মাথা পিছু প্রতি মাসে ভর্তুকিতে যে ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়া হয় তার অতিরিক্ত কোটা। কেন্দ্র গত বছর এপ্রিল মাস নাগাদ এই প্রকল্প চালু করলেও অঘোষিতভাবে নভেম্বর থেকে বন্ধ রেখে দিয়েছিল। তার ব্যাখ্যা আজও দেয়নি। পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফলে বিজেপির বিরুদ্ধে গনগনে আঁচ লক্ষ্য করে অন্ন যোজনার পুনঃপ্রবর্তন করল। সামনে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন। দুর্ভাবনা তো থাকবেই। কিন্তু গুদামজাত চাল নিয়ে ‘প্রতিশ্রুতির রাজনীতি’র চালবাজি করা থেকে বিরত থাকুক। অতিমারীর বছরে দেশের ১৮টি রাজ্যের ৮৮টি জেলা ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলোর এক সমীক্ষা বলছে, রেশনকার্ড থাকা নাগরিকদের ৯৪ শতাংশই রেশন নিয়েছেন। এটা বুঝিয়ে দেয় ব্যাপকতম নাগরিক ভারত রেশন ব্যবস্থার ওপর কেমন নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তবু এখনও বহু দেশবাসীকে এই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। শাসকের রংবাজিতে প্রতারিত হয় মানুষ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্র বলছে, এফসিআই গুদামে এখন মজুদ চাল-গমের পরিমাণ ৯০০ লক্ষ টন, যা দিয়ে মোট চাহিদার দ্বিগুণেরও বেশি পূরণ করা যায়। সুতরাং গণবন্টণ নিয়ে কোনও গদ্দারি যেন না করা হয়।

খণ্ড-28
সংখ্যা-22